মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনঃ সুশাসন নির্বাসনে
বছর দশেক আগে সুশাসন বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত শব্দে পরিণত হয়েছিল। হেন দিন ছিল না যেদিন দেশের কোনো না কোনো স্থানে good governance অর্থাত্ বাংলায় সুশাসন নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন না হতো। এ-জাতীয় ওয়ার্কশপ আয়োজনে বিদেশি অর্থসাহায্য পাওয়াও তখন সহজ ছিল। সুশাসন বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা কেন জানি না শেখ হাসিনার এবারের শাসনামলে লাপাত্তা হয়ে আছেন। সেসব ‘ডাকসাইটে’ সেমিনারজীবীর মধ্যে অনেকে অবশ্য ২০০৭ এবং ২০০৮ সালের দু’বছর জরুরি সরকারে যোগ দিয়ে জেনারেল মইনের হুকুম অকাতরে তামিল করেছেন। তাদের সম্ভবত ধারণা হয়েছিল, মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের আজব প্রকৃতির মিশ্র সরকারই কেবল পেছন থেকে সেনা সমর্থনের জোরে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তাদের বিবেচনায় হয়তো শেখ হাসিনার বাংলাদেশে ইতোমধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে! অতএব উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার পর তারা নীরবতাকেই শ্রেয় মনে করছেন।
যাকগে পুরনো সব কথা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দিনবদলের সরকারের আমলে ‘বাঙালি’ সুশাসনের চেহারাটা বরঞ্চ খানিক দেখার চেষ্টা করা যাক। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এই বিষয়ের পণ্ডিতরা good governance-এর বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। আমি পণ্ডিতদের বিতর্কে না জড়িয়ে জাতিসংঘের সংজ্ঞাটিকে গ্রহণ করে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করব। UN বলছে, good governance-এর নিম্নোক্ত আটটি উপাদান রয়েছে :
* Consensus Oriented (ঐকমত্য সম্পর্কিত)
* Participatory (অংশীদারিত্বভিত্তিক)
* Rule of Law (আইনের শাসন)
* Effective and efficient (ফলপ্রসূ ও দক্ষ)
* Accountable (দায়বদ্ধ)
* Transparent (স্বচ্ছ)
* Responsive (দায়িত্বপূর্ণ)
* Equitable and inclusive (নিরপেক্ষ এবং সর্বব্যাপী)
উপরিউক্ত সংজ্ঞার আলোকে সুশাসনকে সহজ ভাষায় বুঝতে গেলে বলা যেতে পারে, এটি আইনের শাসনভিত্তিক, দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত, দায়বদ্ধ এবং সর্বতোভাবে দলীয়করণমুক্ত একটি শাসনব্যবস্থা। বর্ণিত পাঁচটি উপাদানের মধ্যেই আমার আজকের লেখাটি সীমিত রাখার চেষ্টা করব।
বর্তমান বাংলাদেশে আইনের শাসনের দুরবস্থা বোঝার জন্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। এ মাসেরই ১১ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত কলামে তিনি লিখেছেন, “বিরাজমান পরিস্থিতি আমার কাছে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে হয়। কী মূল্যস্ফীতি, কী আইনশৃঙ্খলা, কী প্রশাসন, কী অর্থনীতি, কী পররাষ্ট্রনীতি, কী দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের পরিস্থিতি—সর্বত্রই একটা ক্রমাবনতিশীল চেহারা প্রতিদিন অবনতির দিকেই ধাবিত হচ্ছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ-আশঙ্কা ব্যক্ত না করে আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। দেশের এই অধঃগতিতে এমন একটা লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে আমাকে আশ্বাসের সুরে বলতে পারবে যে আমি যা দেখছি তা সব ভুল এবং আমার যে উদ্বেগ, এটার কোনো ভিত্তিই নেই।... আমাদের চিত্তের উন্মত্ততা, আমাদের কর্মের নিষ্ঠুরতা ও আমাদের বিচারবুদ্ধির দেউলিয়াপনা আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ইতিপূর্বে আমি আমার দেশে এই চরম মত্তাবস্থা কোনো দিন দেখিনি।”
বিচারপতি মোস্তফা কামাল তাঁর অবসর জীবনে পাদপ্রদীপ থেকে দূরে থাকতেই অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দেশের সার্বিক অবস্থা কতখানি রসাতলে গেলে বিবেকের তাড়নায় সেই নিভৃতচারী মানুষটি কলম ধরেছেন, তা সহজেই অনুমেয়। আইনের শাসনের তিন অত্যাবশ্যকীয় উপাদান, যথাক্রমে বিধিনিয়ম দ্বারা আবদ্ধ প্রশাসন, আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকের সমতা এবং নিরপেক্ষ বিচারিক পুনরীক্ষণ বাংলাদেশে নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বাস্তবতায় আজ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
সরকারের দক্ষতা প্রমাণের জন্যে মাত্র একবার বাসে চড়ে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করলেই চলবে। এই রাস্তার ধারেই মাওনার কাছাকাছি এক স্থানে আমার একটি রফতানিমুখী সিরামিক কারখানা ছিল। ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের জুনের ১ তারিখে গ্রেফতার হওয়ার আগপর্যন্ত সেই কারখানায় নিয়মিত যাতায়াত করেছি। গুলশানের বাসগৃহ থেকে মাওনা পৌঁছাতে কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া সচরাচর দেড় ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হয়নি। জেলে বন্দি থাকতেই বৈরী সরকারের নানা প্রকার অসহযোগিতার কারণে কারখানাটি বিক্রি করে দেয়ায় সৌভাগ্যবশত এখন আর আমাকে ওই পথে যেতে হয় না। আমার দেশ পত্রিকার স্থানীয় সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, মাওনা পর্যন্ত যাওয়ার দুঃসাহসী প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে রাস্তার বিশাল বিশাল সব গর্তে পড়ে গাড়ি না ভাঙলে একই পথ পার হতে বর্তমানে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। খানাখন্দকে পূর্ণ মহাসড়কটি (?) ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় বিগত এক সপ্তাহ ধরে বাস মালিকরা ওই রাস্তায় বাস চালাচ্ছেন না।
কাছের ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের অবস্থাও তথৈবচ। রাস্তা সংস্কারের দাবিতে মিনিবাস মালিক সমিতি ওই রুটেও তাদের বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যেও যে কোনো সময় একই কারণে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। পোশাকশিল্প অধ্যুষিত গাজীপুর, মাওনা, শ্রীপুরের রফতানিকারকরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। তাদের পক্ষে কাঁচামাল এবং তৈরি পোশাক পরিবহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে ভদ্রলোক আমার সিরামিক কারখানাটি কিনেছেন, তার জন্য আন্তরিক সহানুভূতি বোধ করছি।
ক’দিন পরেই বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যকার ৮৭ শতাংশ মুসলমান ধর্মাবলম্বীর সবচেয়ে আনন্দের উত্সব ঈদুল ফিতর আসছে। সে সময় বিপুল সংখ্যক জনগণ প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ কাটানোর জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া-আসা করবেন। দেশের রাস্তা-ঘাটের বর্তমান দুরবস্থায় তাদেরকে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে বলেই ধারণা করছি। নদী-নালায় পানি থাকলেও না হয় আওয়ামী লীগের প্রিয় বাহন নৌকা ব্যবহার করার চেষ্টা করা যেত। কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্রের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহারের বদান্যতায় সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত একটি পত্রিকায় মাস দুয়েক আগেই লাল হরফে চার কলামব্যাপী শিরোনাম দেখেছিলাম, ‘আধা ঘণ্টায় গাজীপুর থেকে সদরঘাট’। আগামী দিনের রূপকথার এক কল্পকাহিনী ফাঁদা হয়েছিল সেই শীর্ষ সংবাদে। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল মার্কা গল্পের মতো করে জনগণকে স্বপ্ন দেখিয়ে বলা হয়েছে, সরকার হাজার কোটি টাকার এমন এক প্রকল্প হাতে নিয়েছে যেটি বাস্তবায়ন হলে নাকি মাত্র তিরিশ মিনিটে গাজীপুর থেকে বাসে চেপে সদরঘাট পৌঁছানো যাবে। আরে বাবা, ভিক্ষা চাই না, দয়া করে কুকুর সামলান। বাংলাদেশকে আর সিঙ্গাপুর বানানোর দরকার নেই। দয়া করে মহাসড়কগুলো পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিন। ডিজিটাল থেকে আমাদের রক্ষা করুন, আমরা এনালগ দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। এ ধরনের সরকার তোষণকারী সংবাদপত্র বাংলাদেশের জনগণের অসহায়ত্ব নিয়ে তামাশা করে একপ্রকার বিকৃত আনন্দ বোধ করে থাকে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকারের সাফল্যও চমত্কৃত হওয়ার মতো। গত আড়াই বছরে দাম অন্তত দ্বিগুণ হয়নি এমন কোনো পণ্য বাজারে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। কিন্তু তাতে কী! আমাদের দক্ষ অর্থমন্ত্রী জনগণকে সপ্তাহে একদিন বাজারে না যাওয়ার প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। তিনি সম্ভবত সপ্তাহের সাত দিনই বাজারে গিয়ে কেনা-কাটায় অভ্যস্ত। অধিকতর দক্ষ এবং বাংলাদেশের অন্যতম বিত্তবান বাণিজ্যমন্ত্রী একধাপ এগিয়ে দরিদ্র মানুষদের আরও কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বহুদিন আগে দেখা সত্যজিত্ রায়ের রূপকধর্মী চলচ্চিত্র ‘হীরক রাজার দেশে’র কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীর মতো এত দক্ষ মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর চারদিকে থাকতে সরকারের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে সাধ্য কার?
প্রশাসনে দুর্নীতির ভয়াবহ ও লাজলজ্জাহীন বিস্তার নিয়ে কোনো কিছু লেখার কথা কল্পনায় আনলেও এখন এদেশে যে কোনো সাংবাদিকের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক বহুল আলোচিত দুর্নীতির অভিযোগের সংবাদ ছাপিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার এবং সার্বিকভাবে আমার পত্রিকার কী হাল হয়েছে, তার খবর দেশবাসী তো বটেই, 'The Economist'-এর কল্যাণে বিশ্ববাসী পর্যন্ত জেনে গেছে। শীর্ষ নিউজে সরকারের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার পর সম্পাদক একরামুল হককে কিঞ্চিত্ রিমান্ড থেরাপি প্রয়োগের মাধ্যমে সাপ্তাহিক ও অন-লাইন পত্রিকাটিকে সংবাদ প্রত্যাহার ও ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছে। আমার দেশ পত্রিকা যেহেতু সাহসের সঙ্গে স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চা করে চলেছে, তাই কারও হুমকির পরোয়া না করে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতির তথ্যভিত্তিক সংবাদ এত নির্যাতন সত্ত্বেও আগের মতোই প্রকাশ করছে। লন্ডনের ‘দি ইকোনমিস্ট’ বর্তমান সরকারের আমলের দুর্নীতির সর্বব্যাপী বিস্তারকে astonishing বা তাক লাগানো বলে অভিহিত করেছে। ইকোনমিস্ট লিখেছে : 'Corruption flourishes at levels astonishing even by South Asian standards.' (দুর্নীতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা দক্ষিণ এশিয়ার মাপকাঠিতেও তাক লাগানো।) আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের পক্ষে বোধহয় ইকোনমিস্টের এডিটর Daniel Franklin (দানিয়েল ফ্রাঙ্কলিন)-কে ধরে এনে ক্যান্টনমেন্ট থানা, ডিবি অথবা টিএফআই সেলে নিয়ে আমার এবং একরামুল হকের মতো দাওয়াই প্রয়োগ সম্ভব হবে না। তবে ক্রোধান্বিত কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী লন্ডনের ইকোনমিস্ট জঙ্গিবাদ, মাদক ও অস্ত্র বিক্রির অর্থায়নে পরিচালিত—এই তাক লাগানো অভিযোগ করে স্বভাবসুলভ হুঙ্কার সহকারে দাবি করেছেন, ‘টুডে আর টুমরো’ তারা ক্ষমা চাইবে। বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ইকোনমিস্টের সম্পাদক বিশ্বের সাত নম্বর ক্ষমতাধর নারী, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোড়হস্তে ক্ষমা চাইছেন, এমন দৃশ্য দেখতে পেলে এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অবশ্যই গর্বে আমার বুক ফুলে উঠবে।
দায়বদ্ধতার প্রশ্নে অবশ্য বর্তমান সরকারকে একশ’র মধ্যে একশ’ নম্বর না দিলে আমি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে পড়ব। ২০০৮ সালে যারা টাকার থলে দিয়ে নির্বাচনে সহযোগিতা করেছিল, গত আড়াই বছরে তাদের সব দায়-দেনা সুদসহ মিটিয়ে দিয়েছে সকৃতজ্ঞ মহাজোট সরকার। উদাহরণস্বরূপ ট্রানজিটের নামে দেশকে টুকরো টুকরো করে প্রতিবেশীকে করিডোর দেয়া হচ্ছে, ভৌগোলিকভাবে অতি ক্ষুদ্র বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার জমি কেটে নিয়ে এমনভাবে অকাতরে বৃহত্ ভারতকে দান করা হচ্ছে, যাতে মনে হতে পারে ষোল কোটি মানুষের এই দেশ কোনো বিশেষ ব্যক্তির পৈতৃক জমিদারি, সীমান্তে পরাক্রমশালী আঞ্চলিক পরাশক্তি যাতে বিনা প্রতিরোধে আমাদের অসহায়, দরিদ্র নাগরিকদের যথেচ্ছ হত্যা করতে পারে, সেই লক্ষ্য পূরণে ঐতিহ্যবাহী, শক্তিশালী বিডিআর ভেঙে দুর্বল বিজিবি গঠন করা হয়েছে, ভারতের পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশস্তি করে বলা হচ্ছে, ভারত মুখ ফুটে চাইবার আগেই বাংলাদেশ সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এতকিছুর পর সুশাসনের অন্যতম উপাদান দায়বদ্ধতা নিয়ে আমার অন্তত আর কোনো মন্তব্য নেই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের কাছে স্নেহের সুরে আমার পুলিশ বাহিনী বলে উল্লেখ করে থাকেন। সেই পুলিশ বিভাগ দিয়েই প্রশাসনে দলীয়করণের চিত্রটি দেখার চেষ্টা করা যাক।
রাজধানীর থানাগুলোতে ওসিসহ পুলিশ বিভাগের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে শুধু আওয়ামীপন্থী হলেই এখন চলছে না, তার সঙ্গে একটি বা দু’টি বিশেষ জেলার অধিবাসী হওয়াটাও অত্যাবশ্যক। তার ফলে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় পালিত অথচ সরকারদলীয় ক্যাডারের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের ধৃষ্টতা এতখানি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তারা বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে প্রকাশ্য দিবালোকে, কয়েক ডজন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কিল, ঘুষি, লাথি মেরে ও লাঠিপেটা করে অজ্ঞান করার পর সদম্ভে বলতে পারে, পুলিশের লাঠি চুমু খাওয়ার জন্য দেয়া হয়নি।
প্রশাসনের অন্যান্য বিভাগের অবস্থাও পুলিশের মতোই। এক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে জেনেছি, সরকারি ব্যাংকে একটা সামান্য চাকরি পেতেও নাকি আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের প্রত্যয়নপত্র প্রয়োজন হয়। এই সুযোগে প্রত্যয়নপত্রের বিনিময়ে ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শের সৈনিকদের আয়-রোজগারের অবশ্য একটা বন্দোবস্ত হয়েছে। ঘরে ঘরে চাকরির ব্যবস্থা করতে না পারলেও সরকার আওয়ামী পরিবারের জন্য চাঁদাবাজির নিত্য-নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে চলেছে। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব সরকারের আমলেই রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। তবে এতদিন পর্যন্ত মেজর, লেফটেন্যান্ট-কর্নেল ইত্যাদি পদে পদোন্নতি বিবেচনায় কর্মদক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা এবং সততাই মুখ্য ছিল। দলীয়করণ এতটা নিম্নপর্যায়ে এতদিন প্রবেশ করেনি। কিন্তু দিনবদলের সরকার এই তুলনামূলক নিম্নপদগুলোতেও রাজনীতি আমদানি করে আমাদের সেনাবাহিনীর সার্বিক পেশাদারিত্ব ও দক্ষতাকেই আজ প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। কোনো কর্মকর্তার দূর সম্পর্কের কোনো তুতো-ভাই বিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তার চাকরির বারোটা বেজে যেতে পারে।
সর্বশেষ আলোচনা বিচার বিভাগের দলীয়করণ নিয়ে। বিচার বিভাগে দলীয়করণের মাত্রা দেশে এমন এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, এ বিষয়েই একটি পূর্ণাঙ্গ মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখা আবশ্যক। সে কাজটি আগামী বুধবারের জন্যে তুলে রাখলাম। তবে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আজ শুধু ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি। দেশের এই সর্বজন শ্রদ্ধেয় আইনজীবী, যার একাধিক ছাত্র প্রধান বিচারপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন, তিনি আগস্টের ১০ তারিখে ‘সাপ্তাহিক বুধবার’ পত্রিকায় এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ‘আদালতে গেলে শোনা যায় আওয়ামী লীগ বেঞ্চ, বিএনপি বেঞ্চ, জামায়াত বেঞ্চ, এগুলো কি শুনতে ভালো লাগে? এভাবেই আমাদের বিচার বিভাগ চলছে।’
২০০৮ সালের নির্বাচনপূর্ব ঢাকঢোল পেটানো আওয়ামী লীগের জমকালো ইশতেহারে সুশাসন সম্পর্কে নিম্নোক্ত প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল :
“আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে মানবাধিকার সংরক্ষণ করা হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করা হবে। নিয়োগ ও পদোন্নতির ভিত্তি হবে মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, সততা ও দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে প্রশাসনকে ব্যবহার বন্ধ নিশ্চিত করা হবে।” দশ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর মতো সুশাসন প্রতিষ্ঠার গালভরা প্রতিশ্রুতিও সরকারের অর্ধেক মেয়াদের মধ্যেই শূন্যে মিলিয়ে গেছে।
জনগণকে প্রতারণাপূর্বক প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসিয়ে ক্ষমতালাভ করে বর্তমান সরকার সুশাসনকে পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমেই ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। মানুষের জীবনযাপনের জন্য ন্যূনতম চাহিদা পূরণ তো দূরের কথা, কারও জীবনেরই যেন এদেশে কোনো মূল্য নেই। বছরের পর বছর ধরে কমিশন সংগ্রহ ও লুটপাটে ব্যস্ত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অবহেলায় সংস্কারবিহীন সড়কে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এখন নিত্যদিনের ঘটনা। আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতিদৃষ্টে মনে হয় না দেশে আদৌ কোনো সরকার আছে। খোদ রাজধানীতে সন্ধ্যারাতে শত শত মানুষের চোখের সামনে বন্দুকযুদ্ধের নামে নিরাপত্তা বাহিনী অবলীলাক্রমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। অপরদিকে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ নাগরিকের সন্ধ্যা নামলে রিকশা-সিএনজিতে চলাচল করাই বিপজ্জনক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশের সহযোগিতায় যে হারে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা চলছে, তাতে করে বহির্বিশ্বে আমাদের একটি বিকারগ্রস্ত জাতি হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে। এভাবে একটি সভ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা বিকশিত হতে পারে না।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মানবতাবাদী লেখক, বুদ্ধিজীবী টমাস পেইন (Thomas Paine) তার 'Rights of Man' গ্রন্থে বলেছেন, একজন নাগরিক তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা (liberty) রাষ্ট্রপ্রদত্ত নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে সরকারের কাছে গচ্ছিত রাখে। পেইন আরও বলছেন, সরকার যদি জনগণের গচ্ছিত সেই বিশ্বাসের (trust) সঙ্গে তঞ্চকতা করে, তাহলে সেই সরকার পরিবর্তনের সার্বভৌম ক্ষমতা (sovereign power) জনগণ অবশ্যই প্রয়োগ করতে পারে। টমাস পেইনের সঙ্গে সহমত পোষণকারী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে বিষয়টি জনগণ ও সরকারের মধ্যকার এক ধরনের সামাজিক চুক্তি (social contract)। একই শতকের ব্রিটিশ উদারনীতিক দার্শনিক জন লক (John Locke) আরও একটু এগিয়ে 'Two Treaties of Government' গ্রন্থে জনগণ কর্তৃক সরকারকে প্রদত্ত ক্ষমতাকে শর্তাধীন (conditional) এবং অস্থায়ী (temporary) রূপে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন :
''...have set limits to the duration of their legislative, and made this supreme power in any person or assembly only temporary, if it is forfeited; upon the forfeiture of their rules, or at the determination of the time set, it reverts to the society, and the people have the right to act as supreme, and continue the legislative in themselves or place it in a new form, or new hands, as they think good.'' (...আইনপ্রণেতাদের মেয়াদকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, এবং কোনো ব্যক্তি অথবা আইনসভাকে প্রদত্ত এই ক্ষমতা অস্থায়ীমাত্র; প্রদত্ত ক্ষমতা প্রত্যাহৃত হলে; বিধি-বিধান প্রত্যাহার অথবা মেয়াদপূর্ণ হলে, সেই ক্ষমতা সমাজের কাছেই ফিরে আসে, এবং সে পরিস্থিতিতে জনগণের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে তাদের সুবিবেচনা প্রয়োগ করে আইনসভার দায়িত্ব নিজেরা গ্রহণ করা অথবা নতুন পদ্ধতি নির্মাণ করা অথবা নতুন হাতে ক্ষমতা অর্পণ করার।)
বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যেখানে ন্যূনতম আইনের শাসনের কোথাও কোনো অস্তিত্ব নেই, সেক্ষেত্রে সুশাসন খুঁজে বেড়ানো অর্থহীন। অতএব, টমাস পেইন এবং জন লকের তত্ত্ব অনুযায়ী সার্বভৌম জনগণ ক্ষমতাসীনদের একতরফা চুক্তি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করে বিকল্প শাসন ব্যবস্থার দায়িত্ব নিজেরা গ্রহণ করবে কিনা, সেটাই জিজ্ঞাসা।
No comments