১০- জেল সুপারের বাড়ি ‘পুণ্যভূমি’ গোপালগঞ্জে আমার কথা শুনে মুখ মলিন হয়ে গেল তার
তরুণরা আমাকে চিনতে পেরে শুভেচ্ছা জানাতে লাগল
... রাস্তাঘাটে প্রিজন ভ্যান দেখলেই খাঁচাভর্তি আসামির দিকে পথচারীরা বিতৃষ্ণামাখা কৌতূহল নিয়ে তাকায়। প্রথমদিকে অস্বস্তি হলেও এই পাঁচ মাসে সেই দৃষ্টি আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। ছেলেগুলোও প্রিজন ভ্যানের দিকে তাকিয়ে সেখানে আর কোনো লোকজন না দেখে খানিক হকচকিয়ে গিয়েই একমাত্র আসামিকে চিনে ফেলল। তারপর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে সবাই একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাত নেড়ে আমার প্রতি তাদের সমর্থন ও শুভেচ্ছা জানাতে লাগল।...
... রাস্তাঘাটে প্রিজন ভ্যান দেখলেই খাঁচাভর্তি আসামির দিকে পথচারীরা বিতৃষ্ণামাখা কৌতূহল নিয়ে তাকায়। প্রথমদিকে অস্বস্তি হলেও এই পাঁচ মাসে সেই দৃষ্টি আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। ছেলেগুলোও প্রিজন ভ্যানের দিকে তাকিয়ে সেখানে আর কোনো লোকজন না দেখে খানিক হকচকিয়ে গিয়েই একমাত্র আসামিকে চিনে ফেলল। তারপর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে সবাই একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাত নেড়ে আমার প্রতি তাদের সমর্থন ও শুভেচ্ছা জানাতে লাগল।...
বর্তমান প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তার কথা রেখেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম দু’জন বিতর্কিত ব্যক্তিকে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে শপথ গ্রহণ না করালেও নতুন প্রধান বিচারপতির তাতে কোনো সমস্যা হয়নি। হত্যা মামলা এবং সুপ্রিমকোর্ট ভাংচুরের ঘটনায় অভিযুক্ত দুই ব্যক্তিকে শপথ গ্রহণ করিয়ে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক আদালতের ভাবমর্যাদা একেবারে আকাশে উঠিয়ে ছেড়েছেন। অথচ, জনগণের ইনসাফপ্রাপ্তির অধিকারের কথা কাগজে লিখলে এই দেশে আদালত অবমাননা হয়। যে দুই আইনজীবী এখন থেকে হাইকোর্টের বিচারকের আসন অলঙ্কৃত করবেন, তাদের নামের পাশে মাননীয় বিচারপতি লেখা হলে অবশ্যই তাদের ব্যক্তিগত মান-মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। তবে ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগের কী হবে, সে বিবেচনার ভার পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিলাম।
আমি বন্দি মানুষ। কাশিমপুর জেলের সলিটারি কনফাইনমেন্টে আপন মনে লিখে চলেছি। জেলেই যখন আছি, তখন লেখার অপরাধে নতুন করে জেলে তো আর নিতে পারছে না। জেলের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শুনলাম, গত রাতে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভের চিত্র দেখিয়েছে। বার সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করে ঘোষণা করেছেন, নতুন দুই বিচারপতির এজলাসে কোনো মামলায় তারা অংশগ্রহণ করবেন না। সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে কাল কালো পতাকা উড়েছে এবং আগামী সপ্তাহে উচ্চ আদালত খোলার পর বারের পক্ষ থেকে নাকি আরও কর্মসূচি দেয়া হবে। অবশ্য সুপ্রিমকোর্টের আওয়ামী আইনজীবী গোষ্ঠী শপথ পড়ানোয় প্রধান বিচারপতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং হাইকোর্টের উভয় মাননীয়কে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাদের হাবভাবে মনে হচ্ছে কুংফু, কারাটে জানা রাজপথের লড়াকু আইনজীবী হাইকোর্টের বিচারপতির আসন কৃপা করে অলঙ্কৃত করায় হাইকোর্টই যেন ধন্য হয়ে গেছেন। এদিকে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক আত্মপক্ষ সমর্থন করে দাবি করেছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তাকে শপথ পড়াতেই হয়েছে।
বিচারপতি খায়রুল হকের দাবি সঠিক হলে বলতে হবে, সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম সংবিধান লঙ্ঘন করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের বিদায় মুহূর্তে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম একই রকম অভিযোগ করে সাবেক প্রধান বিচারপতির বিচার পর্যন্ত দাবি করেছিলেন। এতসব রথী-মহারথীর পরস্পরবিরোধী আইনের ব্যাখ্যা শুনে আমাদের মতো আমজনতার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আরও বলেছেন, শপথ পড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে তার জনপ্রিয়তা কমেও যেতে পারে। ভবিষ্যত্ই বলে দেবে বিচারপতি খায়রুল হক কতটা সম্মান এবং জনপ্রিয়তা নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট থেকে বিদায় নেন। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষার পালা।
আমার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত আদালত অবমাননার দু’টি মামলা হয়েছে এবং সর্বোচ্চ আদালতে উভয় মামলাতেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রথমটায় সাজা সাত মাস এবং দ্বিতীয়টায় একদিন। ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শীর্ষক মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার অপরাধে দ্বিতীয় মামলায় আমাকে একদিনের সাজা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। এই লেখাটির কয়েকটি লাইন উচ্চ আদালতের বর্তমান অশান্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে উদ্ধৃত করছি, “একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মাননীয় বিচারকদের সঙ্কীর্ণ দলীয় চিন্তাধারা অতিক্রম করে কেবল সংবিধান ও দেশের আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগকে দলীয়করণের যে মন্দ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, সেখান থেকে তারা নিবৃত্ত না হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের দেশের দুর্গতির জন্যে এক সময় ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হতো। তারপর আমলা এবং রাজনীতিকদের। একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগ এবার কলঙ্কিত হয়েছে। বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারকদের আচার-আচরণ; সর্বত্র অন্যায়ের সুস্পষ্ট চিহ্ন দৃশ্যমান। এই অনাচারের পরিণামে জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম মূল্যই আমাদের দিতে হবে।” গত বৃহস্পতিবার দু’জন বিতর্কিত ব্যক্তিকে হাইকোর্টে বিচারক পদে শপথ পড়ানো নিয়ে সংঘটিত দৃশ্য যারা দেখেছেন অথবা জেনেছেন, তাদের মধ্য থেকে ক’জন এবং কোন যুক্তিতে আমার মন্তব্য-প্রতিবেদনের উদ্ধৃত অংশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন জানতে পারলে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করতাম। সর্বোচ্চ আদালত থেকে ইনসাফ পাইনি, তবে পাঠকদের কাছ থেকে ইনসাফ পাওয়ার আশা সর্বদাই পোষণ করি।
লেখার মধ্যেই কাশিমপুর জেলের এক জমাদার জেলগেট থেকে এসে কোর্ট হাজিরার একখানি স্লিপ হাতে ধরিয়ে দিল। ২০০৯ সালে বিটিআরসির দায়ের করা মানহানি মামলায় কাল আকস্মিক হাজিরা। বিটিআরসি ২০০৯ সালে কয়েকজন ভারতীয়কে স্পর্শকাতর পদে চাকরি দিয়েছিল। রাষ্ট্রের গোপনীয়তা ভঙ্গের আশঙ্কা রয়েছে এমন স্থানে ভারতীয়দের চাকরি দেয়া নিয়ে সে সময় আমার দেশ পত্রিকায় লিড নিউজ ছাপা হয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির কর্মকর্তারা ক্ষেপে গিয়ে আমিসহ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকে দেয়। মামলা দায়েরের আগে বিটিআরসি সম্পাদকের কাছে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠায়, যেটি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে ছাপাও হয়। তাতেও অবশ্য কর্তাব্যক্তিদের ক্রোধের উপশম হয়নি। প্রতিবাদপত্রে বিটিআরসি স্বীকারও করে নিয়েছিল যে, ভারতীয়দের চাকরি দেয়া হয়েছিল। তবে তাদের যুক্তি ছিল এই চাকরি প্রদান সাময়িক, কর্তব্য পালন শেষে বিদেশিরা স্বদেশে ফিরে গেছে এবং রাষ্ট্রের কোনো গোপন তথ্য তারা নাকি নিয়ে যায়নি। সাধারণ জ্ঞানে এই মামলা দায়েরের কোনো আইনানুগ যুক্তি না থাকলেও ‘স্বাধীন’ ম্যাজিস্ট্রেট তত্ক্ষণাত্ মামলা আমলে নিয়ে আজতক শুনানি চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলে আসার পর এই পাঁচ মাস মামলাটির কোনো খোঁজ-খবর ছিল না। হঠাত্ করে হাজিরার নির্দেশ পেয়ে ভাবলাম সরকার কাশিমপুর-ঢাকা রুটে আমার প্রিজন ভ্যান ভ্রমণের সংখ্যা বাড়াতে চাচ্ছে। সহ্যশক্তির এই পরীক্ষা দিতে ভালোই লাগছে।
আজকের হাজিরায় হয়রানির মাত্রা বাড়ল। আয়োজন অবশ্য একই রকম ছিল। সেই ভাঙা-চোরা প্রিজন ভ্যান, বসার জন্য প্লাস্টিকের পলকা চেয়ার, ভেতরের দুর্গন্ধ, দীর্ঘপথ আসা-যাওয়ার ঝাঁকুনি ইত্যাদি। এগুলো এতদিনে গা-সওয়া হয়ে গেছে বলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়া অতিরিক্ত ঝামেলাটা বাধালেন। আসামিদের কাঠগড়ায় না তুলে শুনানির পরবর্তী তারিখ দিতে তিনি কিছুতেই সম্মত হলেন না। তাতেও কোনো অসুবিধা ছিল না, যদি ম্যাজিস্ট্রেট এজলাসে সময়মত বসতেন। কিন্তু তাও হলো না। দুপুর দুটায় আদালত বসার পর কোর্ট গারদের তালা খুলে আমাকে কাঠগড়ায় হাজির করা হলে জানুয়ারির ছয় পরবর্তী তারিখ পড়ল। তিনটায় ফিরতি যাত্রা শুরু করে কাশিমপুরে জেলে যখন পৌঁছালাম, তখন চারদিক থেকে মাগরিবের চমত্কার আজানধ্বনি ভেসে আসছে। সারাদিন পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। সকালে নিয়ত করে গেলে একটা নফল রোজা হয়ে যেত। জেলগেটে আমাদের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা জেল সুপার টিপু সুলতানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বছর দেড়েকের একমাত্র ছেলে কোলে সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে বের হয়েছে। কুশল বিনিময়ের পর রসিকতার ছলে বললাম, আজকে আপনার প্রধানমন্ত্রী খানিকটা অতিরিক্ত সাজা দিতে পেরেছেন। সুপারের দেশের বাড়ি ‘পুণ্যভূমি’ গোপালগঞ্জে। আমার কথা শুনে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় চোয়াল শক্তসমেত মুখটা মলিন হয়ে গেল। আশপাশে নানান সংস্থার দু’চারটে গোয়েন্দাও নিশ্চয়ই রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাঙ্গপাঙ্গদের কানে আমার মন্তব্য গেলে তারা রসিকতার মর্ম তো বুঝবেই না; উপরন্তু বেচারার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। এমনিতেই বাঙালির রসিকতাবোধ বেশ কম। আমি আর কথা না বাড়িয়ে টিপু সুলতানের ছেলেকে আদর করে সেলের পথ ধরলাম।
সারাদিন খাওয়া না জুটলেও তিনটে ঘটনায় মন বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। সকালে গাজীপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অকস্মাত্ ছাতিম ফুলের গন্ধে নোংরা ভ্যানের ভেতরটা সুবাসিত হয়ে গেল। আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে আইবিএতে পড়াকালীন বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়ে যাওয়া-আসার সময় প্রায়ই এই মন মাতানো সুবাস পেতাম। তখন ভাবতাম বুড়ো হলে স্ত্রীকে সঙ্গে করে ওই রাস্তায় ছাতিমের গন্ধ নিতে নিতে রিকশায় ঘুরে বেড়াব। সে সময় সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে আসলেই রিকশায় ঘুরতাম। আমি, মা এবং পারভীন তখন লালমাটিয়ায় এক ভাড়াবাড়ির চারতলায় থাকি। আর শ্বশুরবাড়ি ছিল ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে। অনেক রাতেই আইবিএ থেকে সান্ধ্যকালীন ক্লাস শেষ করে রাতের আহারের জন্য সোজা শ্বশুরবাড়ি যেতাম। তারপর রাতে রিকশা করে নিজেদের ভাড়াবাড়িতে ফিরতে বড় ভালো লাগত।
মানুষের স্মৃতির কোনো মাথা-মুণ্ডু নেই। প্রিজন ভ্যানের ভেতরে ভেসে আসা ছাতিমের গন্ধ এক লহমায় আমাকে সেই তিরিশ বছর আগে নিয়ে গেল। মানুষের মনের গতির কাছে টাইম মেশিন ফেল। সকালের কথা এখন লিখতে বসে প্রতিমার সেই বিখ্যাত গান মনে পড়ছে, স্মৃতি জানলা খুলে চেয়ে থাকে। কী জ্বালা, বুড়ো হলে যখন তখন চোখে পানি চলে আসে। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে সকালে কখন টঙ্গী থেকে বাহাদুর শাহ্ পার্ক চলে গেছে, টেরই পাইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার এই ছাতিমপ্রীতির কথা জানতে পারলে হয়তো কাশিমপুর জেল থেকে ঢাকা পর্যন্ত রাস্তার আশপাশের যাবতীয় ছাতিম গাছ কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়ে দেবেন।
নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকা পৌঁছে দীর্ঘক্ষণ গারদে বসে থাকতে হয়েছে। বিকেল তিনটায় বেশ খানিকটা বিরক্তি নিয়েই প্রিজন ভ্যানে উঠে পাদানির কাছে দাঁড়িয়ে উপস্থিত আইনজীবী, সাংবাদিক, শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশে হাত নাড়ার সময় একজন নিম্নবিত্ত মধ্যবয়সিনী মহিলার দিকে চোখ পড়ল। তিনি দূর থেকে দু’হাত আকাশের দিকে তুলে মোনাজাতের ভঙ্গি করে সম্ভবত আমার জন্য আল্লাহর দরবারে তার দোয়া করার বিষয়টি বোঝাতে চাচ্ছিলেন। বোরখা আবৃত পর্দানশীন মহিলা হয়তো কোনো কাজে সিএমএম কোর্টে এসেছেন। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে তাকে সালাম জানিয়ে ভ্যানের ভেতরে প্রবেশ করলাম। চেয়ারে বসার আগেই মনের সব বিরক্তি, ক্ষুধা-তৃষ্ণা এক দোয়ায় উধাও হয়ে গেছে। তিন নম্বর ঘটনার অকুস্থল সকালের ছাতিম স্মৃতিবিজড়িত সেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আমি যথারীতি ভ্যানের ঝাঁকুনির সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে পথ চলছি, হঠাত্ গাড়ির গতি কমে এলো। সম্ভবত সামনে যানবাহনের দীর্ঘ সারি রয়েছে। প্রিজন ভ্যানের পাশে একেবারে গা ঘেঁষে আরেকটি যাত্রীবাহী বাস চলছে, যাত্রীরা সবাই তরুণ। দেখে মনে হলো, কোনো কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একসঙ্গে তাদের গন্তব্যে চলেছে। রাস্তাঘাটে প্রিজন ভ্যান দেখলেই খাঁচাভর্তি আসামির দিকে পথচারীরা বিতৃষ্ণামাখা কৌতূহল নিয়ে তাকায়। প্রথমদিকে অস্বস্তি হলেও এই পাঁচ মাসে সেই দৃষ্টি আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। ছেলেগুলোও প্রিজন ভ্যানের দিকে তাকিয়ে সেখানে আর কোনো লোকজন না দেখে খানিক হকচকিয়ে গিয়েই একমাত্র আসামিকে চিনে ফেলল। তারপর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে সবাই একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাত নেড়ে আমার প্রতি তাদের সমর্থন ও শুভেচ্ছা জানাতে লাগল। দু’টি গাড়ি যতক্ষণ পাশাপাশি ছিল, আমিও ওদের দিকেই হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলাম। পরিবারের বাইরে এ দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী আমাকে যে আজও স্মরণে রেখেছে, আমার কথা হয়তো তাদের আন্দোলিত করে—এর চেয়ে বড় পাওয়া আমার মতো এক তুচ্ছ আদম সন্তানের অকিঞ্চিত্কর জীবনে আর কী-ইবা হতে পারে! এই সমর্থন এবং ভালোবাসার শক্তিতেই শাসকশ্রেণীর সব জুলুম ইনশাআল্লাহ, সইতে পারব।
আমি বন্দি মানুষ। কাশিমপুর জেলের সলিটারি কনফাইনমেন্টে আপন মনে লিখে চলেছি। জেলেই যখন আছি, তখন লেখার অপরাধে নতুন করে জেলে তো আর নিতে পারছে না। জেলের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শুনলাম, গত রাতে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভের চিত্র দেখিয়েছে। বার সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করে ঘোষণা করেছেন, নতুন দুই বিচারপতির এজলাসে কোনো মামলায় তারা অংশগ্রহণ করবেন না। সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে কাল কালো পতাকা উড়েছে এবং আগামী সপ্তাহে উচ্চ আদালত খোলার পর বারের পক্ষ থেকে নাকি আরও কর্মসূচি দেয়া হবে। অবশ্য সুপ্রিমকোর্টের আওয়ামী আইনজীবী গোষ্ঠী শপথ পড়ানোয় প্রধান বিচারপতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং হাইকোর্টের উভয় মাননীয়কে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তাদের হাবভাবে মনে হচ্ছে কুংফু, কারাটে জানা রাজপথের লড়াকু আইনজীবী হাইকোর্টের বিচারপতির আসন কৃপা করে অলঙ্কৃত করায় হাইকোর্টই যেন ধন্য হয়ে গেছেন। এদিকে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক আত্মপক্ষ সমর্থন করে দাবি করেছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তাকে শপথ পড়াতেই হয়েছে।
বিচারপতি খায়রুল হকের দাবি সঠিক হলে বলতে হবে, সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম সংবিধান লঙ্ঘন করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিমের বিদায় মুহূর্তে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম একই রকম অভিযোগ করে সাবেক প্রধান বিচারপতির বিচার পর্যন্ত দাবি করেছিলেন। এতসব রথী-মহারথীর পরস্পরবিরোধী আইনের ব্যাখ্যা শুনে আমাদের মতো আমজনতার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আরও বলেছেন, শপথ পড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে তার জনপ্রিয়তা কমেও যেতে পারে। ভবিষ্যত্ই বলে দেবে বিচারপতি খায়রুল হক কতটা সম্মান এবং জনপ্রিয়তা নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট থেকে বিদায় নেন। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষার পালা।
আমার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত আদালত অবমাননার দু’টি মামলা হয়েছে এবং সর্বোচ্চ আদালতে উভয় মামলাতেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্রথমটায় সাজা সাত মাস এবং দ্বিতীয়টায় একদিন। ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শীর্ষক মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার অপরাধে দ্বিতীয় মামলায় আমাকে একদিনের সাজা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। এই লেখাটির কয়েকটি লাইন উচ্চ আদালতের বর্তমান অশান্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে উদ্ধৃত করছি, “একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মাননীয় বিচারকদের সঙ্কীর্ণ দলীয় চিন্তাধারা অতিক্রম করে কেবল সংবিধান ও দেশের আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগকে দলীয়করণের যে মন্দ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, সেখান থেকে তারা নিবৃত্ত না হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের দেশের দুর্গতির জন্যে এক সময় ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হতো। তারপর আমলা এবং রাজনীতিকদের। একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগ এবার কলঙ্কিত হয়েছে। বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারকদের আচার-আচরণ; সর্বত্র অন্যায়ের সুস্পষ্ট চিহ্ন দৃশ্যমান। এই অনাচারের পরিণামে জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম মূল্যই আমাদের দিতে হবে।” গত বৃহস্পতিবার দু’জন বিতর্কিত ব্যক্তিকে হাইকোর্টে বিচারক পদে শপথ পড়ানো নিয়ে সংঘটিত দৃশ্য যারা দেখেছেন অথবা জেনেছেন, তাদের মধ্য থেকে ক’জন এবং কোন যুক্তিতে আমার মন্তব্য-প্রতিবেদনের উদ্ধৃত অংশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন জানতে পারলে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করতাম। সর্বোচ্চ আদালত থেকে ইনসাফ পাইনি, তবে পাঠকদের কাছ থেকে ইনসাফ পাওয়ার আশা সর্বদাই পোষণ করি।
লেখার মধ্যেই কাশিমপুর জেলের এক জমাদার জেলগেট থেকে এসে কোর্ট হাজিরার একখানি স্লিপ হাতে ধরিয়ে দিল। ২০০৯ সালে বিটিআরসির দায়ের করা মানহানি মামলায় কাল আকস্মিক হাজিরা। বিটিআরসি ২০০৯ সালে কয়েকজন ভারতীয়কে স্পর্শকাতর পদে চাকরি দিয়েছিল। রাষ্ট্রের গোপনীয়তা ভঙ্গের আশঙ্কা রয়েছে এমন স্থানে ভারতীয়দের চাকরি দেয়া নিয়ে সে সময় আমার দেশ পত্রিকায় লিড নিউজ ছাপা হয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির কর্মকর্তারা ক্ষেপে গিয়ে আমিসহ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকে দেয়। মামলা দায়েরের আগে বিটিআরসি সম্পাদকের কাছে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠায়, যেটি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে ছাপাও হয়। তাতেও অবশ্য কর্তাব্যক্তিদের ক্রোধের উপশম হয়নি। প্রতিবাদপত্রে বিটিআরসি স্বীকারও করে নিয়েছিল যে, ভারতীয়দের চাকরি দেয়া হয়েছিল। তবে তাদের যুক্তি ছিল এই চাকরি প্রদান সাময়িক, কর্তব্য পালন শেষে বিদেশিরা স্বদেশে ফিরে গেছে এবং রাষ্ট্রের কোনো গোপন তথ্য তারা নাকি নিয়ে যায়নি। সাধারণ জ্ঞানে এই মামলা দায়েরের কোনো আইনানুগ যুক্তি না থাকলেও ‘স্বাধীন’ ম্যাজিস্ট্রেট তত্ক্ষণাত্ মামলা আমলে নিয়ে আজতক শুনানি চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলে আসার পর এই পাঁচ মাস মামলাটির কোনো খোঁজ-খবর ছিল না। হঠাত্ করে হাজিরার নির্দেশ পেয়ে ভাবলাম সরকার কাশিমপুর-ঢাকা রুটে আমার প্রিজন ভ্যান ভ্রমণের সংখ্যা বাড়াতে চাচ্ছে। সহ্যশক্তির এই পরীক্ষা দিতে ভালোই লাগছে।
আজকের হাজিরায় হয়রানির মাত্রা বাড়ল। আয়োজন অবশ্য একই রকম ছিল। সেই ভাঙা-চোরা প্রিজন ভ্যান, বসার জন্য প্লাস্টিকের পলকা চেয়ার, ভেতরের দুর্গন্ধ, দীর্ঘপথ আসা-যাওয়ার ঝাঁকুনি ইত্যাদি। এগুলো এতদিনে গা-সওয়া হয়ে গেছে বলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়া অতিরিক্ত ঝামেলাটা বাধালেন। আসামিদের কাঠগড়ায় না তুলে শুনানির পরবর্তী তারিখ দিতে তিনি কিছুতেই সম্মত হলেন না। তাতেও কোনো অসুবিধা ছিল না, যদি ম্যাজিস্ট্রেট এজলাসে সময়মত বসতেন। কিন্তু তাও হলো না। দুপুর দুটায় আদালত বসার পর কোর্ট গারদের তালা খুলে আমাকে কাঠগড়ায় হাজির করা হলে জানুয়ারির ছয় পরবর্তী তারিখ পড়ল। তিনটায় ফিরতি যাত্রা শুরু করে কাশিমপুরে জেলে যখন পৌঁছালাম, তখন চারদিক থেকে মাগরিবের চমত্কার আজানধ্বনি ভেসে আসছে। সারাদিন পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। সকালে নিয়ত করে গেলে একটা নফল রোজা হয়ে যেত। জেলগেটে আমাদের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা জেল সুপার টিপু সুলতানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বছর দেড়েকের একমাত্র ছেলে কোলে সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে বের হয়েছে। কুশল বিনিময়ের পর রসিকতার ছলে বললাম, আজকে আপনার প্রধানমন্ত্রী খানিকটা অতিরিক্ত সাজা দিতে পেরেছেন। সুপারের দেশের বাড়ি ‘পুণ্যভূমি’ গোপালগঞ্জে। আমার কথা শুনে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় চোয়াল শক্তসমেত মুখটা মলিন হয়ে গেল। আশপাশে নানান সংস্থার দু’চারটে গোয়েন্দাও নিশ্চয়ই রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাঙ্গপাঙ্গদের কানে আমার মন্তব্য গেলে তারা রসিকতার মর্ম তো বুঝবেই না; উপরন্তু বেচারার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। এমনিতেই বাঙালির রসিকতাবোধ বেশ কম। আমি আর কথা না বাড়িয়ে টিপু সুলতানের ছেলেকে আদর করে সেলের পথ ধরলাম।
সারাদিন খাওয়া না জুটলেও তিনটে ঘটনায় মন বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। সকালে গাজীপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অকস্মাত্ ছাতিম ফুলের গন্ধে নোংরা ভ্যানের ভেতরটা সুবাসিত হয়ে গেল। আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে আইবিএতে পড়াকালীন বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়ে যাওয়া-আসার সময় প্রায়ই এই মন মাতানো সুবাস পেতাম। তখন ভাবতাম বুড়ো হলে স্ত্রীকে সঙ্গে করে ওই রাস্তায় ছাতিমের গন্ধ নিতে নিতে রিকশায় ঘুরে বেড়াব। সে সময় সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে আসলেই রিকশায় ঘুরতাম। আমি, মা এবং পারভীন তখন লালমাটিয়ায় এক ভাড়াবাড়ির চারতলায় থাকি। আর শ্বশুরবাড়ি ছিল ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে। অনেক রাতেই আইবিএ থেকে সান্ধ্যকালীন ক্লাস শেষ করে রাতের আহারের জন্য সোজা শ্বশুরবাড়ি যেতাম। তারপর রাতে রিকশা করে নিজেদের ভাড়াবাড়িতে ফিরতে বড় ভালো লাগত।
মানুষের স্মৃতির কোনো মাথা-মুণ্ডু নেই। প্রিজন ভ্যানের ভেতরে ভেসে আসা ছাতিমের গন্ধ এক লহমায় আমাকে সেই তিরিশ বছর আগে নিয়ে গেল। মানুষের মনের গতির কাছে টাইম মেশিন ফেল। সকালের কথা এখন লিখতে বসে প্রতিমার সেই বিখ্যাত গান মনে পড়ছে, স্মৃতি জানলা খুলে চেয়ে থাকে। কী জ্বালা, বুড়ো হলে যখন তখন চোখে পানি চলে আসে। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে সকালে কখন টঙ্গী থেকে বাহাদুর শাহ্ পার্ক চলে গেছে, টেরই পাইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার এই ছাতিমপ্রীতির কথা জানতে পারলে হয়তো কাশিমপুর জেল থেকে ঢাকা পর্যন্ত রাস্তার আশপাশের যাবতীয় ছাতিম গাছ কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়ে দেবেন।
নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকা পৌঁছে দীর্ঘক্ষণ গারদে বসে থাকতে হয়েছে। বিকেল তিনটায় বেশ খানিকটা বিরক্তি নিয়েই প্রিজন ভ্যানে উঠে পাদানির কাছে দাঁড়িয়ে উপস্থিত আইনজীবী, সাংবাদিক, শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশে হাত নাড়ার সময় একজন নিম্নবিত্ত মধ্যবয়সিনী মহিলার দিকে চোখ পড়ল। তিনি দূর থেকে দু’হাত আকাশের দিকে তুলে মোনাজাতের ভঙ্গি করে সম্ভবত আমার জন্য আল্লাহর দরবারে তার দোয়া করার বিষয়টি বোঝাতে চাচ্ছিলেন। বোরখা আবৃত পর্দানশীন মহিলা হয়তো কোনো কাজে সিএমএম কোর্টে এসেছেন। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে তাকে সালাম জানিয়ে ভ্যানের ভেতরে প্রবেশ করলাম। চেয়ারে বসার আগেই মনের সব বিরক্তি, ক্ষুধা-তৃষ্ণা এক দোয়ায় উধাও হয়ে গেছে। তিন নম্বর ঘটনার অকুস্থল সকালের ছাতিম স্মৃতিবিজড়িত সেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আমি যথারীতি ভ্যানের ঝাঁকুনির সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে পথ চলছি, হঠাত্ গাড়ির গতি কমে এলো। সম্ভবত সামনে যানবাহনের দীর্ঘ সারি রয়েছে। প্রিজন ভ্যানের পাশে একেবারে গা ঘেঁষে আরেকটি যাত্রীবাহী বাস চলছে, যাত্রীরা সবাই তরুণ। দেখে মনে হলো, কোনো কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র একসঙ্গে তাদের গন্তব্যে চলেছে। রাস্তাঘাটে প্রিজন ভ্যান দেখলেই খাঁচাভর্তি আসামির দিকে পথচারীরা বিতৃষ্ণামাখা কৌতূহল নিয়ে তাকায়। প্রথমদিকে অস্বস্তি হলেও এই পাঁচ মাসে সেই দৃষ্টি আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। ছেলেগুলোও প্রিজন ভ্যানের দিকে তাকিয়ে সেখানে আর কোনো লোকজন না দেখে খানিক হকচকিয়ে গিয়েই একমাত্র আসামিকে চিনে ফেলল। তারপর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে সবাই একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাত নেড়ে আমার প্রতি তাদের সমর্থন ও শুভেচ্ছা জানাতে লাগল। দু’টি গাড়ি যতক্ষণ পাশাপাশি ছিল, আমিও ওদের দিকেই হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলাম। পরিবারের বাইরে এ দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী আমাকে যে আজও স্মরণে রেখেছে, আমার কথা হয়তো তাদের আন্দোলিত করে—এর চেয়ে বড় পাওয়া আমার মতো এক তুচ্ছ আদম সন্তানের অকিঞ্চিত্কর জীবনে আর কী-ইবা হতে পারে! এই সমর্থন এবং ভালোবাসার শক্তিতেই শাসকশ্রেণীর সব জুলুম ইনশাআল্লাহ, সইতে পারব।
No comments