৯- যদি রাষ্ট্রদ্রোহ করেই থাকি, মহাজোট সরকারের উচিত আমাকে মিত্ররূপে বিবেচনা করা
ক্রসফায়ারের জন্য সময়টা
আমি কেবলই ভাবছি, ক্রসফায়ারের জন্য সময়টা বোধহয় একটু আগে হয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে অস্ত্রধারী প্রহরীর সংখ্যা বাড়ল। হাজতের সামনে ডিউটি অফিসারদের বসার জায়গা পেরিয়ে যে কলাপসিবল দরজাটা আগে কোনোদিন বন্ধ হতে দেখিনি, সেই রাতে সেটিও বন্ধ করা হলো। সব মিলে থমথমে পরিবেশ। ফজরের নামাজ শেষ করে চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখন ছ’টা বেজে গেছে। কলাপসিবল গেট খুলে গেল। আইও অসম্ভব গম্ভীর মুখ করে দ্রুত পায়ে সেলের দিকে এগিয়ে আসছেন...
আমি কেবলই ভাবছি, ক্রসফায়ারের জন্য সময়টা বোধহয় একটু আগে হয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে অস্ত্রধারী প্রহরীর সংখ্যা বাড়ল। হাজতের সামনে ডিউটি অফিসারদের বসার জায়গা পেরিয়ে যে কলাপসিবল দরজাটা আগে কোনোদিন বন্ধ হতে দেখিনি, সেই রাতে সেটিও বন্ধ করা হলো। সব মিলে থমথমে পরিবেশ। ফজরের নামাজ শেষ করে চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখন ছ’টা বেজে গেছে। কলাপসিবল গেট খুলে গেল। আইও অসম্ভব গম্ভীর মুখ করে দ্রুত পায়ে সেলের দিকে এগিয়ে আসছেন...
জুনের ষোল তারিখে ম্যাজিস্ট্রেট আমার রিমান্ড সাময়িকভাবে স্থগিত করে ভগ্ন-স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য জেলহাজতে পাঠিয়েছিলেন। চার দিনের মাথায় কুড়ি তারিখ বিকালে ডিবি পুলিশের গাড়ি নাজিমউদ্দিন রোডে এসে উপস্থিত হলো আমাকে তাদের হেফাজতে ফিরিয়ে নিতে। আমি অবশ্য নির্যাতনের শেষ দেখার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত। দশ মিনিটের মধ্যেই সেই পুরনো সাদা ঝোলানো ব্যাগে টুকিটাকি জিনিস ভরে ডিবির গাড়িতে উঠলাম। এবার তথাকথিত উত্তরা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। মামলার আইও মোরশেদুল ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হলাম। ডিবির এই কর্মকর্তা ছাড়াও তার ঊর্ধ্বতন একজন এসি এসেছিলেন আমাকে নেয়ার জন্যে। তার ব্যবহারেও আপাত সৌজন্যের কোনো ঘাটতি পেলাম না।
ডিবি অফিসের সেই চেনা সেলেই স্থান হলো। সেখানকার কর্মকর্তারা এমনভাবে অভ্যর্থনা জানালেন যেন ক’দিন বিরতি শেষে পুরনো কর্মস্থলে ফিরে এসেছি। প্রথম রাতে জিজ্ঞাসাবাদ হলো না। দ্বিতীয় রাতে ডাক পড়ল ডিসির দোতলার পরিচিত কক্ষে। প্রশ্নকর্তারা গম্ভীর মুখে আসামির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হবেইবা না কেন? রাষ্ট্রদ্রোহের মতো গুরুতর অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। মোরশেদুল ইসলাম অভিযোগ পড়ে শোনালেন। ঘটনা কেবল চার বছরের পুরনোই নয়, বর্তমান সরকারের ক্ষমতাগ্রহণের আড়াই বছর আগের। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে উত্তরায় আমার সিরামিক প্রতিষ্ঠানের ভাড়া করা অফিসে ডজনখানেক তরুণ সরকারি কর্মকর্তাকে নিয়ে এক বৈঠকে আমি নাকি তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সরকারকে উত্খাতের ষড়যন্ত্র চালিয়েছিলাম। অভিযোগ শুনে হাসব না কাঁদব ভেবে পেলাম না। এই প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন চালাল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও তাদের মহাজোটের সঙ্গী-সাথী। তাদের লগি-বৈঠার নৃশংসতায় কত মায়ের বুক খালি হলো। দিনের পর দিন আন্দোলনকারীরা বঙ্গভবন অবরোধ করে রাখল। রাষ্ট্রপতির গ্যাস, পানি, বিদ্যুত্ তো বটেই, এমনকি আল্লাহর দেয়া অক্সিজেন পর্যন্ত বন্ধ করার হুমকি দিল। সেই সন্ত্রাসী আন্দোলনের ফসলস্বরূপ সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের কাঁধে সওয়ার হয়ে এলো মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন। জেনারেল মইন ও ড. ফখরুদ্দীনের আশীর্বাদে ডিজিটাল নির্বাচনে ক্ষমতায় এলেন শেখ হাসিনা। আর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা আমার বিরুদ্ধে? আমি যদি সেই সময় তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েই থাকি, তাহলে মহাজোট সরকারের তো উচিত আমাকে তাদের মিত্ররূপে বিবেচনা করা। রিমান্ডে এনে নির্যাতন করার পরিবর্তে আমার তো পুরস্কার প্রাপ্য। ঝাড়া পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে একবারও না থেমে আমার জবাব দিয়ে গেলাম। ডিসি মাহবুবুর রহমান একাধিকবার আমার বক্তব্যে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও আমি নাছোড়বান্দা। নিম্নোক্ত দশটি যুক্তি উপস্থাপন করলাম :
১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে সর্বদা বেগম খালেদা জিয়ার তল্পিবাহকরূপেই বিবেচনা করে এসেছেন এবং তাকে খালেদার ইয়েসউদ্দিন নামকরণও করেছিলেন। আজ যেমন গোটাদশেক উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যার যার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, আমিও বেগম খালেদা জিয়ার তেমন একজন উপদেষ্টা ছিলাম। বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবেও দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী আমি তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছেই সরাসরি রিপোর্ট করতাম। এক-এগারো-পরবর্তীকালে ক্যান্টনমেন্টের কয়েকজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তির ইশারায় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলে সংস্কারের ধুয়া উঠলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূলধারার প্রতি আমি বিশ্বাস ও আনুগত্যে অটল ছিলাম। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রকাশ্যে অভিযুক্ত সেই খালেদা জিয়ার কথিত তল্পিবাহক প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের সরকারের বিরুদ্ধে আমার ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব কোনো যুক্তিতেই ধোপে টিকবে না।
২. ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে এক-এগারো পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের সাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার সহিংস আন্দোলন করেছে। কাজেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বরং সেই সময়ের আন্দোলনকারী মোর্চার বিরুদ্ধেই দায়ের হওয়া উচিত।
৩. আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে বর্তমান সরকার নীতিগতভাবে মেনে নিচ্ছে যে, প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের সরকারকে উত্খাতের যে কোনোরকম প্রচেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে। জেনারেল মইন অস্ত্রের মুখে প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। তিনি তত্কালীন বিমান ও নৌবাহিনী প্রধান এবং নবম ডিভিশনের জিওসি লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় বঙ্গভবনে যান এবং রাষ্ট্রপ্রধানকে দিয়ে জোর করে জরুরি অবস্থা জারি করান। এর চেয়ে প্রকাশ্য রাষ্ট্রদ্রোহ আর কী হতে পারে? সুতরাং আইনের শাসনে বিশ্বাস করলে অনতিবিলম্বে উল্লিখিত সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রুজু করাই বর্তমান সরকারের দায়িত্ব। সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীনসহ সুশীল (?) সমাজের যেসব রথী-মহারথী সেই সময় এই চরম নিন্দনীয় অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের পক্ষে ছিলেন, তাদেরও আইনত একই মামলার আসামি হওয়ার কথা।
৪. এক-এগারো থেকে ডিজিটাল নির্বাচন পর্যন্ত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের যৌথ নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হয়েছে। আমি সেই সরকারের কঠোর সমালোচক ছিলাম। বস্তুত তখন থেকেই আমার লেখালেখির সূত্রপাত। সেই বিচিত্র সরকারের আমলেও প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা কি অবিশ্বাস্য ব্যাপার নয় যে, আমি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলাম, অথচ জরুরি আমলেও সেই কথিত অপরাধে তিনি এবং মিলিটারি জান্তা আমার বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা, কোনো অভিযোগই উত্থাপন করলেন না?
৫. উত্তরার তথাকথিত বৈঠক নিয়ে প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্কালীন কৃষি সচিব এমএ আজিজের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশনের প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়, ওই বৈঠকের সঙ্গে কোনোরূপ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায় নাই। যেখানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেক্ষেত্রে এই দীর্ঘ চার বছর পর রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপন করা অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হয়রানিমূলক। কেবল তাই নয়, ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই পরেবর্তীকালে অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমা করা হয় এবং তাদের বিভিন্ন স্থানে পদায়নও করা হয়। তত্কালীন কৃষি সচিব এমএ আজিজ জরুরি সরকারের আমলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন। মহাজোট সরকারের আমলে তিনি কেবল তার পদ ধরেই রাখেননি, তাকে একাধিকবার এক্সটেনশনও দেয়া হয়েছে। অর্থাত্ তিনি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, জেনারেল মইনউদ্দিন আহমেদ, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এবং শেখ হাসিনা—চারজনেরই অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
৬. কয়েকজন নিম্নপদস্থ তরুণ আমলার পক্ষে সরকার উত্খাতের মতো ষড়যন্ত্র করা একেবারেই অবাস্তব। আমার অফিসের নৈশভোজে উপস্থিতদের অধিকাংশই সহকারী সচিব এবং উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। গুলশান-বারিধারা এলাকায় নিয়মিতভাবে আয়োজিত যে কোনো নৈশভোজে অন্তত গোটাছয়েক সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন। বেচারা সহকারী সচিবদের একটিমাত্র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জড়িত করা হলে সচিবদের বেলায় দায়ের করার মতো উপযুক্ত মামলার ধারা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
৭. রাষ্ট্রদ্রোহের ষড়যন্ত্রের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞে ধারাবাহিকতার প্রয়োজন হয়। উত্তরার ওই একটিমাত্র রাতের নৈশভোজ ব্যতীত ওইসব কর্মকর্তার সঙ্গে আমার রাষ্ট্রীয় কাজ ছাড়া আগে বা পরে কখনও সাক্ষাত্ হয়নি। ২০০৬ সালের ওই রাতের পর দীর্ঘ চার বছর অতিবাহিত হয়েছে। মাঝখানে ২০০৭ থেকে ২০০৮ একটি অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। অথচ ওইসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আর কোনো ষড়যন্ত্রে আমি জড়িত হলাম না। সেই তরুণ কর্মকর্তারা এখন কোথায়, কী দায়িত্ব পালন করছেন, তাও আমার অজানা।
৮. একটি নৈশভোজের তুচ্ছ ঘটনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ আখ্যা দিয়ে মামলা দায়ের করা হলে ১৯৯৬ সালের জনতার মঞ্চের ঘটনাকে আমরা কি নামে অভিহিত করব? সেদিন কর্মরত সচিবরা দলবেঁধে একটি রাজনৈতিক দলের জনসভা মঞ্চে উঠে প্রকাশ্যে সেই দলটির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। সেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আজ কোন ধারায় মামলা দায়ের করা হবে? সেই সচিবদের মধ্যে একজন তো আজ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক-মণ্ডলী, প্রেসিডিয়াম সদস্য। একই ব্যক্তি শেখ হাসিনার গেলবারের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীও হয়েছিলেন। জনতার মঞ্চের অন্য কুশীলবরাও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন।
৯. মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আর আজ ২০১০ সালের জুনের একুশ। এই দেড় বছরের মধ্যে সরকার আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার কোনো গরজ অনুভব করেনি। এমনকি এই মাসেরই ১ তারিখে গায়ের জোরে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং বানোয়াট মামলায় আমাকে গ্রেফতারের পূর্ব পর্যন্ত এজাতীয় কোনো মামলা দায়ের হয়নি। মামলা দায়ের করা হলো আমি যখন জেলখানায় বন্দি। মামলাটি যে সর্বৈব মিথ্যা এবং হয়রানিমূলক, এই সহজ বিষয়টি এরপরও কি বোঝার বাকি থাকে?
১০. আমার বিরুদ্ধে সব মামলার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়-সংক্রান্ত একটি সংবাদ আমারই সম্পাদিত পত্রিকা আমার দেশ-এ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে। সেই সংবাদ প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে আমার এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদদাতার ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে, আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতারা দেশের বিভিন্ন জেলায় আমার বিরুদ্ধে পঁচিশটি মানহানি মামলা দায়ের করেছে এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে ডিও পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের এই বানোয়াট মামলা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সেই নির্দেশের বাস্তবায়ন মাত্র। দেশের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকই বুঝবেন যে, এই মামলার সব কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকেই উদ্ভূত।
আমার বক্তব্য প্রদান শেষে স্বাভাবিকভাবেই ডিসির কক্ষের পরিবেশ আর বন্ধুত্বপূর্ণ রইল না। যথেষ্ট বিরক্তিসহকারে মাহবুবুর রহমান আমাকে তার বন্দিশালায় ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেন।
বাইশ তারিখ বিকাল থেকেই লক্ষ্য করলাম সেলের বাইরে পাহারারত সেন্ট্রি এবং কর্মকর্তাদের আচরণে পরিবর্তন এসেছে। তারা যথাসম্ভব আমার দৃষ্টি এড়িয়ে চলছেন। আইও মোরশেদুল ইসলাম বারদুয়েক সেলের সামনে দিয়ে ঘুরে গেলেও আমার সঙ্গে কোনো বাক্যালাপ করলেন না। এর আগে এসেই সর্বপ্রথম কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। আজ আমাকে রীতিমত উপেক্ষা করলেন, ব্যবহারে ব্যতিক্রম চোখে পড়ার মতো। আমার সেলের লাগোয়া স্থানে যে ডিউটি অফিসার বসেন, তার সঙ্গে একবার অনুচ্চকণ্ঠে কিছুক্ষণ আলাপও করে গেলেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আইও হন্তদন্ত হয়ে এসেই আর কোনো কথা না বলে আমাকে তক্ষুনি তৈরি হতে বললেন। এই রূঢ় আচরণে বেশ অবাক হলাম। দু’দফায় ডিবিতে সাত দিনের রিমান্ডের অভিজ্ঞতায় রাত এগারোটার আগে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হতে দেখিনি। ভাবলাম ডিসির অন্য কোনো কাজের ঝামেলা থাকায় আজ আগেই জিজ্ঞাসাবাদের পালা শেষ করতে চাইছেন। তৈরি হতে পাঁচ মিনিটের অধিক সময় নেইনি। সেল থেকে বের হয়ে স্যান্ডেলে সবে পা গলাচ্ছি, পাশ থেকে ডিউটি অফিসার ফিসফিস করে এক বোতল পানি সঙ্গে নিতে পরামর্শ দিলেন। পানি লাগবে কেন? বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার সামনে ঝকঝকে পানিভর্তি গ্লাস রাখা হলেও কোনোদিনই পান করার প্রয়োজন বোধ করিনি। আইও এবং অপর একজন ডিবি কর্মকর্তা আমাকে নিয়ে দোতলায় ওঠার পরিবর্তে যখন র্যাবের অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে রওনা দিল, তখন বুঝলাম আমার এতদিনের আশঙ্কা আজ সত্যে পরিণত হতে চলেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঝকঝকে গাড়িটি জোড়া কেবিন পিকআপ। সম্ভবত চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই কেনা হয়েছিল। আমাকে মাঝখানে ঠেলে পেছনের কেবিনে দু’পাশে দুই কর্মকর্তা বসলেন। সামনের কেবিনে ড্রাইভার এবং আরও একজন কর্মকর্তা।
আমাদের গন্তব্য জানতে চেয়ে কারও কাছ থেকেই কোনো জবাব পেলাম না। পাথরের মতো মুখ সবার। আমি কেবলই ভাবছি, ক্রসফায়ারের জন্য সময়টা বোধহয় একটু আগে হয়ে গেল। এসব ঘটনা তো সচরাচর রাত তিনটা-চারটার দিকে ঘটে থাকে। পিকআপ রওনা হয়ে একটু এগোতেই একজন হাতের ইশারায় ড্রাইভারকে থামতে বলল। আইও পিকআপ থেকে নেমে গেলেন। ভেতর থেকেই দেখলাম, মোরশেদুল ইসলাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে ডিবিরই একজন এসির সঙ্গে কথা বলছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২০ তারিখে এই এসিই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। আইও ফিরে এলে গাড়ি আবার স্টার্ট দেয়া হলো। ডিবি অফিসের প্রধান প্রবেশদ্বারের কাছে পৌঁছানোর আগেই আবারও বাধা। আইওর মোবাইলে কল আসায় তিনি নেমে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। গাড়ির ভেতরে বসেই আছি। প্রায় পনেরো মিনিট পর আইও ফিরে এসে পিকআপের ড্রাইভারকে বললেন, আমরা যাচ্ছি না। মূল অফিসের সামনে পিকআপ ফিরে এলে আমাকে নামতে বললেন। যন্ত্রচালিতের মতো নেমে এলাম।
আমাকে সেলে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে মোরশেদ কোনো কথা না বলেই চলে গেলেন। ডিউটি অফিসারের সামনে তখন আরও দু’জন ডিবির লোক সিভিল পোশাকে বসে গলা নিচু করে কথা বলছে। সম্ভবত একবারের জন্য টিএফআই শব্দটি শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে অস্ত্রধারী প্রহরীর সংখ্যা বাড়ল। হাজতের সামনে ডিউটি অফিসারদের বসার জায়গা পেরিয়ে যে কল্যাপসিবল দরজাটা আগে কোনোদিন বন্ধ হতে দেখিনি, সেই রাতে সেটিও বন্ধ করা হলো। সব মিলে থমথমে পরিবেশ। আমাকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা যে একটা চলছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না। সারারাত আর কেউ এলো না। রাত তিনটার দিকে গোসল করার সময় মনে হচ্ছিল এটা শেষ গোসলও হতে পারে। নোংরা টয়লেটে যথাসম্ভব পরিষ্কার করে গায়ে-মাথায় প্রচুর পানি দিয়ে গোসল করলাম। তাহাজ্জতের নামাজ কোনোদিন পড়িনি। কী মনে করে সেটাও সে রাতে পড়লাম। জীবনের সব ভুলভ্রান্তির জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করলাম। শুধু একটা দুঃখ থেকে গেল—আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী যাদের সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করেছি কিংবা কোনো অন্যায় করেছি, তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া হলো না। ফজরের নামাজ শেষ করে চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখন ছ’টা বেজে গেছে। কল্যাপসিবল গেট খুলে গেল। দেখলাম অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার এবং আমার আইও অসম্ভব গম্ভীর মুখ করে দ্রুত পায়ে সেলের দিকে এগিয়ে আসছেন।
ডিবি অফিসের সেই চেনা সেলেই স্থান হলো। সেখানকার কর্মকর্তারা এমনভাবে অভ্যর্থনা জানালেন যেন ক’দিন বিরতি শেষে পুরনো কর্মস্থলে ফিরে এসেছি। প্রথম রাতে জিজ্ঞাসাবাদ হলো না। দ্বিতীয় রাতে ডাক পড়ল ডিসির দোতলার পরিচিত কক্ষে। প্রশ্নকর্তারা গম্ভীর মুখে আসামির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হবেইবা না কেন? রাষ্ট্রদ্রোহের মতো গুরুতর অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। মোরশেদুল ইসলাম অভিযোগ পড়ে শোনালেন। ঘটনা কেবল চার বছরের পুরনোই নয়, বর্তমান সরকারের ক্ষমতাগ্রহণের আড়াই বছর আগের। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে উত্তরায় আমার সিরামিক প্রতিষ্ঠানের ভাড়া করা অফিসে ডজনখানেক তরুণ সরকারি কর্মকর্তাকে নিয়ে এক বৈঠকে আমি নাকি তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সরকারকে উত্খাতের ষড়যন্ত্র চালিয়েছিলাম। অভিযোগ শুনে হাসব না কাঁদব ভেবে পেলাম না। এই প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন চালাল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও তাদের মহাজোটের সঙ্গী-সাথী। তাদের লগি-বৈঠার নৃশংসতায় কত মায়ের বুক খালি হলো। দিনের পর দিন আন্দোলনকারীরা বঙ্গভবন অবরোধ করে রাখল। রাষ্ট্রপতির গ্যাস, পানি, বিদ্যুত্ তো বটেই, এমনকি আল্লাহর দেয়া অক্সিজেন পর্যন্ত বন্ধ করার হুমকি দিল। সেই সন্ত্রাসী আন্দোলনের ফসলস্বরূপ সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের কাঁধে সওয়ার হয়ে এলো মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন। জেনারেল মইন ও ড. ফখরুদ্দীনের আশীর্বাদে ডিজিটাল নির্বাচনে ক্ষমতায় এলেন শেখ হাসিনা। আর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা আমার বিরুদ্ধে? আমি যদি সেই সময় তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েই থাকি, তাহলে মহাজোট সরকারের তো উচিত আমাকে তাদের মিত্ররূপে বিবেচনা করা। রিমান্ডে এনে নির্যাতন করার পরিবর্তে আমার তো পুরস্কার প্রাপ্য। ঝাড়া পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে একবারও না থেমে আমার জবাব দিয়ে গেলাম। ডিসি মাহবুবুর রহমান একাধিকবার আমার বক্তব্যে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও আমি নাছোড়বান্দা। নিম্নোক্ত দশটি যুক্তি উপস্থাপন করলাম :
১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে সর্বদা বেগম খালেদা জিয়ার তল্পিবাহকরূপেই বিবেচনা করে এসেছেন এবং তাকে খালেদার ইয়েসউদ্দিন নামকরণও করেছিলেন। আজ যেমন গোটাদশেক উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যার যার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, আমিও বেগম খালেদা জিয়ার তেমন একজন উপদেষ্টা ছিলাম। বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবেও দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী আমি তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছেই সরাসরি রিপোর্ট করতাম। এক-এগারো-পরবর্তীকালে ক্যান্টনমেন্টের কয়েকজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তির ইশারায় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলে সংস্কারের ধুয়া উঠলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূলধারার প্রতি আমি বিশ্বাস ও আনুগত্যে অটল ছিলাম। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রকাশ্যে অভিযুক্ত সেই খালেদা জিয়ার কথিত তল্পিবাহক প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের সরকারের বিরুদ্ধে আমার ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব কোনো যুক্তিতেই ধোপে টিকবে না।
২. ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে এক-এগারো পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের সাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার সহিংস আন্দোলন করেছে। কাজেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বরং সেই সময়ের আন্দোলনকারী মোর্চার বিরুদ্ধেই দায়ের হওয়া উচিত।
৩. আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে বর্তমান সরকার নীতিগতভাবে মেনে নিচ্ছে যে, প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের সরকারকে উত্খাতের যে কোনোরকম প্রচেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে। জেনারেল মইন অস্ত্রের মুখে প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। তিনি তত্কালীন বিমান ও নৌবাহিনী প্রধান এবং নবম ডিভিশনের জিওসি লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় বঙ্গভবনে যান এবং রাষ্ট্রপ্রধানকে দিয়ে জোর করে জরুরি অবস্থা জারি করান। এর চেয়ে প্রকাশ্য রাষ্ট্রদ্রোহ আর কী হতে পারে? সুতরাং আইনের শাসনে বিশ্বাস করলে অনতিবিলম্বে উল্লিখিত সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রুজু করাই বর্তমান সরকারের দায়িত্ব। সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীনসহ সুশীল (?) সমাজের যেসব রথী-মহারথী সেই সময় এই চরম নিন্দনীয় অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের পক্ষে ছিলেন, তাদেরও আইনত একই মামলার আসামি হওয়ার কথা।
৪. এক-এগারো থেকে ডিজিটাল নির্বাচন পর্যন্ত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের যৌথ নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হয়েছে। আমি সেই সরকারের কঠোর সমালোচক ছিলাম। বস্তুত তখন থেকেই আমার লেখালেখির সূত্রপাত। সেই বিচিত্র সরকারের আমলেও প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা কি অবিশ্বাস্য ব্যাপার নয় যে, আমি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলাম, অথচ জরুরি আমলেও সেই কথিত অপরাধে তিনি এবং মিলিটারি জান্তা আমার বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা, কোনো অভিযোগই উত্থাপন করলেন না?
৫. উত্তরার তথাকথিত বৈঠক নিয়ে প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্কালীন কৃষি সচিব এমএ আজিজের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশনের প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়, ওই বৈঠকের সঙ্গে কোনোরূপ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায় নাই। যেখানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেক্ষেত্রে এই দীর্ঘ চার বছর পর রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপন করা অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হয়রানিমূলক। কেবল তাই নয়, ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই পরেবর্তীকালে অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমা করা হয় এবং তাদের বিভিন্ন স্থানে পদায়নও করা হয়। তত্কালীন কৃষি সচিব এমএ আজিজ জরুরি সরকারের আমলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন। মহাজোট সরকারের আমলে তিনি কেবল তার পদ ধরেই রাখেননি, তাকে একাধিকবার এক্সটেনশনও দেয়া হয়েছে। অর্থাত্ তিনি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, জেনারেল মইনউদ্দিন আহমেদ, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এবং শেখ হাসিনা—চারজনেরই অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
৬. কয়েকজন নিম্নপদস্থ তরুণ আমলার পক্ষে সরকার উত্খাতের মতো ষড়যন্ত্র করা একেবারেই অবাস্তব। আমার অফিসের নৈশভোজে উপস্থিতদের অধিকাংশই সহকারী সচিব এবং উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। গুলশান-বারিধারা এলাকায় নিয়মিতভাবে আয়োজিত যে কোনো নৈশভোজে অন্তত গোটাছয়েক সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন। বেচারা সহকারী সচিবদের একটিমাত্র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জড়িত করা হলে সচিবদের বেলায় দায়ের করার মতো উপযুক্ত মামলার ধারা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
৭. রাষ্ট্রদ্রোহের ষড়যন্ত্রের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞে ধারাবাহিকতার প্রয়োজন হয়। উত্তরার ওই একটিমাত্র রাতের নৈশভোজ ব্যতীত ওইসব কর্মকর্তার সঙ্গে আমার রাষ্ট্রীয় কাজ ছাড়া আগে বা পরে কখনও সাক্ষাত্ হয়নি। ২০০৬ সালের ওই রাতের পর দীর্ঘ চার বছর অতিবাহিত হয়েছে। মাঝখানে ২০০৭ থেকে ২০০৮ একটি অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। অথচ ওইসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আর কোনো ষড়যন্ত্রে আমি জড়িত হলাম না। সেই তরুণ কর্মকর্তারা এখন কোথায়, কী দায়িত্ব পালন করছেন, তাও আমার অজানা।
৮. একটি নৈশভোজের তুচ্ছ ঘটনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ আখ্যা দিয়ে মামলা দায়ের করা হলে ১৯৯৬ সালের জনতার মঞ্চের ঘটনাকে আমরা কি নামে অভিহিত করব? সেদিন কর্মরত সচিবরা দলবেঁধে একটি রাজনৈতিক দলের জনসভা মঞ্চে উঠে প্রকাশ্যে সেই দলটির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। সেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আজ কোন ধারায় মামলা দায়ের করা হবে? সেই সচিবদের মধ্যে একজন তো আজ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক-মণ্ডলী, প্রেসিডিয়াম সদস্য। একই ব্যক্তি শেখ হাসিনার গেলবারের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীও হয়েছিলেন। জনতার মঞ্চের অন্য কুশীলবরাও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন।
৯. মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আর আজ ২০১০ সালের জুনের একুশ। এই দেড় বছরের মধ্যে সরকার আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার কোনো গরজ অনুভব করেনি। এমনকি এই মাসেরই ১ তারিখে গায়ের জোরে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং বানোয়াট মামলায় আমাকে গ্রেফতারের পূর্ব পর্যন্ত এজাতীয় কোনো মামলা দায়ের হয়নি। মামলা দায়ের করা হলো আমি যখন জেলখানায় বন্দি। মামলাটি যে সর্বৈব মিথ্যা এবং হয়রানিমূলক, এই সহজ বিষয়টি এরপরও কি বোঝার বাকি থাকে?
১০. আমার বিরুদ্ধে সব মামলার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়-সংক্রান্ত একটি সংবাদ আমারই সম্পাদিত পত্রিকা আমার দেশ-এ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে। সেই সংবাদ প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে আমার এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদদাতার ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে, আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতারা দেশের বিভিন্ন জেলায় আমার বিরুদ্ধে পঁচিশটি মানহানি মামলা দায়ের করেছে এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে ডিও পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের এই বানোয়াট মামলা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সেই নির্দেশের বাস্তবায়ন মাত্র। দেশের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকই বুঝবেন যে, এই মামলার সব কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকেই উদ্ভূত।
আমার বক্তব্য প্রদান শেষে স্বাভাবিকভাবেই ডিসির কক্ষের পরিবেশ আর বন্ধুত্বপূর্ণ রইল না। যথেষ্ট বিরক্তিসহকারে মাহবুবুর রহমান আমাকে তার বন্দিশালায় ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেন।
বাইশ তারিখ বিকাল থেকেই লক্ষ্য করলাম সেলের বাইরে পাহারারত সেন্ট্রি এবং কর্মকর্তাদের আচরণে পরিবর্তন এসেছে। তারা যথাসম্ভব আমার দৃষ্টি এড়িয়ে চলছেন। আইও মোরশেদুল ইসলাম বারদুয়েক সেলের সামনে দিয়ে ঘুরে গেলেও আমার সঙ্গে কোনো বাক্যালাপ করলেন না। এর আগে এসেই সর্বপ্রথম কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। আজ আমাকে রীতিমত উপেক্ষা করলেন, ব্যবহারে ব্যতিক্রম চোখে পড়ার মতো। আমার সেলের লাগোয়া স্থানে যে ডিউটি অফিসার বসেন, তার সঙ্গে একবার অনুচ্চকণ্ঠে কিছুক্ষণ আলাপও করে গেলেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আইও হন্তদন্ত হয়ে এসেই আর কোনো কথা না বলে আমাকে তক্ষুনি তৈরি হতে বললেন। এই রূঢ় আচরণে বেশ অবাক হলাম। দু’দফায় ডিবিতে সাত দিনের রিমান্ডের অভিজ্ঞতায় রাত এগারোটার আগে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হতে দেখিনি। ভাবলাম ডিসির অন্য কোনো কাজের ঝামেলা থাকায় আজ আগেই জিজ্ঞাসাবাদের পালা শেষ করতে চাইছেন। তৈরি হতে পাঁচ মিনিটের অধিক সময় নেইনি। সেল থেকে বের হয়ে স্যান্ডেলে সবে পা গলাচ্ছি, পাশ থেকে ডিউটি অফিসার ফিসফিস করে এক বোতল পানি সঙ্গে নিতে পরামর্শ দিলেন। পানি লাগবে কেন? বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার সামনে ঝকঝকে পানিভর্তি গ্লাস রাখা হলেও কোনোদিনই পান করার প্রয়োজন বোধ করিনি। আইও এবং অপর একজন ডিবি কর্মকর্তা আমাকে নিয়ে দোতলায় ওঠার পরিবর্তে যখন র্যাবের অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে রওনা দিল, তখন বুঝলাম আমার এতদিনের আশঙ্কা আজ সত্যে পরিণত হতে চলেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঝকঝকে গাড়িটি জোড়া কেবিন পিকআপ। সম্ভবত চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই কেনা হয়েছিল। আমাকে মাঝখানে ঠেলে পেছনের কেবিনে দু’পাশে দুই কর্মকর্তা বসলেন। সামনের কেবিনে ড্রাইভার এবং আরও একজন কর্মকর্তা।
আমাদের গন্তব্য জানতে চেয়ে কারও কাছ থেকেই কোনো জবাব পেলাম না। পাথরের মতো মুখ সবার। আমি কেবলই ভাবছি, ক্রসফায়ারের জন্য সময়টা বোধহয় একটু আগে হয়ে গেল। এসব ঘটনা তো সচরাচর রাত তিনটা-চারটার দিকে ঘটে থাকে। পিকআপ রওনা হয়ে একটু এগোতেই একজন হাতের ইশারায় ড্রাইভারকে থামতে বলল। আইও পিকআপ থেকে নেমে গেলেন। ভেতর থেকেই দেখলাম, মোরশেদুল ইসলাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে ডিবিরই একজন এসির সঙ্গে কথা বলছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২০ তারিখে এই এসিই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। আইও ফিরে এলে গাড়ি আবার স্টার্ট দেয়া হলো। ডিবি অফিসের প্রধান প্রবেশদ্বারের কাছে পৌঁছানোর আগেই আবারও বাধা। আইওর মোবাইলে কল আসায় তিনি নেমে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। গাড়ির ভেতরে বসেই আছি। প্রায় পনেরো মিনিট পর আইও ফিরে এসে পিকআপের ড্রাইভারকে বললেন, আমরা যাচ্ছি না। মূল অফিসের সামনে পিকআপ ফিরে এলে আমাকে নামতে বললেন। যন্ত্রচালিতের মতো নেমে এলাম।
আমাকে সেলে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে মোরশেদ কোনো কথা না বলেই চলে গেলেন। ডিউটি অফিসারের সামনে তখন আরও দু’জন ডিবির লোক সিভিল পোশাকে বসে গলা নিচু করে কথা বলছে। সম্ভবত একবারের জন্য টিএফআই শব্দটি শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে অস্ত্রধারী প্রহরীর সংখ্যা বাড়ল। হাজতের সামনে ডিউটি অফিসারদের বসার জায়গা পেরিয়ে যে কল্যাপসিবল দরজাটা আগে কোনোদিন বন্ধ হতে দেখিনি, সেই রাতে সেটিও বন্ধ করা হলো। সব মিলে থমথমে পরিবেশ। আমাকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা যে একটা চলছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না। সারারাত আর কেউ এলো না। রাত তিনটার দিকে গোসল করার সময় মনে হচ্ছিল এটা শেষ গোসলও হতে পারে। নোংরা টয়লেটে যথাসম্ভব পরিষ্কার করে গায়ে-মাথায় প্রচুর পানি দিয়ে গোসল করলাম। তাহাজ্জতের নামাজ কোনোদিন পড়িনি। কী মনে করে সেটাও সে রাতে পড়লাম। জীবনের সব ভুলভ্রান্তির জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করলাম। শুধু একটা দুঃখ থেকে গেল—আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী যাদের সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করেছি কিংবা কোনো অন্যায় করেছি, তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া হলো না। ফজরের নামাজ শেষ করে চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখন ছ’টা বেজে গেছে। কল্যাপসিবল গেট খুলে গেল। দেখলাম অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার এবং আমার আইও অসম্ভব গম্ভীর মুখ করে দ্রুত পায়ে সেলের দিকে এগিয়ে আসছেন।
No comments