মাহমুদুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনঃ দেশপ্রেমিক হলে দেশের স্বার্থ দেখুন
কাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তার দেশের মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রভাবশালী আমলাদের এক বিরাট দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সেই সফরসঙ্গীদের মধ্যে বাংলাদেশসংলগ্ন রাজ্যগুলোসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও রয়েছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সফরকে উপলক্ষ করেই সাপ্তাহিক লেখাটা বুধবারের পরিবর্তে দু’দিন এগিয়ে আনতে হলো। দেশের দীর্ঘমেয়াদি অনিষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারকসহ দেশবাসীর চৈতন্যোদয়ের সর্বশেষ ব্যক্তিগত, ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হিসেবেই আমার আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন।
শক্তিধর ও আগ্রাসী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের এই সফর নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি মহলে অনেক দিন ধরেই সাজ সাজ রব চলছে। এ দেশের ভারতপ্রেমীরাও তাদের আরাধ্য দেবতাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ব্যাকুলচিত্তে অপেক্ষমাণ। এই সফরে বাংলাদেশ কী কী অর্জন করবে, তার বায়বীয় হিসাবও আগ বাড়িয়ে পরজীবী সুশীল (?)রা করে চলেছেন।
ট্রানজিটের মোড়কে ভারতকে করিডোর দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর আষাঢ়ে গল্প এই চিহ্নিত গোষ্ঠী বিগত প্রায় দুই দশক ধরে ফেরি করে কার্যোদ্ধারের পর ইদানীং পিঠ বাঁচানোর জন্য কিছুটা ভিন্ন সুরে গান গাইছেন। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নিয়ে লেখার আগে সোজাসাপটা বলে রাখছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিতে নয়, তিনি বাংলাদেশ থেকে নিতে আসছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এক ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা ছাড়া সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীকে ওরা কখনও কিছু দেয়নি।
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানের পেছনেও তাদের রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থচিন্তা কাজ করেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে পূর্ববঙ্গের সম্পদে লুটেরা সাম্রাজ্যবাদীদের রাজধানী কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। প্রধানত, উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদারশ্রেণী এপার থেকে কৃষকের হাড়-মাংস নিংড়ে খাজনা আদায় করে ওপারে প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন, বাবু সংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়েছেন। তত্কালীন পূর্ববঙ্গকে মূলত, কাঁচামাল এবং খাদ্যশস্য সরবরাহকারী হিন্টারল্যান্ড (hinterland) বা পশ্চাত্প্রদেশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্ববঙ্গের দরিদ্র কৃষকের সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ন্যূনতম সুযোগও যাতে না পায়, সেই লক্ষ্যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ কলকাতার ব্রাহ্মণ বাবু সমাজ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও ঘোরতর বিরোধিতা করেছিলেন।
পাকিস্তান আমলে গঙ্গার জলপ্রবাহ আটকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশকে ক্রমশঃ মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য। ১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে আমদানি-রফতানির সুবিধার্থে ভারত সরকারের কাছে সাময়িকভাবে কলকাতা বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব করলে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু অবজ্ঞাভরে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন,
"It is a strange demand from a peculiar country. A passage to go to their own country through a foreign country, it is unprecedented." (এটা এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের আজব দাবি। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের ভেতর দিয়ে তাদের দেশে যাওয়ার জন্য পথ, এটা নজিরবিহীন।)
আজ সেই পণ্ডিত নেহরুর বর্তমান প্রজন্ম বাংলাদেশের কাছে একাধিক চিরস্থায়ী করিডোর প্রাপ্তির আজবতর দাবি করতে এতটুকু লজ্জাবোধ করছে না, এটাই আশ্চর্য!
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মাত্র ক’দিন আগে আমরা যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত স্বার্থ বিকিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার সাধ্যমত বিরোধিতা করছি, তাদেরকে ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ বলে গাল দিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে আগামী দু’দিনের আনুষ্ঠানিক আলোচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখের সামনে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে তার উদ্ধৃত বক্তব্যের জন্য একইভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীন বলতে পারলে আমরা অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর নৈতিক দৃঢ়তা ও সাহসের প্রশংসা করব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মতিতে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে বিগত তিন যুগে এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ অংশকে প্রায় শুষ্ক করে ফেলেছে পরম ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত। সত্তরের দশকে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে মহান প্রতিবেশী ভারত তথাকথিত ‘শান্তি বাহিনী’ তৈরি করেছিল ওই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাস উসকে দেয়ার জন্য। ভারত সরকার প্ররোচিত এবং পরিচালিত সেই সন্ত্রাসী তত্পরতায় বাংলাদেশের কত বাঙালি ও পাহাড়ি বেসামরিক নাগরিক এবং আমাদের সেনাবাহিনীর কত সদস্যের প্রাণ গেছে, তার হিসাব আমরা ক’জনই বা রাখি!
শেখ হাসিনার আগের আমলে ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যাকাণ্ড কমে এলেও ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে অসহায় বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা আগের মতোই সমানতালে চলছে। গুলি করে, পিটিয়ে, তীর ও পাথর ছুঁড়ে অথবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সপ্তাহে গড়ে অন্তত দু’জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধের পর এবার সিলেট সীমান্তের ওপারে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের তোড়জোড় চলছে বাংলাদেশের অপর এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিণত করার উদ্দেশ্যে। একই অঞ্চলে সারি নদীর (ভারতে মাইনথ্রু নদী) উজানে বাঁধ দিয়ে জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের পরিবেশকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করা হয়েছে। গত তিন যুগে পদ্মা বেসিন শুকিয়ে যাওয়ার পর আগামী তিরিশ বছরে মেঘনা বেসিনের জন্যও একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। এদিকে তিস্তা নদীর পানিচুক্তি নিয়েও প্রতিদিন পরস্পরবিরোধী খবর শুনতে পাচ্ছি।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এমন প্রেক্ষাপটেই কাল বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখছেন আমাদের সম্মানিত অতিথি ড. মনমোহন সিং। ২০১০ সালের মার্চে ভারত সফরে গিয়ে সে দেশের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং দলীয় ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যে যে একতরফা চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে এসেছেন, সেগুলোকে পাকাপোক্ত করে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য করার জন্যই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে আগমন। এই কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে তার প্রতিফল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোগ করতে হবে। গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের এই ভয়ানক বিপদের বিষয়ে জনগণকে অব্যাহতভাবে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার যে সমস্ত অনিষ্পন্ন সমস্যা রয়েছে, তার সবগুলো নিয়ে আলোচনা একটি মাত্র মন্তব্য প্রতিবেদনে সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। আজ আমি কেবল ট্রানজিট, পানি আগ্রাসন, বাণিজ্য ঘাটতি এবং সীমান্ত হত্যার মধ্যেই আমার লেখা সীমিত রাখব।
১। ট্রানজিট :
গত মাসেরই ৩ তারিখে ‘ভারতের ট্রানজিটে বাংলাদেশের ফায়দা নাই’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদনে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ট্রানজিট প্রদানের পক্ষে বাংলাদেশে জনমত তৈরিতে ভারতপন্থী, পরজীবী বুদ্ধিজীবী ও সুশীল (?) সমাজের অপতত্পরতার বিষয়ে লিখেছিলাম। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী এই কর্মকাণ্ড এ দেশে বিগত প্রায় দুই দশক ধরে চালানো হচ্ছে। জনমত বিভ্রান্ত করার অপকর্মে এই মেয়াদে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাগণ।
গত মাসের ২৫ তারিখে আওয়ামীপন্থী বিএফইউজে ও ডিইউজে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ট্রানজিট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দুটো মন্তব্য করেছেন। সেখানে তিনি দাবি করেন জিয়াউর রহমানের আমলেই নাকি ট্রানজিট কাঠামো তৈরি হয় এবং সেই দলিলে সই করেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের তত্কালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী ও প্রণব মুখার্জী। ট্রানজিট প্রদান প্রসঙ্গে তিনি একই অনুষ্ঠানে আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, ট্রানজিট চুক্তি হবে না। কারণ, এখনও অবকাঠামো বা রাস্তাঘাট ঠিক হয়নি।’ ট্রানজিট প্রসঙ্গে ইতিহাস বিকৃত করে জিয়াউর রহমানকে টেনে আনার ব্যাপারটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শেখ হাসিনা সম্ভবত উপলব্ধি করছেন যে, ভারতকে ট্রানজিট দেয়াটা জাতীয় স্বার্থবিরোধী হচ্ছে এবং সেই কারণেই এর দায়-দায়িত্ব তিনি মরহুম জিয়াউর রহমানের কাঁধে চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। তিনি যদি সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের প্রকৃতই লাভ হবে, তাহলে সেই কৃতিত্ব অবশ্যই তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দিতেন অথবা নিজে গ্রহণ করতেন। দুর্ভাগ্যবশত তারই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী প্রধানমন্ত্রীর নতুন ইতিহাস আবিষ্কারের আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে ডুবিয়ে ছেড়েছেন। ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘‘নতুন কোনো চুক্তি ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হবে। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতেই ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা বলা আছে। আমরা এখন সেই চুক্তিই বাস্তবায়ন করব। নতুন কোনো চুক্তি বা প্রটোকল সইয়ের প্রয়োজন নেই।”
জিয়াউর রহমানের ওপর ট্রানজিটের দায়-দায়িত্ব চাপানোর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অনৈতিক চেষ্টা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি উল্লেখের মাধ্যমে ব্যর্থ করে দিয়েছেন তারই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। তবে ড. গওহর রিজভীর তথ্যেও কিছু সংশোধনী প্রয়োজন। ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির তিন মাসের মধ্যেই। ১৯৭২ সালের মার্চের ২৯ তারিখে 'Trade agreement between the Government of India and the Government of Bangladesh' শিরোনামে নয়াদিল্লিতে যে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তার অত্ঃরপষব ৫ অর্থাত্ অনুচ্ছেদ ৫ এ বলা হয়েছে,
"The two Governments agree to make mutually beneficial arrangements for the use of their waterways, railways and roadways for commerce between the two countries and for passage of goods between two places in one country through the territory of the other."
(দুই সরকার এই মর্মে সম্মত হচ্ছে যে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহায়তা প্রদান এবং একটি দেশের এক অংশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের ভেতর দিয়ে সেই দেশের অপর অংশে পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে উভয় সরকার পারস্পরিক লাভালাভের ভিত্তিতে যার যার দেশের নৌপথ, রেলপথ এবং সড়ক পথ ব্যবহারোপযোগী করবে।)
দৃশ্যতই ভারতের একতরফা স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রণীত উপরিউক্ত চুক্তিতে সেই সময় স্বাক্ষর করেছিলেন দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীদ্বয় যথাক্রমে এম আর সিদ্দিকী এবং এলএন মিশ্র। দিল্লিতে স্বাক্ষরিত ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ১৯৭২-এর পুরনো চুক্তিকেই পোক্ত করেছিল। ১৯৭২ এবং ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত উভয় চুক্তির সর্বরকম দায়-দায়িত্ব অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে। এখানে জিয়াউর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের মহান সিপাহী জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে। এটাই প্রকৃত ইতিহাস। শেখ হাসিনা হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসের পন্থা অনুসরণ করে বার বার মিথ্যা বললেও সেই ইতিহাস পাল্টানো যাবে না। উল্লেখ্য, ভারতকে কোনো চুক্তি ব্যতিরেকেই এই মুহূর্তে ট্রানজিট দিতে উদগ্রীব ড. গওহর রিজভী এর আগে বলেছিলেন, “ভারতকে ট্রানজিট দিতে ৪০ বছর অপেক্ষা করেছি, আর অপেক্ষা করতে আমি রাজি নই।” বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ভাগ্য নির্ধারণে এই ব্যক্তিটি নিজেকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন কেন, সেটা বুঝতে আমি অক্ষম। লোকমুখে লোকটির নাম আমি প্রথম শুনি এক এগারোর সময়। ডিজিএফআই-এর তত্কালীন ডাকসাঁইটে কর্মকর্তা এবং বর্তমানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত আসামি মেজর জেনারেল (অব.) আমিন এই ড. গওহর রিজভীকে নিয়েই সেই সময় বিশেষ কারাগারে আটক শেখ হাসিনার সঙ্গে নানান কিসিমের দর কষাকষি সম্পন্ন করেছেন। হয়তো তার সেই সাফল্যের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে আসা ব্যক্তিটি পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত প্রভাবশালী পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা বনে গেছেন।
ড. গওহর রিজভী জনপ্রতিনিধি নন, এমনকি তার প্রকৃত নাগরিকত্ব নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী চল্লিশ বছরের মধ্যে তিনি ক’দিন বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন, তাও এ দেশের জনগণ জানে না। তার পরিবার-পরিজন সম্পর্কেও জাতি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এমন এক রহস্যময় চরিত্র আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে আজ ছিনিমিনি খেলছেন এবং দেখতে পাচ্ছি, দেশের ষোল কোটি জনতা সেই অনধিকার চর্চা বিনা প্রতিবাদে আবার মেনেও নিচ্ছে! ড. গওহর রিজভীর ট্রানজিটবিষয়ক সর্বশেষ বক্তব্যের তিনদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঢাকায় এক কর্মশালায় বলেছেন, “ট্রানজিট দেয়ার আগে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক হওয়ায় এগুলোর উন্নয়ন ছাড়া এখনই ট্রানজিট সম্ভব নয়।”
উপদেষ্টা কণ্টকিত বর্তমান সরকারের অপর এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান দিল্লি সফর শেষে ১৯ আগস্ট দেশে ফিরে বলেছিলেন, “মনমোহনের সফরের সময় ট্রানজিট নিয়ে কোনো চুক্তি হবে না। কারণ, ট্রানজিটের বিষয়ে দু’টি প্রটোকল ইতোমধ্যেই স্বাক্ষর হয়েছে।” এই মশিউর রহমানই এর আগে ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, ট্রানজিটের বিনিময়ে ফি দাবি করলে আমরা নাকি এক অসভ্য জাতিতে পরিণত হব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপুমনি অপ্রত্যাশিত মন্ত্রিত্ব লাভের পর থেকে তোতা পাখির মতো কানেক্টিভিটির গল্প আউড়ে ট্রানজিটের পক্ষে ওকালতি করেই চলেছেন। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের এই জাতীয় বিভ্রান্তিকর, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, তারা জাতিকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে দেশের স্বার্থ পুরোপুরি বিকিয়ে দিয়েই ভারতকে করিডোর দিতে আগ্রহী। ১৯৭২ সালের বাণিজ্য চুক্তিতে ‘পারস্পরিক লাভালাভের’ যে বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, তা থেকেও শেখ হাসিনা সরকার দৃশ্যত সরে এসেছেন। তাদের কাছে ব্যক্তিগত ও ভারতের লাভই বর্তমানে একমাত্র বিবেচ্য, বাংলাদেশের লাভের কোনো প্রয়োজন নেই। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে এ দেশের ষোল কোটি নাগরিকের ট্রানজিটের মোড়কে করিডোরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আমি দেশবাসীর কাছে পুনরায় সেই আহ্বানই জানাই।
২. পানি আগ্রাসন
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকেই বলে এসেছে তাদের বর্তমান মেয়াদের মধ্যেই ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন হবে। পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, সেই চুক্তির খসড়াও নাকি মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত করে ফেলেছে। বাংলাদেশের জনগণ অবশ্য এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এ ধরনের একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি হওয়ার আগে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নাগরিকের মধ্যে যে ধরনের মতবিনিময় করা হয়ে থাকে, তার কিছুই তিস্তা নদীর চুক্তির ক্ষেত্রে করা হয়নি। আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দিল্লিতে এ বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলাপ সেরে এসেছেন দুই উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী এবং ড. মশিউর রহমান। এদের মধ্যে কেউ পানি বিশেষজ্ঞ, এমন তথ্য আমার অন্তত জানা নেই। বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় সম্ভবত এখনও একজন পানিসম্পদ মন্ত্রী রয়েছেন। চুক্তির খসড়া প্রস্তুতে তার এবং তার মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাটাও কেউ জানে না। এই সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ প্রক্রিয়াতেই প্রণীত হতে যাচ্ছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি। ক্ষমতাসীনদের কর্মকাণ্ডদৃষ্টে কবি শামসুর রাহমানের সেই বহুল পরিচিত কবিতাটির বিখ্যাত পঙিক্তর কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’
পানি আগ্রাসন জায়েজ করতে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের কৌশলটাও চমত্কারভাবে কার্যকরী। ভাটির দেশের ন্যায্য হিস্যার কোনোরকম তোয়াক্কা না করে প্রথমে তারা আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করতে থাকে দীর্ঘদিন ধরে। কয়েক দশক এই অবস্থা চলার ফলে অসহায় ও দুর্বল ভাটি অঞ্চলের রাষ্ট্রের, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নদীসমূহ ভরাট হয়ে মরুকরণ প্রক্রিয়া অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর কোনোরকম একটা চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে তারা বাহবা নেয়। একই খেলা আমরা দেখেছি ফারাক্কা বাঁধের বেলায়। তিস্তার ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
এদিকে দু’দিন আগে বলা হলো, তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি নাকি ড. মনমোহনের সফরের সময় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের এজেন্ডা থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে। কূটনৈতিক মহলে শোনা গেল, আলোচনা থেকে তিস্তা চুক্তি বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন একজন অতি মাত্রায় ভারতপন্থী উপদেষ্টা। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী অবশ্য, তিস্তা পানিচুক্তি এজেন্ডায় ফেরত এসেছে। তবে সেই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পেতে যাচ্ছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আর এক অনিশ্চয়তা। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে গজলডোবা পয়েন্টে পানি ৫২:৪৮ হারে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। অপরদিকে বিবিসি রেডিওতে পশ্চিমবঙ্গের ওই এলাকার সাংসদ বলেছেন, বাংলাদেশ নাকি মাত্র ২৫ শতাংশ পানি পাবে। উল্লেখ্য, গজলডোবা পয়েন্টের আগেই অন্তত ডজনখানেক স্থান থেকে ভারত তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। অথচ এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চুপ, জনগণ অন্ধকারে। তিস্তা নিয়ে প্রতিদিন যেভাবে নাটকের স্ক্রিপ্টের পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে চুক্তি সই না হওয়া পর্যন্ত কোনোরকম ভরসা পাচ্ছি না।
যাই হোক, একদা নদীমাতৃক বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচাতে হলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান সফরের সময় আমাদের নিম্নোক্ত দাবিগুলো জোরের সঙ্গে, পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে :
১. গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ এবং তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি হয়েছে, ভারতকে তার যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২. অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে।
৩. টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বন্ধের ঘোষণা দিতে হবে।
৪. সীমান্তের ওপারে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী সংযোগ করে সেই পানি ভারতের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে প্রত্যাহারের পরিবেশ বিপর্যয়কারী যে প্রকল্প ভারত সরকার গ্রহণ করেছে, সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে।
৩. বাণিজ্য ঘাটতি
বাংলাদেশের শতাধিক পণ্যকে বিনাশুল্কে ভারতের বাজারে রফতানির সুযোগ প্রদানের একটি প্রতিশ্রুতির মুলা নব্বইয়ের দশক থেকে সে দেশের সরকার আমাদের নাকের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। এদিকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসেবেই এই ঘাটতির পরিমাণ এখন ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ঘাটতি পূরণে কোনো রকম কার্যকর সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে বাংলাদেশে উত্পাদিত যে যত্সামান্য পণ্য ভারতে রফতানি হয়ে থাকে, সেটাও বন্ধের জন্য ভারতীয় প্রশাসন নানারকম শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অব্যাহতভাবে তৈরি করে চলেছে। ১৯৯৮ সালে তত্কালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী ঢাকায় এসে অবিলম্বে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির যে সুবিধা দানের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তার বাস্তবায়ন দীর্ঘ এক যুগেও সম্পন্ন হয়নি। পার্শ্ববর্তী দেশের উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যে বাংলাদেশের পণ্য রফতানির যে সুযোগ এতদিন বিদ্যমান ছিল, সেটাও বাংলাদেশের বর্তমান ভারত-বান্ধব সরকার ট্রানজিট প্রদানের মাধ্যমে চিরতরে শেষ করে দিচ্ছে।
সুতরাং ভারতের বাজার উন্মুক্ত করার জন্য এখনই যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির বোঝা বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ঈদের পূর্ব রাতে হঠাত্ করে একটি সরকারপন্থী ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় স্ক্রলে লেখা দেখলাম, ভারত নাকি তৈরি পোশাকসহ ৪৭টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু, গত ক’দিনে এ নিয়ে কোনো মহল থেকেই আর কোনো উচ্চবাচ্য শুনিনি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে এমন কোনো ঘোষণা আসছে কিনা, সেটা আমাদের জানা নেই। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে দু’টি আশঙ্কার কথা আগে থেকেই উত্থাপন করে রাখছি। শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকায় এমন কোনো পণ্যের উল্লেখ যেন না থাকে, যা বাংলাদেশে উত্পাদিতই হয় না। একবার শুনেছিলাম, শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকায় নাকি ‘বিমানের যন্ত্রাংশ’ থাকবে। এই প্রকার পণ্য বাংলাদেশে বর্তমানে উত্পাদিত তো হচ্ছেই না, নিকট ভবিষ্যতেও আমাদের সেই প্রযুক্তি অর্জনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির সুবিধা পাওয়ার নামে এই প্রকার তামাশা আশা করি বর্তমান সরকার দেশবাসীর সঙ্গে করবে না।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় ঘোষণা কেবলমাত্র কাগজেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে। চল্লিশ বছর ধরে ভারত তিনবিঘা করিডোরসহ বাংলাদেশকে অনেক রকম কাগুজে সুবিধা দিয়েছে। ঘোষণার প্রকৃত বাস্তবায়ন দেখার আগ পর্যন্ত আমাদের ক্ষুদ্র হৃদয়ের মহান প্রতিবেশীর ওপর এ বিষয়ে আস্থা স্থাপন করা সম্ভব নয়।
৪. সীমান্ত হত্যা
সীমান্তে ভারত কর্তৃক নির্মিত কাঁটাতারে কিশোরী ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি। গত এক দশক ধরে গড়ে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’জন দরিদ্র বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করে চলেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বিএসএফ। চল্লিশ বছরের ইতিহাসে ভারতের প্রতি সর্বাপেক্ষা নমনীয় সরকার এ দেশে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরও এই নির্মম গণহত্যা বন্ধ হয়নি। বিডিআর যতদিন সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল, ততদিন অন্তত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হতো। বিডিআর-এর লাশের ওপর বিজিবির জন্মের পর থেকে উল্টো নিহতদেরই চোরাকারবারি, সন্ত্রাসী, ইত্যকার নামে অভিহিত করে বিএসএফ’র হত্যাযজ্ঞকেই এক প্রকার ন্যায্যতা দেয়ার অপচেষ্টা চলছে।
গত দুই মাসে দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশটি ভারতীয় সেনাপতি, মন্ত্রী, উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সে দেশ থেকে প্রতিবার একজন হোমরা-চোমরা আসছেন, আর ভাঙা রেকর্ড বাজাচ্ছেন যে এখন থেকে আর কোনো বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করা হবে না। এটুকুতেই আমাদের ক্ষমতাসীনরা কৃতজ্ঞতার ভারে নুয়ে পড়ছেন। মাস দুয়েক আগে একবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকে ভরসা দিয়েছিলেন যে, ভারতীয় সফরকারী সেনাপ্রধান তাকে নাকি সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে কথা দিয়ে গেছেন। আগের অনেক প্রতিশ্রুতির মতো এই প্রতিশ্রুতি ভাঙতেও ভারত খুব একটা বিলম্ব করেনি। সীমান্তে প্রকৃত অবস্থা এতটাই ভয়ানক যে, নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানিয়ে ভারত সরকারের কাছে অবিলম্বে হত্যা, নির্যাতন বন্ধের দাবি করেছে। গত বছর ডিসেম্বরে 'Trigger Happy : Exessive use of force by Indian troops at the Bangladesh Border' শিরোনামে ৮১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংস্থাটি গত দশ বছরে সীমান্তে ৯০০ বাংলাদেশীকে হত্যার কথা বলেছে।
প্রতিবেদনের একটি প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি, "Because of the absence of effective accountability mechanism for abuses carried by BSF, even the most serious abuses go unpunished. This sends a clear message that the Indian government finds such abuses acceptable.’
(বিএসএফএ’র নির্যাতন রোধে কোনো কার্যকর জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা না থাকায় অত্যন্ত গুরুতর অপরাধেও কোনো সাজা হচ্ছে না। এখান থেকে পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, ভারত সরকারের কাছে এসব নির্যাতন গ্রহণযোগ্য।)
ভারতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী এবং ইউপি (UPA) জোট প্রধান মিসেস সোনিয়া গান্ধীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় সীমান্ত হত্যা নিয়ে ঐজড আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম, "India : New killing, Torture at Bangladesh border" মিসেস সোনিয়া গান্ধীর ঢাকায় আগমনের দিনেও বিএসএফ একজন বাংলাদেশীকে হত্যা এবং অপর একজনকে অপহরণ করেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার প্রশ্ন, এসব অসহায় নাগরিকদের প্রতি তার কি কোনো দায়িত্ব নেই? ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের দৃশ্যে তার হৃদয়ে কি কোনো রক্তক্ষরণ হয় না?
আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেকে দেশের এক নম্বর দেশপ্রেমিক রূপে ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশে সচরাচর সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ এলে সেখানে দেশপ্রেমিকের বিশেষণ লাগানোর এক আজব রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে। এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও সেই রীতি পালন করতে হবে কিনা, সে সম্পর্কে কোনো সরকারি নির্দেশ মিডিয়াকে অবশ্য এখনও দেয়া হয়নি। জুলাই মাসের একুশ তারিখে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় সম্ভবত অতি মাত্রায় আবেগতাড়িত হয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি হয়তো আছি তাই বাংলাদেশ নিরাপদে আছে। আমার চোখ বন্ধ হলে কী হবে তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানেন।” আল্লাহর রহমতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় তিনি সুস্থ আছেন, তার চোখও পুরোপুরি খোলা রয়েছে। দেশপ্রেমের পরীক্ষা দেয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ আজ শেখ হাসিনার সামনে উপস্থিত।
আগেই বলেছি, গত বছর দিল্লি সফরে তিনি দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং দলীয় ঋণ ভালোভাবেই চুকিয়ে এসেছেন। এ দেশের জনগণও আর স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহায়তা প্রদানের একঘেয়ে ঋণের গল্প শুনতে রাজি নয়। এবার দয়া করে দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে ভারতের কাছ থেকে সব বিষয়ে আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারলেই কেবল দেশপ্রেমের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হবেন। তখন তাকে নিজ থেকে আর দেশপ্রেমিকের দাবি করতে হবে না। কৃতজ্ঞ দেশবাসী সানন্দে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সেই আসনে বসাবে।
ক্ষমতাপ্রাপ্তির বিনিময়ে কিংবা ক্ষমতালাভের বাসনায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পায়ে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেশপ্রেমের বড়াই জনগণের সঙ্গে শঠতারই নামান্তর। সরকারি এবং বিরোধী পক্ষ এই সত্যটি স্মরণে রাখলে তারাও উপকৃত হবেন, দেশও রক্ষা পাবে।
No comments