৩৯- ফ্যাসিবাদের পক্ষের সংবাদকর্মীরও অভাব নেই ফলে শাসকশ্রেণী নিপীড়ন করে সহজেই পার পায়
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তামাশায় পরিণত
...দুর্বিনীত শাসকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এদেশে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমকে ভয়াবহ হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। চিন্তা, বিবেক, মতপ্রকাশ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা আমাদের সংবিধানে দেয়া হয়েছে, তাকে তামাশায় পরিণত করেছে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সমর্থনপুষ্ট বর্তমান বলদর্পী শাসকরা...
...দুর্বিনীত শাসকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এদেশে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমকে ভয়াবহ হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। চিন্তা, বিবেক, মতপ্রকাশ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা আমাদের সংবিধানে দেয়া হয়েছে, তাকে তামাশায় পরিণত করেছে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সমর্থনপুষ্ট বর্তমান বলদর্পী শাসকরা...
আদালত অবমাননা মামলায় আমার ছয়মাস দণ্ড ভোগের মাত্র এক মাস পার হয়েছে। এরপর রয়েছে জরিমানা অনাদায়ে অতিরিক্ত এক মাস। দুটো মিলে আগামী বছর মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত জীবিত থাকলে জেলের অন্ন আমার জন্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। ঢাকা জেলে সুপার এবং জেলার ছাড়া সব কারারক্ষী, কর্মকর্তা আমার সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করছেন। আপিল বিভাগ আমাকে সাজা দেয়ার পর থেকে আমার প্রতি এসব কর্মকর্তার সহমর্মিতার মাত্রা দৃশ্যত: বেড়েছে। একজন কর্মকর্তা তো বললেনই যে, তার বাবা নাকি নামাজঅন্তে নিয়মিতভাবে আমার জন্য দোয়া করেন। সাধারণ মানুষের এই ভালোবাসার স্পর্শে মনের সব গ্লানি নিমেষে দূর হয়ে যায়। সুপার, জেলার আমার সঙ্গে কদাচিত্ দেখা-সাক্ষাত্ হলে যে কোনো রকম উপেক্ষা প্রদর্শন করেন তাও নয়, তবে কারা জীবনযাপন কষ্টকর করে তুলতে তাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই।
একটা ছোট উদাহরণ দেই। দীর্ঘদিন ধরে আমার মেরুদণ্ডের হাড়ে অস্টিওপরোসিসজনিত সমস্যা রয়েছে। মুক্ত জীবনে দু-তিনমাস পর পর ট্র্যাকশন নিতে হতো। বিনা চিকিত্সায় জেল জীবনের প্রায় চারমাস চলছে। এদিকে ভোরবেলায় নিয়মিতভাবে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করায় কোমরের ব্যথাটাও খানিক বেড়েছে। এই অবস্থায় অন্তত: হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি ভরে সেঁক নিতে পারলে উপকার হতো। পানি গরম করার জন্য পারভীন একটা ইলেকট্রিক কেতলি চার-পাঁচদিন আগে পাঠালেও সেটা এখনো পর্যন্ত জেল অফিসেই পড়ে আছে। জেলার প্রথমে বললেন, জেল ডাক্তার সুপারিশ করলে আমি কেতলিটি ব্যবহারের সুযোগ পাব। ডাক্তারের কাছ থেকে যথাযথ সুপারিশ আনার পর এখন বলা হচ্ছে, উপরের নির্দেশ ছাড়া এই ‘সাংঘাতিক’ যন্ত্র আমাকে দেয়া যাচ্ছে না। আমাদের সাত নম্বর সেলেই এ ধরনের কেতলি একাধিক ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সমস্ত জেলের হিসাব নিলে কেতলির সংখ্যা কয়েক শ’ তো হবেই। জায়গামত খরচাপাতির বিনিময়ে সাধারণ বন্দিদের মধ্যকার প্রভাবশালী অংশ হরহামেশা এসব বস্তু ব্যবহার করছে। আমার ক্ষেত্রে দ্বিবিধ সমস্যা। এখানকার কর্মকর্তাদের পক্ষে আমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেয়া সম্ভব নয় এবং আমিও কোনোরকম লেনদেনে অভ্যস্ত নই।
আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো, আমার বিষয়ে গোয়েন্দাদের বিশেষ নজরদারির কারণে কর্মকর্তারাও আমার ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আসলেই দ্বিধার মধ্যে থাকেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পোস্টিং লাভ করতে বেচারাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মাহমুদুর রহমানকে কোনোরকম সহায়তা করে রাতারাতি দূরের বান্দরবান কিংবা দিনাজপুর জেলে বদলি হওয়ার ঝুঁকি তারা কেউ নিতে চাইবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
সপ্তাহখানেক ধরে অনেক হাইকোর্ট দেখানোর পর কি মনে করে সুপার শেষ পর্যন্ত আমার কেতলিটা পাঠিয়েছেন। প্রায় চার মাস পর ঈষদুষ্ণ পানিতে ভোরবেলা গোসলের বিলাসিতা অনেকক্ষণ ধরে উপভোগ করলাম। বন্দি জীবন মানুষের মনকে কত ছোট করে দেয়! এই সামান্য গরম পানিতে গোসলের সুবিধা, এতেই কৃতার্থ হয়ে গেছি। খবরটা পেলে আমার মা এবং স্ত্রীও খানিকটা স্বস্তি বোধ করবেন। এদিকে জেল পলাতক বন্দির বিষয়টি সপ্তাহখানেক ঝুলিয়ে রাখার পর কর্তৃপক্ষ ভালোভাবেই ধামাচাপা দিতে পেরেছে। এখন বলা হচ্ছে, জেল অফিসের গুনতির হিসেবেই গড়বড় ছিল। আদতে কোনো আসামি নাকি পলাতকই হয়নি! সব কুছ্ ঠিক হ্যায়।
গতকাল একদলীয় সংসদে অপ্রত্যাশিত উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা মিলে সাংবাদিক ও সুশীল (?) সমাজের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছেড়েছে। প্রথম আলো, যুগান্তর এবং সমকালের মালিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের দেখে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সংসদে প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমানকে এক এগারোর সরকারের দালাল বলে গাল দেয়ার বিষয়টিকেই আমার কাছে সবচেয়ে কৌতুককর মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের কণ্ঠে মইন-ফখরুদ্দীন জোটের দালালির অভিযোগ শুনলে সেই পুরাতন প্রবাদবাক্যটির কথা স্মরণে এসে যায়। চালুনি বলে সুচকে তোর পাছায় কেন ফুটো? আওয়ামী লীগ এবং সুশীলদের মধ্যে কে জরুরি সরকারের বড় দালাল ছিল, এ জাতীয় একটি প্রতিযোগিতা হলে আমজনতা এত নিরানন্দের মধ্যে উপভোগ করার মতো একটা চমত্কার বিষয় পেত। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা দুই সতীনের ঝগড়ার মতো হয়ে যাচ্ছে না? কাল সংসদে এক উত্তেজিত আওয়ামী নেতা তো প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমানকে ২১ আগস্টের বোমা হামলার চক্রান্তকারী নামে অভিহিত করে তার বিচার পর্যন্ত দাবি করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের এই বিশিষ্ট সম্পাদকের বাইরের খুঁটি কতটা শক্ত তার একটা পরীক্ষা এবার বোধহয় হয়ে যাবে। আমার মতো খুঁটিহীন হলে এতক্ষণে তাকে যে পাশের সেলে দেখতে পেতাম, এতে বকুল নামের সেলের বাসিন্দাদের মনে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। আমার দেশ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের ন্যক্কারজনক আচরণের পর অন্যান্য সংবাদপত্রের বিরুদ্ধেও এই বিষোদগারে আমি একেবারেই অবাক হইনি। যুগে যুগে ফ্যাসিবাদের নখর এভাবেই মুক্ত চিন্তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। বিভাজনের এই দেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার মতো সংবাদকর্মীদেরও অভাব নেই। ফলে শাসকশ্রেণী খুব সহজেই নিপীড়ন করে পার পেয়ে যায়।
গ্রেফতারপূর্ব ছয়মাস এবং গ্রেফতারপরবর্তী চার মাস, এই দশ মাসে আমার প্রতি যে অপরিসীম নির্যাতন চালানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সেক্যুলারপন্থী সাংবাদিকগোষ্ঠীকে কোনোরকম প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। সম্পাদকরাও আমার দেশ অফিস ও প্রেসে হাজার পুলিশ পাঠিয়ে তালা মারার পর একটি মাত্র যৌথ বিবৃতি দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। বরং অনেক সরকারপন্থী পত্রিকায় আমাকে শাপ-শাপান্ত করে নির্যাতনের সপক্ষে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা লাইন ধরে কলাম লিখেছেন। আমার বন্দিত্বের কারণে আমি যখন জবাব দিতে অক্ষম, সেই সময় আমাকে গালাগাল করতে এ সকল বুদ্ধিজীবীর রুচিতে বাধেনি। অথচ আমার প্রায় ৪ বছরের লেখালেখির জীবনে এদের মধ্যে কাউকে কোনো লেখার প্রতিবাদে কিছু লিখতে দেখিনি। গতকাল সংসদে আক্রান্ত প্রথম আলো পত্রিকাতেই আমাকে ‘সমাজের স্থায়ী উত্পাত’ নামেও ডাকা হয়েছে। আজ সেই পত্রিকার সম্পাদকই সংসদে তাদের পছন্দের দল কর্তৃক খুনের চক্রান্তকারী নামে অভিহিত হয়েছেন। এরই নাম বোধহয় ইতিহাসের বিচার!
ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে দেশের সার্বিক অবস্থাটা দেখার চেষ্টা করি। বাস্তবতা হলো, দুর্বিনীত শাসকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এদেশে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমকে ভয়াবহ হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। চিন্তা, বিবেক, মত প্রকাশ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা আমাদের সংবিধানে দেয়া হয়েছে, তাকে তামাশায় পরিণত করেছে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সমর্থনপুষ্ট বর্তমান বলদর্পী শাসকরা। সংসদ সদস্যরা এখন দল বেঁধে আস্ফাালন করছেন, ‘বেয়াদব’ সাংবাদিকদের সংসদে ধরে নিয়ে মাফ চাইতে বাধ্য করা হবে। আপিল বিভাগের কাছে মাফ চাইতে অস্বীকার করায় আমার স্থান হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাত নম্বর সেলে। ১৯৯১ সাল থেকে এদেশে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন রাজাধিরাজ। বাংলাদেশের সংবিধানে যাই লেখা থাকুক, বাস্তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টুকু ছাড়া মহামান্য রাষ্ট্রপতি দেশের দুই নম্বর রাজা। সেই রাজার তালিকায় এখন যুক্ত হয়েছেন পর্বতপ্রমাণ আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মাননীয় বিচারকরা। সুতরাং, বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, সংসদ সদস্য, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সবাই রাজা। এত রাজার রাজত্বে অসহায় প্রজাসাধারণ এখন যায় কোথায়? ২০০৮-এর অনেক ঢাকঢোল পেটানো ডিজিটাল নির্বাচনের রঙ্গে মাতোয়ারা ভোটারদের মোহভঙ্গ বেশ দ্রুতই ঘটে গেল। বর্তমান সরকারের মাত্র পৌনে দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যেই আমজনতার নাভিশ্বাস উঠে গেছে। বাকি সোয়া তিন বছরের অত্যাচার, নির্যাতন সইবার মতো ক্ষমতা এ দেশের নাগরিকের থাকে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
প্রতি সকালের মতো গোসল সাঙ্গ করে এক মগ গরম হরলিক্স বানিয়ে সেলের আঙিনায় বসে আছি, এমন সময় এজমালি সেবক আকাশ শুকনো মুখে সালাম দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। চোখ তুলে চাইতেই জানাল, এই মাত্র জেলগেট থেকে শুনে এসেছে আমার নামে রাজশাহীতে নতুন মানহানির মামলা দায়ের হয়েছে। কে বাদী, কি বৃত্তান্ত কিছুই মাথায় ঢুকল না, শুধু এটুকু বুঝলাম মামলা নম্বর ঊনপঞ্চাশ দায়ের হলো। আর একটা হলেই অর্ধশতকে পৌঁছানো উপলক্ষে সাত নম্বর সেলে একটা ভোজের আয়োজন করতে পারি। শুক্রবার সারাটা দিন মন ভার করেই কাটালাম। রাজশাহীর মামলার কারণে নয়, মনে মেঘ জমেছে আজ সাপ্তাহিক দেখায় আমার কাছে কেউ না আসাতে। এই দিনটাতে দেখা করতে আসা আইনজীবী অথবা আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে গৃহের কুশল সংবাদটা অন্তত পাই। এটুকুই তো আমার পিছুটান। সংসারের সবাই আমাকে ছেড়ে বাঁচাটা অভ্যাস করে নিতে পারলে আমিও নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে জেল জীবন কাটাতে পারতাম। বন্দিত্বের সঙ্গে এই চারমাসে ভালোই মানিয়ে নিয়েছি। বর্তমান সরকারের পুরো মেয়াদটাও যদি এই নাজিমউদ্দিন রোডে কাটাতে হয় তাতেও অসুবিধে নেই।
সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখে ঢাকা সিএমএম আদালতে হাজিরার দিন নির্ধারিত আছে। তার আগে বাড়ির খবর পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সুতরাং আগামী চারদিন উদ্বিগ্ন চিত্তে অপেক্ষাই বিধিলিপি। সন্ধ্যায় এক কারা কর্মকর্তার মাধ্যমে রাজশাহীর মামলার বিবরণ জানলাম। আমি কারাগারে আসার পর আমাদের রাজশাহী ব্যুরো চিফ সরদার আনিস রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা নিয়ে একটা রিপোর্ট করেছে। সেই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় সিটি মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন রাগান্বিত হয়ে আনিস এবং আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। জেলে বন্দি থাকলেও যে নতুন নতুন মামলা এদেশে হতে পারে, তারই উদাহরণ আমার বিরুদ্ধে ঊনপঞ্চাশ নম্বর মামলা। মামলার বৃত্তান্ত শুনে আনন্দিতই হলাম। মামলার আগামী তারিখে রাজশাহী যাওয়ার সুযোগ পাব। বন্দি জীবনে এক জেলে পড়ে না থেকে জেলে জেলে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা আমার কাছে ভালোই লাগছে। এ পর্যন্ত অবশ্য ঢাকা জেলের বাইরে কেবল গোপালগঞ্জ জেল দেখার ‘সৌভাগ্য’ হয়েছে। আগামীতে অন্তত কক্সবাজার, ফরিদপুর এবং রাজশাহী দেখা নিশ্চিত। এছাড়া কারাবাসের মেয়াদকালে অন্য জেলে চালানের সম্ভাবনাও রয়েছে। এদিকে অক্টোবরের ১১ তারিখ দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওইদিন আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলার শুনানি হবে আবারও সেই আপিল বিভাগে। আজ আমার আইনজীবীর সেই মামলার ‘শো-কজের’ জবাবের খসড়া তৈরি করে নিয়ে আসার কথা ছিল। সাপ্তাহিক দেখায় কেউ না আসায় সেই খসড়া প্রস্তুত হয়েছে কিনা, সেটা বুঝতে পারছি না। গেল বারের মতোই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই হয়তো আবারও লর্ডশিপদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের প্রশ্নবাণ এবং কটুবাক্যে জর্জরিত হতে হবে। বিশ্বের যে কোনো দেশেই এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই যথেষ্ট ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়েই করতে হয়। আমাদের দেশে তফাত্টা হচ্ছে, এখানে ব্যক্তিগত ঝুঁকির পাশাপাশি পরিবারও ঝুঁকির মধ্যেই থাকে। প্রতিবেশী ফয়সাল এই বিষয়টাই প্রায় প্রতিদিন আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ওর সমালোচনার জায়গাটা হলো, সাহস এবং দুঃসাহসের মধ্যকার ভেদরেখাটা আমি নাকি ধরতে পারিনি।
একটা ছোট উদাহরণ দেই। দীর্ঘদিন ধরে আমার মেরুদণ্ডের হাড়ে অস্টিওপরোসিসজনিত সমস্যা রয়েছে। মুক্ত জীবনে দু-তিনমাস পর পর ট্র্যাকশন নিতে হতো। বিনা চিকিত্সায় জেল জীবনের প্রায় চারমাস চলছে। এদিকে ভোরবেলায় নিয়মিতভাবে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করায় কোমরের ব্যথাটাও খানিক বেড়েছে। এই অবস্থায় অন্তত: হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি ভরে সেঁক নিতে পারলে উপকার হতো। পানি গরম করার জন্য পারভীন একটা ইলেকট্রিক কেতলি চার-পাঁচদিন আগে পাঠালেও সেটা এখনো পর্যন্ত জেল অফিসেই পড়ে আছে। জেলার প্রথমে বললেন, জেল ডাক্তার সুপারিশ করলে আমি কেতলিটি ব্যবহারের সুযোগ পাব। ডাক্তারের কাছ থেকে যথাযথ সুপারিশ আনার পর এখন বলা হচ্ছে, উপরের নির্দেশ ছাড়া এই ‘সাংঘাতিক’ যন্ত্র আমাকে দেয়া যাচ্ছে না। আমাদের সাত নম্বর সেলেই এ ধরনের কেতলি একাধিক ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সমস্ত জেলের হিসাব নিলে কেতলির সংখ্যা কয়েক শ’ তো হবেই। জায়গামত খরচাপাতির বিনিময়ে সাধারণ বন্দিদের মধ্যকার প্রভাবশালী অংশ হরহামেশা এসব বস্তু ব্যবহার করছে। আমার ক্ষেত্রে দ্বিবিধ সমস্যা। এখানকার কর্মকর্তাদের পক্ষে আমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেয়া সম্ভব নয় এবং আমিও কোনোরকম লেনদেনে অভ্যস্ত নই।
আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো, আমার বিষয়ে গোয়েন্দাদের বিশেষ নজরদারির কারণে কর্মকর্তারাও আমার ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আসলেই দ্বিধার মধ্যে থাকেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পোস্টিং লাভ করতে বেচারাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মাহমুদুর রহমানকে কোনোরকম সহায়তা করে রাতারাতি দূরের বান্দরবান কিংবা দিনাজপুর জেলে বদলি হওয়ার ঝুঁকি তারা কেউ নিতে চাইবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
সপ্তাহখানেক ধরে অনেক হাইকোর্ট দেখানোর পর কি মনে করে সুপার শেষ পর্যন্ত আমার কেতলিটা পাঠিয়েছেন। প্রায় চার মাস পর ঈষদুষ্ণ পানিতে ভোরবেলা গোসলের বিলাসিতা অনেকক্ষণ ধরে উপভোগ করলাম। বন্দি জীবন মানুষের মনকে কত ছোট করে দেয়! এই সামান্য গরম পানিতে গোসলের সুবিধা, এতেই কৃতার্থ হয়ে গেছি। খবরটা পেলে আমার মা এবং স্ত্রীও খানিকটা স্বস্তি বোধ করবেন। এদিকে জেল পলাতক বন্দির বিষয়টি সপ্তাহখানেক ঝুলিয়ে রাখার পর কর্তৃপক্ষ ভালোভাবেই ধামাচাপা দিতে পেরেছে। এখন বলা হচ্ছে, জেল অফিসের গুনতির হিসেবেই গড়বড় ছিল। আদতে কোনো আসামি নাকি পলাতকই হয়নি! সব কুছ্ ঠিক হ্যায়।
গতকাল একদলীয় সংসদে অপ্রত্যাশিত উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা মিলে সাংবাদিক ও সুশীল (?) সমাজের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছেড়েছে। প্রথম আলো, যুগান্তর এবং সমকালের মালিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের দেখে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সংসদে প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমানকে এক এগারোর সরকারের দালাল বলে গাল দেয়ার বিষয়টিকেই আমার কাছে সবচেয়ে কৌতুককর মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের কণ্ঠে মইন-ফখরুদ্দীন জোটের দালালির অভিযোগ শুনলে সেই পুরাতন প্রবাদবাক্যটির কথা স্মরণে এসে যায়। চালুনি বলে সুচকে তোর পাছায় কেন ফুটো? আওয়ামী লীগ এবং সুশীলদের মধ্যে কে জরুরি সরকারের বড় দালাল ছিল, এ জাতীয় একটি প্রতিযোগিতা হলে আমজনতা এত নিরানন্দের মধ্যে উপভোগ করার মতো একটা চমত্কার বিষয় পেত। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা দুই সতীনের ঝগড়ার মতো হয়ে যাচ্ছে না? কাল সংসদে এক উত্তেজিত আওয়ামী নেতা তো প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমানকে ২১ আগস্টের বোমা হামলার চক্রান্তকারী নামে অভিহিত করে তার বিচার পর্যন্ত দাবি করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের এই বিশিষ্ট সম্পাদকের বাইরের খুঁটি কতটা শক্ত তার একটা পরীক্ষা এবার বোধহয় হয়ে যাবে। আমার মতো খুঁটিহীন হলে এতক্ষণে তাকে যে পাশের সেলে দেখতে পেতাম, এতে বকুল নামের সেলের বাসিন্দাদের মনে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। আমার দেশ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের ন্যক্কারজনক আচরণের পর অন্যান্য সংবাদপত্রের বিরুদ্ধেও এই বিষোদগারে আমি একেবারেই অবাক হইনি। যুগে যুগে ফ্যাসিবাদের নখর এভাবেই মুক্ত চিন্তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। বিভাজনের এই দেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার মতো সংবাদকর্মীদেরও অভাব নেই। ফলে শাসকশ্রেণী খুব সহজেই নিপীড়ন করে পার পেয়ে যায়।
গ্রেফতারপূর্ব ছয়মাস এবং গ্রেফতারপরবর্তী চার মাস, এই দশ মাসে আমার প্রতি যে অপরিসীম নির্যাতন চালানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সেক্যুলারপন্থী সাংবাদিকগোষ্ঠীকে কোনোরকম প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। সম্পাদকরাও আমার দেশ অফিস ও প্রেসে হাজার পুলিশ পাঠিয়ে তালা মারার পর একটি মাত্র যৌথ বিবৃতি দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। বরং অনেক সরকারপন্থী পত্রিকায় আমাকে শাপ-শাপান্ত করে নির্যাতনের সপক্ষে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা লাইন ধরে কলাম লিখেছেন। আমার বন্দিত্বের কারণে আমি যখন জবাব দিতে অক্ষম, সেই সময় আমাকে গালাগাল করতে এ সকল বুদ্ধিজীবীর রুচিতে বাধেনি। অথচ আমার প্রায় ৪ বছরের লেখালেখির জীবনে এদের মধ্যে কাউকে কোনো লেখার প্রতিবাদে কিছু লিখতে দেখিনি। গতকাল সংসদে আক্রান্ত প্রথম আলো পত্রিকাতেই আমাকে ‘সমাজের স্থায়ী উত্পাত’ নামেও ডাকা হয়েছে। আজ সেই পত্রিকার সম্পাদকই সংসদে তাদের পছন্দের দল কর্তৃক খুনের চক্রান্তকারী নামে অভিহিত হয়েছেন। এরই নাম বোধহয় ইতিহাসের বিচার!
ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে দেশের সার্বিক অবস্থাটা দেখার চেষ্টা করি। বাস্তবতা হলো, দুর্বিনীত শাসকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এদেশে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমকে ভয়াবহ হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। চিন্তা, বিবেক, মত প্রকাশ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা আমাদের সংবিধানে দেয়া হয়েছে, তাকে তামাশায় পরিণত করেছে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সমর্থনপুষ্ট বর্তমান বলদর্পী শাসকরা। সংসদ সদস্যরা এখন দল বেঁধে আস্ফাালন করছেন, ‘বেয়াদব’ সাংবাদিকদের সংসদে ধরে নিয়ে মাফ চাইতে বাধ্য করা হবে। আপিল বিভাগের কাছে মাফ চাইতে অস্বীকার করায় আমার স্থান হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাত নম্বর সেলে। ১৯৯১ সাল থেকে এদেশে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন রাজাধিরাজ। বাংলাদেশের সংবিধানে যাই লেখা থাকুক, বাস্তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টুকু ছাড়া মহামান্য রাষ্ট্রপতি দেশের দুই নম্বর রাজা। সেই রাজার তালিকায় এখন যুক্ত হয়েছেন পর্বতপ্রমাণ আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মাননীয় বিচারকরা। সুতরাং, বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, সংসদ সদস্য, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সবাই রাজা। এত রাজার রাজত্বে অসহায় প্রজাসাধারণ এখন যায় কোথায়? ২০০৮-এর অনেক ঢাকঢোল পেটানো ডিজিটাল নির্বাচনের রঙ্গে মাতোয়ারা ভোটারদের মোহভঙ্গ বেশ দ্রুতই ঘটে গেল। বর্তমান সরকারের মাত্র পৌনে দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যেই আমজনতার নাভিশ্বাস উঠে গেছে। বাকি সোয়া তিন বছরের অত্যাচার, নির্যাতন সইবার মতো ক্ষমতা এ দেশের নাগরিকের থাকে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
প্রতি সকালের মতো গোসল সাঙ্গ করে এক মগ গরম হরলিক্স বানিয়ে সেলের আঙিনায় বসে আছি, এমন সময় এজমালি সেবক আকাশ শুকনো মুখে সালাম দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। চোখ তুলে চাইতেই জানাল, এই মাত্র জেলগেট থেকে শুনে এসেছে আমার নামে রাজশাহীতে নতুন মানহানির মামলা দায়ের হয়েছে। কে বাদী, কি বৃত্তান্ত কিছুই মাথায় ঢুকল না, শুধু এটুকু বুঝলাম মামলা নম্বর ঊনপঞ্চাশ দায়ের হলো। আর একটা হলেই অর্ধশতকে পৌঁছানো উপলক্ষে সাত নম্বর সেলে একটা ভোজের আয়োজন করতে পারি। শুক্রবার সারাটা দিন মন ভার করেই কাটালাম। রাজশাহীর মামলার কারণে নয়, মনে মেঘ জমেছে আজ সাপ্তাহিক দেখায় আমার কাছে কেউ না আসাতে। এই দিনটাতে দেখা করতে আসা আইনজীবী অথবা আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে গৃহের কুশল সংবাদটা অন্তত পাই। এটুকুই তো আমার পিছুটান। সংসারের সবাই আমাকে ছেড়ে বাঁচাটা অভ্যাস করে নিতে পারলে আমিও নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে জেল জীবন কাটাতে পারতাম। বন্দিত্বের সঙ্গে এই চারমাসে ভালোই মানিয়ে নিয়েছি। বর্তমান সরকারের পুরো মেয়াদটাও যদি এই নাজিমউদ্দিন রোডে কাটাতে হয় তাতেও অসুবিধে নেই।
সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখে ঢাকা সিএমএম আদালতে হাজিরার দিন নির্ধারিত আছে। তার আগে বাড়ির খবর পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সুতরাং আগামী চারদিন উদ্বিগ্ন চিত্তে অপেক্ষাই বিধিলিপি। সন্ধ্যায় এক কারা কর্মকর্তার মাধ্যমে রাজশাহীর মামলার বিবরণ জানলাম। আমি কারাগারে আসার পর আমাদের রাজশাহী ব্যুরো চিফ সরদার আনিস রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা নিয়ে একটা রিপোর্ট করেছে। সেই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় সিটি মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন রাগান্বিত হয়ে আনিস এবং আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। জেলে বন্দি থাকলেও যে নতুন নতুন মামলা এদেশে হতে পারে, তারই উদাহরণ আমার বিরুদ্ধে ঊনপঞ্চাশ নম্বর মামলা। মামলার বৃত্তান্ত শুনে আনন্দিতই হলাম। মামলার আগামী তারিখে রাজশাহী যাওয়ার সুযোগ পাব। বন্দি জীবনে এক জেলে পড়ে না থেকে জেলে জেলে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা আমার কাছে ভালোই লাগছে। এ পর্যন্ত অবশ্য ঢাকা জেলের বাইরে কেবল গোপালগঞ্জ জেল দেখার ‘সৌভাগ্য’ হয়েছে। আগামীতে অন্তত কক্সবাজার, ফরিদপুর এবং রাজশাহী দেখা নিশ্চিত। এছাড়া কারাবাসের মেয়াদকালে অন্য জেলে চালানের সম্ভাবনাও রয়েছে। এদিকে অক্টোবরের ১১ তারিখ দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওইদিন আদালত অবমাননার দ্বিতীয় মামলার শুনানি হবে আবারও সেই আপিল বিভাগে। আজ আমার আইনজীবীর সেই মামলার ‘শো-কজের’ জবাবের খসড়া তৈরি করে নিয়ে আসার কথা ছিল। সাপ্তাহিক দেখায় কেউ না আসায় সেই খসড়া প্রস্তুত হয়েছে কিনা, সেটা বুঝতে পারছি না। গেল বারের মতোই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই হয়তো আবারও লর্ডশিপদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের প্রশ্নবাণ এবং কটুবাক্যে জর্জরিত হতে হবে। বিশ্বের যে কোনো দেশেই এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই যথেষ্ট ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়েই করতে হয়। আমাদের দেশে তফাত্টা হচ্ছে, এখানে ব্যক্তিগত ঝুঁকির পাশাপাশি পরিবারও ঝুঁকির মধ্যেই থাকে। প্রতিবেশী ফয়সাল এই বিষয়টাই প্রায় প্রতিদিন আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ওর সমালোচনার জায়গাটা হলো, সাহস এবং দুঃসাহসের মধ্যকার ভেদরেখাটা আমি নাকি ধরতে পারিনি।
No comments