৫- কাশিমপুর জেল আমি তৈরি হতে দেখেছি ভাবিনি কয়েদি হয়ে এখানেই থাকতে হবে
তিন ঘণ্টার প্রিজন ভ্যান ভ্রমণে অবস্থা কাহিল
...প্রিজন ভ্যান ছুটে চললো কাশিমপুর জেল অভিমুখে। এর আগে এত দীর্ঘপথ প্রিজন ভ্যানে চড়া হয়নি। গ্রেফতারের পরদিন বিকেলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুরনো ঢাকার কোর্ট এবং রিমান্ডে সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট থানা পর্যন্তই ছিল দীর্ঘতম প্রিজন ভ্যান ভ্রমণ। আজকের তিন ঘণ্টার অভিজ্ঞতা সুখকর হলো না। ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং গরমের যুগপত্ আক্রমণে কাহিল অবস্থা।...
...প্রিজন ভ্যান ছুটে চললো কাশিমপুর জেল অভিমুখে। এর আগে এত দীর্ঘপথ প্রিজন ভ্যানে চড়া হয়নি। গ্রেফতারের পরদিন বিকেলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুরনো ঢাকার কোর্ট এবং রিমান্ডে সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট থানা পর্যন্তই ছিল দীর্ঘতম প্রিজন ভ্যান ভ্রমণ। আজকের তিন ঘণ্টার অভিজ্ঞতা সুখকর হলো না। ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং গরমের যুগপত্ আক্রমণে কাহিল অবস্থা।...
গত রাতেও যদি এই চালানের কথা জানা থাকত, তাহলে গোছগাছ করে রাখার পাশাপাশি চালানে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতিটা নিয়ে রাখতে পারতাম। জেল প্রশাসন কর্তৃক বন্দিদের নির্যাতনের এটাও একটা প্রক্রিয়া। যেমন আমি এখন অকূল পাথারে। মুক্তজীবনে বিদেশযাত্রার সময় স্ত্রী প্রতিবার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার, রুমাল পর্যন্ত কেনার অভ্যাস নেই। এই সকালবেলা আয়েশ করে চা পানের মাঝখানে আচমকা গৃহচ্যুতির সংবাদে মনটাও বেশ খারাপ হয়েছে। অজানা গন্তব্যে যাওয়ার অনিশ্চয়তা সম্ভবত যে কোনো মানুষকেই ভারাক্রান্ত করে তোলে। আজ আবার সাপ্তাহিক দেখার দিন, আইনজীবী সঙ্গে করে পারভীনের এগারোটায় আসার কথা ছিল। একশ’ টাকা জরিমানার পর বাসার কারও সঙ্গে দেখা হয়নি, মা কেমন আছেন তাও জানি না। সব মিলিয়ে একটু অসহায়ই বোধ হলো। বন্দিত্বের আসল জ্বালা এখানেই।
প্রতিবেশীদের সহায়তায় আধঘণ্টার মধ্যেই বাঁধা-ছাঁদা সম্পন্ন করলাম। আমার সেবক সালাহউদ্দিনের ব্যবহারের জন্যে অর্ধেক জিনিসই রেখে গেলাম। জয়নাল ভাই, ফয়সাল, মুকুল, ভাগ্নে মনির বিষণ্ন মনে বিদায় জানাল। এদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে কি-না জানি না। তবে যতদিন জীবিত থাকব, প্রত্যেকেই আমার স্মৃতির অংশ হয়ে থাকবেন। সালাহউদ্দিন এবং সাত নম্বর সেলের এজমালি সেবক আকাশ ব্যাগ ঘাড়ে আমাকে জেলগেট পর্যন্ত পৌঁছে দিল। দু’জনই অঝোরে কাঁদছে। আকাশ থেমে থেমে বলে উঠছে—এটা অন্যায়, কাজটা এরা ভালো করল না। স্নেহের ধমক দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে সালাহউদ্দিন আর আকাশের কান্না থামালাম। তারপর মুক্তজীবনে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জেলগেটে প্রবেশ করলাম। পেছনে পড়ে রইল ঢাকা জেলে সাড়ে চার মাসের ঘটনাবহুল, বিচিত্র বন্দিজীবন। সুবেদার ফজলু আমাকে নিয়ে ডেপুটি জেলারদের অফিসে ঢুকলো। সেখানে পিসির হিসাব মেটানোতে কিছুটা সময় লাগল। এক ফাঁকে ডেপুটি জেলার মাসুম আনুষ্ঠানিকভাবে কাশিমপুর জেলে পাঠানোর সংবাদ দিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিত্সক ডা. শামসুদ্দিন ও ডা. রফিক ওখানেই দেখা করতে এলেন।
আমাকে প্রিজন ভ্যানে করে কাশিমপুর পাঠানোর যে বন্দোবস্ত কারা কর্তৃপক্ষ করেছে, তাতে সবারই দেখলাম মন খারাপ। কিন্তু কিছু করার নেই। আইজি এবং সুপার মিলে সব আয়োজন করেছেন। বিদায়কালেও সুপার কিংবা জেলার সৌজন্যের খাতিরেও আমার সঙ্গে দেখা করার কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না। এরা বোধহয় ভেবেছেন প্রিজন ভ্যানে পাঠিয়ে আমাকে শায়েস্তা করবেন। মূর্খরা এখনও আমাকে পুরোপুরি চিনে উঠতে পারেনি। নোংরা, দুর্গন্ধময় প্রিজন ভ্যানে উঠে দেখলাম, আমার মালপত্র ভ্যানের মেঝেয় সারিবদ্ধভাবে আগেই রাখা আছে। প্রিজন ভ্যান একটু এগোতেই রাস্তার পাশে পারভীনের গাড়ি দাঁড়ানো দেখে আশ্বস্ত হলাম। গাড়ির সামনে চালক সানোয়ার দাঁড়িয়ে আছে, কাচ বন্ধ থাকায় ভেতরে বসে থাকা স্ত্রীকে দেখা সম্ভব হলো না। ঘুলঘুলির কাছে গিয়ে হাত নাড়লাম হয়তো ওরা দেখতে পাবে এই ভরসায়। সানোয়ার আমাকে ঠিকই দেখতে পেয়ে সালামের ভঙ্গিতে কপালে হাত ছোঁয়ালো।
প্রিজন ভ্যান ছুটে চললো কাশিমপুর জেল অভিমুখে। এর আগে এত দীর্ঘপথ প্রিজন ভ্যানে চড়া হয়নি। গ্রেফতারের পরদিন বিকেলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুরনো ঢাকার কোর্ট এবং রিমান্ডে সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট থানা পর্যন্তই ছিল দীর্ঘতম প্রিজন ভ্যান ভ্রমণ। আজকের তিন ঘণ্টার অভিজ্ঞতা সুখকর হলো না। ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং গরমের যুগপত্ আক্রমণে কাহিল অবস্থা। শরীর বেয়ে অবিরত ঘাম ঝরছে। সঙ্গে পানি দেয়নি যে, একটু গলায় ঢালব। তবে অতিরিক্ত ঘামার ফলে যাত্রাপথের তিন ঘণ্টায় টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। গাড়ির ঝাঁকুনিতে কোমরের ব্যথা সর্বাঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে। দুপুর আড়াইটায় কাশিমপুরে একেবারে জেল গেটের ভেতরে প্রবেশ করে গাড়ি থামল।
মিনিট দশেক পার হয়ে গেছে। প্রিজন ভ্যানের ভেতরে বসে বসে ঘামছি। কী কারণে জানি না, দরজার তালা খুলতে বেশ দেরি হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রক্ষী একজন এসে তালা খুললে প্রথমবারের মতো পা রাখলাম কাশিমপুর জেলের মাটিতে। সরকারি পোশাক পরিহিত অপেক্ষমাণ একজন স্মার্ট ব্যক্তি হাসিমুখে স্যালুট দিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দনের ফাঁকে বুকের ওপর লেখা নামটার দিকে চোখ রাখলাম। ভদ্রলোক সুবেদার সাত্তার, কাশিমপুর দুই নম্বর জেলের বড় সুবেদার। দ্বিতীয় ফটক পার হয়ে জেলের ভেতরে ঢুকতেই আরও একজন দীর্ঘদেহী তরুণ সালাম দিয়ে জানালো, সে ডেপুটি জেলার ফারুক। অভ্যর্থনা এ পর্যন্ত মন্দ হলো না। নাজিমউদ্দীন রোডের জেলখানায় প্রথম রাতে হয়রানির চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এখানকার প্রশাসন এখন পর্যন্ত সৌজন্যই দেখাচ্ছে। চারদিকের গাছপালা, সবুজের সমারোহ আর উঁচু ইমারত দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। পথিমধ্যে জানলাম, কাশিমপুরে চারটি কারাগার রয়েছে। কাশিমপুর এক এবং দুই পুরুষ ও কাশিমপুর তিন মহিলা বন্দিদের জন্যে নির্ধারিত। কাশিমপুর চার এখনও চালু হয়নি। হাই সিকিউরিটির এই প্রিজনে টপ টেরর, কথিত ইসলামী জঙ্গি ও অন্য সন্ত্রাসীদের রাখা হবে।
আমার নির্ধারিত বাসস্থানে এসে থমকে দাঁড়ালাম। তিন তলা ভবনের গায়ে লেখা সাত নম্বর ব্যারাক। অবাক কাণ্ড, সাত নম্বর সেল থেকে সাত নম্বর ব্যারাক। অবশ্য নামে মিল নেই। ঢাকা জেলে ছিল ‘বকুল’, আর এখানে ‘সুরমা’। বিস্ময়ের তখনও বাকি ছিল। তিন তলার যে সেলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো, তারও নম্বর সাত। অর্থাত্ আমার বর্তমান ঠিকানা ৭ বাই ৭, কাশিমপুর দুই নম্বর জেল। সেলে ঢুকে আমি রীতিমত মুগ্ধ। সারাদিনের বিরক্তি নিমেষে উধাও। বিশাল ঘরের মাপ অন্তত ৩০ ফুট বাই ২০ ফুট, বড় বড় জানালা ছয়টি। যেদিকে তাকাই, অবারিত প্রকৃতি। যথেষ্ট আব্রুসম্মত টয়লেট কাম বাথরুম। হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে চমত্কার বেসিন, সামনে আবার আয়নাও রয়েছে। ঢাকার মতো মাটিতে বসে আর দাড়ি কামাতে হবে না ভেবে স্বস্তিবোধ করলাম। সবচেয়ে আনন্দের কথা, টয়লেটে প্যানের পরিবর্তে কমোড। যাদেরই আমার মতো কোমরে হাড়ক্ষয়ের সমস্যা রয়েছে, তারাই এই তফাতের মর্ম বুঝবেন। গত সাড়ে চার মাসে প্যান ব্যবহারের কসরত আর কহতব্য নয়। আইজি আশরাফুল ইসলাম খান আমাকে শায়েস্তা করতে দেখি পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়ে এলেন! বেঁচে থাকো বাবা।
ঘরের মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার দেখে একটু বিচলিত বোধ করে হেতু জানতে চাইলাম। তখনই শুনলাম, ক’দিন আগপর্যন্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর এখানেই থাকতেন। এক-এগারোর সরকার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ভদ্রলোকের ওপর অমানবিক অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় লুত্ফুজ্জামান বাবরকে প্রায়ই অক্সিজেন নিতে হয়। নির্বাচিত সরকারের এই ‘গণতান্ত্রিক’ আচরণের নমুনাটিকে পাশের সেলে স্থানান্তরের অনুরোধ করামাত্র পালন করা হলো। লুত্ফুজ্জামান বাবরকে যারা দেখা-শোনা করতো, রেঁধে খাওয়াত, আমার জন্যেও তাদেরই নিয়োগ দেয়া হলো। সেবকদ্বয় কালাম ও শফিক এবং পাচক শুকুর মাহমুদ। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা তিনটে পেরিয়েছে। সকালে নাস্তার পর থেকে এক ফোঁটা পানিও জোটেনি। একটু চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে জোহরের নামাজ পড়তে বসে গেলাম। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় শেষ করার আগেই জেলগেট থেকে কারারক্ষী দেখার সংবাদ নিয়ে এলো। বিস্ময় এবং আনন্দের সঙ্গে বুঝলাম, পারভীন আজই এখানে চলে এসেছে।
একজন ডেপুটি জেলারের অফিস কক্ষে দেখার আয়োজন করা হয়েছে। পৌঁছে দেখলাম, পারভীন শুকনো মুখে বসে আছে। সরকারের হিংস্রতা দেখা হয়ে গেছে, তাই পারভীন আমার এখানে আসার ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারেনি। ভেবেছে আবারও নির্যাতন করার জন্যে আমাকে হয়তো কোনো অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাশিমপুর জেলে এসে প্রাথমিকভাবে আমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পায়নি। ঘণ্টা দুয়েক গাড়িতে বসে অপেক্ষা করার পরই কেবল অনুমতি মিলেছে। আজ সকালে আমার দেশ-এর পরিচালক কৃষিবিদ আনোয়ারুন্নবী মজুমদার বাবলা এবং প্রকৌশলী রিজুকে নিয়ে ঢাকা জেলে যাওয়ার পর সেখানে পারভীন আমার চালানের বিষয়টি জানতে পারে। তারপর আমার প্রিজন ভ্যান অনুসরণ করে কাশিমপুরে এসেছে। নাজিমউদ্দীন রোডে গাড়ির ভেতরে বসে আমার হাত নাড়াও দেখতে পেয়েছে। স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে ঢাকার সাত নম্বর সেলের তুলনায় এখানকার রাজকীয় বন্দোবস্তের কথা বললাম। আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে পারভীন বুঝতে চাইল কথাগুলো আমি আন্তরিকভাবে বলছি কি-না। বারকয়েক আশ্বস্ত করার পর মনে হলো ঘরণী শান্ত হয়েছে।
বন্ধুবর বাবলু ১১ তারিখে আমার জেলজীবনের প্রথম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি কথামত পারভীনের হাতে দিয়েছে। সে রাতে না ঘুমিয়ে আমার অস্পষ্ট হাতের লেখা কষ্ট করে পড়েছে এবং সারা রাতই কেঁদেছে। পারভীন প্রচুর বই-পত্র পড়ে। ভাবলাম, একবার জিজ্ঞেস করি সাহিত্যমানে লেখাটা উেরছে কি-না। পরক্ষণেই মনে হলো, কোনো লাভ নেই। কারণ, আমার সামনে ব্যাকুল মুখ নিয়ে বসে থাকা মধ্যবয়সিনী নারী আমার জায়া, তিনি কোনো নির্মোহ পাঠিকা নন। নতুন জেল আর ঘর-সংসারের দু’চারটে কথা বলতেই আধঘণ্টা পার হয়ে গেল। আমাদের সিরামিক কোম্পানির অফিস উত্তরায় এবং কারখানাটি গাজীপুরের বাঘের বাজারে। আমি কাশিমপুর আসায় পারভীনের বরং সুবিধাই হলো। সপ্তাহে অন্তত দু’টি দিন ওকে কারখানায় যেতে হয়। এখন থেকে তার মধ্যে যে কোনো একদিন আমাকে দেখে যেতে পারবে। পারভীনের দিনটা উদ্বেগের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও সমাপ্তিতে বেশ প্রশান্তি নিয়েই বাড়ি ফিরে গেল।
আর একটা কথা বলা হয়নি। ১৯৯৫ সালে পারভীন একটা ছোট মেলামাইন কারখানা করেছিল। ক্ল্যাসিক মেলামাইন নামের সেই কারখানা কাশিমপুর জেলের একেবারে কাছেই। সেই সময় আসা-যাওয়ার পথে এই জেল নির্মিত হতে দেখেছি। তবে কখনও ভাবিনি একদিন আমাকে কয়েদি হয়ে এই জেলেই থাকতে হবে। পারভীনও ভাবেনি জেলের বিশাল দরজার সামনে তাকে উদ্বিগ্নচিত্তে অপেক্ষা করতে হবে কখন বন্দি স্বামীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মিলবে। এরই নাম বোধহয় অনিশ্চিত জীবন। সেই মেলামাইন কারখানার বিক্রিলব্ধ আয় দিয়েই পরে আমরা আর্টিজান সিরামিক বানিয়েছি। কাশিমপুর জেলের প্রথম সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান দেয়ার আগেই জমাদার লক-আপ করতে চলে এলে কিছুটা বিস্মিত হলেও প্রতিবাদ করলাম না। রোজার মাস থেকে ঢাকা জেলে আমি না বলা পর্যন্ত সেখানকার কর্তৃপক্ষ লক-আপ করত না। ছ’টার মধ্যে অন্য সবাই সেলে ঢুকে পড়লে আমি বারান্দায় পায়চারি করতাম। ভাবলাম, এখানে বুঝি এটাই দস্তুর। আমার অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা নেই। সেল তো প্রায় ফুটবল খেলার মাঠ। রাতে হাঁটাহাঁটি করতে ইচ্ছে হলে জায়গার অভাব হবে না। রাত আটটায় আবার লক-আপ খোলা হলো আমার রাতের আহার পর্ব সাঙ্গ করার জন্য। সেবক কালাম খাওয়া শেষে মশারি টাঙিয়ে দিলে একটা বই হাতে শুতে গেলাম। সুখে-দুঃখে কাশিমপুরের প্রথম দিন মন্দ কাটল না।
প্রতিবেশীদের সহায়তায় আধঘণ্টার মধ্যেই বাঁধা-ছাঁদা সম্পন্ন করলাম। আমার সেবক সালাহউদ্দিনের ব্যবহারের জন্যে অর্ধেক জিনিসই রেখে গেলাম। জয়নাল ভাই, ফয়সাল, মুকুল, ভাগ্নে মনির বিষণ্ন মনে বিদায় জানাল। এদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে কি-না জানি না। তবে যতদিন জীবিত থাকব, প্রত্যেকেই আমার স্মৃতির অংশ হয়ে থাকবেন। সালাহউদ্দিন এবং সাত নম্বর সেলের এজমালি সেবক আকাশ ব্যাগ ঘাড়ে আমাকে জেলগেট পর্যন্ত পৌঁছে দিল। দু’জনই অঝোরে কাঁদছে। আকাশ থেমে থেমে বলে উঠছে—এটা অন্যায়, কাজটা এরা ভালো করল না। স্নেহের ধমক দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে সালাহউদ্দিন আর আকাশের কান্না থামালাম। তারপর মুক্তজীবনে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জেলগেটে প্রবেশ করলাম। পেছনে পড়ে রইল ঢাকা জেলে সাড়ে চার মাসের ঘটনাবহুল, বিচিত্র বন্দিজীবন। সুবেদার ফজলু আমাকে নিয়ে ডেপুটি জেলারদের অফিসে ঢুকলো। সেখানে পিসির হিসাব মেটানোতে কিছুটা সময় লাগল। এক ফাঁকে ডেপুটি জেলার মাসুম আনুষ্ঠানিকভাবে কাশিমপুর জেলে পাঠানোর সংবাদ দিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিত্সক ডা. শামসুদ্দিন ও ডা. রফিক ওখানেই দেখা করতে এলেন।
আমাকে প্রিজন ভ্যানে করে কাশিমপুর পাঠানোর যে বন্দোবস্ত কারা কর্তৃপক্ষ করেছে, তাতে সবারই দেখলাম মন খারাপ। কিন্তু কিছু করার নেই। আইজি এবং সুপার মিলে সব আয়োজন করেছেন। বিদায়কালেও সুপার কিংবা জেলার সৌজন্যের খাতিরেও আমার সঙ্গে দেখা করার কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না। এরা বোধহয় ভেবেছেন প্রিজন ভ্যানে পাঠিয়ে আমাকে শায়েস্তা করবেন। মূর্খরা এখনও আমাকে পুরোপুরি চিনে উঠতে পারেনি। নোংরা, দুর্গন্ধময় প্রিজন ভ্যানে উঠে দেখলাম, আমার মালপত্র ভ্যানের মেঝেয় সারিবদ্ধভাবে আগেই রাখা আছে। প্রিজন ভ্যান একটু এগোতেই রাস্তার পাশে পারভীনের গাড়ি দাঁড়ানো দেখে আশ্বস্ত হলাম। গাড়ির সামনে চালক সানোয়ার দাঁড়িয়ে আছে, কাচ বন্ধ থাকায় ভেতরে বসে থাকা স্ত্রীকে দেখা সম্ভব হলো না। ঘুলঘুলির কাছে গিয়ে হাত নাড়লাম হয়তো ওরা দেখতে পাবে এই ভরসায়। সানোয়ার আমাকে ঠিকই দেখতে পেয়ে সালামের ভঙ্গিতে কপালে হাত ছোঁয়ালো।
প্রিজন ভ্যান ছুটে চললো কাশিমপুর জেল অভিমুখে। এর আগে এত দীর্ঘপথ প্রিজন ভ্যানে চড়া হয়নি। গ্রেফতারের পরদিন বিকেলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুরনো ঢাকার কোর্ট এবং রিমান্ডে সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট থানা পর্যন্তই ছিল দীর্ঘতম প্রিজন ভ্যান ভ্রমণ। আজকের তিন ঘণ্টার অভিজ্ঞতা সুখকর হলো না। ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং গরমের যুগপত্ আক্রমণে কাহিল অবস্থা। শরীর বেয়ে অবিরত ঘাম ঝরছে। সঙ্গে পানি দেয়নি যে, একটু গলায় ঢালব। তবে অতিরিক্ত ঘামার ফলে যাত্রাপথের তিন ঘণ্টায় টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। গাড়ির ঝাঁকুনিতে কোমরের ব্যথা সর্বাঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে। দুপুর আড়াইটায় কাশিমপুরে একেবারে জেল গেটের ভেতরে প্রবেশ করে গাড়ি থামল।
মিনিট দশেক পার হয়ে গেছে। প্রিজন ভ্যানের ভেতরে বসে বসে ঘামছি। কী কারণে জানি না, দরজার তালা খুলতে বেশ দেরি হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রক্ষী একজন এসে তালা খুললে প্রথমবারের মতো পা রাখলাম কাশিমপুর জেলের মাটিতে। সরকারি পোশাক পরিহিত অপেক্ষমাণ একজন স্মার্ট ব্যক্তি হাসিমুখে স্যালুট দিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দনের ফাঁকে বুকের ওপর লেখা নামটার দিকে চোখ রাখলাম। ভদ্রলোক সুবেদার সাত্তার, কাশিমপুর দুই নম্বর জেলের বড় সুবেদার। দ্বিতীয় ফটক পার হয়ে জেলের ভেতরে ঢুকতেই আরও একজন দীর্ঘদেহী তরুণ সালাম দিয়ে জানালো, সে ডেপুটি জেলার ফারুক। অভ্যর্থনা এ পর্যন্ত মন্দ হলো না। নাজিমউদ্দীন রোডের জেলখানায় প্রথম রাতে হয়রানির চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এখানকার প্রশাসন এখন পর্যন্ত সৌজন্যই দেখাচ্ছে। চারদিকের গাছপালা, সবুজের সমারোহ আর উঁচু ইমারত দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। পথিমধ্যে জানলাম, কাশিমপুরে চারটি কারাগার রয়েছে। কাশিমপুর এক এবং দুই পুরুষ ও কাশিমপুর তিন মহিলা বন্দিদের জন্যে নির্ধারিত। কাশিমপুর চার এখনও চালু হয়নি। হাই সিকিউরিটির এই প্রিজনে টপ টেরর, কথিত ইসলামী জঙ্গি ও অন্য সন্ত্রাসীদের রাখা হবে।
আমার নির্ধারিত বাসস্থানে এসে থমকে দাঁড়ালাম। তিন তলা ভবনের গায়ে লেখা সাত নম্বর ব্যারাক। অবাক কাণ্ড, সাত নম্বর সেল থেকে সাত নম্বর ব্যারাক। অবশ্য নামে মিল নেই। ঢাকা জেলে ছিল ‘বকুল’, আর এখানে ‘সুরমা’। বিস্ময়ের তখনও বাকি ছিল। তিন তলার যে সেলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো, তারও নম্বর সাত। অর্থাত্ আমার বর্তমান ঠিকানা ৭ বাই ৭, কাশিমপুর দুই নম্বর জেল। সেলে ঢুকে আমি রীতিমত মুগ্ধ। সারাদিনের বিরক্তি নিমেষে উধাও। বিশাল ঘরের মাপ অন্তত ৩০ ফুট বাই ২০ ফুট, বড় বড় জানালা ছয়টি। যেদিকে তাকাই, অবারিত প্রকৃতি। যথেষ্ট আব্রুসম্মত টয়লেট কাম বাথরুম। হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে চমত্কার বেসিন, সামনে আবার আয়নাও রয়েছে। ঢাকার মতো মাটিতে বসে আর দাড়ি কামাতে হবে না ভেবে স্বস্তিবোধ করলাম। সবচেয়ে আনন্দের কথা, টয়লেটে প্যানের পরিবর্তে কমোড। যাদেরই আমার মতো কোমরে হাড়ক্ষয়ের সমস্যা রয়েছে, তারাই এই তফাতের মর্ম বুঝবেন। গত সাড়ে চার মাসে প্যান ব্যবহারের কসরত আর কহতব্য নয়। আইজি আশরাফুল ইসলাম খান আমাকে শায়েস্তা করতে দেখি পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়ে এলেন! বেঁচে থাকো বাবা।
ঘরের মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার দেখে একটু বিচলিত বোধ করে হেতু জানতে চাইলাম। তখনই শুনলাম, ক’দিন আগপর্যন্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর এখানেই থাকতেন। এক-এগারোর সরকার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ভদ্রলোকের ওপর অমানবিক অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় লুত্ফুজ্জামান বাবরকে প্রায়ই অক্সিজেন নিতে হয়। নির্বাচিত সরকারের এই ‘গণতান্ত্রিক’ আচরণের নমুনাটিকে পাশের সেলে স্থানান্তরের অনুরোধ করামাত্র পালন করা হলো। লুত্ফুজ্জামান বাবরকে যারা দেখা-শোনা করতো, রেঁধে খাওয়াত, আমার জন্যেও তাদেরই নিয়োগ দেয়া হলো। সেবকদ্বয় কালাম ও শফিক এবং পাচক শুকুর মাহমুদ। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা তিনটে পেরিয়েছে। সকালে নাস্তার পর থেকে এক ফোঁটা পানিও জোটেনি। একটু চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে জোহরের নামাজ পড়তে বসে গেলাম। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় শেষ করার আগেই জেলগেট থেকে কারারক্ষী দেখার সংবাদ নিয়ে এলো। বিস্ময় এবং আনন্দের সঙ্গে বুঝলাম, পারভীন আজই এখানে চলে এসেছে।
একজন ডেপুটি জেলারের অফিস কক্ষে দেখার আয়োজন করা হয়েছে। পৌঁছে দেখলাম, পারভীন শুকনো মুখে বসে আছে। সরকারের হিংস্রতা দেখা হয়ে গেছে, তাই পারভীন আমার এখানে আসার ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারেনি। ভেবেছে আবারও নির্যাতন করার জন্যে আমাকে হয়তো কোনো অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাশিমপুর জেলে এসে প্রাথমিকভাবে আমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পায়নি। ঘণ্টা দুয়েক গাড়িতে বসে অপেক্ষা করার পরই কেবল অনুমতি মিলেছে। আজ সকালে আমার দেশ-এর পরিচালক কৃষিবিদ আনোয়ারুন্নবী মজুমদার বাবলা এবং প্রকৌশলী রিজুকে নিয়ে ঢাকা জেলে যাওয়ার পর সেখানে পারভীন আমার চালানের বিষয়টি জানতে পারে। তারপর আমার প্রিজন ভ্যান অনুসরণ করে কাশিমপুরে এসেছে। নাজিমউদ্দীন রোডে গাড়ির ভেতরে বসে আমার হাত নাড়াও দেখতে পেয়েছে। স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে ঢাকার সাত নম্বর সেলের তুলনায় এখানকার রাজকীয় বন্দোবস্তের কথা বললাম। আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে পারভীন বুঝতে চাইল কথাগুলো আমি আন্তরিকভাবে বলছি কি-না। বারকয়েক আশ্বস্ত করার পর মনে হলো ঘরণী শান্ত হয়েছে।
বন্ধুবর বাবলু ১১ তারিখে আমার জেলজীবনের প্রথম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি কথামত পারভীনের হাতে দিয়েছে। সে রাতে না ঘুমিয়ে আমার অস্পষ্ট হাতের লেখা কষ্ট করে পড়েছে এবং সারা রাতই কেঁদেছে। পারভীন প্রচুর বই-পত্র পড়ে। ভাবলাম, একবার জিজ্ঞেস করি সাহিত্যমানে লেখাটা উেরছে কি-না। পরক্ষণেই মনে হলো, কোনো লাভ নেই। কারণ, আমার সামনে ব্যাকুল মুখ নিয়ে বসে থাকা মধ্যবয়সিনী নারী আমার জায়া, তিনি কোনো নির্মোহ পাঠিকা নন। নতুন জেল আর ঘর-সংসারের দু’চারটে কথা বলতেই আধঘণ্টা পার হয়ে গেল। আমাদের সিরামিক কোম্পানির অফিস উত্তরায় এবং কারখানাটি গাজীপুরের বাঘের বাজারে। আমি কাশিমপুর আসায় পারভীনের বরং সুবিধাই হলো। সপ্তাহে অন্তত দু’টি দিন ওকে কারখানায় যেতে হয়। এখন থেকে তার মধ্যে যে কোনো একদিন আমাকে দেখে যেতে পারবে। পারভীনের দিনটা উদ্বেগের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও সমাপ্তিতে বেশ প্রশান্তি নিয়েই বাড়ি ফিরে গেল।
আর একটা কথা বলা হয়নি। ১৯৯৫ সালে পারভীন একটা ছোট মেলামাইন কারখানা করেছিল। ক্ল্যাসিক মেলামাইন নামের সেই কারখানা কাশিমপুর জেলের একেবারে কাছেই। সেই সময় আসা-যাওয়ার পথে এই জেল নির্মিত হতে দেখেছি। তবে কখনও ভাবিনি একদিন আমাকে কয়েদি হয়ে এই জেলেই থাকতে হবে। পারভীনও ভাবেনি জেলের বিশাল দরজার সামনে তাকে উদ্বিগ্নচিত্তে অপেক্ষা করতে হবে কখন বন্দি স্বামীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মিলবে। এরই নাম বোধহয় অনিশ্চিত জীবন। সেই মেলামাইন কারখানার বিক্রিলব্ধ আয় দিয়েই পরে আমরা আর্টিজান সিরামিক বানিয়েছি। কাশিমপুর জেলের প্রথম সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান দেয়ার আগেই জমাদার লক-আপ করতে চলে এলে কিছুটা বিস্মিত হলেও প্রতিবাদ করলাম না। রোজার মাস থেকে ঢাকা জেলে আমি না বলা পর্যন্ত সেখানকার কর্তৃপক্ষ লক-আপ করত না। ছ’টার মধ্যে অন্য সবাই সেলে ঢুকে পড়লে আমি বারান্দায় পায়চারি করতাম। ভাবলাম, এখানে বুঝি এটাই দস্তুর। আমার অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা নেই। সেল তো প্রায় ফুটবল খেলার মাঠ। রাতে হাঁটাহাঁটি করতে ইচ্ছে হলে জায়গার অভাব হবে না। রাত আটটায় আবার লক-আপ খোলা হলো আমার রাতের আহার পর্ব সাঙ্গ করার জন্য। সেবক কালাম খাওয়া শেষে মশারি টাঙিয়ে দিলে একটা বই হাতে শুতে গেলাম। সুখে-দুঃখে কাশিমপুরের প্রথম দিন মন্দ কাটল না।
No comments