৬- রিমান্ডের বিভীষিকা
টয়লেটের জন্যে তো একচিলতে আধখোলা জায়গা। হাজতে আসামির সংখ্যা ততক্ষণে অন্তত পনেরোজন। কাজেই টয়লেটে যাওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে যার যার কাপড়েই কাজ সারা হতে লাগল। এরপর বসে থাকা তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেয়াও নরকযন্ত্রণার সমতুল্য।...
কোতোয়ালি থানায় যখন পৌঁছলাম, সূর্য তখনও পুরোপুরি অস্ত যায়নি। সিএমএম আদালত থেকে স্বল্প দূরত্বের থানায় যাওয়ার পথে রিমান্ডের আসন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে চিন্তার পরিবর্তে পথ-ঘাট ঠাহর করতেই অধিকতর মনোযোগী ছিলাম। বাল্যকাল কেটেছে পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। সে সময় নানার সঙ্গে প্রায়ই সদরঘাটের আড়ত থেকে ফল এবং পাটুয়াটুলির এক বোম্বাই মিষ্টান্নের দোকান থেকে অতীব সুস্বাদু মিষ্টি কিনতে আসতাম। প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে মনে হলো, যেন বাল্যের সেই চেনা জায়গাগুলোই অতিক্রম করছি। কাছাকাছি মায়া নামে এক সিনেমা হলও ছিল। আমার নানা সিনেমা দেখা অপছন্দ করলেও নানীর শখ ছিল ষোলআনাই। অতি শৈশবে নানা ছাড়া পরিবারের আর সবাই একসঙ্গে মায়া হলে যে সিনেমা দেখতে এসেছিলাম, সেই স্মৃতিও এতদিন পর মনে এলো। ছবিটার নায়ক ছিলেন সম্ভবত দিলীপ কুমার। নস্টালজিয়ায় ডুব দিয়ে বেশিক্ষণ থাকা গেল না।
প্রিজন ভ্যান ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে থেমে গেছে। ভ্যানের তালা খোলা হলো। এক তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এসে বললেন, তিনিই কোতোয়ালি থানার দায়ের করা মামলার আইও। যথেষ্ট সম্ভ্রমের সঙ্গে নিয়ে গেলেন থানার সেকেন্ড অফিসারের কক্ষে। চা এবং বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়িত হলাম। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি চাইলে সেই অনুরোধও রক্ষিত হলো। একে একে সেকেন্ড অফিসার এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেই কক্ষে এসে যথেষ্ট সৌজন্যের সঙ্গে পরিচয়পর্ব সাঙ্গ করলেন। দু’জনারই দেশের বাড়ি কাকতালীয়ভাবে গোপালগঞ্জে। নাম যথাক্রমে আতাউর এবং সালাহ্উদ্দিন। রাতে কী খেতে চাই, তাও সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো। সকাল থেকে পেটে তেমন কিছু না পড়লেও আমি চা ছাড়া আর কিছু খেতে চাইলাম না। আমাকে ভরসা দিয়ে জানানো হলো, সেকেন্ড অফিসারের কক্ষেই রাতযাপন এবং পরদিন রিমান্ডের আনুষ্ঠানিকতা অন্তে যথাসময়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুনরায় হাজির করানো হবে। মামলা যে লজ্জাকরভাবে বানোয়াট, সেটা যেহেতু উভয় পক্ষেরই জানা ছিল, কাজেই জিজ্ঞাসাবাদ নামক বিষয়টি এই প্রাথমিক আলোচনায় কোনো স্থানই পেল না।
ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন দেখতে পেলাম। শুনলাম থানা কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট সদ্দিচ্ছা (?) সত্ত্বেও আমাকে সেকেন্ড অফিসারের কক্ষে আর রাখা যাচ্ছে না। উপরের নির্দেশে হাজতে তখনই স্থানান্তর করতে হবে। আমিও তথাস্তু বলে আইও’র পেছন পেছন কোতোয়ালি থানার হাজতে প্রবেশ করলাম। ক্যান্টনমেন্ট থানা এবং কোর্ট গারদে দেখা হাজতের তুলনায় সেলটি বেশ ছোট। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। হাজতে ঢুকে দেখলাম, আমি তখন পর্যন্ত সেখানে একমাত্র আসামি। কাজেই ভাবলাম, একজন মানুষের জন্য এটিও প্রকাণ্ড সেল। এশার নামাজ হাজতে পড়লাম, মাগরিবের নামাজ আগেই সেকেন্ড অফিসারের অফিস ঘরে পড়ে নিয়েছিলাম। থানা প্রশাসনের প্রকৃত চরিত্র তখনও চেনা হয়ে ওঠেনি।
রাত আটটার পর থেকে পরিস্থিতি আরও পাল্টাতে শুরু করলো। হাজতে তিনজন নতুন আসামি ঢোকানো হলো। তাদের মধ্যে একজন ডাণ্ডাবেড়ি পরিহিত। সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখেই তিনজন বসলো। খানিকটা ভড়কে গেলেও ভাবলাম, এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে গল্প-গুজব করলেই বরং রাতটা ভালো কাটবে। ডাণ্ডাবেড়ি পরা ছেলেটিকেই নেতা মনে হলো। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, তাকে ডাকাতি মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে একবার রিমান্ড পর্ব সাঙ্গ করা হয়েছে। এবার দ্বিতীয় দফা রিমান্ড। সপ্তাহখানেক আগের রিমান্ডের চিহ্ন ফোলা হাঁটু এবং দুই হাতের কনুইয়ে দৃশ্যমান। পরে অবশ্য থানার লোকজনই জানিয়েছিল সে নাকি রাজধানীর একজন দুর্ধর্ষ, পেশাদার খুনি। ক’দিন আগে পুরনো ঢাকায় এক পুলিশ কর্মকর্তা হত্যায় তাকেই সন্দেহ করা হচ্ছে। ওরকম রোগা-পটকা, তিরিশের ঘরে পা না দেয়া যুবককে দুর্ধর্ষ খুনি হিসেবে কল্পনা করা কঠিন। অবশ্য গুলি চালানোর জন্যে তো আর গামা পাহলোয়ান হওয়ার দরকার নেই।
সারা রাত ধরে এই ছেলেটি আমাকে ওই নারকীয় পরিবেশে যথাসম্ভব স্বাচ্ছন্দ্য দেয়ার চেষ্টা করেছে। তবে সেই বর্ণনায় পরে আসছি। রাত দশটায় পুনরায় গারদের তালা খোলা হলো। এবার যে পাঁচজন আসামি টলতে টলতে ঢুকলো তাদের পরনে শতছিন্ন, নোংরা, দুর্গন্ধময় পোশাক। শরীরে হাড় ছাড়া আর কিছু নেই। অসংলগ্ন আচরণ করতে করতে প্রায় আমার ঘাড়ের ওপর বসে পড়লো তারা। গাঁজা, সিগারেট এবং অপরিচ্ছন্ন শরীরের দুর্গন্ধে নিমেষে হাজতের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। কথিত খুনি ছেলেটি দেখলাম এদের চেনে। ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থাতেই উঠে এসে ঠেলে, ধাক্কিয়ে আমার কাছ থেকে যতটা দূরে সম্ভব দলটিকে সরিয়ে দিল। তারপর হাসতে হাসতে জানালো, এরা সবাই হেরোইনসেবী। সদরঘাট, ইসলামপুর এলাকার দোকানের বারান্দা এদের নিবাস। ওদের পুলিশ কেন ধরে এনেছে, জিজ্ঞাসা করতেই সমস্বরে যা বললো তার মর্মার্থ উদ্ধার করা কঠিন। যতটুকু বুঝলাম, তাতে আমার সন্দেহ জন্মালো—আমাকে মানসিকভাবে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবেই এই মাদকাসক্তদের হাজতে আগমন। কাল সকালে হয় থানা থেকেই ছেড়ে দেবে অথবা তিন ধারায় চালান দিয়ে আদালতে কয়েকশ’ টাকা জরিমানা করা হবে। টাকাটা তাত্ক্ষণিকভাবে দিতে পারলে সিএমএম কোর্ট থেকেই মুক্তি, নইলে সর্বোচ্চ পাঁচ দিনের জেলবাস। এর মধ্যেই রাতের আহার চলে এলো। একই থালার মধ্যে ভাত, ডাল এবং সবজি জাতীয় একটা কিছু। নেশাখোরদের ভাত খাওয়ার দৃশ্য দেখে অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হলো। ডাল মেশানো ভাত মুখে, শরীরে, মেঝেতে সর্বত্র। কেউ কেউ খাচ্ছে এবং ঝিমুচ্ছে। চিবুতে ভুলে গেছে। একজন দেখলাম, খাওয়া অসমাপ্ত রেখে এঁটো হাতেই হাজতের টয়লেট ঘুরে এসে নির্বিকারভাবে আবার ভাতের থালায় হাত ডুবালো। নারকীয় দৃশ্য। আমার ভেতর থেকে সবকিছু উঠে আসতে চাচ্ছে। নেহাত উঠে আসার মতো পেটে কিছু ছিল না। ডাণ্ডাবেড়ির জন্যে বাসা থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে উন্নত খাদ্য এলো। ছেলেটি আমাকে অনুরোধ করলো তার খাওয়ায় ভাগ বসাতে। তার মা নাকি রান্না করে পাঠিয়েছে। খাব কী! আমি তখন প্রাণপণ চেষ্টায় বমি আটকাচ্ছি। পরবর্তী ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে দুই দফায় আরও পাঁচজনকে ঠেসে দেয়া হলো একই হাজতে।
কোনোক্রমে এক কোণে বসে আছি। এর মধ্যে মাদকাসক্তদের পেটে ভাত পড়ার প্রতিক্রিয়া শুরু হলো। টয়লেটের জন্যে তো একচিলতে আধখোলা জায়গা। হাজতে আসামির সংখ্যা ততক্ষণে অন্তত পনেরোজন। কাজেই টয়লেটে যাওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে যার যার কাপড়েই কাজ সারা হতে লাগল। এরপর বসে থাকা তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেয়াও নরকযন্ত্রণার সমতুল্য। ডাণ্ডাবেড়ি আমার প্রাণান্তকর অবস্থা লক্ষ্য করছিল। হঠাত্ তার বোঁচকার মধ্য থেকে ভোজবাজির মতো আগরবাতির বাক্স এবং ম্যাচ বার হলো। ছেলেটি একটা আগরবাতি জ্বালিয়ে আমার একেবারে কাছে নিয়ে এলে কৃতজ্ঞতামাখা কেবল একটা হাসি প্রতিদান দিতে পেরেছিলাম। হাতের ঘড়িতে দেখলাম, রাত প্রায় দুটো। খানিক পর আইও এসে বলল, এবার আমার জিজ্ঞাসাবাদ হবে। আমার কাছে তখন ওই নরককুণ্ড থেকে বার হওয়াই জীবন ফিরে পাওয়ার শামিল। জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমাকে শারীরিক নির্যাতন করা হবে কি-না, সেটা নিয়ে আর ভাবছি না। গন্তব্য সেই সেকেন্ড অফিসারের কক্ষ। আমার অসুবিধার জন্যে বারবার ক্ষমাপ্রার্থনা করে ভদ্রলোক চা খাওয়াতে চাইলেন। আমি ভাবলেশহীনভাবে চায়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু করতে বললাম। আইও এবং সেকেন্ড অফিসার পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে জানালো, তাদের কোনো জিজ্ঞাস্য নেই। আধঘণ্টাখানেক নির্বাক বসে থাকার পর আইও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। এখন আবার হাজতে ফিরতে হবে। সেখানে ফিরে দেখি, আরও জনা দুই আসামি এসেছে, যারা সম্ভবত খানিক আগেই প্রচুর মদ্যপান করেছে। কারণ গাঁজা ও বিষ্ঠার গন্ধ ছাপিয়ে মদের গন্ধে হাজত ভরে গেছে। সেই সঙ্গে আমার বসার জায়গাটাও বেদখল। কী আর করা! কোনোরকমে ঠেলেঠুলে গারদের একেবারে দরজা ঘেঁষে একটুখানি দাঁড়ানোর স্থান মিললো। শিকের ফাঁক দিয়ে নাকটাকে বাইরে নিয়ে অক্সিজেন নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম। সদ্য মৃতব্যক্তির শোকাতুর বাড়িতেও রাত পোহায়। কোতোয়ালি থানার হাজতের রাতও প্রকৃতির নিয়মে একসময় শেষ হলো। ঘড়ি দেখতে আর ইচ্ছে করছিল না। ধারণা করছি, সকাল আটটার মতো হবে। সেলের ওই জমাটবাঁধা দুর্গন্ধের মধ্যে আবার নাস্তার পাট শুরু হলো। সবাই নির্বিকারভাবে খেয়ে যাচ্ছে। একমাত্র ব্যতিক্রম আমি। সকালের সেন্ট্রি ইতস্তত করে একবার খাওয়ার কথা ওঠানোয় চশমার ভেতর দিয়ে চোখ তুলে তার দিকে তাকাতেই পিছিয়ে গেল। সকাল ন’টায় দু’জন করে আসামিকে হাজত থেকে বের করে উল্টোদিকের ঘরে নিয়ে শুরু হলো পেটানো। হাজতে বসেই লাঠির আওয়াজ আর বাবাগো, মাগো চিত্কার শুনতে থাকলাম। এক এক দলের বরাদ্দ পনেরো মিনিট। হাত-পায়ের কবজিতে রক্তের চিহ্ন নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরতে লাগল তারা। ফিরে এসে কান্নার ফাঁকে ফাঁকে পুলিশের বাবা-মাকে উদ্দেশ করে অশ্রাব্য গালাগাল। ঘণ্টা দুয়েক এই সার্কাস চললো।
আমি গারদের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। একসময় দূরে ডিউটি অফিসারের অফিসকক্ষে মনে হলো যেন আমার সহকর্মী সাংবাদিক নাছিরকে দেখলাম। নাছির আমাদের পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার। হয়তো আমি বেঁচে আছি কি-না, খবর নিতে এসেছে। দূর থেকে হলেও ওকে দেখে স্বজনকে ফিরে পাওয়ার অনুভূতি হলো। এর মধ্যেই আসামিদের নেয়ার জন্যে প্রথম দফা প্রিজন ভ্যান এসেছে। আসামিদের গারদ থেকে বের করে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে কোমরে দড়ি এবং হাতকড়া পরানো হচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম না. আমাকেও ওই লাইনে দাঁড়াতে হবে কি-না। থানা প্রশাসন নির্বিকার, কিছুই জানাচ্ছে না। আমার আইও সেই যে রাতে ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ পর গায়েব হয়েছে, তারপর থেকে দেখা নেই। হাজতের সামনে দিয়ে যাতায়াতরত অন্যান্য কর্মকর্তা এবং কনস্টেবলদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, তারা আমারও কোমরে দড়ি পরানোর চূড়ান্ত নির্দেশের জন্যই অপেক্ষমাণ। কোর্টহাজত থেকে আগত এক নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা আড়চোখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল। শেষ পর্যন্ত দুপুর একটার দিকে হারানো আইও এসে সংবাদ দিল আমাকে নেয়ার জন্যে প্রিজন ভ্যান এসেছে। ভ্যানে উঠতে যাচ্ছি, সেকেন্ড অফিসারসহ থানার অন্যান্য কর্মকর্তা আমার সামনে প্রায় হাতজোড় করে অন্তত এক গ্লাস পানি মুখে দেয়ার অনুরোধ করল। আত্মসংযম যথাসম্ভব বজায় রেখে গম্ভীরভাবে তাদের অনুরোধ ফিরিয়ে দিলাম। আমার মানসিক অবস্থা টের পেয়ে ওদেরই একজন অনুচ্চকণ্ঠে বলল, আমার ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের নির্দেশ ছিল। কোতোয়ালি থানা নাকি তাতে সম্মত হয়নি। মনে আছে, সে বলেছিল বারো দিনের রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই তার কথার সত্যতার প্রমাণ আমি পেয়ে যাব। সেই প্রমাণ পেতে আমাকে বারো ঘণ্টার অধিক সময় অপেক্ষা করতে হয়নি।
কোতোয়ালি থানা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে না তুলে আমাকে সরাসরি কোর্ট গারদে নেয়া হলে হতাশ হলাম। আমি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে একরাতের রিমান্ডের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে চাচ্ছিলাম, যাতে জাতি এই ফ্যাসিস্ট সরকারের স্বরূপ চিনতে পারে। কেবলই মনে হচ্ছিল, মহান আল্লাহ্র রহমত এবং দেশপ্রেমিক, বিবেকবান জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদ ছাড়া এই মৃত্যুগুহা থেকে আমি আর ফিরতে পারব না। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কোর্ট গারদে বসিয়ে রেখে আমাকে জানানো হলো, কোর্টে না তুলেই সরাসরি দ্বিতীয় রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। প্রিজন ভ্যানের কাছে পৌঁছেই দেখি, ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম দাঁড়িয়ে আছে। সে শ্বাপদের মতো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। চারদিকে দাঙ্গা পুলিশের মধ্যেই আমি আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার দাবি করলাম। কোনো কথা না বলে রূঢ় ভঙ্গিতে ইন্সপেক্টর রেজা প্রিজন ভ্যানে উঠতে ইশারা করল। বুঝলাম সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। প্রিজন ভ্যান স্টার্ট দেয়ার মুহূর্তে শুনতে পেলাম, কে যেন উচ্চস্বরে ডাকছে, মাহমুদ ভাই আপনি কোথায়? সর্বশক্তি জড়ো করে চিত্কার করে উঠলাম, আমি ভ্যানের ভেতরে। উঁচু লোহার গ্রিলের ফাঁকের মধ্য দিয়ে অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদারকে দেখতে পেয়ে ভরসা হলো, আমার অন্তিম বক্তব্য দেশবাসী তাহলে জানতে পারবে। ততক্ষণে মাসুদ ভাই আইও রেজার সঙ্গে বিষম তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। তিনি আদালত থেকে আমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি নিয়ে এসেছেন, অথচ আইও দেখা করতে দেবে না। পারলে মাসুদ তালুকদারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে প্রিজন ভ্যান চালিয়ে দেয়। তর্কাতর্কি চলাকালেই আরেকজন জুনিয়র আইনজীবী আদালতের লিখিত নির্দেশনামা নিয়ে এলে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেজাউল করিম ভ্যানের তালা খুলে আমাকে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিল। অ্যাডভোকেট মাসুদকে সঙ্গে করে কোর্ট গারদে ফিরে গেলাম। আগের চব্বিশ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমার সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে, তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত সংবাদমাধ্যমকে জানানোর অনুরোধ করলাম। ততক্ষণে অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিঞাও আমাদের আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। তারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করলেন। আমি তাদের আগাম বলে গেলাম পরবর্তী রিমান্ডে আমার প্রাণসংশয় রয়েছে। এক ধরনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখন আমার মধ্যে কাজ করছিল। আইও’র অবয়বে একজন হত্যাকারীকে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার কিছু হলে বাড়ির লোকজনদের দেখার অনুরোধ করে দুই আইনজীবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুনর্বার প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। দু’জনই বিষণ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ইন্সপেক্টর রেজা আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিল তার শিকারকে যথাস্থানে পৌঁছে দেয়ার জন্যে।
পুরনো ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে ভিআইপি রোড ধরে কারওয়ান বাজারে আমার দেশ কার্যালয় অতিক্রম করার সময় ভাবছিলাম, আর কি কোনোদিন সম্পাদকের অফিসে ফিরতে পারব? আমাদের পত্রিকা অফিসের একেবারে কাছেই তেজগাঁও থানা। ভ্যান থানা অতিক্রম করে এগিয়ে গেলে বুঝলাম, আমরা অন্য কোনো স্থানে চলেছি। এদিন ভ্যানের ভেতরে আমার সঙ্গে একজন অতিরিক্ত কনস্টেবল পাহারার জন্যে দেয়া হয়েছিল। একবার ভাবলাম, কোথায় যাচ্ছি ওকেই জিজ্ঞেস করি। পরক্ষণেই মনে হলো, দরিদ্র বেচারার চাকরি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে কী লাভ? গ্রেফতারের রাতের মতো জাহাঙ্গীর গেট পেরিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রিজন ভ্যান প্রবেশ করতেই নিশ্চিত হলাম, আমাকে ক্যান্টনমেন্ট থানাতেই নেয়া হচ্ছে। স্বজনদের এই সংবাদটি জানানোর জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠলেও আমি অসহায়, পিঞ্জরাবদ্ধ। এরই নাম বাংলাদেশে আইনের শাসন? যে থানা মামলা দায়ের করে, রিমান্ডে সেই থানাতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা আইনত বাধ্যতামূলক হলেও আমাকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গৃহে কোনো পুরুষ মানুষ নেই যে, ছোটাছুটি করে আমার সঠিক অবস্থান খুঁজে বার করবে। অসহায় শাশুড়ি ও পুত্রবধূ কাদের দ্বারে দ্বারে একটুখানি খবরের আশায় ছুটে বেড়িয়ে অপমানিত হবে, কে জানে? এই গণতন্ত্রের জন্যে তাহলে ১৯৭১ সালে আমরা রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ করেছি, ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছি! আকাশ-পাতাল ভাবনার মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট থানা চলে এলো।
আজকের ড্রাইভার রাস্তা চেনে। প্রথম রাতের মতো ভুল করে অন্য জায়গায় নিয়ে গাড়ি থামায়নি। পরিচিত থানায় প্রিজন ভ্যান থেকে নেমে সময়ক্ষেপণ না করে সোজা ডিউটি অফিসারের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। আমার পেছন পেছন আইও রেজা ঘরে ঢুকে, আরেকটি চেয়ার নিয়ে আমার পাশে বসেই ডিউটি অফিসারকে নানারকম নির্দেশ দিতে লাগল। বাসা থেকে একটা ছোট ব্যাগে আমার জন্য টুকিটাকি কিছু জিনিস পাঠানো হয়েছিল। এক সেট পরিষ্কার প্যান্ট-শার্ট, একটা লুঙ্গি, টুথ ব্রাশ, পেস্ট, সাবান, কিছু শুকনো খাবার ইত্যাদি। সেই ব্যাগটি ডিউটি অফিসারের হাতে দেয়ার পর অনুচ্চকণ্ঠে দু’জনার মধ্যে কিছু বাক্যবিনিময় হলো। আমার শোনার কোনো উত্সাহ ছিল না। তবে আমার দিকে ডিউটি অফিসারের চকিত, রহস্যময় চাহনি দেখে খানিকটা সচকিত হয়ে উঠলাম। কোতোয়ালি থানার অচেনা, তরুণ পুলিশ কর্মকর্তার আজ দুপুরের ভয়ঙ্কর নির্যাতনের আগাম সতর্কবার্তার কথা মনে পড়লো। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে পূর্বপরিচিত হাজতখানায় ঢুকলাম। বাসা থেকে পাঠানো ব্রাশ, পেস্ট এবং সাবান সঙ্গে নিতে দেয়া হলো না। বলা হলো, প্রয়োজন অনুযায়ী ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ব্যবহার শেষে প্রতিবার ফেরত দিতে হবে। আমি যে ফ্যাসিবাদী প্রশাসনের একেবারে হাতের মুঠোয়, সেটাই অবমাননাকরভাবে বুঝিয়ে দেয়া আর কি! নোংরা টয়লেটের ওপর দাঁড়িয়ে বদনায় পানি ভরে গোসল করলাম। আগের রাতে হেরোইনসেবীদের সঙ্গে একই সেলে গাদাগাদি করে কাটিয়ে নিজেকে বড় ক্লেদাক্ত বোধ হচ্ছিল। ব্যবহার শেষে টুথ ব্রাশ, পেস্ট এবং সাবান ফেরত গেল ডিউটি অফিসারের কাছে। কাল সকালে আবার চাইতে হবে। রাত ন’টার দিকে থানা কর্তৃপক্ষ পরোটা, ডিমভাজি এবং লেবু দেয়া রং চা সরবরাহ করলে সামান্য ডিমভাজি দিয়ে অর্ধেক পরোটা এবং পুরো কাপ চা পেটে চালান করে রাতের আহার সাঙ্গ করলাম। প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা উপোসের পর এই আহার। তারপর হাজতের নোংরা মেঝেতেই শুয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগলাম।
প্রিজন ভ্যান ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে থেমে গেছে। ভ্যানের তালা খোলা হলো। এক তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এসে বললেন, তিনিই কোতোয়ালি থানার দায়ের করা মামলার আইও। যথেষ্ট সম্ভ্রমের সঙ্গে নিয়ে গেলেন থানার সেকেন্ড অফিসারের কক্ষে। চা এবং বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়িত হলাম। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি চাইলে সেই অনুরোধও রক্ষিত হলো। একে একে সেকেন্ড অফিসার এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেই কক্ষে এসে যথেষ্ট সৌজন্যের সঙ্গে পরিচয়পর্ব সাঙ্গ করলেন। দু’জনারই দেশের বাড়ি কাকতালীয়ভাবে গোপালগঞ্জে। নাম যথাক্রমে আতাউর এবং সালাহ্উদ্দিন। রাতে কী খেতে চাই, তাও সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো। সকাল থেকে পেটে তেমন কিছু না পড়লেও আমি চা ছাড়া আর কিছু খেতে চাইলাম না। আমাকে ভরসা দিয়ে জানানো হলো, সেকেন্ড অফিসারের কক্ষেই রাতযাপন এবং পরদিন রিমান্ডের আনুষ্ঠানিকতা অন্তে যথাসময়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুনরায় হাজির করানো হবে। মামলা যে লজ্জাকরভাবে বানোয়াট, সেটা যেহেতু উভয় পক্ষেরই জানা ছিল, কাজেই জিজ্ঞাসাবাদ নামক বিষয়টি এই প্রাথমিক আলোচনায় কোনো স্থানই পেল না।
ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন দেখতে পেলাম। শুনলাম থানা কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট সদ্দিচ্ছা (?) সত্ত্বেও আমাকে সেকেন্ড অফিসারের কক্ষে আর রাখা যাচ্ছে না। উপরের নির্দেশে হাজতে তখনই স্থানান্তর করতে হবে। আমিও তথাস্তু বলে আইও’র পেছন পেছন কোতোয়ালি থানার হাজতে প্রবেশ করলাম। ক্যান্টনমেন্ট থানা এবং কোর্ট গারদে দেখা হাজতের তুলনায় সেলটি বেশ ছোট। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। হাজতে ঢুকে দেখলাম, আমি তখন পর্যন্ত সেখানে একমাত্র আসামি। কাজেই ভাবলাম, একজন মানুষের জন্য এটিও প্রকাণ্ড সেল। এশার নামাজ হাজতে পড়লাম, মাগরিবের নামাজ আগেই সেকেন্ড অফিসারের অফিস ঘরে পড়ে নিয়েছিলাম। থানা প্রশাসনের প্রকৃত চরিত্র তখনও চেনা হয়ে ওঠেনি।
রাত আটটার পর থেকে পরিস্থিতি আরও পাল্টাতে শুরু করলো। হাজতে তিনজন নতুন আসামি ঢোকানো হলো। তাদের মধ্যে একজন ডাণ্ডাবেড়ি পরিহিত। সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখেই তিনজন বসলো। খানিকটা ভড়কে গেলেও ভাবলাম, এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে গল্প-গুজব করলেই বরং রাতটা ভালো কাটবে। ডাণ্ডাবেড়ি পরা ছেলেটিকেই নেতা মনে হলো। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, তাকে ডাকাতি মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে একবার রিমান্ড পর্ব সাঙ্গ করা হয়েছে। এবার দ্বিতীয় দফা রিমান্ড। সপ্তাহখানেক আগের রিমান্ডের চিহ্ন ফোলা হাঁটু এবং দুই হাতের কনুইয়ে দৃশ্যমান। পরে অবশ্য থানার লোকজনই জানিয়েছিল সে নাকি রাজধানীর একজন দুর্ধর্ষ, পেশাদার খুনি। ক’দিন আগে পুরনো ঢাকায় এক পুলিশ কর্মকর্তা হত্যায় তাকেই সন্দেহ করা হচ্ছে। ওরকম রোগা-পটকা, তিরিশের ঘরে পা না দেয়া যুবককে দুর্ধর্ষ খুনি হিসেবে কল্পনা করা কঠিন। অবশ্য গুলি চালানোর জন্যে তো আর গামা পাহলোয়ান হওয়ার দরকার নেই।
সারা রাত ধরে এই ছেলেটি আমাকে ওই নারকীয় পরিবেশে যথাসম্ভব স্বাচ্ছন্দ্য দেয়ার চেষ্টা করেছে। তবে সেই বর্ণনায় পরে আসছি। রাত দশটায় পুনরায় গারদের তালা খোলা হলো। এবার যে পাঁচজন আসামি টলতে টলতে ঢুকলো তাদের পরনে শতছিন্ন, নোংরা, দুর্গন্ধময় পোশাক। শরীরে হাড় ছাড়া আর কিছু নেই। অসংলগ্ন আচরণ করতে করতে প্রায় আমার ঘাড়ের ওপর বসে পড়লো তারা। গাঁজা, সিগারেট এবং অপরিচ্ছন্ন শরীরের দুর্গন্ধে নিমেষে হাজতের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। কথিত খুনি ছেলেটি দেখলাম এদের চেনে। ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থাতেই উঠে এসে ঠেলে, ধাক্কিয়ে আমার কাছ থেকে যতটা দূরে সম্ভব দলটিকে সরিয়ে দিল। তারপর হাসতে হাসতে জানালো, এরা সবাই হেরোইনসেবী। সদরঘাট, ইসলামপুর এলাকার দোকানের বারান্দা এদের নিবাস। ওদের পুলিশ কেন ধরে এনেছে, জিজ্ঞাসা করতেই সমস্বরে যা বললো তার মর্মার্থ উদ্ধার করা কঠিন। যতটুকু বুঝলাম, তাতে আমার সন্দেহ জন্মালো—আমাকে মানসিকভাবে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবেই এই মাদকাসক্তদের হাজতে আগমন। কাল সকালে হয় থানা থেকেই ছেড়ে দেবে অথবা তিন ধারায় চালান দিয়ে আদালতে কয়েকশ’ টাকা জরিমানা করা হবে। টাকাটা তাত্ক্ষণিকভাবে দিতে পারলে সিএমএম কোর্ট থেকেই মুক্তি, নইলে সর্বোচ্চ পাঁচ দিনের জেলবাস। এর মধ্যেই রাতের আহার চলে এলো। একই থালার মধ্যে ভাত, ডাল এবং সবজি জাতীয় একটা কিছু। নেশাখোরদের ভাত খাওয়ার দৃশ্য দেখে অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হলো। ডাল মেশানো ভাত মুখে, শরীরে, মেঝেতে সর্বত্র। কেউ কেউ খাচ্ছে এবং ঝিমুচ্ছে। চিবুতে ভুলে গেছে। একজন দেখলাম, খাওয়া অসমাপ্ত রেখে এঁটো হাতেই হাজতের টয়লেট ঘুরে এসে নির্বিকারভাবে আবার ভাতের থালায় হাত ডুবালো। নারকীয় দৃশ্য। আমার ভেতর থেকে সবকিছু উঠে আসতে চাচ্ছে। নেহাত উঠে আসার মতো পেটে কিছু ছিল না। ডাণ্ডাবেড়ির জন্যে বাসা থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে উন্নত খাদ্য এলো। ছেলেটি আমাকে অনুরোধ করলো তার খাওয়ায় ভাগ বসাতে। তার মা নাকি রান্না করে পাঠিয়েছে। খাব কী! আমি তখন প্রাণপণ চেষ্টায় বমি আটকাচ্ছি। পরবর্তী ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে দুই দফায় আরও পাঁচজনকে ঠেসে দেয়া হলো একই হাজতে।
কোনোক্রমে এক কোণে বসে আছি। এর মধ্যে মাদকাসক্তদের পেটে ভাত পড়ার প্রতিক্রিয়া শুরু হলো। টয়লেটের জন্যে তো একচিলতে আধখোলা জায়গা। হাজতে আসামির সংখ্যা ততক্ষণে অন্তত পনেরোজন। কাজেই টয়লেটে যাওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে যার যার কাপড়েই কাজ সারা হতে লাগল। এরপর বসে থাকা তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেয়াও নরকযন্ত্রণার সমতুল্য। ডাণ্ডাবেড়ি আমার প্রাণান্তকর অবস্থা লক্ষ্য করছিল। হঠাত্ তার বোঁচকার মধ্য থেকে ভোজবাজির মতো আগরবাতির বাক্স এবং ম্যাচ বার হলো। ছেলেটি একটা আগরবাতি জ্বালিয়ে আমার একেবারে কাছে নিয়ে এলে কৃতজ্ঞতামাখা কেবল একটা হাসি প্রতিদান দিতে পেরেছিলাম। হাতের ঘড়িতে দেখলাম, রাত প্রায় দুটো। খানিক পর আইও এসে বলল, এবার আমার জিজ্ঞাসাবাদ হবে। আমার কাছে তখন ওই নরককুণ্ড থেকে বার হওয়াই জীবন ফিরে পাওয়ার শামিল। জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমাকে শারীরিক নির্যাতন করা হবে কি-না, সেটা নিয়ে আর ভাবছি না। গন্তব্য সেই সেকেন্ড অফিসারের কক্ষ। আমার অসুবিধার জন্যে বারবার ক্ষমাপ্রার্থনা করে ভদ্রলোক চা খাওয়াতে চাইলেন। আমি ভাবলেশহীনভাবে চায়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু করতে বললাম। আইও এবং সেকেন্ড অফিসার পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে জানালো, তাদের কোনো জিজ্ঞাস্য নেই। আধঘণ্টাখানেক নির্বাক বসে থাকার পর আইও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। এখন আবার হাজতে ফিরতে হবে। সেখানে ফিরে দেখি, আরও জনা দুই আসামি এসেছে, যারা সম্ভবত খানিক আগেই প্রচুর মদ্যপান করেছে। কারণ গাঁজা ও বিষ্ঠার গন্ধ ছাপিয়ে মদের গন্ধে হাজত ভরে গেছে। সেই সঙ্গে আমার বসার জায়গাটাও বেদখল। কী আর করা! কোনোরকমে ঠেলেঠুলে গারদের একেবারে দরজা ঘেঁষে একটুখানি দাঁড়ানোর স্থান মিললো। শিকের ফাঁক দিয়ে নাকটাকে বাইরে নিয়ে অক্সিজেন নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম। সদ্য মৃতব্যক্তির শোকাতুর বাড়িতেও রাত পোহায়। কোতোয়ালি থানার হাজতের রাতও প্রকৃতির নিয়মে একসময় শেষ হলো। ঘড়ি দেখতে আর ইচ্ছে করছিল না। ধারণা করছি, সকাল আটটার মতো হবে। সেলের ওই জমাটবাঁধা দুর্গন্ধের মধ্যে আবার নাস্তার পাট শুরু হলো। সবাই নির্বিকারভাবে খেয়ে যাচ্ছে। একমাত্র ব্যতিক্রম আমি। সকালের সেন্ট্রি ইতস্তত করে একবার খাওয়ার কথা ওঠানোয় চশমার ভেতর দিয়ে চোখ তুলে তার দিকে তাকাতেই পিছিয়ে গেল। সকাল ন’টায় দু’জন করে আসামিকে হাজত থেকে বের করে উল্টোদিকের ঘরে নিয়ে শুরু হলো পেটানো। হাজতে বসেই লাঠির আওয়াজ আর বাবাগো, মাগো চিত্কার শুনতে থাকলাম। এক এক দলের বরাদ্দ পনেরো মিনিট। হাত-পায়ের কবজিতে রক্তের চিহ্ন নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরতে লাগল তারা। ফিরে এসে কান্নার ফাঁকে ফাঁকে পুলিশের বাবা-মাকে উদ্দেশ করে অশ্রাব্য গালাগাল। ঘণ্টা দুয়েক এই সার্কাস চললো।
আমি গারদের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। একসময় দূরে ডিউটি অফিসারের অফিসকক্ষে মনে হলো যেন আমার সহকর্মী সাংবাদিক নাছিরকে দেখলাম। নাছির আমাদের পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার। হয়তো আমি বেঁচে আছি কি-না, খবর নিতে এসেছে। দূর থেকে হলেও ওকে দেখে স্বজনকে ফিরে পাওয়ার অনুভূতি হলো। এর মধ্যেই আসামিদের নেয়ার জন্যে প্রথম দফা প্রিজন ভ্যান এসেছে। আসামিদের গারদ থেকে বের করে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে কোমরে দড়ি এবং হাতকড়া পরানো হচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম না. আমাকেও ওই লাইনে দাঁড়াতে হবে কি-না। থানা প্রশাসন নির্বিকার, কিছুই জানাচ্ছে না। আমার আইও সেই যে রাতে ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ পর গায়েব হয়েছে, তারপর থেকে দেখা নেই। হাজতের সামনে দিয়ে যাতায়াতরত অন্যান্য কর্মকর্তা এবং কনস্টেবলদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, তারা আমারও কোমরে দড়ি পরানোর চূড়ান্ত নির্দেশের জন্যই অপেক্ষমাণ। কোর্টহাজত থেকে আগত এক নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা আড়চোখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল। শেষ পর্যন্ত দুপুর একটার দিকে হারানো আইও এসে সংবাদ দিল আমাকে নেয়ার জন্যে প্রিজন ভ্যান এসেছে। ভ্যানে উঠতে যাচ্ছি, সেকেন্ড অফিসারসহ থানার অন্যান্য কর্মকর্তা আমার সামনে প্রায় হাতজোড় করে অন্তত এক গ্লাস পানি মুখে দেয়ার অনুরোধ করল। আত্মসংযম যথাসম্ভব বজায় রেখে গম্ভীরভাবে তাদের অনুরোধ ফিরিয়ে দিলাম। আমার মানসিক অবস্থা টের পেয়ে ওদেরই একজন অনুচ্চকণ্ঠে বলল, আমার ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের নির্দেশ ছিল। কোতোয়ালি থানা নাকি তাতে সম্মত হয়নি। মনে আছে, সে বলেছিল বারো দিনের রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই তার কথার সত্যতার প্রমাণ আমি পেয়ে যাব। সেই প্রমাণ পেতে আমাকে বারো ঘণ্টার অধিক সময় অপেক্ষা করতে হয়নি।
কোতোয়ালি থানা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে না তুলে আমাকে সরাসরি কোর্ট গারদে নেয়া হলে হতাশ হলাম। আমি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে একরাতের রিমান্ডের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে চাচ্ছিলাম, যাতে জাতি এই ফ্যাসিস্ট সরকারের স্বরূপ চিনতে পারে। কেবলই মনে হচ্ছিল, মহান আল্লাহ্র রহমত এবং দেশপ্রেমিক, বিবেকবান জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদ ছাড়া এই মৃত্যুগুহা থেকে আমি আর ফিরতে পারব না। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কোর্ট গারদে বসিয়ে রেখে আমাকে জানানো হলো, কোর্টে না তুলেই সরাসরি দ্বিতীয় রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। প্রিজন ভ্যানের কাছে পৌঁছেই দেখি, ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম দাঁড়িয়ে আছে। সে শ্বাপদের মতো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। চারদিকে দাঙ্গা পুলিশের মধ্যেই আমি আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার দাবি করলাম। কোনো কথা না বলে রূঢ় ভঙ্গিতে ইন্সপেক্টর রেজা প্রিজন ভ্যানে উঠতে ইশারা করল। বুঝলাম সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। প্রিজন ভ্যান স্টার্ট দেয়ার মুহূর্তে শুনতে পেলাম, কে যেন উচ্চস্বরে ডাকছে, মাহমুদ ভাই আপনি কোথায়? সর্বশক্তি জড়ো করে চিত্কার করে উঠলাম, আমি ভ্যানের ভেতরে। উঁচু লোহার গ্রিলের ফাঁকের মধ্য দিয়ে অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদারকে দেখতে পেয়ে ভরসা হলো, আমার অন্তিম বক্তব্য দেশবাসী তাহলে জানতে পারবে। ততক্ষণে মাসুদ ভাই আইও রেজার সঙ্গে বিষম তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। তিনি আদালত থেকে আমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি নিয়ে এসেছেন, অথচ আইও দেখা করতে দেবে না। পারলে মাসুদ তালুকদারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে প্রিজন ভ্যান চালিয়ে দেয়। তর্কাতর্কি চলাকালেই আরেকজন জুনিয়র আইনজীবী আদালতের লিখিত নির্দেশনামা নিয়ে এলে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেজাউল করিম ভ্যানের তালা খুলে আমাকে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিল। অ্যাডভোকেট মাসুদকে সঙ্গে করে কোর্ট গারদে ফিরে গেলাম। আগের চব্বিশ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমার সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে, তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত সংবাদমাধ্যমকে জানানোর অনুরোধ করলাম। ততক্ষণে অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিঞাও আমাদের আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। তারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করলেন। আমি তাদের আগাম বলে গেলাম পরবর্তী রিমান্ডে আমার প্রাণসংশয় রয়েছে। এক ধরনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখন আমার মধ্যে কাজ করছিল। আইও’র অবয়বে একজন হত্যাকারীকে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার কিছু হলে বাড়ির লোকজনদের দেখার অনুরোধ করে দুই আইনজীবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুনর্বার প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। দু’জনই বিষণ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ইন্সপেক্টর রেজা আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিল তার শিকারকে যথাস্থানে পৌঁছে দেয়ার জন্যে।
পুরনো ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে ভিআইপি রোড ধরে কারওয়ান বাজারে আমার দেশ কার্যালয় অতিক্রম করার সময় ভাবছিলাম, আর কি কোনোদিন সম্পাদকের অফিসে ফিরতে পারব? আমাদের পত্রিকা অফিসের একেবারে কাছেই তেজগাঁও থানা। ভ্যান থানা অতিক্রম করে এগিয়ে গেলে বুঝলাম, আমরা অন্য কোনো স্থানে চলেছি। এদিন ভ্যানের ভেতরে আমার সঙ্গে একজন অতিরিক্ত কনস্টেবল পাহারার জন্যে দেয়া হয়েছিল। একবার ভাবলাম, কোথায় যাচ্ছি ওকেই জিজ্ঞেস করি। পরক্ষণেই মনে হলো, দরিদ্র বেচারার চাকরি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে কী লাভ? গ্রেফতারের রাতের মতো জাহাঙ্গীর গেট পেরিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রিজন ভ্যান প্রবেশ করতেই নিশ্চিত হলাম, আমাকে ক্যান্টনমেন্ট থানাতেই নেয়া হচ্ছে। স্বজনদের এই সংবাদটি জানানোর জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠলেও আমি অসহায়, পিঞ্জরাবদ্ধ। এরই নাম বাংলাদেশে আইনের শাসন? যে থানা মামলা দায়ের করে, রিমান্ডে সেই থানাতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা আইনত বাধ্যতামূলক হলেও আমাকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গৃহে কোনো পুরুষ মানুষ নেই যে, ছোটাছুটি করে আমার সঠিক অবস্থান খুঁজে বার করবে। অসহায় শাশুড়ি ও পুত্রবধূ কাদের দ্বারে দ্বারে একটুখানি খবরের আশায় ছুটে বেড়িয়ে অপমানিত হবে, কে জানে? এই গণতন্ত্রের জন্যে তাহলে ১৯৭১ সালে আমরা রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ করেছি, ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছি! আকাশ-পাতাল ভাবনার মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট থানা চলে এলো।
আজকের ড্রাইভার রাস্তা চেনে। প্রথম রাতের মতো ভুল করে অন্য জায়গায় নিয়ে গাড়ি থামায়নি। পরিচিত থানায় প্রিজন ভ্যান থেকে নেমে সময়ক্ষেপণ না করে সোজা ডিউটি অফিসারের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। আমার পেছন পেছন আইও রেজা ঘরে ঢুকে, আরেকটি চেয়ার নিয়ে আমার পাশে বসেই ডিউটি অফিসারকে নানারকম নির্দেশ দিতে লাগল। বাসা থেকে একটা ছোট ব্যাগে আমার জন্য টুকিটাকি কিছু জিনিস পাঠানো হয়েছিল। এক সেট পরিষ্কার প্যান্ট-শার্ট, একটা লুঙ্গি, টুথ ব্রাশ, পেস্ট, সাবান, কিছু শুকনো খাবার ইত্যাদি। সেই ব্যাগটি ডিউটি অফিসারের হাতে দেয়ার পর অনুচ্চকণ্ঠে দু’জনার মধ্যে কিছু বাক্যবিনিময় হলো। আমার শোনার কোনো উত্সাহ ছিল না। তবে আমার দিকে ডিউটি অফিসারের চকিত, রহস্যময় চাহনি দেখে খানিকটা সচকিত হয়ে উঠলাম। কোতোয়ালি থানার অচেনা, তরুণ পুলিশ কর্মকর্তার আজ দুপুরের ভয়ঙ্কর নির্যাতনের আগাম সতর্কবার্তার কথা মনে পড়লো। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে পূর্বপরিচিত হাজতখানায় ঢুকলাম। বাসা থেকে পাঠানো ব্রাশ, পেস্ট এবং সাবান সঙ্গে নিতে দেয়া হলো না। বলা হলো, প্রয়োজন অনুযায়ী ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ব্যবহার শেষে প্রতিবার ফেরত দিতে হবে। আমি যে ফ্যাসিবাদী প্রশাসনের একেবারে হাতের মুঠোয়, সেটাই অবমাননাকরভাবে বুঝিয়ে দেয়া আর কি! নোংরা টয়লেটের ওপর দাঁড়িয়ে বদনায় পানি ভরে গোসল করলাম। আগের রাতে হেরোইনসেবীদের সঙ্গে একই সেলে গাদাগাদি করে কাটিয়ে নিজেকে বড় ক্লেদাক্ত বোধ হচ্ছিল। ব্যবহার শেষে টুথ ব্রাশ, পেস্ট এবং সাবান ফেরত গেল ডিউটি অফিসারের কাছে। কাল সকালে আবার চাইতে হবে। রাত ন’টার দিকে থানা কর্তৃপক্ষ পরোটা, ডিমভাজি এবং লেবু দেয়া রং চা সরবরাহ করলে সামান্য ডিমভাজি দিয়ে অর্ধেক পরোটা এবং পুরো কাপ চা পেটে চালান করে রাতের আহার সাঙ্গ করলাম। প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা উপোসের পর এই আহার। তারপর হাজতের নোংরা মেঝেতেই শুয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগলাম।
No comments