৭- তিন আততায়ী বাংলাদেশের, না ভিনদেশের তাও কেউ জানে না
বিভীষিকার সেই কালো রাত
হঠাত্ করেই দু’দিক থেকে দু’জন আমার দু’হাত ধরে এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে দিল। অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে বলল, ‘নিয়ে চল ব্যাটাকে জায়গা মতো। দেখি কত বড় বীর পুরুষ’। চোখ বাঁধা, তাই কোনদিকে ঠেলছে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। জ্ঞান হারানোর আগে ক্রসফায়ারে নিয়ে যাচ্ছে এরকম কিছু একটা বোধহয় ভেবেছিলাম। ...
হঠাত্ করেই দু’দিক থেকে দু’জন আমার দু’হাত ধরে এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে দিল। অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে বলল, ‘নিয়ে চল ব্যাটাকে জায়গা মতো। দেখি কত বড় বীর পুরুষ’। চোখ বাঁধা, তাই কোনদিকে ঠেলছে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। জ্ঞান হারানোর আগে ক্রসফায়ারে নিয়ে যাচ্ছে এরকম কিছু একটা বোধহয় ভেবেছিলাম। ...
গত দু’রাত না ঘুমিয়েই কেটেছে। তার ওপর কোতোয়ালিতে সারা রাত ঠায় দাঁড়ানো। ক্যান্টনমেন্ট থানার নোংরা মেঝেতে শুয়ে ঘুমের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে এলেও ঘুমের দেখা নেই। মাঝে মাঝে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। পরক্ষণেই চমকে তন্দ্রা ছুটে যাচ্ছে। রাত বোধহয় তখন দেড়টা থেকে দুটোর মাঝামাঝি। গারদের তালা খোলার আওয়াজে চোখ মেলে তাকালাম। বাতি নেই, হয়তো বিদ্যুত্ চলে গেছে; তবে প্রকৃতির আলো আছে। সেই আলো-আঁধারিতে দেখলাম গারদের সামনে বেশ কয়েকটি ছায়া। একজনের হাতে বাক্সসদৃশ কিছু দেখতে পেলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, এই আগন্তুকরাই আমার সেলের তালা খোলার আগে থানার বাতি নিভিয়ে দিয়েছিল।
গারদের দরজা খুলে গেল। খর্বাকৃতি একটা অবয়ব আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি ততক্ষণে উঠে বসেছি। লোকটি দ্রুত পায়ে এসেই আমার শার্টের কলার ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল। তাকে চিনে ফেললাম। আমার মামলার আইও ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্য একজন পেছন থেকে দ্রুত আমার চোখ বেঁধে ফেলেছে। রেজাউল করিম শার্টের বোতাম খুলে শরীর থেকে শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘোর কেটে মাথা পরিষ্কার কাজ করছে। এরা আততায়ী, দেশের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারকের নির্দেশে আমাকে শেষ করে দিতে এসেছে। একবার ভাবলাম, চিত্কার করি। পরক্ষণেই মনে হলো, আমার সেই চিত্কার এই কাপুরুষদের আনন্দের খোরাকই কেবল জোগাবে। স্যাডিস্ট মহাপ্রভুর সামনে বসে রসিয়ে রসিয়ে আমার অন্তিম চিত্কারের গল্প বলে তার মনোরঞ্জন করবে। শুধু একবার মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করলাম। এর মধ্যে আমাকে একটা জ্যাকেট পরানো হয়েছে, সম্ভবত দু’হাত আটকে ফেলার জন্য। যন্ত্রের মতো কাজ চলছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। আমার কানের কাছে মধ্যরাতের আগন্তুকদের দ্রুত তালে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো সেলের কোণের দিকে, সেখানে কেবলই দেয়াল, বাইরে থেকে দেখা যাবে না ভেতরে কী ঘটছে। নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে আমাকে ঠেলে বসিয়ে দেয়া হলো। সামনে আমার দুই পা প্রসারিত, কাঁধের ওপর শক্ত দুটো হাত, পেছন থেকে পিঠ একজন তার হাঁটু দিয়ে চেপে রেখেছে। পরের ঘটনায় আবারও অবাক হলাম। কেউ দ্রুত আমার কোমরের বেল্ট খুলতে শুরু করেছে। প্যান্ট খুলে ফেলা হলো। কী করতে যাচ্ছে এরা? এত ঝামেলার প্রয়োজন কী? মাথার পাশে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে একবার গুলি করলেই তো যথেষ্ট। এক-এগারোর নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় শুনেছি বর্তমান ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারও নাকি লোকজনকে ধরে এনে হরেকরকম নির্যাতনের মধ্যে শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে ইলেকট্রিক শক দেয়। আমাকেও কি তেমন কিছু করতে যাচ্ছে? নইলে প্যান্ট খুলছে কেন? সঙ্গে আনা বাক্সের মধ্যে অত্যাচারের কোন ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে তাও জানা নেই। প্যান্ট খুললেও অন্তর্বাস অবশ্য যথাস্থানেই রইল। হঠাত্ করেই দু’দিক থেকে দু’জন আমার দু’হাত ধরে এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে দিল। অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে বলল, ‘নিয়ে চল ব্যাটাকে জায়গামত। দেখি কত বড় বীরপুরুষ।’ চোখ বাঁধা, তাই কোনদিকে ঠেলছে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। জ্ঞান হারানোর আগে ক্রসফায়ারে নিয়ে যাচ্ছে এরকম কিছু একটা বোধহয় ভেবেছিলাম। দু’দিনেরও অধিক সময় ধরে অনাহারক্লিষ্ট, নির্ঘুম, দুর্বল শরীর আর সইতে পারল না। দুই আততায়ীর শক্ত মুঠোর মধ্য দিয়েই আমার উভয় হাত পিছলে বার হয়ে এলো।
আমি শূন্যে ভাসতে লাগলাম। কোনো কষ্ট নেই, যাতনা নেই, কেবল অনাবিল প্রশান্তি। তারপর সব অন্ধকার। জ্ঞান যখন ফিরল—আমি থানার ডিউটি অফিসারের মেঝেতে শুয়ে আছি, সর্বাঙ্গ ভেজা। সম্ভবত জ্ঞান ফেরানোর জন্য পানি ঢালা হয়েছে। পাশ ফিরতে গিয়ে কোমরে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে দেখলাম প্যান্ট যথাস্থানে আছে। তবে বেল্ট উল্টো করে বাঁধা। আততায়ীরা আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় প্যান্ট পরানোর সময় বেল্ট উল্টো হয়ে গেছে। আমার অস্ফুট, বেদনার্ত আওয়াজ শুনে ডিউটি অফিসার ছুটে এসে বলল, স্যার আপনি ভালো আছেন, কোনো চিন্তা করবেন না, আমরা আপনাকে পাহারা দিচ্ছি। আমার তখন টয়লেটে যাওয়া দরকার, অথচ উঠতে পারছি না। দু’জন সেন্ট্রির কাঁধে ভর দিয়ে টয়লেটে গেলাম। সেখান থেকে ফিরে ডিউটি অফিসারকে অনুরোধ করলাম আমাকে হাজতে ফেরত পাঠাতে। ফজরের আজান শুনে তখনও জীবিত থাকার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অতি কষ্টে বসে ইশারায় নামাজ পড়লাম।
সকাল সাতটা না বাজতেই ক্যান্টনমেন্ট থানার কর্মকর্তা, কনস্টেবল দল বেঁধে এসে আমাকে সহানুভূতি জানিয়ে গেলেন। রাতের হত্যা প্রচেষ্টার ঘটনা পুরো থানায় জানাজানি হয়ে গেছে। ওদের কাছ থেকেই টুকরো টুকরো যে খবর পেলাম, সেগুলো জোড়া দিয়ে গতরাতে কী ঘটেছিল সেই চিত্রটি দিনভর সাজালাম। সেটাই আমার মতো করে বিবৃত করছি। রাত একটার পর একটি সিভিল গাড়িতে পাঁচজনের একটি দল ক্যান্টনমেন্ট থানায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা ছিল, যার একজনকে আমি চিনতে পেরেছি। অন্য কর্মকর্তার নাম জিজ্ঞাসা করে জবাব পেলাম না। সবাই এড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাকি তিনজনকে থানার কেউ চিনতে পারেনি। কনস্টেবল, কর্মকর্তারা একবাক্যে বলল, ওই তিনজন পুলিশ বাহিনীর কেউ নয়। তাহলে তারা কারা? তিন আততায়ী বাংলাদেশের, না ভিনদেশের তাও কেউ জানে না। দলটি এসেই কর্তব্যরত এএসআই’র কাছ থেকে আমার সেলের চাবি নিয়ে থানার বাতি নিভিয়ে দেয়। সেলে ঢোকার সময় থানার কাউকে কাছে-পিঠে থাকতে দেয়নি। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে এরা খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে থানার লোকজনদের ডেকে নিয়ে আসে। তারা বাতি জ্বালিয়ে দেখতে পায়, আমি সেলের কোণে অর্ধ উলঙ্গ নিথর পড়ে আছি। কর্তব্যরত কর্মকর্তা এবং সিপাহীরা মিলে আমাকে কাঁধে করে সেল থেকে ডিউটি অফিসারের কক্ষে নিয়ে ফ্যানের নিচে মেঝেতে শুইয়ে দেয়। তারপর চোখে-মুখে পানির ছিটা, পায়ের তালুতে সর্ষের তেল ঘষা, মাথায় পানি দেয়া ইত্যাদি অন্তে প্রায় দুই ঘণ্টা পর আমার জ্ঞান ফেরে। এই সময়ের মধ্যে আততায়ী বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থানা ত্যাগ করে। সর্বপ্রথমে তিন অচেনা ব্যক্তি এবং সর্বশেষ আইও রেজাউল করিম থানা ছেড়ে যায়। এমনই কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা আগে থেকে থাকলেও একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সরকারের এই বিশেষ খুনে বাহিনী কাজটা অসমাপ্ত রেখে গেল কেন? তাহলে কি আজ রাতে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে ফিরে আসবে? যে কোনো উপায়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে এই হত্যা প্রচেষ্টার সংবাদ দ্রুত জানানো দরকার। নইলে রিমান্ডের বাকি দুই দিনের মধ্যেই কোনো এক ঝোপ-জঙ্গলে আমার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পড়ে থাকার সমূহ আশঙ্কা। পুরো থানায় পরিচিত কেউ নেই। আমার অসহায় অবস্থায় প্রশাসনের কাউকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। জানি না কী বুঝে সিদ্ধান্ত নিলাম অনাহারে থাকব। মনে হলো, আততায়ীর বুলেটে অথবা নির্যাতনে প্রাণত্যাগ করার চাইতে অতিরিক্ত দৌর্বল্যে হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়াই উত্তম। আজন্ম আমার রক্তচাপ বেশ কমের দিকে। সুতরাং রক্তচাপ আরও খানিকটা কমলেই হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন সহজতর এবং দ্রুততর হবে। থানার প্রতিটি কর্মকর্তা সারাদিন ধরে অনুরোধ করেও আমাকে কিছু খেতে সম্মত করাতে পারল না।
বিকেলের শিফটে দায়িত্বরত ডিউটি অফিসার গারদের তালা খুলে আমাকে তার কক্ষে ফ্যানের নিচে বসে কিছুটা সময় অন্তত আরাম করার অনুরোধ করল। এই দু’দিনে মশার কামড়ে আমার সমস্ত শরীর ফুলে গেছে; ঘামে ভিজতে ভিজতে সর্বাঙ্গ চটচটে, দুর্গন্ধময়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলেটির সঙ্গে গেলাম। সেখানে গিয়ে মনে হলো, না আসাটাই ঠিক ছিল। আইও রেজা ডিউটি অফিসারের কক্ষে আগে থেকেই অপেক্ষমাণ। তাকে সেখানে দেখে গত রাতের কথা মনে করে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম। লোকটি খেজুরের একটি বাক্স আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে খেতে অনুরোধ করল। খেজুর আমি বেশ পছন্দ করেই খাই। বাক্সটি দেখেই বুঝলাম, এটা আমারই বাসা থেকে এসেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ভেতর থেকে প্রবল হয়ে উঠে আসা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ক্রোধ সংবরণ করলাম। কোনো কথা না বলে সম্ভাব্য হত্যাকারীর হাত থেকেই একটা খেজুর নিয়ে মুখে দিতেই বমনেচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল। লোকটি আমার চেহারার রং পরিবর্তন লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা পানি আনতে নির্দেশ দিল। একজন সেন্ট্রি ছুটে গিয়ে এক গ্লাস ফ্রিজে ঠাণ্ডা করা পানি নিয়ে এলে পুরোটাই খেলাম। ওখানে বসে থাকা আমার অসহ্য বোধ হতে লাগল। সেই মানসিক নির্যাতনের তীব্রতা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কাউকে বোঝানো কঠিন। ডিউটি অফিসার এবং ইন্সপেক্টর রেজার বাধা উপেক্ষা করে গারদে ফিরে এলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মন শক্ত করে রাতের আসন্ন আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। আমার সেলে যাদের ডিউটি ছিল সেসব সিপাহী তো বটেই, থানার অন্য সেন্ট্রিরাও কিছুক্ষণ পরপর আমাকে ভরসা দিয়ে যাচ্ছিল। তারা দৃঢ়কণ্ঠে বলছিল, আজ রাতে আপনার ওপর যে কোনো আঘাত আমরা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করব। তাতে লড়াই বাধলেও পিছিয়ে যাব না। ওদের কথা শুনে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আমি তাহলে নিঃসঙ্গ নই। সত্যের পক্ষে সিনা টান করে দাঁড়ানোর মতো সৈনিক এখনও এই দেশে আছে। মন প্রশান্ত হয়ে গেল। জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম একদিন ইনশাআল্লাহ, শুরু হবে। সেই মহান সংগ্রামে আমার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যক্তির আগাম মৃত্যু যত্সামান্য ত্যাগ স্বীকার মাত্র। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে লাখ লাখ তরুণ আত্মদান করেছেন, তাদের ক’জনকেই বা আমরা চিনি। কিন্তু, এই আত্মত্যাগের ফলেই পাকিস্তানি স্বৈরশাসন থেকে আমরা মুক্তিলাভ করেছি। সাম্রাজ্যবাদের দোসর, বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠী চার দশক পর দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে। সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আজ অকাতরে প্রাণ দেয়ার সময় এসেছে। অতএব, আল্লাহ ভরসা।
রাত বারোটার ঘণ্টা বেজেছে বেশ খানিক আগে। একাধিক বুটের শব্দ শুনলাম। গারদের সামনে আইও রেজাউল করিম, পাশে ক্যান্টনমেন্ট থানার ডিউটি অফিসার আহসান হাবিব। থানার বাতি জ্বালানোই রয়েছে। বলা হলো, আমার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হচ্ছে। আইও একটি কালো কাপড় বের করে রূঢ়ভাবে জানাল, আমার চোখ বাঁধা হবে। এর হেতু জিজ্ঞাসা করতেই শুনলাম, এটাই নাকি আইন। প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু না হতেই আরও একজনের বুটের আওয়াজ শুনতে পেলাম। সেই আওয়াজ সেলে ঢুকে আমার চারপাশে পায়চারি করছে। তৃতীয় ব্যক্তির পরিচয় আমার কাছে গোপন রাখা হলো। আধ ঘণ্টাখানেক ধরে জিজ্ঞাসাবাদের তামাসা চলছে। ঘুরে-ফিরে একই প্রশ্ন। গ্রেফতারের রাতে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকদের মধ্যে কারা কারা আমার দেশ কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের আমি ডেকে এনেছিলাম কি-না? হঠাত্ একজন সেন্ট্রি ছুটে এসে খবর দিল, অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদার আমার খোঁজে থানায় এসেছেন। উত্তেজনা চাপতে না পেরে উচ্চকণ্ঠেই বলে উঠলাম, তিনি আমার আইনজীবী। জিজ্ঞাসাবাদ থেমে গেল। মিনিট পাঁচেক পর চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। তারপর সব চুপচাপ। খানিক বাদে এক সেন্ট্রি এসে চুপি চুপি বলে গেল, আমার স্ত্রীও নাকি এসেছে। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। কোনো ভদ্র পরিবারের মহিলাদের আসার স্থান থানা নয়। তার ওপর রাত তখন প্রায় দুটো। অপর একজন খবর দিল, মাসুদ তালুকদার ছাড়াও অন্যান্য ব্যারিস্টার এবং জাতীয়তাবাদী দলের সংসদ সদস্যরাও আমার খোঁজে এসেছেন। মনে হলো, আল্লাহ তাঁর রহমতের ভাণ্ডার আমার জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। তিনিই আমার একমাত্র নিরাপত্তাদাতা। ভোর চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আছি। জিজ্ঞাসাবাদের খবর নেই। শেষ পর্যন্ত আহসান হাবিব এসে জানালেন, আমি এবার ঘুমাতে পারি। আজ রাতের মতো জিজ্ঞাসাবাদে ইতি। আর খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতেই ফজরের নামাজের ওয়াক্ত হলো। নামাজ শেষ করে ঘুমিয়ে যখন জেগে উঠলাম, তখন সকাল প্রায় আটটা। সারাদিন আর কেউ এলো না। পাহারারত সেন্ট্রির সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করে আর খানিক পরপর রঙ চা খেয়ে সময় কাটালাম। সন্ধ্যা সাতটায় আরেক দফা জিজ্ঞাসাবাদের কথা জানানো হলো। তবে জিজ্ঞাসাবাদ সেলে হবে না। ভিন্ন স্থানে যেতে হবে। ডিউটি অফিসারের কক্ষে পৌঁছে যথারীতি রেজাউল করিমকে দেখতে পেলাম। তার ইচ্ছেতেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার চমত্কার অফিসে যাওয়া হলো। তৃতীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদে যোগ দিল। তরুণটি ইন্সপেক্টর রেজাউল করিমের জুনিয়র। আবারও সেই একঘেয়ে প্রশ্ন। আজ কিন্তু আমার চোখ বাঁধা হলো না। পূর্বরাতে আমাকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ পুলিশের আইনই হচ্ছে চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করা। আজকে এই আইন ভঙ্গ করায় ইন্সপেক্টর রেজার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কি-না, নির্দোষভাবে জানতে চাইলে সে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। এসব ক্ষেত্রে আমারও চোখ নামানোর অভ্যাস নেই। রেজাউল করিমের চোখের ভাষায় আমি যেন পড়ছিলাম, তেল তাহলে এখনও পুরোটা যায়নি। জুনিয়রের সামনে আমার বেমক্কা প্রশ্নে দৃশ্যত অপমানিত আইও জিজ্ঞাসাবাদে সমাপ্তি টেনে আমাকে হাজতে নিয়ে যেতে বলল। আমিও কোনো সেন্ট্রির জন্য অপেক্ষা না করে ওসি’র ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা হাজতে চলে গেলাম। এই তিন দিনে থানার পথ-ঘাট মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে। তেজগাঁও থানার দায়ের করা মামলার রিমান্ডের সর্বশেষ রাতে উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটলো না। তবে সেন্ট্রির মাধ্যমে খবর পেলাম সংসদ সদস্য পাপিয়া, রুনু, আইনজীবী মুন্সি কবির আমার কুশল জানতে থানায় এসেছিলেন। এদের ঋণ শোধ করা আমার সাধ্যাতীত।
বারই জুন দুপুর একটায় প্রিজন ভ্যান আমাকে আদালতে নেয়ার জন্যে এলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভ্যানে উঠলাম। যাওয়ার সময় অবশ্য ধারণা করছিলাম, আদালতের আনুষ্ঠানিকতা শেষে এখানেই বোধহয় ফিরে আসছি। আরও দুই মামলার রিমান্ড সমাপ্ত হতে তখনও আট দিন বাকি রয়েছে। তাছাড়া এই মামলাতেই সরকার পুনরায় রিমান্ডও চাইতে পারে। ঘণ্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ম্যাজিস্ট্রেট একজন তরুণী। অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিঞাকে আগেই বলে রেখেছিলাম, নির্যাতনের ঘটনা আমি নিজমুখে বর্ণনা করতে চাই। তিনি কথামত শুনানির শুরুতেই আদালতের অনুমতি নিয়ে রাখলেন। সরকারপক্ষ যথাসম্ভব বাধা দিলেও ফল হলো না। ম্যাজিস্ট্রেট সম্ভবত আমার বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে করুণাবশত কাঠগড়ায় বসার জন্য একটা চেয়ার দেয়ারও নির্দেশ দিলেন। ক্যান্টনমেন্ট থানায় রাতের তৃতীয় প্রহরের সেই লোমহর্ষক ঘটনা যতটা সম্ভব নিরাসক্তভাবে বর্ণনা করলাম। ম্যাজিস্ট্রেট প্রায় কন্যাসম হওয়ায় পরনের কাপড় খোলার বর্ণনা দেয়ার সময় বিব্রত বোধ করছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেটকে সে কথাটা আমি বললামও। আমি বলে যাচ্ছি। আদালতে পিনপতন নিস্তব্ধতা, কারও চোখে পানি। আওয়ামী লীগ যে চরিত্রগতভাবে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল, সে বিষয়টি এদেশের জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ মোটামুটি জানে। এমনকি আওয়ামী লীগাররাও জানে। তবে তারা বিষয়টি লজ্জাস্কর বিবেচনা না করে বরং একপ্রকার অহঙ্কার বোধ করে। সেই ফ্যাসিবাদী দলটি মার্কিন-ভারতের অন্ধ সমর্থনে এবার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতে’ পরিণত করেছে। আমার বক্তব্য শেষ হতেই সরকারি আইনজীবী তারস্বরে চিত্কার করে বলতে লাগলেন, এগুলো সব বানানো। আমি নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করছি। যে রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সেখানে আমার ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হবে এমন অলীক স্বপ্ন দেখার মতো নির্বোধ আমি নই। তবে আশা করেছিলাম, এই ঘটনা সংবাদকর্মীদের বিবেক অন্তত জাগ্রত করবে। নির্যাতন ও মানবাধিকার প্রশ্নে সব সংবাদকর্মী রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একটি নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করবেন। আমার সেই আশাটি অবশ্য পূরণ হয়নি। তবে সাধারণ জনগণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন, সেই সত্য আমাকে আশান্বিত করছে। ব্যক্তিগত মান-অপমানকে উপেক্ষা করে আদালতে নির্যাতনের কাহিনী বিশদভাবে বর্ণনার উদ্দেশ্যই ছিল এদেশের লড়াকু জনগণকে আরও সচেতন করে তোলা। তেজগাঁও থানার মামলায় সরকারপক্ষ নতুন করে আর রিমান্ড চাইল না। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পরবর্তী রিমান্ডে যাত্রার আগে স্বল্প সময় বিরতির জন্যে আমাকে কোর্ট গারদে পাঠানো হলো। সেখানে আদালতের অনুমতি নিয়ে আমার আইনজীবীরা দেখা করতে এলেন। পারভীন খিচুড়ি রান্না করে পাঠিয়েছে। গারদের নোংরা পরিবেশে খাওয়ার রুচি না হলেও জায়া ও জননীর খানিকটা মানসিক শান্তির জন্যে জোর করে হলেও কয়েক চামচ খিচুড়ি গলাধঃকরণ করলাম। সেদিনই প্রথম শুনলাম, রিমান্ডে আমার ওপর অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় পারভীন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। রক্তচাপ ২০০ এবং ১৩৫। যে কোনো সময় হার্ট অ্যাটাক অথবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা রয়েছে। পঁচিশ বছরের সংসারজীবনে ওকে অনেক প্রতিকূল অবস্থা সামলাতে দেখেছি। এমনভাবে ভেঙে পড়েনি কখনও। আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা তাকে সব সময় শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। এক-এগারোর পর মইনের জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডকে কলমের অস্ত্রে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার সময় থেকেই আমার গ্রেফতারের আশঙ্কা নিয়ে আমাদের মধ্যে বহুবার কথা হয়েছে। জেলে যাওয়ার সার্বক্ষণিক প্রস্তুতিস্বরূপ একটি ব্যাগের মধ্যে আমার প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য টুকিটাকি জিনিসপত্র পারভীন নিজ হাতে গুছিয়ে রেখেছে সেই ২০০৭ সাল থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় দেশে-বিদেশে আওয়ামী পেটোয়া বাহিনীর আক্রমণ এবং সরকারের একটার পর একটা মামলা দায়েরেও সে কখনও বিচলিত হয়নি। স্ত্রী হিসেবে স্বাভাবিকভাবে উদ্বিগ্ন হলেও সাহস হারায়নি একদিনের জন্যেও। আজ তারই অসুস্থতার সংবাদে বড় বিষণ্ন হয়ে পড়লাম। সানাউল্লাহ ভাই, মাসুদ ভাই এবং অন্যান্য আইনজীবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তৃতীয় দফা রিমান্ডের মুখোমুখি হতে অপেক্ষমাণ প্রিজন ভ্যানে প্রবেশ করলাম। তখন চোখ আমার শুষ্ক; কিন্তু হৃদয়ে অবিরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
গারদের দরজা খুলে গেল। খর্বাকৃতি একটা অবয়ব আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি ততক্ষণে উঠে বসেছি। লোকটি দ্রুত পায়ে এসেই আমার শার্টের কলার ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল। তাকে চিনে ফেললাম। আমার মামলার আইও ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্য একজন পেছন থেকে দ্রুত আমার চোখ বেঁধে ফেলেছে। রেজাউল করিম শার্টের বোতাম খুলে শরীর থেকে শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘোর কেটে মাথা পরিষ্কার কাজ করছে। এরা আততায়ী, দেশের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারকের নির্দেশে আমাকে শেষ করে দিতে এসেছে। একবার ভাবলাম, চিত্কার করি। পরক্ষণেই মনে হলো, আমার সেই চিত্কার এই কাপুরুষদের আনন্দের খোরাকই কেবল জোগাবে। স্যাডিস্ট মহাপ্রভুর সামনে বসে রসিয়ে রসিয়ে আমার অন্তিম চিত্কারের গল্প বলে তার মনোরঞ্জন করবে। শুধু একবার মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করলাম। এর মধ্যে আমাকে একটা জ্যাকেট পরানো হয়েছে, সম্ভবত দু’হাত আটকে ফেলার জন্য। যন্ত্রের মতো কাজ চলছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। আমার কানের কাছে মধ্যরাতের আগন্তুকদের দ্রুত তালে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো সেলের কোণের দিকে, সেখানে কেবলই দেয়াল, বাইরে থেকে দেখা যাবে না ভেতরে কী ঘটছে। নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে আমাকে ঠেলে বসিয়ে দেয়া হলো। সামনে আমার দুই পা প্রসারিত, কাঁধের ওপর শক্ত দুটো হাত, পেছন থেকে পিঠ একজন তার হাঁটু দিয়ে চেপে রেখেছে। পরের ঘটনায় আবারও অবাক হলাম। কেউ দ্রুত আমার কোমরের বেল্ট খুলতে শুরু করেছে। প্যান্ট খুলে ফেলা হলো। কী করতে যাচ্ছে এরা? এত ঝামেলার প্রয়োজন কী? মাথার পাশে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে একবার গুলি করলেই তো যথেষ্ট। এক-এগারোর নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় শুনেছি বর্তমান ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারও নাকি লোকজনকে ধরে এনে হরেকরকম নির্যাতনের মধ্যে শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে ইলেকট্রিক শক দেয়। আমাকেও কি তেমন কিছু করতে যাচ্ছে? নইলে প্যান্ট খুলছে কেন? সঙ্গে আনা বাক্সের মধ্যে অত্যাচারের কোন ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে তাও জানা নেই। প্যান্ট খুললেও অন্তর্বাস অবশ্য যথাস্থানেই রইল। হঠাত্ করেই দু’দিক থেকে দু’জন আমার দু’হাত ধরে এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে দিল। অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে বলল, ‘নিয়ে চল ব্যাটাকে জায়গামত। দেখি কত বড় বীরপুরুষ।’ চোখ বাঁধা, তাই কোনদিকে ঠেলছে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। জ্ঞান হারানোর আগে ক্রসফায়ারে নিয়ে যাচ্ছে এরকম কিছু একটা বোধহয় ভেবেছিলাম। দু’দিনেরও অধিক সময় ধরে অনাহারক্লিষ্ট, নির্ঘুম, দুর্বল শরীর আর সইতে পারল না। দুই আততায়ীর শক্ত মুঠোর মধ্য দিয়েই আমার উভয় হাত পিছলে বার হয়ে এলো।
আমি শূন্যে ভাসতে লাগলাম। কোনো কষ্ট নেই, যাতনা নেই, কেবল অনাবিল প্রশান্তি। তারপর সব অন্ধকার। জ্ঞান যখন ফিরল—আমি থানার ডিউটি অফিসারের মেঝেতে শুয়ে আছি, সর্বাঙ্গ ভেজা। সম্ভবত জ্ঞান ফেরানোর জন্য পানি ঢালা হয়েছে। পাশ ফিরতে গিয়ে কোমরে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে দেখলাম প্যান্ট যথাস্থানে আছে। তবে বেল্ট উল্টো করে বাঁধা। আততায়ীরা আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় প্যান্ট পরানোর সময় বেল্ট উল্টো হয়ে গেছে। আমার অস্ফুট, বেদনার্ত আওয়াজ শুনে ডিউটি অফিসার ছুটে এসে বলল, স্যার আপনি ভালো আছেন, কোনো চিন্তা করবেন না, আমরা আপনাকে পাহারা দিচ্ছি। আমার তখন টয়লেটে যাওয়া দরকার, অথচ উঠতে পারছি না। দু’জন সেন্ট্রির কাঁধে ভর দিয়ে টয়লেটে গেলাম। সেখান থেকে ফিরে ডিউটি অফিসারকে অনুরোধ করলাম আমাকে হাজতে ফেরত পাঠাতে। ফজরের আজান শুনে তখনও জীবিত থাকার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অতি কষ্টে বসে ইশারায় নামাজ পড়লাম।
সকাল সাতটা না বাজতেই ক্যান্টনমেন্ট থানার কর্মকর্তা, কনস্টেবল দল বেঁধে এসে আমাকে সহানুভূতি জানিয়ে গেলেন। রাতের হত্যা প্রচেষ্টার ঘটনা পুরো থানায় জানাজানি হয়ে গেছে। ওদের কাছ থেকেই টুকরো টুকরো যে খবর পেলাম, সেগুলো জোড়া দিয়ে গতরাতে কী ঘটেছিল সেই চিত্রটি দিনভর সাজালাম। সেটাই আমার মতো করে বিবৃত করছি। রাত একটার পর একটি সিভিল গাড়িতে পাঁচজনের একটি দল ক্যান্টনমেন্ট থানায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা ছিল, যার একজনকে আমি চিনতে পেরেছি। অন্য কর্মকর্তার নাম জিজ্ঞাসা করে জবাব পেলাম না। সবাই এড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাকি তিনজনকে থানার কেউ চিনতে পারেনি। কনস্টেবল, কর্মকর্তারা একবাক্যে বলল, ওই তিনজন পুলিশ বাহিনীর কেউ নয়। তাহলে তারা কারা? তিন আততায়ী বাংলাদেশের, না ভিনদেশের তাও কেউ জানে না। দলটি এসেই কর্তব্যরত এএসআই’র কাছ থেকে আমার সেলের চাবি নিয়ে থানার বাতি নিভিয়ে দেয়। সেলে ঢোকার সময় থানার কাউকে কাছে-পিঠে থাকতে দেয়নি। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে এরা খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে থানার লোকজনদের ডেকে নিয়ে আসে। তারা বাতি জ্বালিয়ে দেখতে পায়, আমি সেলের কোণে অর্ধ উলঙ্গ নিথর পড়ে আছি। কর্তব্যরত কর্মকর্তা এবং সিপাহীরা মিলে আমাকে কাঁধে করে সেল থেকে ডিউটি অফিসারের কক্ষে নিয়ে ফ্যানের নিচে মেঝেতে শুইয়ে দেয়। তারপর চোখে-মুখে পানির ছিটা, পায়ের তালুতে সর্ষের তেল ঘষা, মাথায় পানি দেয়া ইত্যাদি অন্তে প্রায় দুই ঘণ্টা পর আমার জ্ঞান ফেরে। এই সময়ের মধ্যে আততায়ী বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থানা ত্যাগ করে। সর্বপ্রথমে তিন অচেনা ব্যক্তি এবং সর্বশেষ আইও রেজাউল করিম থানা ছেড়ে যায়। এমনই কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা আগে থেকে থাকলেও একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সরকারের এই বিশেষ খুনে বাহিনী কাজটা অসমাপ্ত রেখে গেল কেন? তাহলে কি আজ রাতে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে ফিরে আসবে? যে কোনো উপায়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে এই হত্যা প্রচেষ্টার সংবাদ দ্রুত জানানো দরকার। নইলে রিমান্ডের বাকি দুই দিনের মধ্যেই কোনো এক ঝোপ-জঙ্গলে আমার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পড়ে থাকার সমূহ আশঙ্কা। পুরো থানায় পরিচিত কেউ নেই। আমার অসহায় অবস্থায় প্রশাসনের কাউকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। জানি না কী বুঝে সিদ্ধান্ত নিলাম অনাহারে থাকব। মনে হলো, আততায়ীর বুলেটে অথবা নির্যাতনে প্রাণত্যাগ করার চাইতে অতিরিক্ত দৌর্বল্যে হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়াই উত্তম। আজন্ম আমার রক্তচাপ বেশ কমের দিকে। সুতরাং রক্তচাপ আরও খানিকটা কমলেই হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন সহজতর এবং দ্রুততর হবে। থানার প্রতিটি কর্মকর্তা সারাদিন ধরে অনুরোধ করেও আমাকে কিছু খেতে সম্মত করাতে পারল না।
বিকেলের শিফটে দায়িত্বরত ডিউটি অফিসার গারদের তালা খুলে আমাকে তার কক্ষে ফ্যানের নিচে বসে কিছুটা সময় অন্তত আরাম করার অনুরোধ করল। এই দু’দিনে মশার কামড়ে আমার সমস্ত শরীর ফুলে গেছে; ঘামে ভিজতে ভিজতে সর্বাঙ্গ চটচটে, দুর্গন্ধময়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলেটির সঙ্গে গেলাম। সেখানে গিয়ে মনে হলো, না আসাটাই ঠিক ছিল। আইও রেজা ডিউটি অফিসারের কক্ষে আগে থেকেই অপেক্ষমাণ। তাকে সেখানে দেখে গত রাতের কথা মনে করে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম। লোকটি খেজুরের একটি বাক্স আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে খেতে অনুরোধ করল। খেজুর আমি বেশ পছন্দ করেই খাই। বাক্সটি দেখেই বুঝলাম, এটা আমারই বাসা থেকে এসেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ভেতর থেকে প্রবল হয়ে উঠে আসা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ক্রোধ সংবরণ করলাম। কোনো কথা না বলে সম্ভাব্য হত্যাকারীর হাত থেকেই একটা খেজুর নিয়ে মুখে দিতেই বমনেচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল। লোকটি আমার চেহারার রং পরিবর্তন লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা পানি আনতে নির্দেশ দিল। একজন সেন্ট্রি ছুটে গিয়ে এক গ্লাস ফ্রিজে ঠাণ্ডা করা পানি নিয়ে এলে পুরোটাই খেলাম। ওখানে বসে থাকা আমার অসহ্য বোধ হতে লাগল। সেই মানসিক নির্যাতনের তীব্রতা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কাউকে বোঝানো কঠিন। ডিউটি অফিসার এবং ইন্সপেক্টর রেজার বাধা উপেক্ষা করে গারদে ফিরে এলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মন শক্ত করে রাতের আসন্ন আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। আমার সেলে যাদের ডিউটি ছিল সেসব সিপাহী তো বটেই, থানার অন্য সেন্ট্রিরাও কিছুক্ষণ পরপর আমাকে ভরসা দিয়ে যাচ্ছিল। তারা দৃঢ়কণ্ঠে বলছিল, আজ রাতে আপনার ওপর যে কোনো আঘাত আমরা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করব। তাতে লড়াই বাধলেও পিছিয়ে যাব না। ওদের কথা শুনে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আমি তাহলে নিঃসঙ্গ নই। সত্যের পক্ষে সিনা টান করে দাঁড়ানোর মতো সৈনিক এখনও এই দেশে আছে। মন প্রশান্ত হয়ে গেল। জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম একদিন ইনশাআল্লাহ, শুরু হবে। সেই মহান সংগ্রামে আমার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যক্তির আগাম মৃত্যু যত্সামান্য ত্যাগ স্বীকার মাত্র। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে লাখ লাখ তরুণ আত্মদান করেছেন, তাদের ক’জনকেই বা আমরা চিনি। কিন্তু, এই আত্মত্যাগের ফলেই পাকিস্তানি স্বৈরশাসন থেকে আমরা মুক্তিলাভ করেছি। সাম্রাজ্যবাদের দোসর, বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠী চার দশক পর দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে। সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আজ অকাতরে প্রাণ দেয়ার সময় এসেছে। অতএব, আল্লাহ ভরসা।
রাত বারোটার ঘণ্টা বেজেছে বেশ খানিক আগে। একাধিক বুটের শব্দ শুনলাম। গারদের সামনে আইও রেজাউল করিম, পাশে ক্যান্টনমেন্ট থানার ডিউটি অফিসার আহসান হাবিব। থানার বাতি জ্বালানোই রয়েছে। বলা হলো, আমার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হচ্ছে। আইও একটি কালো কাপড় বের করে রূঢ়ভাবে জানাল, আমার চোখ বাঁধা হবে। এর হেতু জিজ্ঞাসা করতেই শুনলাম, এটাই নাকি আইন। প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু না হতেই আরও একজনের বুটের আওয়াজ শুনতে পেলাম। সেই আওয়াজ সেলে ঢুকে আমার চারপাশে পায়চারি করছে। তৃতীয় ব্যক্তির পরিচয় আমার কাছে গোপন রাখা হলো। আধ ঘণ্টাখানেক ধরে জিজ্ঞাসাবাদের তামাসা চলছে। ঘুরে-ফিরে একই প্রশ্ন। গ্রেফতারের রাতে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকদের মধ্যে কারা কারা আমার দেশ কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের আমি ডেকে এনেছিলাম কি-না? হঠাত্ একজন সেন্ট্রি ছুটে এসে খবর দিল, অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদার আমার খোঁজে থানায় এসেছেন। উত্তেজনা চাপতে না পেরে উচ্চকণ্ঠেই বলে উঠলাম, তিনি আমার আইনজীবী। জিজ্ঞাসাবাদ থেমে গেল। মিনিট পাঁচেক পর চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। তারপর সব চুপচাপ। খানিক বাদে এক সেন্ট্রি এসে চুপি চুপি বলে গেল, আমার স্ত্রীও নাকি এসেছে। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। কোনো ভদ্র পরিবারের মহিলাদের আসার স্থান থানা নয়। তার ওপর রাত তখন প্রায় দুটো। অপর একজন খবর দিল, মাসুদ তালুকদার ছাড়াও অন্যান্য ব্যারিস্টার এবং জাতীয়তাবাদী দলের সংসদ সদস্যরাও আমার খোঁজে এসেছেন। মনে হলো, আল্লাহ তাঁর রহমতের ভাণ্ডার আমার জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। তিনিই আমার একমাত্র নিরাপত্তাদাতা। ভোর চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আছি। জিজ্ঞাসাবাদের খবর নেই। শেষ পর্যন্ত আহসান হাবিব এসে জানালেন, আমি এবার ঘুমাতে পারি। আজ রাতের মতো জিজ্ঞাসাবাদে ইতি। আর খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতেই ফজরের নামাজের ওয়াক্ত হলো। নামাজ শেষ করে ঘুমিয়ে যখন জেগে উঠলাম, তখন সকাল প্রায় আটটা। সারাদিন আর কেউ এলো না। পাহারারত সেন্ট্রির সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করে আর খানিক পরপর রঙ চা খেয়ে সময় কাটালাম। সন্ধ্যা সাতটায় আরেক দফা জিজ্ঞাসাবাদের কথা জানানো হলো। তবে জিজ্ঞাসাবাদ সেলে হবে না। ভিন্ন স্থানে যেতে হবে। ডিউটি অফিসারের কক্ষে পৌঁছে যথারীতি রেজাউল করিমকে দেখতে পেলাম। তার ইচ্ছেতেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার চমত্কার অফিসে যাওয়া হলো। তৃতীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদে যোগ দিল। তরুণটি ইন্সপেক্টর রেজাউল করিমের জুনিয়র। আবারও সেই একঘেয়ে প্রশ্ন। আজ কিন্তু আমার চোখ বাঁধা হলো না। পূর্বরাতে আমাকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ পুলিশের আইনই হচ্ছে চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করা। আজকে এই আইন ভঙ্গ করায় ইন্সপেক্টর রেজার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কি-না, নির্দোষভাবে জানতে চাইলে সে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। এসব ক্ষেত্রে আমারও চোখ নামানোর অভ্যাস নেই। রেজাউল করিমের চোখের ভাষায় আমি যেন পড়ছিলাম, তেল তাহলে এখনও পুরোটা যায়নি। জুনিয়রের সামনে আমার বেমক্কা প্রশ্নে দৃশ্যত অপমানিত আইও জিজ্ঞাসাবাদে সমাপ্তি টেনে আমাকে হাজতে নিয়ে যেতে বলল। আমিও কোনো সেন্ট্রির জন্য অপেক্ষা না করে ওসি’র ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা হাজতে চলে গেলাম। এই তিন দিনে থানার পথ-ঘাট মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে। তেজগাঁও থানার দায়ের করা মামলার রিমান্ডের সর্বশেষ রাতে উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটলো না। তবে সেন্ট্রির মাধ্যমে খবর পেলাম সংসদ সদস্য পাপিয়া, রুনু, আইনজীবী মুন্সি কবির আমার কুশল জানতে থানায় এসেছিলেন। এদের ঋণ শোধ করা আমার সাধ্যাতীত।
বারই জুন দুপুর একটায় প্রিজন ভ্যান আমাকে আদালতে নেয়ার জন্যে এলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভ্যানে উঠলাম। যাওয়ার সময় অবশ্য ধারণা করছিলাম, আদালতের আনুষ্ঠানিকতা শেষে এখানেই বোধহয় ফিরে আসছি। আরও দুই মামলার রিমান্ড সমাপ্ত হতে তখনও আট দিন বাকি রয়েছে। তাছাড়া এই মামলাতেই সরকার পুনরায় রিমান্ডও চাইতে পারে। ঘণ্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ম্যাজিস্ট্রেট একজন তরুণী। অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিঞাকে আগেই বলে রেখেছিলাম, নির্যাতনের ঘটনা আমি নিজমুখে বর্ণনা করতে চাই। তিনি কথামত শুনানির শুরুতেই আদালতের অনুমতি নিয়ে রাখলেন। সরকারপক্ষ যথাসম্ভব বাধা দিলেও ফল হলো না। ম্যাজিস্ট্রেট সম্ভবত আমার বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে করুণাবশত কাঠগড়ায় বসার জন্য একটা চেয়ার দেয়ারও নির্দেশ দিলেন। ক্যান্টনমেন্ট থানায় রাতের তৃতীয় প্রহরের সেই লোমহর্ষক ঘটনা যতটা সম্ভব নিরাসক্তভাবে বর্ণনা করলাম। ম্যাজিস্ট্রেট প্রায় কন্যাসম হওয়ায় পরনের কাপড় খোলার বর্ণনা দেয়ার সময় বিব্রত বোধ করছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেটকে সে কথাটা আমি বললামও। আমি বলে যাচ্ছি। আদালতে পিনপতন নিস্তব্ধতা, কারও চোখে পানি। আওয়ামী লীগ যে চরিত্রগতভাবে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল, সে বিষয়টি এদেশের জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ মোটামুটি জানে। এমনকি আওয়ামী লীগাররাও জানে। তবে তারা বিষয়টি লজ্জাস্কর বিবেচনা না করে বরং একপ্রকার অহঙ্কার বোধ করে। সেই ফ্যাসিবাদী দলটি মার্কিন-ভারতের অন্ধ সমর্থনে এবার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতে’ পরিণত করেছে। আমার বক্তব্য শেষ হতেই সরকারি আইনজীবী তারস্বরে চিত্কার করে বলতে লাগলেন, এগুলো সব বানানো। আমি নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করছি। যে রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সেখানে আমার ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হবে এমন অলীক স্বপ্ন দেখার মতো নির্বোধ আমি নই। তবে আশা করেছিলাম, এই ঘটনা সংবাদকর্মীদের বিবেক অন্তত জাগ্রত করবে। নির্যাতন ও মানবাধিকার প্রশ্নে সব সংবাদকর্মী রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একটি নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করবেন। আমার সেই আশাটি অবশ্য পূরণ হয়নি। তবে সাধারণ জনগণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন, সেই সত্য আমাকে আশান্বিত করছে। ব্যক্তিগত মান-অপমানকে উপেক্ষা করে আদালতে নির্যাতনের কাহিনী বিশদভাবে বর্ণনার উদ্দেশ্যই ছিল এদেশের লড়াকু জনগণকে আরও সচেতন করে তোলা। তেজগাঁও থানার মামলায় সরকারপক্ষ নতুন করে আর রিমান্ড চাইল না। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পরবর্তী রিমান্ডে যাত্রার আগে স্বল্প সময় বিরতির জন্যে আমাকে কোর্ট গারদে পাঠানো হলো। সেখানে আদালতের অনুমতি নিয়ে আমার আইনজীবীরা দেখা করতে এলেন। পারভীন খিচুড়ি রান্না করে পাঠিয়েছে। গারদের নোংরা পরিবেশে খাওয়ার রুচি না হলেও জায়া ও জননীর খানিকটা মানসিক শান্তির জন্যে জোর করে হলেও কয়েক চামচ খিচুড়ি গলাধঃকরণ করলাম। সেদিনই প্রথম শুনলাম, রিমান্ডে আমার ওপর অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় পারভীন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। রক্তচাপ ২০০ এবং ১৩৫। যে কোনো সময় হার্ট অ্যাটাক অথবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা রয়েছে। পঁচিশ বছরের সংসারজীবনে ওকে অনেক প্রতিকূল অবস্থা সামলাতে দেখেছি। এমনভাবে ভেঙে পড়েনি কখনও। আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা তাকে সব সময় শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। এক-এগারোর পর মইনের জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডকে কলমের অস্ত্রে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার সময় থেকেই আমার গ্রেফতারের আশঙ্কা নিয়ে আমাদের মধ্যে বহুবার কথা হয়েছে। জেলে যাওয়ার সার্বক্ষণিক প্রস্তুতিস্বরূপ একটি ব্যাগের মধ্যে আমার প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য টুকিটাকি জিনিসপত্র পারভীন নিজ হাতে গুছিয়ে রেখেছে সেই ২০০৭ সাল থেকেই। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় দেশে-বিদেশে আওয়ামী পেটোয়া বাহিনীর আক্রমণ এবং সরকারের একটার পর একটা মামলা দায়েরেও সে কখনও বিচলিত হয়নি। স্ত্রী হিসেবে স্বাভাবিকভাবে উদ্বিগ্ন হলেও সাহস হারায়নি একদিনের জন্যেও। আজ তারই অসুস্থতার সংবাদে বড় বিষণ্ন হয়ে পড়লাম। সানাউল্লাহ ভাই, মাসুদ ভাই এবং অন্যান্য আইনজীবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তৃতীয় দফা রিমান্ডের মুখোমুখি হতে অপেক্ষমাণ প্রিজন ভ্যানে প্রবেশ করলাম। তখন চোখ আমার শুষ্ক; কিন্তু হৃদয়ে অবিরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
No comments