৩৭- মুসলিম বিশ্বে জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে জনজাগরণে রেনেসাঁর আবির্ভাব ঘটুক
তারা এক বিশেষ ফ্যাসিবাদী প্রজাতি
...২০০৬ সালের আন্দোলনে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টির পরও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী জোট এবং পুরনো বন্ধু ভারত সম্মিলিতভাবে আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করেছিল। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো তথাকথিত সেক্যুলাররাই এ যুগে সাম্রাজ্য-বাদের ট্রয়ের ঘোড়া হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তদুপরি বাংলাদেশের সেক্যুলাররা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করলেও তারা কট্টর সাম্প্রদায়িক, ইসলামবিদ্বেষী এক বিশেষ ফ্যাসিবাদী প্রজাতি।...
...২০০৬ সালের আন্দোলনে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টির পরও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী জোট এবং পুরনো বন্ধু ভারত সম্মিলিতভাবে আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করেছিল। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো তথাকথিত সেক্যুলাররাই এ যুগে সাম্রাজ্য-বাদের ট্রয়ের ঘোড়া হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তদুপরি বাংলাদেশের সেক্যুলাররা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করলেও তারা কট্টর সাম্প্রদায়িক, ইসলামবিদ্বেষী এক বিশেষ ফ্যাসিবাদী প্রজাতি।...
শতাব্দীরও অধিককাল ধরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের দালাল স্বৈরশাসকদের হাতে নিপীড়িত মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ অবশেষে মহান প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। নিরস্ত্র জনতার স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবে মিসরে হোসনি মোবারকের তিন দশকের ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন ঘটেছে। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা এবং অগণিত নবী-রাসুলের দেশে ভিন্নমতাবলম্বী বিশেষ করে ইসলামপন্থীদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার হোসনি মোবারক এবং তার পূর্বসূরিরা চালিয়েছে, পৃথিবীতে তার নজির কমই রয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে আলজেরিয়ায় ফরাসিদের এবং আমাদের ওপর ব্রিটিশদের নির্যাতনের সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে মিসরে হোসনি মোবারকের শাসনকাল।
আমার মিসরে যাওয়ার কোনো সুযোগ না হলেও ওই দেশে যারা গেছেন, তাদের কাছ থেকে পুলিশি রাষ্ট্রটির শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতার গল্প শুনেছি। বিগত পঞ্চাশ বছর যাবত সে দেশে মুসলিম ব্রাদারহুড কিংবা ইখওয়ানুল মুসলেমিন শব্দটি উচ্চারণ করাটাই নাকি গ্রেফতার হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। একজন চরম অজনপ্রিয় স্বৈরশাসক এতদিন কেবল পশ্চিমাদের আনুকূল্য এবং ইসরাইলের সঙ্গে গোপন আঁতাতের মাধ্যমেই ক্ষমতায় টিকে ছিল। এখন দেখার বিষয়, মিসরের এই গণজাগরণ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রেও ঢেউ তোলে কিনা। তার কিছু আলামত অন্যত্রও দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। হোসনি মোবারকের আগেই পতন ঘটেছে তিউনিসিয়ার তথাকথিত লৌহমানব বেন আলির। বাহরাইন, লিবিয়া, সিরিয়া, মরক্কো এবং জর্ডানেও বিক্ষোভ চলছে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণ জেগে উঠে এক নতুন রেনেসাঁর আবির্ভাব ঘটুক, আল্লাহ্র কাছে এই প্রার্থনাই করছি।
মিসরের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কি শিক্ষালাভের কিছু নেই? এদেশেও তো এখন পশ্চিমা ও ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে। ইসলামপন্থীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা হোসনি মোবারকের মিসরের পর্যায়ে না পৌঁছলেও ইসলাম ধর্মের প্রতি সমাজে বিদ্বেষ ছড়ানোতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা মিসরকে ছাড়িয়ে গেছে। লুটেরা সরকারের অপশাসনে জনজীবন দুর্বিষহ। খবরের কাগজে পড়লাম, সপ্তাহ দুয়েক আগে এক গোলটেবিলে প্রধান অতিথির ভাষণে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলাদেশেও মিসর স্টাইল বিপ্লবের ইঙ্গিত করেছেন। তিনি সেদিন ঠিক কী বলেছেন, সেটা আমার মতো বন্দির জানার কোনো উপায় নেই। তবে তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সরকার সমর্থক ডেইলি স্টারের রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠা দেখে কৌতুক অনুভব করেছি।
সম্পাদকীয় ছেপে এবং পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখে পত্রিকাটি যেভাবে ব্যারিস্টার মওদুদের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, তাতে বিএনপির প্রতি ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয়মণ্ডলীর ক্রোধের মাত্রা বুঝতে সহায়ক হয়েছে। মহাজোট সরকার কোনোদিন ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে এমন কোনো সম্ভাবনার উল্লেখমাত্র পত্রিকাটি যেভাবে শিং উঁচিয়ে তেড়ে আসে, তাতে স্পেনের বিখ্যাত বুল-ফাইটের কথা মনে পড়ে যায়। সেই বুল-ফাইটে ষাঁড়কে তাতিয়ে তোলার জন্য যেভাবে লাল কাপড় ব্যবহার করা হয়, একই রকমভাবে সুশীল(?) ইংরেজি পত্রিকার সামনে বিএনপির ব্যানার ব্যবহার করাই বোধ হয় যথেষ্ট। যাই হোক, ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় পড়েই মনে প্রশ্ন জাগল, তাহরির স্কোয়ার আদলের গণঅভ্যুত্থান বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আদৌ কি ঘটতে পারে?
জবাব খোঁজার আগে দুই দেশের পরিস্থিতির অমিলের বিষয়টি আমলে নেয়া যাক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অমিলটি দুই দেশের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি জনসমর্থন সম্পর্কিত। তিন দশক একচ্ছত্র রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়েও হোসনি মোবারক মিসরের জনগণকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় তার বা তার দলের পক্ষে টানতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেক্যুলার এবং ইসলামপন্থী নির্বিশেষে দেশটির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাকে তীব্রভাবে অপছন্দ করে। অপরদিকে বাংলাদেশে ১৯৭৯ সাল ছাড়া কোনো সাধারণ নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ৩৫ শতাংশের নিচে ভোট পায়নি। অর্থাত্ বাংলাদেশের ভোটারদের প্রতি তিনজনের মধ্যে অন্তত একজন এই ফ্যাসিবাদী দলটির একনিষ্ঠ সমর্থক। অবশ্য এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের ১৫ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে অধিকাংশই প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়ে এসেছে। এই বিশাল ভোট ব্যাংক আওয়ামী লীগের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় শক্তি। এদেশের সেক্যুলারপন্থীরাও নানা রকম অস্বস্তি নিয়েও সচরাচর আওয়ামী লীগকেই তাদের মিত্রশক্তি বিবেচনা করে থাকে। এই ধরনের গণভিত্তিসম্পন্ন একটি সরকারের বিরুদ্ধে সফল গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যেসব শর্ত তৈরি হওয়া আবশ্যক, সেটি এখনও বাংলাদেশে হয়েছে কিনা আমার বর্তমান অবস্থায় সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার সুযোগ নেই।
চিন্তা-চেতনায় আজন্ম ফ্যাসিবাদী মন-মানসিকতায় পুষ্ট হওয়ার কারণে সহিংস আন্দোলন গড়ে তোলার দক্ষতার মাপকাঠিতেও আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি দুগ্ধপোষ্য শিশু। দিনে-দুপুরে ডজন ডজন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে অকাতরে মানুষ হত্যা করে সেই লাশের ওপর তাণ্ডবনৃত্য করা কিংবা হরতাল সফল করার লক্ষ্যে অক্লেশে বাসভর্তি যাত্রী পুড়িয়ে কঙ্কাল বানিয়ে দেয়ার মতো নৃশংস কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য যে ক্যাডার বাহিনীর আবশ্যক, সেই ধরনের লোকজন বিএনপিতে পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে এই ধরনের সহিংস কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ প্রতিবার পার পেলেও বিএনপিকে নিশ্চিতভাবেই দেশি-বিদেশি মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে মহাজোট সরকারের পক্ষাবলম্বন করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, হেগের আন্তর্জাতিক আদালত এবং ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসের এগিয়ে আসাও বিচিত্র নয়। যদিও ২০০৬ সালের আন্দোলনে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টির পরও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী জোট এবং পুরনো বন্ধু ভারত সম্মিলিতভাবে আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করেছিল। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রসমূহে তথাকথিত সেক্যুলাররাই এ যুগে সাম্রাজ্যবাদের ট্রয়ের ঘোড়া (Trojan Horse) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তদুপরি বাংলাদেশের সেক্যুলাররা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করলেও বাস্তবে তারা কট্টর সাম্প্রদায়িক, ইসলামবিদ্বেষী এক বিশেষ ফ্যাসিবাদী প্রজাতি।
বাংলাদেশ এবং মিসরের মধ্যে দ্বিতীয় অমিলের প্রকৃতিটি ভৌগোলিক। মিসর আয়তন, জনসংখ্যা ও সামরিক শক্তির বিচারে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহত্ রাষ্ট্র। অপরদিকে বাংলাদেশ একমাত্র জনসংখ্যা ছাড়া অন্য সব বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র দেশ। তদুপরি আমাদের বিশাল প্রতিবেশী ভারত ক্ষমতাসীন শেখ মুজিব পরিবারের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সচরাচর যে ধরনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে, সেটা থেকে ভারতের শাসকশ্রেণী এবং বাংলাদেশের বর্তমান শাসক পরিবারটির সম্পর্ক একেবারেই ভিন্ন চরিত্রের। এখানে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো ধরনের লেনদেন হচ্ছে না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং তার ষোল কোটি নাগরিকের স্বার্থ ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভারতের প্রতি এদেশের একটিমাত্র ‘রাজপরিবারের’ অপরিসীম কৃতজ্ঞতাবোধ। এই অস্বাভাবিক সম্পর্কের কারণেই আওয়ামী জামানায় প্রণীত বাংলাদেশ-ভারত সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ অকাতরে বিসর্জন দেয়া হয়েছে।
কাজেই, নিজ স্বার্থেই বাংলাদেশের সেই পরিবারটিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী নিশ্চিতভাবেই তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। হোসনি মোবারককে সর্বান্তকরণে সমর্থন করলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় ইসরাইলের পক্ষে মিসরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হয়নি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বাংলাদেশে তাহরির স্কোয়ারের মতো অভ্যুত্থান ঘটলে ভারত শেখ হাসিনার সরকারকে রক্ষা করতে প্রকাশ্যেই প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করবে। পাঠকের স্মরণে থাকার কথা যে ২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সীমান্তের ওপারে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর রণসজ্জার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। হোসনি মোবারকের পক্ষে সাহায্যের জন্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি টেলিফোন করা সম্ভব না হলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিডিআর ম্যাসাকারের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ামাত্র কালবিলম্ব না করে ভারতের অর্থমন্ত্রী এবং তাদের পারিবারিক বন্ধু প্রণব মুখার্জির দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
তাহলে কি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের এমন অপশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনায় পর্বত-প্রমাণ ব্যর্থতা, বিদেশি শক্তির নগ্ন তাঁবেদারি সত্ত্বেও এদেশে নিপীড়িত জনগণের জাগরণ আর সম্ভব নয়? মস্তিষ্ক বলে অবস্থাটা সেরকমই, কিন্তু হৃদয় মানতে চায় না। মাত্র তিন যুগ আগেই ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে এদেশে ফ্যাসিবাদের চরম পরাজয় ঘটেছিল। সম্প্রতি আড়িয়ল বিলের লড়াকু জনতা তাদের সফল প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আশার নিভু নিভু শিখাটিকে পুনর্বার প্রজ্বলিত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী শীতল যুদ্ধ চলাকালীন বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী ইন্ধনে ইসলাম এবং বামপন্থার মধ্যে যে এক চরম বৈরী সম্পর্কের সূত্রপাত করা হয়েছিল, বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রেই তার অবসান ঘটেছে। বরং সেসব দেশে একে অপরের অবস্থানকে উপলব্ধি করার একটা তাগিদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইসলামিস্টরা বামপন্থা মানেই খোদাদ্রোহী, নাস্তিক্যবাদ এবং পুঁজিবাদ অন্ততপক্ষে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তাই তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য, এই অতি সরলীকরণ থেকে সরে আসতে শুরু করেছেন। অপরদিকে ইসলাম ধর্মের সর্বপ্রকার বর্ণবাদবিরোধী সাম্যের বাণী ও সমাজের নিপীড়িত শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপ্লবের মহান আদর্শকে বর্তমান বিশ্বে অনেক বামপন্থী তাত্ত্বিক স্বীকার করতে শুরু করেছেন।
মিসরের গণঅভ্যুত্থান মোকাবিলায় হোসনি মোবারক ইসলামের বিরুদ্ধে সেক্যুলারদের ব্যবহার করার দীর্ঘদিনের কার্যকর কৌশল গ্রহণ করে এবার কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। তাহরির স্কোয়ারে দিনের পর দিন ইসলামিস্ট এবং সেক্যুলারিস্টরা পাশাপাশি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে আবার নামাজও আদায় করেছে। সরকারের পেটোয়া বাহিনীর আক্রমণে বিপুল সংখ্যায় হতাহত হলেও তারা কেউ পশ্চাদপসরণ করেনি। সরকারি এজেন্টরাও ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে পারেনি। বাংলাদেশেও যারা একেবারে চরম ইসলামবিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক সেক্যুলারিস্ট পর্যায়ভুক্ত নন তাদেরও বিশ্ব-রাজনীতির বাস্তবতা এবং আপন নীতি ও আদর্শের নতুন করে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের সময় এসেছে। এদেশে মাদরাসায় পড়ুয়ারা যে অধিকাংশ সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে এই সহজ সত্য যারা দেখতে পান না, তাদের প্রকৃত বামপন্থীরূপে মেনে নেয়া কঠিন। বাংলাদেশের দরিদ্র ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠী ও মাদরাসায় শিক্ষাপ্রাপ্তদের অচ্ছুত বিবেচনা করে শোষিত মানুষের মুক্তির আদর্শ প্রচার এবং শোষণমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা এক ধরনের ‘স্নবারি’ (Snobbery) ছাড়া আর কিছু নয়। ‘মাদরাসা জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র’ তত্ত্বের উদ্ভাবকরা যে প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের এদেশীয় এজেন্ট, এটা উপলব্ধি করতে পারলে সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী শক্তির নেতৃত্বে সর্বজনীন ঐক্য গঠিত হওয়া সম্ভব বলেই আমি বিশ্বাস করি। তারপর অসহনীয় দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে পিষ্ট এবং দুর্বৃত্ত শাসকশ্রেণী দ্বারা নিত্যদিন নিষ্পেষিত জনতার অবশ্যম্ভাবী বিস্ফোরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশে তাহরির স্কোয়ারের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগে এই শর্তগুলো পূরণ হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থেই গণপ্রতিরোধ পরিচালিত হতে হবে, কোনো ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীস্বার্থে কেবল ক্ষমতার পালাবদলের উদ্দেশ্যে কোনো সফল গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দেখি না। সে ধরনের ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হলে ভারত-মার্কিন স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী কর্পোরেট মিডিয়া মোগলদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অবশ্যই গণআন্দোলন আটকে থাকবে না।
তাহরির স্কোয়ার আপাতত শিকেয় তোলা থাক। গাজীপুর জেলে মশার যন্ত্রণায় প্রাণ যায়। এই জেলে মশার কোনো রাত-দিন নেই। ভাতের সঙ্গে প্রতি বেলায় দু-চারটে পেটে গিয়ে প্রোটিনের অভাব মেটাচ্ছে। নামাজ পড়ার সময় তো তাদের একেবারে পোয়াবারো। দেহের কোনো অনাবৃত অংশই তাদের দংশন থেকে নিরাপদ নয়। মশা সুযোগ পেলে টাকেও যে হুল ফোটায়, সেই অভিজ্ঞতাও এখানেই প্রথম হলো। মশা মারার যত রকম ব্যবস্থা তার সবগুলো প্রয়োগ করেও এই রক্তবীজের ঝাড়ের অত্যাচার থেকে নিস্তার পাচ্ছি না। কয়েল তো চব্বিশ ঘণ্টা জ্বালানোই থাকে। পারভীন গত সপ্তাহে মরটিন পাওয়ার বুস্টার নামক এক যন্ত্র দিয়ে গেছে। সেটাও যতক্ষণ বিদ্যুত্ থাকে ততক্ষণ সকেটে ঢোকানোই আছে। এর সঙ্গে এক হাতে এরোসলের ডিব্বা এবং অপর হাতে কয়েক প্রস্থ খবরের কাগজ পেঁচিয়ে তৈরি টেবল টেনিস ব্যাট সদৃশ হোম-মেড মশা সংহার অস্ত্র নিয়ে মশা মেরে বেড়াচ্ছি। এরোসল স্প্রে করতে করতে শ্বাসনালী আর চোখের বারোটা বাজলেও ঝাঁকের পর ঝাঁক মশক বাহিনী আসার কোনো বিরাম নেই।
জেলারের ধারণা, এসব মশা নাকি রাস্তার ওপারের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে জন্মলাভ করছে। সেখানে কামড়ানোর মতো যথেষ্ট মানুষ না পেয়ে মশা তার প্রবল ঘ্রাণশক্তি প্রয়োগ করে ছুটে আসছে এই জেলে বন্দি হাজারখানেক হতভাগ্য কয়েদি-হাজতির রক্তের সন্ধানে। জেলার সাহেবের যুক্তি অকাট্য। ছোট একটি জায়গায় একসঙ্গে এতগুলো লোভনীয় শিকার দ্বিতীয় কোনো স্থানে মিলবে না। তবে জেলে খাদ্যের যা অবস্থা, তাতে আমাদের রক্ত তো মশা বাবাজিদের বিস্বাদ লাগা উচিত ছিল। সাঈদী ভাইয়ের ধারণা, আমাদের শাসকশ্রেণীর মতোই এরা লাজ-লজ্জাহীন, অতি বজ্জাত প্রজাতির মশা। আমিও ওনার সঙ্গে একমত। নইলে এমন গোগ্রাসে রক্তশূন্যতায় ভোগা অসহায় আসামির রক্ত খায়!
যাই হোক, প্রাণে রক্ষা পাওয়ার জন্য জেল কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের খরচায় সেলে নেট লাগানোর প্রস্তাব করেছি। এখন পর্যন্ত অবশ্য ওপরের অনুমতি পাওয়া যায়নি। আজ ফেব্রুয়ারির বাইশ। আমার সাজার মেয়াদ শেষ হতে আর তেইশ দিন বাকি। ওইদিন মুক্তি পাব কিনা জানি না, তবে নয় মাসে জেলের যতটুকু নিয়ম-কানুন দেখেছি, তাতে ধারণা করছি মুক্তি না পেলেও ১৭ মার্চের পর আমাকে গাজীপুর জেলে আর রাখা হবে না। সে পর্যন্ত ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচতে হলে পড়াশোনা শিকেয় তুলে সারাদিন মশা নিধনে ব্যস্ত থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
আমার মিসরে যাওয়ার কোনো সুযোগ না হলেও ওই দেশে যারা গেছেন, তাদের কাছ থেকে পুলিশি রাষ্ট্রটির শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতার গল্প শুনেছি। বিগত পঞ্চাশ বছর যাবত সে দেশে মুসলিম ব্রাদারহুড কিংবা ইখওয়ানুল মুসলেমিন শব্দটি উচ্চারণ করাটাই নাকি গ্রেফতার হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। একজন চরম অজনপ্রিয় স্বৈরশাসক এতদিন কেবল পশ্চিমাদের আনুকূল্য এবং ইসরাইলের সঙ্গে গোপন আঁতাতের মাধ্যমেই ক্ষমতায় টিকে ছিল। এখন দেখার বিষয়, মিসরের এই গণজাগরণ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রেও ঢেউ তোলে কিনা। তার কিছু আলামত অন্যত্রও দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। হোসনি মোবারকের আগেই পতন ঘটেছে তিউনিসিয়ার তথাকথিত লৌহমানব বেন আলির। বাহরাইন, লিবিয়া, সিরিয়া, মরক্কো এবং জর্ডানেও বিক্ষোভ চলছে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণ জেগে উঠে এক নতুন রেনেসাঁর আবির্ভাব ঘটুক, আল্লাহ্র কাছে এই প্রার্থনাই করছি।
মিসরের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কি শিক্ষালাভের কিছু নেই? এদেশেও তো এখন পশ্চিমা ও ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে। ইসলামপন্থীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা হোসনি মোবারকের মিসরের পর্যায়ে না পৌঁছলেও ইসলাম ধর্মের প্রতি সমাজে বিদ্বেষ ছড়ানোতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা মিসরকে ছাড়িয়ে গেছে। লুটেরা সরকারের অপশাসনে জনজীবন দুর্বিষহ। খবরের কাগজে পড়লাম, সপ্তাহ দুয়েক আগে এক গোলটেবিলে প্রধান অতিথির ভাষণে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলাদেশেও মিসর স্টাইল বিপ্লবের ইঙ্গিত করেছেন। তিনি সেদিন ঠিক কী বলেছেন, সেটা আমার মতো বন্দির জানার কোনো উপায় নেই। তবে তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সরকার সমর্থক ডেইলি স্টারের রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠা দেখে কৌতুক অনুভব করেছি।
সম্পাদকীয় ছেপে এবং পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখে পত্রিকাটি যেভাবে ব্যারিস্টার মওদুদের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, তাতে বিএনপির প্রতি ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয়মণ্ডলীর ক্রোধের মাত্রা বুঝতে সহায়ক হয়েছে। মহাজোট সরকার কোনোদিন ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে এমন কোনো সম্ভাবনার উল্লেখমাত্র পত্রিকাটি যেভাবে শিং উঁচিয়ে তেড়ে আসে, তাতে স্পেনের বিখ্যাত বুল-ফাইটের কথা মনে পড়ে যায়। সেই বুল-ফাইটে ষাঁড়কে তাতিয়ে তোলার জন্য যেভাবে লাল কাপড় ব্যবহার করা হয়, একই রকমভাবে সুশীল(?) ইংরেজি পত্রিকার সামনে বিএনপির ব্যানার ব্যবহার করাই বোধ হয় যথেষ্ট। যাই হোক, ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় পড়েই মনে প্রশ্ন জাগল, তাহরির স্কোয়ার আদলের গণঅভ্যুত্থান বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আদৌ কি ঘটতে পারে?
জবাব খোঁজার আগে দুই দেশের পরিস্থিতির অমিলের বিষয়টি আমলে নেয়া যাক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অমিলটি দুই দেশের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি জনসমর্থন সম্পর্কিত। তিন দশক একচ্ছত্র রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়েও হোসনি মোবারক মিসরের জনগণকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় তার বা তার দলের পক্ষে টানতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেক্যুলার এবং ইসলামপন্থী নির্বিশেষে দেশটির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাকে তীব্রভাবে অপছন্দ করে। অপরদিকে বাংলাদেশে ১৯৭৯ সাল ছাড়া কোনো সাধারণ নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ৩৫ শতাংশের নিচে ভোট পায়নি। অর্থাত্ বাংলাদেশের ভোটারদের প্রতি তিনজনের মধ্যে অন্তত একজন এই ফ্যাসিবাদী দলটির একনিষ্ঠ সমর্থক। অবশ্য এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের ১৫ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে অধিকাংশই প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়ে এসেছে। এই বিশাল ভোট ব্যাংক আওয়ামী লীগের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় শক্তি। এদেশের সেক্যুলারপন্থীরাও নানা রকম অস্বস্তি নিয়েও সচরাচর আওয়ামী লীগকেই তাদের মিত্রশক্তি বিবেচনা করে থাকে। এই ধরনের গণভিত্তিসম্পন্ন একটি সরকারের বিরুদ্ধে সফল গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যেসব শর্ত তৈরি হওয়া আবশ্যক, সেটি এখনও বাংলাদেশে হয়েছে কিনা আমার বর্তমান অবস্থায় সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার সুযোগ নেই।
চিন্তা-চেতনায় আজন্ম ফ্যাসিবাদী মন-মানসিকতায় পুষ্ট হওয়ার কারণে সহিংস আন্দোলন গড়ে তোলার দক্ষতার মাপকাঠিতেও আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি দুগ্ধপোষ্য শিশু। দিনে-দুপুরে ডজন ডজন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে অকাতরে মানুষ হত্যা করে সেই লাশের ওপর তাণ্ডবনৃত্য করা কিংবা হরতাল সফল করার লক্ষ্যে অক্লেশে বাসভর্তি যাত্রী পুড়িয়ে কঙ্কাল বানিয়ে দেয়ার মতো নৃশংস কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য যে ক্যাডার বাহিনীর আবশ্যক, সেই ধরনের লোকজন বিএনপিতে পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে এই ধরনের সহিংস কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ প্রতিবার পার পেলেও বিএনপিকে নিশ্চিতভাবেই দেশি-বিদেশি মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে মহাজোট সরকারের পক্ষাবলম্বন করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, হেগের আন্তর্জাতিক আদালত এবং ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসের এগিয়ে আসাও বিচিত্র নয়। যদিও ২০০৬ সালের আন্দোলনে ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টির পরও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী জোট এবং পুরনো বন্ধু ভারত সম্মিলিতভাবে আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করেছিল। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রসমূহে তথাকথিত সেক্যুলাররাই এ যুগে সাম্রাজ্যবাদের ট্রয়ের ঘোড়া (Trojan Horse) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তদুপরি বাংলাদেশের সেক্যুলাররা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করলেও বাস্তবে তারা কট্টর সাম্প্রদায়িক, ইসলামবিদ্বেষী এক বিশেষ ফ্যাসিবাদী প্রজাতি।
বাংলাদেশ এবং মিসরের মধ্যে দ্বিতীয় অমিলের প্রকৃতিটি ভৌগোলিক। মিসর আয়তন, জনসংখ্যা ও সামরিক শক্তির বিচারে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহত্ রাষ্ট্র। অপরদিকে বাংলাদেশ একমাত্র জনসংখ্যা ছাড়া অন্য সব বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র দেশ। তদুপরি আমাদের বিশাল প্রতিবেশী ভারত ক্ষমতাসীন শেখ মুজিব পরিবারের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সচরাচর যে ধরনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে, সেটা থেকে ভারতের শাসকশ্রেণী এবং বাংলাদেশের বর্তমান শাসক পরিবারটির সম্পর্ক একেবারেই ভিন্ন চরিত্রের। এখানে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো ধরনের লেনদেন হচ্ছে না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং তার ষোল কোটি নাগরিকের স্বার্থ ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভারতের প্রতি এদেশের একটিমাত্র ‘রাজপরিবারের’ অপরিসীম কৃতজ্ঞতাবোধ। এই অস্বাভাবিক সম্পর্কের কারণেই আওয়ামী জামানায় প্রণীত বাংলাদেশ-ভারত সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ অকাতরে বিসর্জন দেয়া হয়েছে।
কাজেই, নিজ স্বার্থেই বাংলাদেশের সেই পরিবারটিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী নিশ্চিতভাবেই তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। হোসনি মোবারককে সর্বান্তকরণে সমর্থন করলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় ইসরাইলের পক্ষে মিসরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হয়নি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বাংলাদেশে তাহরির স্কোয়ারের মতো অভ্যুত্থান ঘটলে ভারত শেখ হাসিনার সরকারকে রক্ষা করতে প্রকাশ্যেই প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করবে। পাঠকের স্মরণে থাকার কথা যে ২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সীমান্তের ওপারে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর রণসজ্জার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। হোসনি মোবারকের পক্ষে সাহায্যের জন্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি টেলিফোন করা সম্ভব না হলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিডিআর ম্যাসাকারের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ামাত্র কালবিলম্ব না করে ভারতের অর্থমন্ত্রী এবং তাদের পারিবারিক বন্ধু প্রণব মুখার্জির দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
তাহলে কি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের এমন অপশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনায় পর্বত-প্রমাণ ব্যর্থতা, বিদেশি শক্তির নগ্ন তাঁবেদারি সত্ত্বেও এদেশে নিপীড়িত জনগণের জাগরণ আর সম্ভব নয়? মস্তিষ্ক বলে অবস্থাটা সেরকমই, কিন্তু হৃদয় মানতে চায় না। মাত্র তিন যুগ আগেই ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে এদেশে ফ্যাসিবাদের চরম পরাজয় ঘটেছিল। সম্প্রতি আড়িয়ল বিলের লড়াকু জনতা তাদের সফল প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আশার নিভু নিভু শিখাটিকে পুনর্বার প্রজ্বলিত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী শীতল যুদ্ধ চলাকালীন বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী ইন্ধনে ইসলাম এবং বামপন্থার মধ্যে যে এক চরম বৈরী সম্পর্কের সূত্রপাত করা হয়েছিল, বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রেই তার অবসান ঘটেছে। বরং সেসব দেশে একে অপরের অবস্থানকে উপলব্ধি করার একটা তাগিদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইসলামিস্টরা বামপন্থা মানেই খোদাদ্রোহী, নাস্তিক্যবাদ এবং পুঁজিবাদ অন্ততপক্ষে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তাই তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য, এই অতি সরলীকরণ থেকে সরে আসতে শুরু করেছেন। অপরদিকে ইসলাম ধর্মের সর্বপ্রকার বর্ণবাদবিরোধী সাম্যের বাণী ও সমাজের নিপীড়িত শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপ্লবের মহান আদর্শকে বর্তমান বিশ্বে অনেক বামপন্থী তাত্ত্বিক স্বীকার করতে শুরু করেছেন।
মিসরের গণঅভ্যুত্থান মোকাবিলায় হোসনি মোবারক ইসলামের বিরুদ্ধে সেক্যুলারদের ব্যবহার করার দীর্ঘদিনের কার্যকর কৌশল গ্রহণ করে এবার কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। তাহরির স্কোয়ারে দিনের পর দিন ইসলামিস্ট এবং সেক্যুলারিস্টরা পাশাপাশি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে আবার নামাজও আদায় করেছে। সরকারের পেটোয়া বাহিনীর আক্রমণে বিপুল সংখ্যায় হতাহত হলেও তারা কেউ পশ্চাদপসরণ করেনি। সরকারি এজেন্টরাও ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে পারেনি। বাংলাদেশেও যারা একেবারে চরম ইসলামবিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক সেক্যুলারিস্ট পর্যায়ভুক্ত নন তাদেরও বিশ্ব-রাজনীতির বাস্তবতা এবং আপন নীতি ও আদর্শের নতুন করে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের সময় এসেছে। এদেশে মাদরাসায় পড়ুয়ারা যে অধিকাংশ সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে এই সহজ সত্য যারা দেখতে পান না, তাদের প্রকৃত বামপন্থীরূপে মেনে নেয়া কঠিন। বাংলাদেশের দরিদ্র ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠী ও মাদরাসায় শিক্ষাপ্রাপ্তদের অচ্ছুত বিবেচনা করে শোষিত মানুষের মুক্তির আদর্শ প্রচার এবং শোষণমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা এক ধরনের ‘স্নবারি’ (Snobbery) ছাড়া আর কিছু নয়। ‘মাদরাসা জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র’ তত্ত্বের উদ্ভাবকরা যে প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের এদেশীয় এজেন্ট, এটা উপলব্ধি করতে পারলে সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী শক্তির নেতৃত্বে সর্বজনীন ঐক্য গঠিত হওয়া সম্ভব বলেই আমি বিশ্বাস করি। তারপর অসহনীয় দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে পিষ্ট এবং দুর্বৃত্ত শাসকশ্রেণী দ্বারা নিত্যদিন নিষ্পেষিত জনতার অবশ্যম্ভাবী বিস্ফোরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশে তাহরির স্কোয়ারের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগে এই শর্তগুলো পূরণ হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থেই গণপ্রতিরোধ পরিচালিত হতে হবে, কোনো ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীস্বার্থে কেবল ক্ষমতার পালাবদলের উদ্দেশ্যে কোনো সফল গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দেখি না। সে ধরনের ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হলে ভারত-মার্কিন স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী কর্পোরেট মিডিয়া মোগলদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অবশ্যই গণআন্দোলন আটকে থাকবে না।
তাহরির স্কোয়ার আপাতত শিকেয় তোলা থাক। গাজীপুর জেলে মশার যন্ত্রণায় প্রাণ যায়। এই জেলে মশার কোনো রাত-দিন নেই। ভাতের সঙ্গে প্রতি বেলায় দু-চারটে পেটে গিয়ে প্রোটিনের অভাব মেটাচ্ছে। নামাজ পড়ার সময় তো তাদের একেবারে পোয়াবারো। দেহের কোনো অনাবৃত অংশই তাদের দংশন থেকে নিরাপদ নয়। মশা সুযোগ পেলে টাকেও যে হুল ফোটায়, সেই অভিজ্ঞতাও এখানেই প্রথম হলো। মশা মারার যত রকম ব্যবস্থা তার সবগুলো প্রয়োগ করেও এই রক্তবীজের ঝাড়ের অত্যাচার থেকে নিস্তার পাচ্ছি না। কয়েল তো চব্বিশ ঘণ্টা জ্বালানোই থাকে। পারভীন গত সপ্তাহে মরটিন পাওয়ার বুস্টার নামক এক যন্ত্র দিয়ে গেছে। সেটাও যতক্ষণ বিদ্যুত্ থাকে ততক্ষণ সকেটে ঢোকানোই আছে। এর সঙ্গে এক হাতে এরোসলের ডিব্বা এবং অপর হাতে কয়েক প্রস্থ খবরের কাগজ পেঁচিয়ে তৈরি টেবল টেনিস ব্যাট সদৃশ হোম-মেড মশা সংহার অস্ত্র নিয়ে মশা মেরে বেড়াচ্ছি। এরোসল স্প্রে করতে করতে শ্বাসনালী আর চোখের বারোটা বাজলেও ঝাঁকের পর ঝাঁক মশক বাহিনী আসার কোনো বিরাম নেই।
জেলারের ধারণা, এসব মশা নাকি রাস্তার ওপারের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে জন্মলাভ করছে। সেখানে কামড়ানোর মতো যথেষ্ট মানুষ না পেয়ে মশা তার প্রবল ঘ্রাণশক্তি প্রয়োগ করে ছুটে আসছে এই জেলে বন্দি হাজারখানেক হতভাগ্য কয়েদি-হাজতির রক্তের সন্ধানে। জেলার সাহেবের যুক্তি অকাট্য। ছোট একটি জায়গায় একসঙ্গে এতগুলো লোভনীয় শিকার দ্বিতীয় কোনো স্থানে মিলবে না। তবে জেলে খাদ্যের যা অবস্থা, তাতে আমাদের রক্ত তো মশা বাবাজিদের বিস্বাদ লাগা উচিত ছিল। সাঈদী ভাইয়ের ধারণা, আমাদের শাসকশ্রেণীর মতোই এরা লাজ-লজ্জাহীন, অতি বজ্জাত প্রজাতির মশা। আমিও ওনার সঙ্গে একমত। নইলে এমন গোগ্রাসে রক্তশূন্যতায় ভোগা অসহায় আসামির রক্ত খায়!
যাই হোক, প্রাণে রক্ষা পাওয়ার জন্য জেল কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের খরচায় সেলে নেট লাগানোর প্রস্তাব করেছি। এখন পর্যন্ত অবশ্য ওপরের অনুমতি পাওয়া যায়নি। আজ ফেব্রুয়ারির বাইশ। আমার সাজার মেয়াদ শেষ হতে আর তেইশ দিন বাকি। ওইদিন মুক্তি পাব কিনা জানি না, তবে নয় মাসে জেলের যতটুকু নিয়ম-কানুন দেখেছি, তাতে ধারণা করছি মুক্তি না পেলেও ১৭ মার্চের পর আমাকে গাজীপুর জেলে আর রাখা হবে না। সে পর্যন্ত ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচতে হলে পড়াশোনা শিকেয় তুলে সারাদিন মশা নিধনে ব্যস্ত থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
No comments