২১- জেলের কঠিন জীবনযাপন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ
শবেবরাতে ছিলাম গোপালগঞ্জ জেলে
কেবল জামিন মঞ্জুরের আনুষ্ঠানিকতার জন্য আমাকে গোপালগঞ্জে নেয়ার কী প্রয়োজন ছিল, জানি না। শবেবরাতের রাত গোপালগঞ্জ জেলেই কাটল। গৃহের কথা বড় মনে পড়ছিল। মিষ্টান্নের প্রতি আমার ভয়ানক দুর্বলতা রয়েছে। পারভীন রান্নাঘরে সচরাচর না গেলেও প্রতি শবেবরাতে আমার পছন্দের কয়েক ধরনের হালুয়া তৈরি করে। এবার নিশ্চয়ই রান্নাবান্না বাদ দিয়ে শাশুড়ি-বৌ কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। ...
কেবল জামিন মঞ্জুরের আনুষ্ঠানিকতার জন্য আমাকে গোপালগঞ্জে নেয়ার কী প্রয়োজন ছিল, জানি না। শবেবরাতের রাত গোপালগঞ্জ জেলেই কাটল। গৃহের কথা বড় মনে পড়ছিল। মিষ্টান্নের প্রতি আমার ভয়ানক দুর্বলতা রয়েছে। পারভীন রান্নাঘরে সচরাচর না গেলেও প্রতি শবেবরাতে আমার পছন্দের কয়েক ধরনের হালুয়া তৈরি করে। এবার নিশ্চয়ই রান্নাবান্না বাদ দিয়ে শাশুড়ি-বৌ কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। ...
জেলগেট পার হতেই চেনা প্রিজন ভ্যানের পরিবর্তে এক সুদৃশ্য মাইক্রোবাস অপেক্ষমাণ দেখে বিস্মিত হলাম। গাড়িতে উঠে জানলাম, আমাকে পাহারা দিয়ে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৩ জন পুলিশ এসকর্ট সঙ্গে যাচ্ছে। এই পুলিশ দলটির দায়িত্ব আমাকে গোপালগঞ্জ জেল কর্তৃপক্ষের কাছে সহি-সালামতে হস্তান্তর করা। সকাল সাড়ে ১০টায় নাজিমউদ্দিন রোড থেকে রওনা হয়ে মাওয়াঘাটে পৌঁছাতে ঘণ্টা দেড়েক লাগল। ভরা বর্ষায় একদা প্রমত্তা পদ্মার শীর্ণ রূপ পরম বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীর অপার বন্ধুত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে। শ্রাবণের এই পদ্মা দেখে মনে পড়ল, গ্রেফতার হওয়ার ঠিক দু’সপ্তাহ আগে ১৬ মে’র ফারাক্কা দিবসে রাজশাহীর পদ্মার চরে এক গণজমায়েতে প্রধান অতিথি ছিলাম। সেই সভায় পানিযুদ্ধ চালিয়ে আমার মাতৃভূমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মরুভূমিতে পরিণত করার অপরাধে ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করেছিলাম।
গত দু’মাসের বন্দিজীবনে অনেকবারই মনে হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত সম্পর্কে আমার সরাসরি বক্তব্য ও লেখালেখি এই বন্দিত্বকে ত্বরান্বিত করেছে। মাঝেমধ্যে তর্জনগর্জন করলেও আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পরাশক্তির তাঁবেদার কোনো সংবাদপত্রকে আমার দেশ-এর মতো করে বন্ধ করার ক্ষমতা এই সরকারের কোনোদিনই হবে না। দেশের স্বাধীনতা, জনগণের স্বার্থ এবং নিজ ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে লড়াই করার পরিণতিতে জেলে আসায় আমার কোনোরকম অনুশোচনা নেই। এই পথ আমি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছি। মহান আল্লাহতায়ালাই তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন। পদ্মার বুকে ফেরিতে দুই ঘণ্টা কাটিয়ে গোপালগঞ্জ জেলে পৌঁছাতে বিকেল ৪টা বেজে গেল। নবনির্মিত জেলখানার চাকচিক্য দেখে ভালোই লাগল। জেল কর্মকর্তাদের অভ্যর্থনায় সৌজন্যের কোনো ঘাটতি নেই। ছোট একটি সমস্যার কথা শুনলাম। গোপালগঞ্জ জেলে কোনো ডিভিশন ওয়ার্ড না থাকার কারণে আমাকে কারা হাসপাতালে থাকতে হবে। প্রসন্ন চিত্তে ভারপ্রাপ্ত জেলারকে আশ্বস্ত করে ঢাকা জেলে দুই মাস ধরে সাত সেলে অবস্থানের কথা জানালাম। সাত সেলের বন্দিজীবনে অভ্যস্ত হওয়ার পর ডিভিশন ওয়ার্ডের প্রসঙ্গই এখন আমার কাছে অবান্তর। হাসপাতাল ওয়ার্ডে গিয়ে রীতিমত মুগ্ধ হলাম। বিশাল একটি কক্ষে আমার থাকার আয়োজন করা হয়েছে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, এখানে লাগোয়া টয়লেট রয়েছে। দুটো দিন আমাকে নিজহাতে গণটয়লেট পরিষ্কার করতে হবে না জেনেই আমি পুলকিত। কারা প্রশাসনের লোকজন একে একে পরিচিত হতে এলো। তাদের কাছ থেকেই জানলাম, ২০১০ সালের প্রথম দিকে গোপালগঞ্জের নতুন জেলটি উদ্বোধন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন।
কয়েদি এবং হাজতি মিলে মোট বন্দির সংখ্যা মাত্র সাড়ে তিনশ’। এখানে এমন ওয়ার্ডও আছে যেখানে আজ পর্যন্ত কোনো বন্দি ওঠেনি। উদাহরণস্বরূপ এই দোতলা হাসপাতালে আমিই সর্বপ্রথম বন্দি। একেবারেই নির্জন এই ওয়ার্ডে রাতে আমার জন্যে কোনো পাহারা লাগবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে জেলারকে বললাম, আমি একা থাকতেই বরং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব। ফার্মাসিস্ট রক্তচাপ মাপার যন্ত্র নিয়ে এলে তাকেও জানালাম, আমার রক্তচাপ স্বাভাবিকই আছে, কষ্ট করে পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। দীর্ঘপথ চলার ক্লান্তিতে রাত ১০টার মধ্যেই রাতের আহার শেষ করে হাসপাতালের পরিষ্কার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
ফজরের নামাজ পড়ে জেলজীবনের অভ্যাসমত সকাল ৬টার মধ্যেই গোসল শেষ করে নিজহাতে কাচা লুঙ্গি আর গেঞ্জি শুকানোর ব্যবস্থা করছি, এমন সময় গত রাত থেকে নিয়োজিত সেবক মোস্তফা এসে হাজির। আমি নিজহাতে কাপড় ধুয়েছি দেখে রীতিমত চোটপাট শুরু করে দিল। প্রায় কুড়ি বছর ধরে সাজাখাটা অভিজ্ঞ মেট মোস্তফার এই অসন্তোষের মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া খুঁজে পেয়ে ভালোই লাগল। অঙ্গীকার করতে হলো, যে কদিন গোপালগঞ্জে আছি অন্তত সে ক’দিন এমন গর্হিত কাজ আর করব না। সকাল সাড়ে ৯টায় সুবেদার এলো প্রিজন ভ্যান আসার খবর নিয়ে। জেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম, অন্যরকম আকৃতির এক প্রিজন ভ্যান। পেছনটা খোলা যেখানে সাধারণ কয়েদিরা চাপাচাপি করে বসে আছে, তাদের পাহারা দেয়ার জন্যে অস্ত্রহাতে তিন-চারজন সেন্ট্রি ডালার কাছে দাঁড়িয়ে। আমাকে বলা হলো সামনে ড্রাইভারের পাশে বসতে। আমি গাড়িতে ওঠার পর আমাকে মাঝখানে ঠেলে দরজার দিকে বসলেন একজন এসআই। জেল থেকে আদালত মিনিট দশেকের পথ। সোজা কোর্ট গারদে আমাকে নিয়ে তোলা হলো। মুখোমুখি দুটো গারদ। একটায় সব বন্দিকে ঢোকানো হলো এবং অপরটায় আমি একাই। ঘণ্টাখানেক ধরে অবিরত পায়চারি করে আমার পাদুটো আর চলছে না। কোর্ট ইন্সপেক্টরের বোধহয় মায়া হলো। একটু বিব্রত মুখেই একটা চেয়ার এনে ভদ্রলোক গারদের ভেতরেই আমার বসার ব্যবস্থা করলেন। আরও আধঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে ডাক পড়ল। এজলাসে গিয়ে মনটা উত্ফুল্ল হয়ে গেল। প্রকৌশলী রিজু, হাসিন, রিপন, চুন্নু, নজরুল, সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান, অ্যাডভোকেট মেসবাহ এবং আরও কয়েকজন পেশাজীবী ঢাকা থেকে এতদূর এসেছেন আদালতে আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। আমি অপরিসীম কৃতজ্ঞতাবোধে আপ্লুত হলাম। আজ শবেবরাত হওয়া সত্ত্বেও আপনজনদের ফেলে এতগুলো মানুষ গোপালগঞ্জে এসেছেন আমার কুশল জানতে। দেশপ্রেমিক পেশাজীবীদের এই সমর্থন প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। কাঠগড়ায় দশ আসামি বেশ গাদাগাদি করে দাঁড়ালাম। বাদী আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় নেতা। তার পরিবারের রাজাকারি অতীতের সংবাদ আমার দেশসহ তিন-চারটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় সেই নেতা মানহানি মামলা দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের মধ্যে সবাই সাংবাদিক, তবে সম্পাদক আমি একাই।
দশ আসামির মধ্যে নয়জনকে এরই মধ্যে জামিন দেয়া হয়েছে। এক আমার জন্যেই নাকি আজকের এত আয়োজন। আমি পেশায় যেহেতু আইনজীবী নই, কাজেই আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ বোঝা আমার কর্ম নয়। তবে একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে মনে হলো, এই অপচয়ের কোনো প্রয়োজন ছিল না। মামলার ধারা জামিনযোগ্য, আমি কারাগারে বন্দি, অর্থাত্ রাষ্ট্রীয় হেফাজতে আছি। এরকম পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বহীন, বানোয়াট মামলায় কেবল জামিন মঞ্জুরের আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার জন্যে আমাকে ঢাকা থেকে টেনে আনবার কী প্রয়োজন ছিল, সেটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকল না। আমার পক্ষে স্থানীয় একজন আইনজীবী দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ বিষয় ব্যাখ্যা করে জামিনের আবেদন করলেই তো জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। আমি যেহেতু সরকারের রোষানলে আছি, তাই আমার ব্যক্তিগত হয়রানির কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম, তবে আমাকে টানাহ্যাঁচড়া না করলে সরকারের অনেকগুলো টাকারও তো সাশ্রয় হতো। আমাকে আনা-নেয়ার জন্য দুই দফায় গাড়ি ভাড়া, ডজনখানেক পুলিশের পুরো দুই দিনের কর্মঘণ্টা নষ্ট, তাদের খোরাকির অর্থব্যয়—তা সে যতই সামান্য হোক, ঢাকা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশ প্রশাসনে সতর্কাবস্থা, এসব করে কার কী লাভ হচ্ছে আল্লাহই জানেন! জামিন হয়ে গেলে আদালত থেকে গোপালগঞ্জ জেলে ফিরলাম। ফেরার সময় জেলা পুলিশ প্রশাসন একটা পিক-আপের ব্যবস্থা করায় সকালের প্রিজন ভ্যানে চড়তে হলো না। জেলার সরাসরি না বললেও হাবেভাবে বুঝলাম, কালই ঢাকায় ফেরত চালানে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জেল প্রশাসন আবার চালান নিয়ে নাটক করতে পছন্দ করে। আগে থেকে কিছু না বলে চালানের সকালবেলা আসামিকে তৈরি হতে বলাটাই এদের রীতি। আকস্মিক নির্দেশে আসামি বেচারার যথেষ্ট মানসিক নির্যাতন হয় এবং এতেই কর্তৃপক্ষের বোধহয় অপার আনন্দ।
শবেবরাতের রাত গোপালগঞ্জ জেলেই কাটল। নিজ গৃহের কথা বড় মনে পড়ছিল। মিষ্টান্নের প্রতি আমার ভয়ানক দুর্বলতা রয়েছে। পারভীন রান্নাঘরে সচরাচর না গেলেও প্রতি শবেবরাতে আমার বিশেষ পছন্দের কয়েক ধরনের হালুয়া তৈরি করে। এবার নিশ্চয়ই রান্নাবান্না বাদ দিয়ে শাশুড়ি-বৌ কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। সারা রাত প্রায় অনিদ্রায় কাটিয়ে সকাল থেকে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। ৯টার দিকে ভারপ্রাপ্ত জেলার নূর মোহাম্মদ এসে জানালেন পুলিশ এসকর্ট এসে গেছে, আমি যাত্রা শুরু করতে পারি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দুপুর আড়াইটার দিকে ফিরলাম। সাত সেলের বন্ধুরা আমাকে সুস্থ শরীরে ফিরতে দেখে আনন্দ প্রকাশ করল। শবেবরাতের দিন যার যার বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার খাওয়ার সময় আমার অনুপস্থিতি তাদের পীড়া দিয়েছে শুনে বড় ভালো লাগল। ভাবলাম, জীবন কত বিচিত্র! ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা এই সাত সেলের বারো বন্দি কত অল্প সময়ের মধ্যে স্বজনে পরিণত হয়েছি।
দেখতে দেখতে জুলাই মাসের শেষ দিন চলে এলো। মাসের শেষ দিন শুরুই হলো ভারী বর্ষণের মধ্যে। ফজরের আজান আর বৃষ্টির মিলিত শব্দে ঘুম ভেঙেছে। একটু শীত-শীতও বোধ হচ্ছে। একবার মনে হলো, দৈনন্দিন জেল রুটিনে না হয় ব্যতিক্রম ঘটাই। কী হবে আর এত ভোরে উঠে? চাদর মুড়ি দিয়ে আরও কিছুক্ষণ ঘুমাই। পরক্ষণেই মনের দুর্বলতা ঝেড়ে এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে উঠলাম। জেলখানার এই কঠিন জীবনযাপন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মহাজোটের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে মনের জোর দিয়েই পরাজিত করতে হবে। বালতি এবং মগ নিয়ে চৌবাচ্চার কাছে যখন এলাম, ততক্ষণে বৃষ্টি অনেকটা ধরে এলেও একেবারে থামেনি। আমি দীর্ঘদিনের সাইনাসের রোগী, মাথায় বৃষ্টির পানি পড়লে সমস্যা বাড়ে। জেলে আসার পর থেকে শরীরকে আস্কারা দেয়া যথাসম্ভব বন্ধ করেছি। জেল কর্তৃপক্ষ যে খাদ্যই দেয়, বিনা প্রতিবাদে গলাধঃকরণ করি, যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়তে অস্বস্তিবোধ করি না। পরিষ্কারের সব বাতিক ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। আজ বৃষ্টির পানিতে আমার কেশবিহীন মাথা ভেজালাম। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই টয়লেট পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি শেষ করে গোসল শুরু করার আগেই বৃষ্টির বেগ আবার বেড়ে গেল। বারান্দায় চেয়ার পেতে বৃষ্টি দেখার ফাঁকেই মনে হলো আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতৃভূমি সফরের কথা রয়েছে। মাত্র দু’দিন আগে সরকার আমাকে গোপালগঞ্জ জেল দেখিয়ে এনেছে। জেলের খুব কাছেই প্রধানমন্ত্রীর মরহুম ভাই শেখ কামালের নামে জেলা স্টেডিয়াম। সেই শেখ কামাল স্টেডিয়ামেই শেখ হাসিনার জনসভা করার কথা। জেলখানায় যাওয়া-আসার পথে ব্যাপক প্রস্তুতি দেখে এসেছিলাম। এই বৈরী আবহাওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর গোপালগঞ্জে যাওয়া হবে তো?
বৃষ্টির মধ্যেই ১০টার খানিক পর আমার পড়শি মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিনকে পিজি হাসপাতালে নেয়ার জন্য জেলের লোকজন এসে হাজির। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছেন। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়েই দিনের পর দিন অনেক কষ্টে কোরআনের তাফসির লিখে চলেছেন। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তার প্রয়োজনীয় চিকিত্সার ব্যবস্থা করছিল না। তারা গোঁ ধরে বসে ছিল, জেলের বাইরে জয়নাল ভাইকে নেয়া যাবে না। চিকিত্সা যা হবে, সেটা জেলের মধ্যেই হবে। অথচ চোখের চিকিত্সার সুব্যবস্থা এই জেলে নেই। মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডারকে শেষ পর্যন্ত আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। আদালত চিকিত্সার নির্দেশ দেয়ার পরও প্রশাসন বেশ কিছুদিন ওপরের নির্দেশে টালবাহানা করে কাটিয়েছে। মার্কিন-ভারত সমর্থিত সরকার মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কা করবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই প্রকৃতির শাসকশ্রেণীকে উদ্দেশ করেই মহান আল্লাহতায়ালা সুরা আশ-শুরা’র ৪২ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার চালায় এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার ধর্মপরায়ণ রূপটি জনগণের কাছে বেশ দেখাতে আগ্রহী বলেই আমার সর্বদা মনে হয়েছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যবহৃত তার হিজাবপরিহিত, দু’হাত তুলে মোনাজাতরত পোস্টারের স্মৃতি দেশের অনেক নাগরিকের মনেই আশা করি এখনও উজ্জ্বল। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে তিনি প্রচারাভিযান আরম্ভ করেন হজরত শাহজালাল (র.)-এর রওজা জিয়ারতের মধ্য দিয়ে। প্রায় প্রতিবছর ওমরাহ পালন করেন, তাও দেখতে পাই। কিন্তু এগুলো সবই ধর্মের বাহ্যিক রূপ। পবিত্র গ্রন্থের মর্মবাণী হৃদয়ে প্রবেশ না করলে এসব করে কোনো ফায়দা নেই। জয়নাল ভাই যে সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করেন এবং তাফসির লেখেন তার উল্লেখ আগেই করেছি। ধর্মপ্রাণ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা চোখের চিকিত্সা শেষে আজ হয়তো একটা চশমা নিয়ে ফিরতে পারবেন।
গত দু’মাসের বন্দিজীবনে অনেকবারই মনে হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত সম্পর্কে আমার সরাসরি বক্তব্য ও লেখালেখি এই বন্দিত্বকে ত্বরান্বিত করেছে। মাঝেমধ্যে তর্জনগর্জন করলেও আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পরাশক্তির তাঁবেদার কোনো সংবাদপত্রকে আমার দেশ-এর মতো করে বন্ধ করার ক্ষমতা এই সরকারের কোনোদিনই হবে না। দেশের স্বাধীনতা, জনগণের স্বার্থ এবং নিজ ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে লড়াই করার পরিণতিতে জেলে আসায় আমার কোনোরকম অনুশোচনা নেই। এই পথ আমি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছি। মহান আল্লাহতায়ালাই তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন। পদ্মার বুকে ফেরিতে দুই ঘণ্টা কাটিয়ে গোপালগঞ্জ জেলে পৌঁছাতে বিকেল ৪টা বেজে গেল। নবনির্মিত জেলখানার চাকচিক্য দেখে ভালোই লাগল। জেল কর্মকর্তাদের অভ্যর্থনায় সৌজন্যের কোনো ঘাটতি নেই। ছোট একটি সমস্যার কথা শুনলাম। গোপালগঞ্জ জেলে কোনো ডিভিশন ওয়ার্ড না থাকার কারণে আমাকে কারা হাসপাতালে থাকতে হবে। প্রসন্ন চিত্তে ভারপ্রাপ্ত জেলারকে আশ্বস্ত করে ঢাকা জেলে দুই মাস ধরে সাত সেলে অবস্থানের কথা জানালাম। সাত সেলের বন্দিজীবনে অভ্যস্ত হওয়ার পর ডিভিশন ওয়ার্ডের প্রসঙ্গই এখন আমার কাছে অবান্তর। হাসপাতাল ওয়ার্ডে গিয়ে রীতিমত মুগ্ধ হলাম। বিশাল একটি কক্ষে আমার থাকার আয়োজন করা হয়েছে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, এখানে লাগোয়া টয়লেট রয়েছে। দুটো দিন আমাকে নিজহাতে গণটয়লেট পরিষ্কার করতে হবে না জেনেই আমি পুলকিত। কারা প্রশাসনের লোকজন একে একে পরিচিত হতে এলো। তাদের কাছ থেকেই জানলাম, ২০১০ সালের প্রথম দিকে গোপালগঞ্জের নতুন জেলটি উদ্বোধন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন।
কয়েদি এবং হাজতি মিলে মোট বন্দির সংখ্যা মাত্র সাড়ে তিনশ’। এখানে এমন ওয়ার্ডও আছে যেখানে আজ পর্যন্ত কোনো বন্দি ওঠেনি। উদাহরণস্বরূপ এই দোতলা হাসপাতালে আমিই সর্বপ্রথম বন্দি। একেবারেই নির্জন এই ওয়ার্ডে রাতে আমার জন্যে কোনো পাহারা লাগবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে জেলারকে বললাম, আমি একা থাকতেই বরং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব। ফার্মাসিস্ট রক্তচাপ মাপার যন্ত্র নিয়ে এলে তাকেও জানালাম, আমার রক্তচাপ স্বাভাবিকই আছে, কষ্ট করে পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। দীর্ঘপথ চলার ক্লান্তিতে রাত ১০টার মধ্যেই রাতের আহার শেষ করে হাসপাতালের পরিষ্কার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
ফজরের নামাজ পড়ে জেলজীবনের অভ্যাসমত সকাল ৬টার মধ্যেই গোসল শেষ করে নিজহাতে কাচা লুঙ্গি আর গেঞ্জি শুকানোর ব্যবস্থা করছি, এমন সময় গত রাত থেকে নিয়োজিত সেবক মোস্তফা এসে হাজির। আমি নিজহাতে কাপড় ধুয়েছি দেখে রীতিমত চোটপাট শুরু করে দিল। প্রায় কুড়ি বছর ধরে সাজাখাটা অভিজ্ঞ মেট মোস্তফার এই অসন্তোষের মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া খুঁজে পেয়ে ভালোই লাগল। অঙ্গীকার করতে হলো, যে কদিন গোপালগঞ্জে আছি অন্তত সে ক’দিন এমন গর্হিত কাজ আর করব না। সকাল সাড়ে ৯টায় সুবেদার এলো প্রিজন ভ্যান আসার খবর নিয়ে। জেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম, অন্যরকম আকৃতির এক প্রিজন ভ্যান। পেছনটা খোলা যেখানে সাধারণ কয়েদিরা চাপাচাপি করে বসে আছে, তাদের পাহারা দেয়ার জন্যে অস্ত্রহাতে তিন-চারজন সেন্ট্রি ডালার কাছে দাঁড়িয়ে। আমাকে বলা হলো সামনে ড্রাইভারের পাশে বসতে। আমি গাড়িতে ওঠার পর আমাকে মাঝখানে ঠেলে দরজার দিকে বসলেন একজন এসআই। জেল থেকে আদালত মিনিট দশেকের পথ। সোজা কোর্ট গারদে আমাকে নিয়ে তোলা হলো। মুখোমুখি দুটো গারদ। একটায় সব বন্দিকে ঢোকানো হলো এবং অপরটায় আমি একাই। ঘণ্টাখানেক ধরে অবিরত পায়চারি করে আমার পাদুটো আর চলছে না। কোর্ট ইন্সপেক্টরের বোধহয় মায়া হলো। একটু বিব্রত মুখেই একটা চেয়ার এনে ভদ্রলোক গারদের ভেতরেই আমার বসার ব্যবস্থা করলেন। আরও আধঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে ডাক পড়ল। এজলাসে গিয়ে মনটা উত্ফুল্ল হয়ে গেল। প্রকৌশলী রিজু, হাসিন, রিপন, চুন্নু, নজরুল, সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান, অ্যাডভোকেট মেসবাহ এবং আরও কয়েকজন পেশাজীবী ঢাকা থেকে এতদূর এসেছেন আদালতে আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। আমি অপরিসীম কৃতজ্ঞতাবোধে আপ্লুত হলাম। আজ শবেবরাত হওয়া সত্ত্বেও আপনজনদের ফেলে এতগুলো মানুষ গোপালগঞ্জে এসেছেন আমার কুশল জানতে। দেশপ্রেমিক পেশাজীবীদের এই সমর্থন প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। কাঠগড়ায় দশ আসামি বেশ গাদাগাদি করে দাঁড়ালাম। বাদী আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় নেতা। তার পরিবারের রাজাকারি অতীতের সংবাদ আমার দেশসহ তিন-চারটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় সেই নেতা মানহানি মামলা দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের মধ্যে সবাই সাংবাদিক, তবে সম্পাদক আমি একাই।
দশ আসামির মধ্যে নয়জনকে এরই মধ্যে জামিন দেয়া হয়েছে। এক আমার জন্যেই নাকি আজকের এত আয়োজন। আমি পেশায় যেহেতু আইনজীবী নই, কাজেই আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ বোঝা আমার কর্ম নয়। তবে একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে মনে হলো, এই অপচয়ের কোনো প্রয়োজন ছিল না। মামলার ধারা জামিনযোগ্য, আমি কারাগারে বন্দি, অর্থাত্ রাষ্ট্রীয় হেফাজতে আছি। এরকম পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বহীন, বানোয়াট মামলায় কেবল জামিন মঞ্জুরের আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার জন্যে আমাকে ঢাকা থেকে টেনে আনবার কী প্রয়োজন ছিল, সেটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকল না। আমার পক্ষে স্থানীয় একজন আইনজীবী দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ বিষয় ব্যাখ্যা করে জামিনের আবেদন করলেই তো জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। আমি যেহেতু সরকারের রোষানলে আছি, তাই আমার ব্যক্তিগত হয়রানির কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম, তবে আমাকে টানাহ্যাঁচড়া না করলে সরকারের অনেকগুলো টাকারও তো সাশ্রয় হতো। আমাকে আনা-নেয়ার জন্য দুই দফায় গাড়ি ভাড়া, ডজনখানেক পুলিশের পুরো দুই দিনের কর্মঘণ্টা নষ্ট, তাদের খোরাকির অর্থব্যয়—তা সে যতই সামান্য হোক, ঢাকা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশ প্রশাসনে সতর্কাবস্থা, এসব করে কার কী লাভ হচ্ছে আল্লাহই জানেন! জামিন হয়ে গেলে আদালত থেকে গোপালগঞ্জ জেলে ফিরলাম। ফেরার সময় জেলা পুলিশ প্রশাসন একটা পিক-আপের ব্যবস্থা করায় সকালের প্রিজন ভ্যানে চড়তে হলো না। জেলার সরাসরি না বললেও হাবেভাবে বুঝলাম, কালই ঢাকায় ফেরত চালানে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জেল প্রশাসন আবার চালান নিয়ে নাটক করতে পছন্দ করে। আগে থেকে কিছু না বলে চালানের সকালবেলা আসামিকে তৈরি হতে বলাটাই এদের রীতি। আকস্মিক নির্দেশে আসামি বেচারার যথেষ্ট মানসিক নির্যাতন হয় এবং এতেই কর্তৃপক্ষের বোধহয় অপার আনন্দ।
শবেবরাতের রাত গোপালগঞ্জ জেলেই কাটল। নিজ গৃহের কথা বড় মনে পড়ছিল। মিষ্টান্নের প্রতি আমার ভয়ানক দুর্বলতা রয়েছে। পারভীন রান্নাঘরে সচরাচর না গেলেও প্রতি শবেবরাতে আমার বিশেষ পছন্দের কয়েক ধরনের হালুয়া তৈরি করে। এবার নিশ্চয়ই রান্নাবান্না বাদ দিয়ে শাশুড়ি-বৌ কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। সারা রাত প্রায় অনিদ্রায় কাটিয়ে সকাল থেকে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। ৯টার দিকে ভারপ্রাপ্ত জেলার নূর মোহাম্মদ এসে জানালেন পুলিশ এসকর্ট এসে গেছে, আমি যাত্রা শুরু করতে পারি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দুপুর আড়াইটার দিকে ফিরলাম। সাত সেলের বন্ধুরা আমাকে সুস্থ শরীরে ফিরতে দেখে আনন্দ প্রকাশ করল। শবেবরাতের দিন যার যার বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার খাওয়ার সময় আমার অনুপস্থিতি তাদের পীড়া দিয়েছে শুনে বড় ভালো লাগল। ভাবলাম, জীবন কত বিচিত্র! ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা এই সাত সেলের বারো বন্দি কত অল্প সময়ের মধ্যে স্বজনে পরিণত হয়েছি।
দেখতে দেখতে জুলাই মাসের শেষ দিন চলে এলো। মাসের শেষ দিন শুরুই হলো ভারী বর্ষণের মধ্যে। ফজরের আজান আর বৃষ্টির মিলিত শব্দে ঘুম ভেঙেছে। একটু শীত-শীতও বোধ হচ্ছে। একবার মনে হলো, দৈনন্দিন জেল রুটিনে না হয় ব্যতিক্রম ঘটাই। কী হবে আর এত ভোরে উঠে? চাদর মুড়ি দিয়ে আরও কিছুক্ষণ ঘুমাই। পরক্ষণেই মনের দুর্বলতা ঝেড়ে এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে উঠলাম। জেলখানার এই কঠিন জীবনযাপন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মহাজোটের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে মনের জোর দিয়েই পরাজিত করতে হবে। বালতি এবং মগ নিয়ে চৌবাচ্চার কাছে যখন এলাম, ততক্ষণে বৃষ্টি অনেকটা ধরে এলেও একেবারে থামেনি। আমি দীর্ঘদিনের সাইনাসের রোগী, মাথায় বৃষ্টির পানি পড়লে সমস্যা বাড়ে। জেলে আসার পর থেকে শরীরকে আস্কারা দেয়া যথাসম্ভব বন্ধ করেছি। জেল কর্তৃপক্ষ যে খাদ্যই দেয়, বিনা প্রতিবাদে গলাধঃকরণ করি, যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়তে অস্বস্তিবোধ করি না। পরিষ্কারের সব বাতিক ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। আজ বৃষ্টির পানিতে আমার কেশবিহীন মাথা ভেজালাম। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই টয়লেট পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি শেষ করে গোসল শুরু করার আগেই বৃষ্টির বেগ আবার বেড়ে গেল। বারান্দায় চেয়ার পেতে বৃষ্টি দেখার ফাঁকেই মনে হলো আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতৃভূমি সফরের কথা রয়েছে। মাত্র দু’দিন আগে সরকার আমাকে গোপালগঞ্জ জেল দেখিয়ে এনেছে। জেলের খুব কাছেই প্রধানমন্ত্রীর মরহুম ভাই শেখ কামালের নামে জেলা স্টেডিয়াম। সেই শেখ কামাল স্টেডিয়ামেই শেখ হাসিনার জনসভা করার কথা। জেলখানায় যাওয়া-আসার পথে ব্যাপক প্রস্তুতি দেখে এসেছিলাম। এই বৈরী আবহাওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর গোপালগঞ্জে যাওয়া হবে তো?
বৃষ্টির মধ্যেই ১০টার খানিক পর আমার পড়শি মেজর (অব.) জয়নাল আবেদিনকে পিজি হাসপাতালে নেয়ার জন্য জেলের লোকজন এসে হাজির। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছেন। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়েই দিনের পর দিন অনেক কষ্টে কোরআনের তাফসির লিখে চলেছেন। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তার প্রয়োজনীয় চিকিত্সার ব্যবস্থা করছিল না। তারা গোঁ ধরে বসে ছিল, জেলের বাইরে জয়নাল ভাইকে নেয়া যাবে না। চিকিত্সা যা হবে, সেটা জেলের মধ্যেই হবে। অথচ চোখের চিকিত্সার সুব্যবস্থা এই জেলে নেই। মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডারকে শেষ পর্যন্ত আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। আদালত চিকিত্সার নির্দেশ দেয়ার পরও প্রশাসন বেশ কিছুদিন ওপরের নির্দেশে টালবাহানা করে কাটিয়েছে। মার্কিন-ভারত সমর্থিত সরকার মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কা করবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই প্রকৃতির শাসকশ্রেণীকে উদ্দেশ করেই মহান আল্লাহতায়ালা সুরা আশ-শুরা’র ৪২ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার চালায় এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার ধর্মপরায়ণ রূপটি জনগণের কাছে বেশ দেখাতে আগ্রহী বলেই আমার সর্বদা মনে হয়েছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যবহৃত তার হিজাবপরিহিত, দু’হাত তুলে মোনাজাতরত পোস্টারের স্মৃতি দেশের অনেক নাগরিকের মনেই আশা করি এখনও উজ্জ্বল। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে তিনি প্রচারাভিযান আরম্ভ করেন হজরত শাহজালাল (র.)-এর রওজা জিয়ারতের মধ্য দিয়ে। প্রায় প্রতিবছর ওমরাহ পালন করেন, তাও দেখতে পাই। কিন্তু এগুলো সবই ধর্মের বাহ্যিক রূপ। পবিত্র গ্রন্থের মর্মবাণী হৃদয়ে প্রবেশ না করলে এসব করে কোনো ফায়দা নেই। জয়নাল ভাই যে সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করেন এবং তাফসির লেখেন তার উল্লেখ আগেই করেছি। ধর্মপ্রাণ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা চোখের চিকিত্সা শেষে আজ হয়তো একটা চশমা নিয়ে ফিরতে পারবেন।
No comments