১৬- চরম দলীয়করণের ফলে দেশে ইনসাফ পাওয়ার পথ সবদিক দিয়েই রুদ্ধ
নিম্ন আদালতের পক্ষে জনআস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়
...ক্ষমতাবানদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই। নইলে যাদের অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বক্তৃতা করেছেন, নিম্ন আদালতের সেই বিচারকদের মধ্য থেকে কেউ উঠে দাঁড়িয়ে সাহস করে বলতে পারতেন, যেখানে প্রধান বিচারপতি স্বয়ং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে, সেই পরিস্থিতিতে নিম্ন আদালতের জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের পক্ষে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।...
...ক্ষমতাবানদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই। নইলে যাদের অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বক্তৃতা করেছেন, নিম্ন আদালতের সেই বিচারকদের মধ্য থেকে কেউ উঠে দাঁড়িয়ে সাহস করে বলতে পারতেন, যেখানে প্রধান বিচারপতি স্বয়ং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে, সেই পরিস্থিতিতে নিম্ন আদালতের জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের পক্ষে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।...
পাঁচদিন বিরতির পর আবার লেখার টেবিলে ফিরে এসেছি। এই ক’দিন কোরআনের তফসির পড়েই প্রধানত সময় কেটেছে। বাইরের দুনিয়ার খবর অবশ্য পাচ্ছি কালাম আর মানিকের কাছ থেকে। মানিক অন্য ওয়ার্ডে থাকলেও প্রতি বিকালে আমার সঙ্গে ঘণ্টাখানেক গল্প-গুজব করে যায়। এ তরুণটি আমার মায়ের দীর্ঘদিনের বান্ধবী এবং সহকর্মী সাহারা খালার বোনের ছেলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কয়েকজন বন্ধুসহ কাশিমপুর জেলে এসেছে। মধ্য তিরিশের মানিক দাবি করছে, ওরা সবাই নির্দোষ। আল্লাহই জানেন, ওর কপালে কী আছে!
ছেলেটি নিয়মিত রেডিওতে সংবাদ শোনে আর বিকালে আমাকে বিগত চব্বিশ ঘণ্টার দেশ-বিদেশের হাল-হকিকত জানিয়ে যায়। সন্ধ্যার খবর জানতে পাই কালামের কাছ থেকে যখন ও রাতে আমাকে খাওয়াতে আসে। এছাড়া বেলা এগারোটায় সরকারি পয়সায় ডেইলি স্টার পাই। পত্রিকাটির পাতা ওল্টাতে পনেরো মিনিটের বেশি সময় ব্যয় করি না। রেডিও কিংবা খবরের কাগজ—কোথাও ভালো খবর তেমন পাচ্ছি না। বরং বাংলাদেশ যে ক্রমেই ফ্যাসিবাদী এক পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, তারই আলামত সর্বত্র। এই গতকালই বাংলাদেশ পুলিশের বড় কর্তা হাসান মাহমুদ টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করে এসেছেন। তিনি সেখানে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গিয়েছিলেন, নাকি মহাজোট সরকারের আমলে এই যাওয়াটা আইজি পদের সরকারি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে পড়ে, সেটা অবশ্য আমার জানা নেই। তবে এর আগে কোনো আইজি’র টুঙ্গিপাড়ায় সফর নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে এভাবে প্রচারের কথা স্মরণে আসছে না। সেখানে হাসান মাহমুদ যেতেই পারেন।
জেলজীবনের কথকতা লিখতে বসে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর টুঙ্গিপাড়ায় আইজি আগামীকালের হরতাল প্রসঙ্গে কিছু মন্তব্য করেছেন। বক্তব্য প্রদানকালে তিনি হরতালের সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কঠোর হস্তে দমনের হুমকি দিয়েছেন। আমার আপত্তি এখানেই। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীর পক্ষে এই ভাষায় কথা বলাটা সমীচীন নয়। তার ভাষার মধ্যে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এজাতীয় কথাবার্তা আমরা সব সরকারের আমলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কণ্ঠেই শুনতে অধিকতর অভ্যস্ত। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর মুখের ভাষা যখন দলীয় হয়ে ওঠে তখনই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ফ্যাসিবাদে রূপ নেয়।
অশনি সঙ্কেতের এখানেই শেষ নয়। ‘স্বাধীন’ হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতিও সম্প্রতি এক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করে এসেছেন। সেখানে তার বক্তৃতায় তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে বর্ণনা করে কেবল তিরস্কারই করেননি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে তাকে অভিযুক্তও করেছেন। দেশের নাগরিক হিসেবে একজন বিচারপতির রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বিশ্বাসের ব্যাপারটি তিনি এভাবে প্রকাশ করতে পারেন কি-না, সে প্রশ্নের জবাব প্রধান বিচারপতিকেই দিতে হবে। এখন বিএনপি’র নেতা-কর্মী-সমর্থক এই বিচারকের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে তার এজলাসে যেতে অস্বীকার করলে তাদের আদালত অবমাননা মামলায় অভিযুক্ত করার আর সুযোগ থাকবে কি? আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে নাগরিকদের ধরে ধরে জেলে পুরলেই যে আদালতের হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধার হয় না, এ বিষয়টি প্রধান বিচারপতি যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই সবার মঙ্গল। মাননীয় বিচারপতিদের নীতিনিষ্ঠ আচার-আচরণ এবং আইন ও সংবিধানের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনের মাধ্যমেই কেবল আদালতের মর্যাদা সমুন্নত হতে পারে। ‘স্বাধীন’ বিচার ব্যবস্থার জামানায় বিচার বিভাগের সার্বিক অবস্থাও এ দেশে পুনর্বার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে, হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করার বিষয়টি আমার কাছে কৌতুককর মনে হয়েছে। আমি তো জানতাম মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বর্তমান সরকারপ্রধানের বেজায় খাতির। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পিতৃহন্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, এই পিলে চমকানো তথ্য প্রদান করে সংশ্লিষ্ট বিচারপতি অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন।
ডিসেম্বর চলে এলো। সেই সঙ্গে আমার বন্দি জীবনেরও ছয় মাস পূর্ণ হলো। এ বছরের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের যে চিত্র প্রকাশ করে আপিল বিভাগের লর্ডশিপদের রোষের শিকার হয়েছি, আজ সেই অবক্ষয়ের বিষয়ে চর্চা বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিন চলছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক জেনে গেছেন, চরম দলীয়করণের ফলে এদেশে ইনসাফ পাওয়ার পথ সবদিক দিয়ে রুদ্ধ। কাশিমপুর জেলের এক বন্দি সকালেই ডিসেম্বরের ২ তারিখের যুগান্তর দিয়ে গেল। পত্রিকাটিতে ওই দিনের প্রধান খবরের শিরোনাম, ‘বিচারাঙ্গনে চরম অস্থিরতা’। সেই সংবাদ থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি—‘বিশেষ করে সরকার হাই প্রোফাইল যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে বা তাকে কিংবা তার কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে একটু ইঙ্গিত দিলেই হলো। ওই ব্যক্তির মামলা-মোকদ্দমা বা রিটের ভাগ্য ঝুলে যায় রাষ্ট্রপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। এমন নজির রয়েছে অসংখ্য। যেখানে বিচারকদেরও কিছু করার থাকে না। কেননা বিচার বিভাগ স্বাধীন, এ কথাটা মুখে বলা হলেও কাজ করতে গিয়ে বিচারকরা টের পান আসলেই তারা কতটা চাপের মুখে থাকেন।’
আমার দেশ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশ এবং একই পত্রিকায় মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। উভয় মামলাতেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিয়েছে আপিল বিভাগ। প্রকাশিত সংবাদ এবং মন্তব্য-প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল যথাক্রমে ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ এবং ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’। যুগান্তর পত্রিকার মূল বক্তব্যের সঙ্গে আমার দেশ-এর সংবাদ এবং আমার লেখার লক্ষণীয় মিল রয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক এবং সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হবে না। দেশের সব বিবেকবান নাগরিক আজ যখন একই কথা বলছে, সেই পরিস্থিতিতে কতজনকে আর জেলে পোরা সম্ভব? আমি যখন এই কথাই বলেছিলাম, তখন আমি একা ছিলাম। তদুপরি ক্ষমতাসীন মহল ও তাদের বিদেশি প্রভুরা আমাকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে একমত হয়েছিল। দেশের পরিস্থিতি পাল্টাতে দেখে বড় আনন্দ হচ্ছে। প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের যোগসাজশে সাময়িকভাবে আমার কলম বন্ধ করা গেলেও ষোল কোটি মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করা সম্ভব হয়নি।
আমার প্রথম মামলার শুনানিকালে তত্কালীন প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম রাগত স্বরে আদালত অবমাননায় আমাকে পথপ্রদর্শক (Path finder) নামে ডেকেছিলেন। আজ দেখতে পাচ্ছি ভদ্রলোক রীতিমত ভবিষ্যত্দ্রষ্টা। আমার দেশ পত্রিকার দেখানো পথে যুগান্তরকে হাঁটতে দেখে প্রশান্তিতে মন ভরে যাচ্ছে। তবে সাবেক প্রধান বিচারপতির একটা বড় ভুল হয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন, পথপ্রদর্শককে নজিরবিহীন সাজা দেয়া হলে অন্য সংবাদপত্র ভয়ে কম্পমান হবে; তাদের হাতের কলম থেমে যাবে। কিন্তু আজ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার কাছে তিনি এবং তার লর্ডশিপ ভ্রাতারা পরাজিত হয়েছেন। এক-এগারোর পর থেকে আমার লেখা পড়ে অনেকেই আমাকে উন্মাদ ও নির্বোধ সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু আমি বিবেক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হয়েছি।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) আমাদের মহানবীকে উদ্ধৃত করে তাঁর ভাষণে প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও তার অত্যাচারী হাতকে প্রতিরোধ করবে না, আল্লাহ্ শিগগিরই তাদের ওপর ব্যাপক আজাব নাযেল করবেন।’ আমিও খোলাফায়ে রাশেদিনের নির্দেশিত পথে কলমকে হাতিয়ার করে ফ্যাসিবাদকে সাধ্যমত প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছি। জেল থেকে কবে মুক্তি পাব, জানি না। তবে বিগত ছয় মাসের অত্যাচার-নির্যাতন আমার ঈমানকে আরও মজবুত করেছে। যেদিন মুক্তি পাব, সেদিন থেকেই ইনশাআল্লাহ্ নতুন উদ্যমে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের লড়াই শুরু করব।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কের ব্যাপারটি স্বীকার করলেও বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা এখনও মানতে নারাজ। তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, নাগরিকদের বিপুল সংখ্যায় আদালতের দ্বারস্থ হওয়াটাই নাকি এ দেশের বিচারক এবং সিস্টেমের প্রতি তাদের আস্থা প্রমাণ করে। আমার পাল্টা যুক্তি হলো, মামলার সংখ্যার একটা বড় অংশের বাদী সরকার অথবা সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকরা। এক্ষেত্রে জনগণ স্বেচ্ছায় বিচারালয়ে আসছে, নাকি তাদের টেনে আনা হচ্ছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর ষোল কোটিরও অধিক ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশে স্বাভাবিক নিয়মেই মামলার সংখ্যা বাড়বে। দেশে কোনো বিকল্প বিরোধ নিরসন ব্যবস্থা নেই যে জনগণ আদালতের পরিবর্তে সেখানে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আদালতে না গেলে সাধারণ জনগণকে যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হয়। প্রধান বিচারপতি কি বাংলাদেশকে সেরকম একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত দেখতে চান?
মামলার সংখ্যাধিক্য দিয়ে আস্থা প্রমাণের অদ্ভুত যুক্তির আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার করুণ চিত্র নিজেই ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি দু’জন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতির পদটি কব্জা করার পর এ পর্যন্ত দু’বার নিম্নআদালতের বিচারকদের সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন। উভয় ভাষণে বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিচারকদের দুর্নীতিমুক্ত থাকতে এবং আবেগতাড়িত না হয়ে বিচারকার্য পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন। তার আর একটি প্রিয় দর্শন হলো বিচারকদের নাকি ‘কোল্ড হার্ট’ থাকতে হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পক্ষপাত এবং দলীয়করণের যে অভিযোগ নিয়ে সারা দেশ এখন আন্দোলিত হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। অবশ্য, তার বিরুদ্ধেও যেহেতু পক্ষপাতের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, সে কারণেই হয়তো তিনি এই স্পর্শকাতর বিষয়ে নীরব থাকতে চেয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি সংক্রান্ত মামলার আর্জিতে লিখিতভাবে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে পক্ষপাতের (bias) অভিযোগ এনেছেন। ক্ষমতাবানদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই। নইলে যাদের অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বক্তৃতা করেছেন, নিম্ন আদালতের সেই বিচারকদের মধ্য থেকে কেউ উঠে দাঁড়িয়ে সাহস করে বলতে পারতেন, যেখানে প্রধান বিচারপতি স্বয়ং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে, সেই পরিস্থিতিতে নিম্ন আদালতের জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের পক্ষে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
উপস্থিত কারও মনে এমন চিন্তা এলেও ঢোক গেলা ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না। জনগণ এখনও আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে, এই আত্মপ্রসাদের ঢেঁকুর প্রধান বিচারপতি আর কতদিন তুলতে পারেন, সেটা সময়ই বলে দেবে। অবস্থার ভয়াবহতা তিনি বুঝতে না চাইলেও জনগণের নিজের হাতে আইন তুলে নেয়া শুরু হলে রাষ্ট্রের বর্তমান কাঠামোর বিনাশও অবশ্যম্ভাবী। সমাজের শাসকশ্রেণী নিজ স্বার্থেই স্থিতাবস্থা (Status Quo) ধরে রাখতে চায়। মার্কসবাদীরা বলে থাকেন, সম্পদের মালিকানা কুক্ষিগত করার অসত্ উদ্দেশ্যেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনের শাসনের গল্প ফাঁদা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার বর্তমান করুণ দশা সেই মার্কসবাদী তত্ত্বকেই বৈধতা দিচ্ছে। আইনের শাসনের নামে শাসকশ্রেণী এদেশের স্বল্পশিক্ষিত, দরিদ্র, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ওপর যে জুলুম চালাচ্ছে, তার ফল কোনোদিন শুভ হতে পারে না। এই ঔদ্ধ্যত্বের মাশুল তাদের একদিন দিতে হবে। আদালত অবমাননা নামক নিরাপত্তার ঢাল সেদিন যথেষ্ট নাও হতে পারে।
ছেলেটি নিয়মিত রেডিওতে সংবাদ শোনে আর বিকালে আমাকে বিগত চব্বিশ ঘণ্টার দেশ-বিদেশের হাল-হকিকত জানিয়ে যায়। সন্ধ্যার খবর জানতে পাই কালামের কাছ থেকে যখন ও রাতে আমাকে খাওয়াতে আসে। এছাড়া বেলা এগারোটায় সরকারি পয়সায় ডেইলি স্টার পাই। পত্রিকাটির পাতা ওল্টাতে পনেরো মিনিটের বেশি সময় ব্যয় করি না। রেডিও কিংবা খবরের কাগজ—কোথাও ভালো খবর তেমন পাচ্ছি না। বরং বাংলাদেশ যে ক্রমেই ফ্যাসিবাদী এক পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, তারই আলামত সর্বত্র। এই গতকালই বাংলাদেশ পুলিশের বড় কর্তা হাসান মাহমুদ টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করে এসেছেন। তিনি সেখানে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গিয়েছিলেন, নাকি মহাজোট সরকারের আমলে এই যাওয়াটা আইজি পদের সরকারি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে পড়ে, সেটা অবশ্য আমার জানা নেই। তবে এর আগে কোনো আইজি’র টুঙ্গিপাড়ায় সফর নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে এভাবে প্রচারের কথা স্মরণে আসছে না। সেখানে হাসান মাহমুদ যেতেই পারেন।
জেলজীবনের কথকতা লিখতে বসে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর টুঙ্গিপাড়ায় আইজি আগামীকালের হরতাল প্রসঙ্গে কিছু মন্তব্য করেছেন। বক্তব্য প্রদানকালে তিনি হরতালের সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কঠোর হস্তে দমনের হুমকি দিয়েছেন। আমার আপত্তি এখানেই। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীর পক্ষে এই ভাষায় কথা বলাটা সমীচীন নয়। তার ভাষার মধ্যে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এজাতীয় কথাবার্তা আমরা সব সরকারের আমলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কণ্ঠেই শুনতে অধিকতর অভ্যস্ত। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর মুখের ভাষা যখন দলীয় হয়ে ওঠে তখনই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ফ্যাসিবাদে রূপ নেয়।
অশনি সঙ্কেতের এখানেই শেষ নয়। ‘স্বাধীন’ হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতিও সম্প্রতি এক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করে এসেছেন। সেখানে তার বক্তৃতায় তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে বর্ণনা করে কেবল তিরস্কারই করেননি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে তাকে অভিযুক্তও করেছেন। দেশের নাগরিক হিসেবে একজন বিচারপতির রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বিশ্বাসের ব্যাপারটি তিনি এভাবে প্রকাশ করতে পারেন কি-না, সে প্রশ্নের জবাব প্রধান বিচারপতিকেই দিতে হবে। এখন বিএনপি’র নেতা-কর্মী-সমর্থক এই বিচারকের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে তার এজলাসে যেতে অস্বীকার করলে তাদের আদালত অবমাননা মামলায় অভিযুক্ত করার আর সুযোগ থাকবে কি? আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে নাগরিকদের ধরে ধরে জেলে পুরলেই যে আদালতের হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধার হয় না, এ বিষয়টি প্রধান বিচারপতি যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই সবার মঙ্গল। মাননীয় বিচারপতিদের নীতিনিষ্ঠ আচার-আচরণ এবং আইন ও সংবিধানের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনের মাধ্যমেই কেবল আদালতের মর্যাদা সমুন্নত হতে পারে। ‘স্বাধীন’ বিচার ব্যবস্থার জামানায় বিচার বিভাগের সার্বিক অবস্থাও এ দেশে পুনর্বার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে, হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করার বিষয়টি আমার কাছে কৌতুককর মনে হয়েছে। আমি তো জানতাম মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বর্তমান সরকারপ্রধানের বেজায় খাতির। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পিতৃহন্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, এই পিলে চমকানো তথ্য প্রদান করে সংশ্লিষ্ট বিচারপতি অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন।
ডিসেম্বর চলে এলো। সেই সঙ্গে আমার বন্দি জীবনেরও ছয় মাস পূর্ণ হলো। এ বছরের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের যে চিত্র প্রকাশ করে আপিল বিভাগের লর্ডশিপদের রোষের শিকার হয়েছি, আজ সেই অবক্ষয়ের বিষয়ে চর্চা বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিন চলছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক জেনে গেছেন, চরম দলীয়করণের ফলে এদেশে ইনসাফ পাওয়ার পথ সবদিক দিয়ে রুদ্ধ। কাশিমপুর জেলের এক বন্দি সকালেই ডিসেম্বরের ২ তারিখের যুগান্তর দিয়ে গেল। পত্রিকাটিতে ওই দিনের প্রধান খবরের শিরোনাম, ‘বিচারাঙ্গনে চরম অস্থিরতা’। সেই সংবাদ থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি—‘বিশেষ করে সরকার হাই প্রোফাইল যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে বা তাকে কিংবা তার কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে একটু ইঙ্গিত দিলেই হলো। ওই ব্যক্তির মামলা-মোকদ্দমা বা রিটের ভাগ্য ঝুলে যায় রাষ্ট্রপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। এমন নজির রয়েছে অসংখ্য। যেখানে বিচারকদেরও কিছু করার থাকে না। কেননা বিচার বিভাগ স্বাধীন, এ কথাটা মুখে বলা হলেও কাজ করতে গিয়ে বিচারকরা টের পান আসলেই তারা কতটা চাপের মুখে থাকেন।’
আমার দেশ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশ এবং একই পত্রিকায় মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। উভয় মামলাতেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিয়েছে আপিল বিভাগ। প্রকাশিত সংবাদ এবং মন্তব্য-প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল যথাক্রমে ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ এবং ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’। যুগান্তর পত্রিকার মূল বক্তব্যের সঙ্গে আমার দেশ-এর সংবাদ এবং আমার লেখার লক্ষণীয় মিল রয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক এবং সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হবে না। দেশের সব বিবেকবান নাগরিক আজ যখন একই কথা বলছে, সেই পরিস্থিতিতে কতজনকে আর জেলে পোরা সম্ভব? আমি যখন এই কথাই বলেছিলাম, তখন আমি একা ছিলাম। তদুপরি ক্ষমতাসীন মহল ও তাদের বিদেশি প্রভুরা আমাকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে একমত হয়েছিল। দেশের পরিস্থিতি পাল্টাতে দেখে বড় আনন্দ হচ্ছে। প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের যোগসাজশে সাময়িকভাবে আমার কলম বন্ধ করা গেলেও ষোল কোটি মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করা সম্ভব হয়নি।
আমার প্রথম মামলার শুনানিকালে তত্কালীন প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম রাগত স্বরে আদালত অবমাননায় আমাকে পথপ্রদর্শক (Path finder) নামে ডেকেছিলেন। আজ দেখতে পাচ্ছি ভদ্রলোক রীতিমত ভবিষ্যত্দ্রষ্টা। আমার দেশ পত্রিকার দেখানো পথে যুগান্তরকে হাঁটতে দেখে প্রশান্তিতে মন ভরে যাচ্ছে। তবে সাবেক প্রধান বিচারপতির একটা বড় ভুল হয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন, পথপ্রদর্শককে নজিরবিহীন সাজা দেয়া হলে অন্য সংবাদপত্র ভয়ে কম্পমান হবে; তাদের হাতের কলম থেমে যাবে। কিন্তু আজ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার কাছে তিনি এবং তার লর্ডশিপ ভ্রাতারা পরাজিত হয়েছেন। এক-এগারোর পর থেকে আমার লেখা পড়ে অনেকেই আমাকে উন্মাদ ও নির্বোধ সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু আমি বিবেক ও ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হয়েছি।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) আমাদের মহানবীকে উদ্ধৃত করে তাঁর ভাষণে প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও তার অত্যাচারী হাতকে প্রতিরোধ করবে না, আল্লাহ্ শিগগিরই তাদের ওপর ব্যাপক আজাব নাযেল করবেন।’ আমিও খোলাফায়ে রাশেদিনের নির্দেশিত পথে কলমকে হাতিয়ার করে ফ্যাসিবাদকে সাধ্যমত প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছি। জেল থেকে কবে মুক্তি পাব, জানি না। তবে বিগত ছয় মাসের অত্যাচার-নির্যাতন আমার ঈমানকে আরও মজবুত করেছে। যেদিন মুক্তি পাব, সেদিন থেকেই ইনশাআল্লাহ্ নতুন উদ্যমে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের লড়াই শুরু করব।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কের ব্যাপারটি স্বীকার করলেও বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা এখনও মানতে নারাজ। তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, নাগরিকদের বিপুল সংখ্যায় আদালতের দ্বারস্থ হওয়াটাই নাকি এ দেশের বিচারক এবং সিস্টেমের প্রতি তাদের আস্থা প্রমাণ করে। আমার পাল্টা যুক্তি হলো, মামলার সংখ্যার একটা বড় অংশের বাদী সরকার অথবা সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকরা। এক্ষেত্রে জনগণ স্বেচ্ছায় বিচারালয়ে আসছে, নাকি তাদের টেনে আনা হচ্ছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর ষোল কোটিরও অধিক ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশে স্বাভাবিক নিয়মেই মামলার সংখ্যা বাড়বে। দেশে কোনো বিকল্প বিরোধ নিরসন ব্যবস্থা নেই যে জনগণ আদালতের পরিবর্তে সেখানে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আদালতে না গেলে সাধারণ জনগণকে যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হয়। প্রধান বিচারপতি কি বাংলাদেশকে সেরকম একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত দেখতে চান?
মামলার সংখ্যাধিক্য দিয়ে আস্থা প্রমাণের অদ্ভুত যুক্তির আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার করুণ চিত্র নিজেই ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি দু’জন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতির পদটি কব্জা করার পর এ পর্যন্ত দু’বার নিম্নআদালতের বিচারকদের সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন। উভয় ভাষণে বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিচারকদের দুর্নীতিমুক্ত থাকতে এবং আবেগতাড়িত না হয়ে বিচারকার্য পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন। তার আর একটি প্রিয় দর্শন হলো বিচারকদের নাকি ‘কোল্ড হার্ট’ থাকতে হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পক্ষপাত এবং দলীয়করণের যে অভিযোগ নিয়ে সারা দেশ এখন আন্দোলিত হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। অবশ্য, তার বিরুদ্ধেও যেহেতু পক্ষপাতের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, সে কারণেই হয়তো তিনি এই স্পর্শকাতর বিষয়ে নীরব থাকতে চেয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি সংক্রান্ত মামলার আর্জিতে লিখিতভাবে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে পক্ষপাতের (bias) অভিযোগ এনেছেন। ক্ষমতাবানদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই। নইলে যাদের অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বক্তৃতা করেছেন, নিম্ন আদালতের সেই বিচারকদের মধ্য থেকে কেউ উঠে দাঁড়িয়ে সাহস করে বলতে পারতেন, যেখানে প্রধান বিচারপতি স্বয়ং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে, সেই পরিস্থিতিতে নিম্ন আদালতের জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের পক্ষে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
উপস্থিত কারও মনে এমন চিন্তা এলেও ঢোক গেলা ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না। জনগণ এখনও আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে, এই আত্মপ্রসাদের ঢেঁকুর প্রধান বিচারপতি আর কতদিন তুলতে পারেন, সেটা সময়ই বলে দেবে। অবস্থার ভয়াবহতা তিনি বুঝতে না চাইলেও জনগণের নিজের হাতে আইন তুলে নেয়া শুরু হলে রাষ্ট্রের বর্তমান কাঠামোর বিনাশও অবশ্যম্ভাবী। সমাজের শাসকশ্রেণী নিজ স্বার্থেই স্থিতাবস্থা (Status Quo) ধরে রাখতে চায়। মার্কসবাদীরা বলে থাকেন, সম্পদের মালিকানা কুক্ষিগত করার অসত্ উদ্দেশ্যেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনের শাসনের গল্প ফাঁদা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার বর্তমান করুণ দশা সেই মার্কসবাদী তত্ত্বকেই বৈধতা দিচ্ছে। আইনের শাসনের নামে শাসকশ্রেণী এদেশের স্বল্পশিক্ষিত, দরিদ্র, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ওপর যে জুলুম চালাচ্ছে, তার ফল কোনোদিন শুভ হতে পারে না। এই ঔদ্ধ্যত্বের মাশুল তাদের একদিন দিতে হবে। আদালত অবমাননা নামক নিরাপত্তার ঢাল সেদিন যথেষ্ট নাও হতে পারে।
No comments