৪- টুকরো কাগজগুলো পাশের সেলের বাবুকে দিয়ে বললাম যদি আর না ফিরি এগুলো আমার স্ত্রীর হাতে পৌঁছে দিও
সিএমএম আদালত থেকে সরাসরি রিমান্ডে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলাম।
গ্রেফতার হওয়া থেকে ৭ জুন পর্যন্ত ঘটনাবলী সংক্ষিপ্ত আকারে টুকরো কাগজে লিখে রেখেছিলাম। কোর্টে যাওয়ার আগে পাশের সেলের বাবুর হাতে সেই টুকরো কাগজগুলো দিয়ে অনুরোধ করলাম, যদি আর না ফিরি তাহলে কাগজগুলো যেন আমার স্ত্রীর হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে .....
গ্রেফতার হওয়া থেকে ৭ জুন পর্যন্ত ঘটনাবলী সংক্ষিপ্ত আকারে টুকরো কাগজে লিখে রেখেছিলাম। কোর্টে যাওয়ার আগে পাশের সেলের বাবুর হাতে সেই টুকরো কাগজগুলো দিয়ে অনুরোধ করলাম, যদি আর না ফিরি তাহলে কাগজগুলো যেন আমার স্ত্রীর হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে .....
ফজরের নামাজ শেষ করে সেলের চারদিকে ভালো করে তাকালাম। রাতে যখন এই ঘরে ব্যাগ হাতে ঢুকেছিলাম, তখন কোনো কিছু লক্ষ্য করার মতো শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ছিল না। দৈর্ঘ্যে ১২/১৩ ফুট এবং প্রস্থে টেনেটুনে ৮ ফুটের সেল। থানার হাজতের মতোই কোণে প্রাতঃকৃত্যের স্থান। মেঝেতে দুটো কম্বলের বিছানা পাতা রয়েছে। মাথার কাছে প্লাস্টিকের শেলেফ কয়েকটি বই এবং অন্যান্য টুকিটাকি দ্রব্যাদি রক্ষিত আছে। এগুলো আমি এখানে আসার আগ পর্যন্ত অবস্থানকারী আসামিদের সম্পত্তি। সেলের দেয়ালে পেরেক পুঁতে ব্যাগ ঝোলানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছাদে ফ্যান ঝুলছে এবং দুই সেলের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বাল্ব থেকেই উভয় সেলের বাসিন্দাদের যত্সামান্য বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা। এর মধ্যেই ৬টা বাজার ঘণ্টাধ্বনি শুনলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকালের শিফেটর কারারক্ষী এসে গারদের তালা খুলে দিল। লক-আপ খোলামাত্র দৌড় লাগালাম বাইরের গণটয়লেটে। রাতে কষ্ট হলেও সেলের মধ্যে ওই কাজটি করার রুচি হয়নি। বাইরের টয়লেটের অবস্থাও দেখলাম ভীতিকর। দুর্গন্ধের ধাক্কায় প্রথম চেষ্টায় পিছিয়ে এসে চৌবাচ্চা থেকে বালতিতে পানি নিয়ে আগে ভাসমান ময়লা পরিষ্কার করতে হলো। প্রাতঃকৃত্য শেষে সেই চৌবাচ্চার পাশে দাঁড়িয়েই গোসলও সারলাম। সকালে গোসল করা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এখানেও তার ব্যতিক্রম করলাম না। তবে ঈষদুষ্ণ পানি ব্যবহার করার বিলাসিতা ছাড়তে হলো। এর মধ্যে প্রতিবেশীরাও যার যার সেল থেকে দিনের মতো মুক্তি পেয়েছে। চারদিক থেকে আসা উত্সুক দৃষ্টিতে দ্রুত অভ্যস্ত হতে লাগলাম।
সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ আগের রাতের মতো পেজগি রুটি আর পানি দিয়ে সবে সকালের নাস্তার আয়োজন করছি আর তিন নম্বর কক্ষের একজন প্রতিবেশী এসে হাজির। ছেলেটির নাম বাবু, অস্ত্র মামলার আসামি। সরল-সাধারণ মানুষের সোজাসুজি প্রস্তাব। যতদিন ডিভিশন ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত না হচ্ছি, ওদের সঙ্গে তিনবেলা খেতে হবে এবং কোনো টাকা-পয়সা দেয়া চলবে না। জেলের কয়েদিদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান তারা কেবল সরকারি খাওয়ার ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করে না। জেলে ক্যান্টিন রয়েছে যেখান থেকে তুলনামূলক উন্নত খাদ্য কিনে ক্ষুধা নিবারণ করছে অন্তত এক-চতুর্থাংশ বন্দি। বাকিদের যেহেতু কিনে খাওয়ার মতো অর্থ সংস্থান নেই, কাজেই অতীব নিম্নমানের সরকারি ডায়েটই একমাত্র ভরসা। সকালবেলার সরকারি বরাদ্দ হচ্ছে দু’খানা আধপোড়া ধুলোমাখা রুটি এবং খানিকটা আখের গুড়। আমি যতই বলি পেজগি রুটিতেই চলে যাবে, কিন্তু বাবু নাছোরবান্দা। শেষ পর্যন্ত এই আন্তরিকতার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হলো। জেল ক্যান্টিন যাকে জেল পরিভাষায় পিসি বলা হয়, সেখান থেকে নাস্তা এলো ঘণ্টাখানেক পর। পরোটা, ভাজি এবং ডিমভাজা দিয়ে সকালের খাওয়াটা একেবারে মন্দ হলো না। বাবুর ঘরে চায়ের আয়োজনও রয়েছে। তবে ব্যাপারটা যে বেআইনি, সেটা পরে জেনেছিলাম। এর মধ্যে সারা জেলে আমার আগমনী বার্তা রটে গেছে। বিভিন্ন সেল থেকে বন্দিরা আসছে আমার সঙ্গে পরিচিত হতে। সাত নম্বর সেলে ছোটখাটো ভিড় জমে যেতেই কারারক্ষীরা উদ্বিগ্ন হয়ে আগত অতিথিদের জেলকোড ভঙ্গের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। জেলের ভেতরে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া এক সেল থেকে অন্য সেলে যাতায়াত নিষিদ্ধ থাকলেও কারারক্ষীদের সন্তুষ্ট করতে পারলে তারা সচরাচর চোখ বুজেই থাকে। কিন্তু, সঙ্গত কারণেই আমার ব্যাপারটা অনেক বেশি স্পর্শকাতর। আগত কয়েদিদের সঙ্গে আলাপচারিতার ফাঁকে প্রশাসনের লোক এলো আমার ছবি তুলতে। নতুন আসামির বুকে নম্বর সেঁটে ছবি তোলা বাধ্যতামূলক। ‘একে ধরিয়ে দিন’ মার্কা ছবি আর কী! ছবি তোলার জন্য আমাকে জেল হাসপাতাল প্রাঙ্গণে যেতে হলো। জায়গাটি সাত নম্বর সেলের কাছেই। সেখানেও আমাকে ঘিরে ছোটখাটো ভিড় জমে গেল। ছবি তুলিয়ে ফিরে আসতে না আসতেই জেল অফিস থেকে পেয়াদা এসে হাজির। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী জেলগেটে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তেজগাঁও থানা থেকে আইও এসে গেছে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, পেটানো শারীরিক গঠনের খর্বাকৃতির এক ব্যক্তি অপেক্ষমাণ। নাম জিজ্ঞেস করায় জানাল ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম। প্রথম দর্শনেই লোকটিকে অপছন্দ হলো। মিনিট পনেরোর বেশি জিজ্ঞাসাবাদ জমল না। আমাকে গ্রেফতারের সময় আমার দেশ কার্যালয়ে সাংবাদিক এবং শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে কারা উপস্থিত ছিল সেটাই প্রধানত তার জিজ্ঞাস্য। এসব ব্যক্তিকে পত্রিকা অফিসে আসার জন্য আমি ফোন করেছিলাম কি-না তাও জানতে চাইল। নেতিবাচক জবাব দিয়ে আমি পাল্টা জানতে চাইলাম, আদালতের কোনো পরোয়ানা ছাড়া কোন অধিকারে সেদিন এতজন পুলিশ আমার অফিসে হাজির হয়েছিল। আমার দেশ বন্ধ করার আইনগত ব্যাখ্যাও দাবি করলাম। ইন্সপেক্টর রেজার পক্ষে আমার একটি প্রশ্নের জবাব দেয়াও সম্ভব হলো না। সে স্বভাবতই বিরক্তবোধ করতে লাগল। আমি জোর দিয়ে বললাম, আমার প্রতিটি প্রশ্ন তার প্রতিবেদনে বিশদভাবে উল্লেখ করতে হবে। কেবল একতরফা জবাব লিখে কাজ সারলে চলবে না। বিব্রত হওয়াতে তার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটার গতি বেড়ে গেল। সওয়াল-জবাব চলাকালেই আইও আকস্মিকভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, এখানে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো পরিবেশ নেই। আর কোনো প্রশ্ন আছে কি-না, আমার এই প্রশ্নের জবাবে সে দু’দিকে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, জিজ্ঞাসাবাদ সমাপ্ত হয়েছে। আমিও কালক্ষেপণ না করে সাত নম্বর সেলের ফিরতি পথ ধরলাম।
জেলের তৃতীয় দিন ব্যারিস্টার নাসিমউদ্দিন অসীম এবং সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। বন্দি হওয়ার পর প্রথমবারের মতো পরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ব্যগ্র হয়ে জেলগেটে গেলাম। মা ও পারভীনের কুশল জানতে চাইলে ওরা বলল, সবাই ভালো আছেন। আমার স্ত্রী যে বাস্তবে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে সেটা সেদিন আমাকে আর কেউ জানায়নি। জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে ডিভিশন দেয়নি জেনে অসীম বিস্মিত হয়ে বলল, ওখান থেকে সরাসরি প্রেস ক্লাবে গিয়ে তারা সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের কথা জানাবেন। আমার পার্শ্ববর্তী সেলের বাসিন্দারা আমাকে চাঁদা তুলে দু’দিন ধরে তিনবেলা খাওয়াচ্ছে শুনে নোমানের বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে গেল। অলিউল্লাহ নোমানের কাছ থেকে জানলাম, জেলে আসার দিনই আমার নামে দশ হাজার টাকা পিসিতে জমা দেয়া হয়েছে। পিসি শব্দটি ইংরেজি Personal Cash (ব্যক্তিগত তহবিল)-এর ক্ষুদ্র প্রতিশব্দ। এখানে জমাকৃত টাকা দিয়ে জেল ক্যান্টিন থেকে কয়েদিরা পছন্দমত খাবার কিনে খেতে পারে। প্রায় তিনদিন পার হয়ে গেলেও টাকা জমার খবরটি জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। সরকার কতখানি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে, এরপর আর না বোঝার কারণ রইল না। হাইকোর্টে রিট করে যত শিগগির সম্ভব পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে অসীমের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সেদিনই বিকাল ৫টার দিকে সুবেদার ফজলু এসে সংবাদ দিল, জেল কর্তৃপক্ষ আমার ডিভিশনপ্রাপ্তি মঞ্জুর করেছে। আমি চাইলে তখনই সঙ্গে আনা ব্যাগ নিয়ে ডিভিশন ওয়ার্ড চম্পাকলি, যেটি ২৬ নম্বর সেল হিসেবেও পরিচিত, সেখানে যেতে পারি। প্রশাসনের এই হঠাত্ বদান্যতার কারণ যে অসীম এবং নোমানের জেলগেটে আগমন, সেটি বুঝতে আমার কোনো সমস্যা হলো না। কেন যেন মনে হলো আল্লাহ্ আমার পরীক্ষা চাইছেন। কোরআন-হাদিস অধ্যয়ন করে আমি জানি, আল্লাহ্র কাছে পরীক্ষা দেয়া বান্দার সাধ্যাতীত। তারপরও যে সরকার জেল কোডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একজন নাগরিককে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনটি দিন হেনস্তা করেছে, খাদ্য ও পানীয় থেকে বঞ্চিত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে—তাদের ডিভিশন গ্রহণ করতে মন চাইল না। সাধারণ কয়েদিদের মতো কষ্টকর কারাজীবনে অভ্যস্ত হয়েই নৈতিকভাবে ফ্যাসিবাদী প্রশাসনকে পরাজিত করার তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম। উপস্থিত বন্দি, কারারক্ষী, নির্বিশেষে সবাইকে অবাক করে আমি ডিভিশন প্রত্যাখ্যান করলাম। সারা জেলে হৈচৈ পড়ে গেল। ডিভিশনপ্রাপ্তির জন্য এখানে কত আকাঙ্ক্ষা, কত হা-হুতাশ। এমন অবাক করা কাণ্ড কারা প্রশাসন জন্মে দেখেনি। স্বয়ং জেলার ছুটে এসে তিনদিন ডিভিশন না দেয়ার সপক্ষে নানারকম দুর্বল যুক্তি দিতে লাগল। আমি অনড় রইলাম। এরপর প্রচ্ছন্ন হুমকি। বলা হলো, সরকারের বদান্যতার অসম্মান করলে আমাকে আর আইনজীবীদের সঙ্গে জেলগেটে সাক্ষাত্ করতে দেয়া হবে না। আমি ওকালতনামাতেও সই করতে পারব না। কাজেই আমার মামলা লড়াও সম্ভব হবে না। জেলার মোখলেসুর রহমান আমার মতো চিজের পাল্লায় আগে কখনও পড়েননি। কঠিনভাবে তাকে বলে দিলাম, যে হুমকি তিনি দিচ্ছেন তার একটিও করার ক্ষমতা তার নেই। তর্কাতর্কির মধ্যেই শেষ পর্যন্ত একটা রফা হলো। আমি ডিভিশন ওয়ার্ডে যাব না। তার পরিবর্তে আমার সাত নম্বর সেলের সেই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠেই একটি চৌকি ও চেয়ার-টেবিল দেয়া হবে। ভূমি শয্যা থেকে চৌকিতে উত্তরণ ঘটল গ্রেফতারের তিনদিন পর।
আরও দু’দিন কাটল। এর মধ্যে সরকার তিনটি নতুন মামলা দায়ের করেছে। সাতাশটি মামলার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে জুনের ২ তারিখ ভোর রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানা হাজতে প্রবেশ করেছিলাম। ৭ তারিখের মধ্যে মামলার সংখ্যা দাঁড়াল একত্রিশে। কোতোয়ালি থানা পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার মামলা দায়ের করা হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে সিএমএম আদালতে আমাকে আনার দিনে আদালত এলাকায় জনগণের প্রতিবাদের অপরাধে। সেদিন আদালত চত্বরে যখন প্রচণ্ড বিক্ষোভ চলছিল, আমি তখন শত শত পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় প্রিজন ভ্যানে আটকাবস্থায় ছিলাম। বিক্ষোভের খবরও আমার জানা ছিল না। অথচ আমিই নাকি এই মামলার এক নম্বর আসামি। পুলিশের অভিযোগ অনুযায়ী আমার উস্কানিতেই হাজারের ওপর আইনজীবী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, সাধারণ নাগরিক সেখানে জমায়েত হয়েছিল। অভিযোগ সত্য হলে সাধারণ জ্ঞান বলে, আমাকে পাহারারত পুলিশও সমভাবে অপরাধী। তাদের সংশ্রব ও সহযোগিতা ছাড়া বন্দি অবস্থায় আমার পক্ষে লোক জমায়েত এবং তাদের উস্কানি দেয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের কথিত স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি প্রশাসনের এই উপহাসে আমি চমত্কৃত হলেও বিচারকরা নির্বিকার। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মামলা তুলনামূলকভাবে অনেক গুরুতর। উত্তরা থানায় ইসলামী জঙ্গিত্বের অভিযোগে এবং বিমানবন্দর থানায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের হয়েছে। সবক’টি মামলাতেই সেই অতিচেনা শোন অ্যারেস্ট (Shown Arrest)| শেখ হাসিনার এবারের শাসনকালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের শায়েস্তা করার জন্য শোন অ্যারেস্ট নামক আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার চলছে। যে কোনো নাগরিককে একটি বানোয়াট মামলায় গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে এন্তার মামলা দায়েরের মাধ্যমে শোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে বিনা বিচারে সুদীর্ঘকাল আটক রাখার নয়া পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে দেশে পুরনো কালো আইন নামে পরিচিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের আর প্রয়োজন হচ্ছে না। গত দুই বছরে নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সপক্ষে আমার দেশ জোরালো অবস্থান নিয়ে ক্রসফায়ার, গুম-খুন, শোন অ্যারেস্ট, রিমান্ডের নামে ভয়াবহ নির্যাতন এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু সম্পর্কিত সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দূরের এবং কাছের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আজ্ঞাবহ সরকার মানবাধিকারের পক্ষে আমার দেশ-এর নৈতিক অবস্থানকে সহ্য করতে পারেনি। জনগণ তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠলে যে কোনো স্বৈরাচারী সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী। আমার সম্পাদনায় আমার দেশ স্বাধীনতার কথা বলেছে, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য জনমত তৈরির যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এই ‘অপরাধের’ জন্য হয়তো আমাকে চরম মূল্যই দিতে হবে। খবর পেলাম, নতুন তিনটি মামলাসহ তেজগাঁও থানার পুরনো মামলাতেও সরকার নতুন করে রিমান্ড প্রার্থনা করেছে। ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম কেন বলেছিল জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের পরিবেশ নেই, তাও এবার বুঝতে পারলাম। সব মামলারই রিমান্ড শুনানির জন্য সিএমএম আদালত ৭ জুন দিন ধার্য করেছে। দেখতে দেখতে সাত তারিখ এসে গেল। আজ আদালতে যেতে হবে। এর মধ্যে অ্যাডভোকেট মুন্সী কবির জেলগেটে এসে জানিয়ে গেছে, সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী এবং ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের মতো দেশবরেণ্য আইনজীবী অনেকটা প্রথাবিরুদ্ধভাবে নিম্ন আদালতে আমার পক্ষে মামলা লড়তে আসবেন। এ আমার জন্য এক বিরাট সম্মান হলেও কাজের কাজ যে কিছুই হবে না সে বিষয়ে কোনোরকম সন্দেহ পোষণ করছিলাম না। নিম্ন আদালতে রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর কোন প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে সেটা সবারই জানা। সাত তারিখে সিএমএম আদালত থেকে সরাসরি রিমান্ডে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। আমার মনে ক্রমেই দৃঢ়বিশ্বাস জন্মে যাচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী আমার প্রাণহীন দেহটাকেই কেবল মা এবং স্ত্রীর কাছে ফেরত পাঠাতে চান। গ্রেফতার হওয়া থেকে ৭ জুন পর্যন্ত ঘটনাবলী সংক্ষিপ্ত আকারে টুকরো কাগজে লিখে রেখেছিলাম। কোর্টে যাওয়ার আগে পাশের সেলের বাবুর হাতে সেই টুকরো কাগজগুলো দিয়ে অনুরোধ করলাম, যদি আর না ফিরি তাহলে কাগজগুলো যেন আমার স্ত্রীর হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে। লেখার মধ্যে আমার জীবনের শেষ ক’দিনের স্মৃতিটা অন্তত তার বাকি জীবনের বাঁচার অবলম্বন হতে পারে। সন্ত্রাসের অভিযোগে আটক ছেলেটি আমার দু’হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বাবু সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমরা দু’জনই বাইরে থাকলে এই ছেলেই হয়তো দলের নেতা-নেত্রীর নির্দেশে আমার গাড়িতে বোমা হামলা চালাবে। অথচ জেলের ভেতরে মাত্র ক’দিনেই কত আপন হয়ে উঠেছে। এজন্যই মানুষ আশরাফুল মখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব।
সকাল ১০টায় জেল থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো কোর্ট গারদে। বাহন সেই প্রিজন ভ্যান। এর আগে কোর্ট গারদ চত্বর পর্যন্ত এসেছিলাম। সেদিন আমাকে প্রিজন ভ্যানের ভেতরেই ঘণ্টাখানেক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। আজ সরাসরি গারদে। নোংরা, দুর্গন্ধময় গারদে আমাকে ঢুকিয়েই তালা মেরে দেয়া হলো। ঢাকা সিএমএম আদালতে সেই গারদখানার দু’পাশে চারটি হাজত রয়েছে। আমাকে রাখা হলো পূর্বদিকের শেষ সেলটায়। বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। বসতে হলে কফ, পানি এবং অন্যান্য মনুষ্য বর্জ্যময় মেঝেই একমাত্র স্থান। ওরকম জায়গায় বসতে তখন পর্যন্ত অভ্যস্ত হতে পারিনি। শুরু করলাম পায়চারি। প্রথমে ধীরে, তারপর দ্রুত এবং সবশেষে অতি দ্রুত। অনেকটা ঘোরলাগা মানুষের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেই চলেছি। চুল, কপাল বেয়ে অবিরত ধারায় ঘাম ঝরছে। দুপুর ২টার দিকে এক দঙ্গল পুলিশ এসে হাজতের দরজা খুলল। ততক্ষণে আমার ঘামে ভেজা, রুক্ষ, পরিশ্রান্ত চেহারা ভীতিকর রূপ নিয়েছে। জানানো হলো, মহামান্য ম্যাজিস্ট্রেট এজলাসে উঠেছেন। আমার মামলার শুনানির সময় হয়েছে। হাজত থেকে সামনের চত্বরে নেমে দেখি অসংখ্য পুলিশ চত্বর ভরে ফেলেছে। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা হাত ধরতে এলে রূঢ় কণ্ঠে আমাকে স্পর্শ না করতে নির্দেশ দিলাম। তারা থমকে পিছিয়ে গেল। শুরু হলো আদালত পানে সম্মিলিত পদযাত্রা।
সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ আগের রাতের মতো পেজগি রুটি আর পানি দিয়ে সবে সকালের নাস্তার আয়োজন করছি আর তিন নম্বর কক্ষের একজন প্রতিবেশী এসে হাজির। ছেলেটির নাম বাবু, অস্ত্র মামলার আসামি। সরল-সাধারণ মানুষের সোজাসুজি প্রস্তাব। যতদিন ডিভিশন ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত না হচ্ছি, ওদের সঙ্গে তিনবেলা খেতে হবে এবং কোনো টাকা-পয়সা দেয়া চলবে না। জেলের কয়েদিদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান তারা কেবল সরকারি খাওয়ার ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করে না। জেলে ক্যান্টিন রয়েছে যেখান থেকে তুলনামূলক উন্নত খাদ্য কিনে ক্ষুধা নিবারণ করছে অন্তত এক-চতুর্থাংশ বন্দি। বাকিদের যেহেতু কিনে খাওয়ার মতো অর্থ সংস্থান নেই, কাজেই অতীব নিম্নমানের সরকারি ডায়েটই একমাত্র ভরসা। সকালবেলার সরকারি বরাদ্দ হচ্ছে দু’খানা আধপোড়া ধুলোমাখা রুটি এবং খানিকটা আখের গুড়। আমি যতই বলি পেজগি রুটিতেই চলে যাবে, কিন্তু বাবু নাছোরবান্দা। শেষ পর্যন্ত এই আন্তরিকতার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হলো। জেল ক্যান্টিন যাকে জেল পরিভাষায় পিসি বলা হয়, সেখান থেকে নাস্তা এলো ঘণ্টাখানেক পর। পরোটা, ভাজি এবং ডিমভাজা দিয়ে সকালের খাওয়াটা একেবারে মন্দ হলো না। বাবুর ঘরে চায়ের আয়োজনও রয়েছে। তবে ব্যাপারটা যে বেআইনি, সেটা পরে জেনেছিলাম। এর মধ্যে সারা জেলে আমার আগমনী বার্তা রটে গেছে। বিভিন্ন সেল থেকে বন্দিরা আসছে আমার সঙ্গে পরিচিত হতে। সাত নম্বর সেলে ছোটখাটো ভিড় জমে যেতেই কারারক্ষীরা উদ্বিগ্ন হয়ে আগত অতিথিদের জেলকোড ভঙ্গের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। জেলের ভেতরে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া এক সেল থেকে অন্য সেলে যাতায়াত নিষিদ্ধ থাকলেও কারারক্ষীদের সন্তুষ্ট করতে পারলে তারা সচরাচর চোখ বুজেই থাকে। কিন্তু, সঙ্গত কারণেই আমার ব্যাপারটা অনেক বেশি স্পর্শকাতর। আগত কয়েদিদের সঙ্গে আলাপচারিতার ফাঁকে প্রশাসনের লোক এলো আমার ছবি তুলতে। নতুন আসামির বুকে নম্বর সেঁটে ছবি তোলা বাধ্যতামূলক। ‘একে ধরিয়ে দিন’ মার্কা ছবি আর কী! ছবি তোলার জন্য আমাকে জেল হাসপাতাল প্রাঙ্গণে যেতে হলো। জায়গাটি সাত নম্বর সেলের কাছেই। সেখানেও আমাকে ঘিরে ছোটখাটো ভিড় জমে গেল। ছবি তুলিয়ে ফিরে আসতে না আসতেই জেল অফিস থেকে পেয়াদা এসে হাজির। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী জেলগেটে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তেজগাঁও থানা থেকে আইও এসে গেছে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, পেটানো শারীরিক গঠনের খর্বাকৃতির এক ব্যক্তি অপেক্ষমাণ। নাম জিজ্ঞেস করায় জানাল ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম। প্রথম দর্শনেই লোকটিকে অপছন্দ হলো। মিনিট পনেরোর বেশি জিজ্ঞাসাবাদ জমল না। আমাকে গ্রেফতারের সময় আমার দেশ কার্যালয়ে সাংবাদিক এবং শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে কারা উপস্থিত ছিল সেটাই প্রধানত তার জিজ্ঞাস্য। এসব ব্যক্তিকে পত্রিকা অফিসে আসার জন্য আমি ফোন করেছিলাম কি-না তাও জানতে চাইল। নেতিবাচক জবাব দিয়ে আমি পাল্টা জানতে চাইলাম, আদালতের কোনো পরোয়ানা ছাড়া কোন অধিকারে সেদিন এতজন পুলিশ আমার অফিসে হাজির হয়েছিল। আমার দেশ বন্ধ করার আইনগত ব্যাখ্যাও দাবি করলাম। ইন্সপেক্টর রেজার পক্ষে আমার একটি প্রশ্নের জবাব দেয়াও সম্ভব হলো না। সে স্বভাবতই বিরক্তবোধ করতে লাগল। আমি জোর দিয়ে বললাম, আমার প্রতিটি প্রশ্ন তার প্রতিবেদনে বিশদভাবে উল্লেখ করতে হবে। কেবল একতরফা জবাব লিখে কাজ সারলে চলবে না। বিব্রত হওয়াতে তার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটার গতি বেড়ে গেল। সওয়াল-জবাব চলাকালেই আইও আকস্মিকভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, এখানে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো পরিবেশ নেই। আর কোনো প্রশ্ন আছে কি-না, আমার এই প্রশ্নের জবাবে সে দু’দিকে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, জিজ্ঞাসাবাদ সমাপ্ত হয়েছে। আমিও কালক্ষেপণ না করে সাত নম্বর সেলের ফিরতি পথ ধরলাম।
জেলের তৃতীয় দিন ব্যারিস্টার নাসিমউদ্দিন অসীম এবং সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। বন্দি হওয়ার পর প্রথমবারের মতো পরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ব্যগ্র হয়ে জেলগেটে গেলাম। মা ও পারভীনের কুশল জানতে চাইলে ওরা বলল, সবাই ভালো আছেন। আমার স্ত্রী যে বাস্তবে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে সেটা সেদিন আমাকে আর কেউ জানায়নি। জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে ডিভিশন দেয়নি জেনে অসীম বিস্মিত হয়ে বলল, ওখান থেকে সরাসরি প্রেস ক্লাবে গিয়ে তারা সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের কথা জানাবেন। আমার পার্শ্ববর্তী সেলের বাসিন্দারা আমাকে চাঁদা তুলে দু’দিন ধরে তিনবেলা খাওয়াচ্ছে শুনে নোমানের বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে গেল। অলিউল্লাহ নোমানের কাছ থেকে জানলাম, জেলে আসার দিনই আমার নামে দশ হাজার টাকা পিসিতে জমা দেয়া হয়েছে। পিসি শব্দটি ইংরেজি Personal Cash (ব্যক্তিগত তহবিল)-এর ক্ষুদ্র প্রতিশব্দ। এখানে জমাকৃত টাকা দিয়ে জেল ক্যান্টিন থেকে কয়েদিরা পছন্দমত খাবার কিনে খেতে পারে। প্রায় তিনদিন পার হয়ে গেলেও টাকা জমার খবরটি জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। সরকার কতখানি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে, এরপর আর না বোঝার কারণ রইল না। হাইকোর্টে রিট করে যত শিগগির সম্ভব পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে অসীমের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সেদিনই বিকাল ৫টার দিকে সুবেদার ফজলু এসে সংবাদ দিল, জেল কর্তৃপক্ষ আমার ডিভিশনপ্রাপ্তি মঞ্জুর করেছে। আমি চাইলে তখনই সঙ্গে আনা ব্যাগ নিয়ে ডিভিশন ওয়ার্ড চম্পাকলি, যেটি ২৬ নম্বর সেল হিসেবেও পরিচিত, সেখানে যেতে পারি। প্রশাসনের এই হঠাত্ বদান্যতার কারণ যে অসীম এবং নোমানের জেলগেটে আগমন, সেটি বুঝতে আমার কোনো সমস্যা হলো না। কেন যেন মনে হলো আল্লাহ্ আমার পরীক্ষা চাইছেন। কোরআন-হাদিস অধ্যয়ন করে আমি জানি, আল্লাহ্র কাছে পরীক্ষা দেয়া বান্দার সাধ্যাতীত। তারপরও যে সরকার জেল কোডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একজন নাগরিককে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনটি দিন হেনস্তা করেছে, খাদ্য ও পানীয় থেকে বঞ্চিত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে—তাদের ডিভিশন গ্রহণ করতে মন চাইল না। সাধারণ কয়েদিদের মতো কষ্টকর কারাজীবনে অভ্যস্ত হয়েই নৈতিকভাবে ফ্যাসিবাদী প্রশাসনকে পরাজিত করার তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম। উপস্থিত বন্দি, কারারক্ষী, নির্বিশেষে সবাইকে অবাক করে আমি ডিভিশন প্রত্যাখ্যান করলাম। সারা জেলে হৈচৈ পড়ে গেল। ডিভিশনপ্রাপ্তির জন্য এখানে কত আকাঙ্ক্ষা, কত হা-হুতাশ। এমন অবাক করা কাণ্ড কারা প্রশাসন জন্মে দেখেনি। স্বয়ং জেলার ছুটে এসে তিনদিন ডিভিশন না দেয়ার সপক্ষে নানারকম দুর্বল যুক্তি দিতে লাগল। আমি অনড় রইলাম। এরপর প্রচ্ছন্ন হুমকি। বলা হলো, সরকারের বদান্যতার অসম্মান করলে আমাকে আর আইনজীবীদের সঙ্গে জেলগেটে সাক্ষাত্ করতে দেয়া হবে না। আমি ওকালতনামাতেও সই করতে পারব না। কাজেই আমার মামলা লড়াও সম্ভব হবে না। জেলার মোখলেসুর রহমান আমার মতো চিজের পাল্লায় আগে কখনও পড়েননি। কঠিনভাবে তাকে বলে দিলাম, যে হুমকি তিনি দিচ্ছেন তার একটিও করার ক্ষমতা তার নেই। তর্কাতর্কির মধ্যেই শেষ পর্যন্ত একটা রফা হলো। আমি ডিভিশন ওয়ার্ডে যাব না। তার পরিবর্তে আমার সাত নম্বর সেলের সেই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠেই একটি চৌকি ও চেয়ার-টেবিল দেয়া হবে। ভূমি শয্যা থেকে চৌকিতে উত্তরণ ঘটল গ্রেফতারের তিনদিন পর।
আরও দু’দিন কাটল। এর মধ্যে সরকার তিনটি নতুন মামলা দায়ের করেছে। সাতাশটি মামলার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে জুনের ২ তারিখ ভোর রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানা হাজতে প্রবেশ করেছিলাম। ৭ তারিখের মধ্যে মামলার সংখ্যা দাঁড়াল একত্রিশে। কোতোয়ালি থানা পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার মামলা দায়ের করা হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে সিএমএম আদালতে আমাকে আনার দিনে আদালত এলাকায় জনগণের প্রতিবাদের অপরাধে। সেদিন আদালত চত্বরে যখন প্রচণ্ড বিক্ষোভ চলছিল, আমি তখন শত শত পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় প্রিজন ভ্যানে আটকাবস্থায় ছিলাম। বিক্ষোভের খবরও আমার জানা ছিল না। অথচ আমিই নাকি এই মামলার এক নম্বর আসামি। পুলিশের অভিযোগ অনুযায়ী আমার উস্কানিতেই হাজারের ওপর আইনজীবী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, সাধারণ নাগরিক সেখানে জমায়েত হয়েছিল। অভিযোগ সত্য হলে সাধারণ জ্ঞান বলে, আমাকে পাহারারত পুলিশও সমভাবে অপরাধী। তাদের সংশ্রব ও সহযোগিতা ছাড়া বন্দি অবস্থায় আমার পক্ষে লোক জমায়েত এবং তাদের উস্কানি দেয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের কথিত স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি প্রশাসনের এই উপহাসে আমি চমত্কৃত হলেও বিচারকরা নির্বিকার। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মামলা তুলনামূলকভাবে অনেক গুরুতর। উত্তরা থানায় ইসলামী জঙ্গিত্বের অভিযোগে এবং বিমানবন্দর থানায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের হয়েছে। সবক’টি মামলাতেই সেই অতিচেনা শোন অ্যারেস্ট (Shown Arrest)| শেখ হাসিনার এবারের শাসনকালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের শায়েস্তা করার জন্য শোন অ্যারেস্ট নামক আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার চলছে। যে কোনো নাগরিককে একটি বানোয়াট মামলায় গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে এন্তার মামলা দায়েরের মাধ্যমে শোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে বিনা বিচারে সুদীর্ঘকাল আটক রাখার নয়া পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে দেশে পুরনো কালো আইন নামে পরিচিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের আর প্রয়োজন হচ্ছে না। গত দুই বছরে নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সপক্ষে আমার দেশ জোরালো অবস্থান নিয়ে ক্রসফায়ার, গুম-খুন, শোন অ্যারেস্ট, রিমান্ডের নামে ভয়াবহ নির্যাতন এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু সম্পর্কিত সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দূরের এবং কাছের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আজ্ঞাবহ সরকার মানবাধিকারের পক্ষে আমার দেশ-এর নৈতিক অবস্থানকে সহ্য করতে পারেনি। জনগণ তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠলে যে কোনো স্বৈরাচারী সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী। আমার সম্পাদনায় আমার দেশ স্বাধীনতার কথা বলেছে, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য জনমত তৈরির যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এই ‘অপরাধের’ জন্য হয়তো আমাকে চরম মূল্যই দিতে হবে। খবর পেলাম, নতুন তিনটি মামলাসহ তেজগাঁও থানার পুরনো মামলাতেও সরকার নতুন করে রিমান্ড প্রার্থনা করেছে। ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম কেন বলেছিল জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের পরিবেশ নেই, তাও এবার বুঝতে পারলাম। সব মামলারই রিমান্ড শুনানির জন্য সিএমএম আদালত ৭ জুন দিন ধার্য করেছে। দেখতে দেখতে সাত তারিখ এসে গেল। আজ আদালতে যেতে হবে। এর মধ্যে অ্যাডভোকেট মুন্সী কবির জেলগেটে এসে জানিয়ে গেছে, সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী এবং ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের মতো দেশবরেণ্য আইনজীবী অনেকটা প্রথাবিরুদ্ধভাবে নিম্ন আদালতে আমার পক্ষে মামলা লড়তে আসবেন। এ আমার জন্য এক বিরাট সম্মান হলেও কাজের কাজ যে কিছুই হবে না সে বিষয়ে কোনোরকম সন্দেহ পোষণ করছিলাম না। নিম্ন আদালতে রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর কোন প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে সেটা সবারই জানা। সাত তারিখে সিএমএম আদালত থেকে সরাসরি রিমান্ডে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। আমার মনে ক্রমেই দৃঢ়বিশ্বাস জন্মে যাচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী আমার প্রাণহীন দেহটাকেই কেবল মা এবং স্ত্রীর কাছে ফেরত পাঠাতে চান। গ্রেফতার হওয়া থেকে ৭ জুন পর্যন্ত ঘটনাবলী সংক্ষিপ্ত আকারে টুকরো কাগজে লিখে রেখেছিলাম। কোর্টে যাওয়ার আগে পাশের সেলের বাবুর হাতে সেই টুকরো কাগজগুলো দিয়ে অনুরোধ করলাম, যদি আর না ফিরি তাহলে কাগজগুলো যেন আমার স্ত্রীর হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে। লেখার মধ্যে আমার জীবনের শেষ ক’দিনের স্মৃতিটা অন্তত তার বাকি জীবনের বাঁচার অবলম্বন হতে পারে। সন্ত্রাসের অভিযোগে আটক ছেলেটি আমার দু’হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বাবু সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমরা দু’জনই বাইরে থাকলে এই ছেলেই হয়তো দলের নেতা-নেত্রীর নির্দেশে আমার গাড়িতে বোমা হামলা চালাবে। অথচ জেলের ভেতরে মাত্র ক’দিনেই কত আপন হয়ে উঠেছে। এজন্যই মানুষ আশরাফুল মখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব।
সকাল ১০টায় জেল থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো কোর্ট গারদে। বাহন সেই প্রিজন ভ্যান। এর আগে কোর্ট গারদ চত্বর পর্যন্ত এসেছিলাম। সেদিন আমাকে প্রিজন ভ্যানের ভেতরেই ঘণ্টাখানেক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। আজ সরাসরি গারদে। নোংরা, দুর্গন্ধময় গারদে আমাকে ঢুকিয়েই তালা মেরে দেয়া হলো। ঢাকা সিএমএম আদালতে সেই গারদখানার দু’পাশে চারটি হাজত রয়েছে। আমাকে রাখা হলো পূর্বদিকের শেষ সেলটায়। বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। বসতে হলে কফ, পানি এবং অন্যান্য মনুষ্য বর্জ্যময় মেঝেই একমাত্র স্থান। ওরকম জায়গায় বসতে তখন পর্যন্ত অভ্যস্ত হতে পারিনি। শুরু করলাম পায়চারি। প্রথমে ধীরে, তারপর দ্রুত এবং সবশেষে অতি দ্রুত। অনেকটা ঘোরলাগা মানুষের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেই চলেছি। চুল, কপাল বেয়ে অবিরত ধারায় ঘাম ঝরছে। দুপুর ২টার দিকে এক দঙ্গল পুলিশ এসে হাজতের দরজা খুলল। ততক্ষণে আমার ঘামে ভেজা, রুক্ষ, পরিশ্রান্ত চেহারা ভীতিকর রূপ নিয়েছে। জানানো হলো, মহামান্য ম্যাজিস্ট্রেট এজলাসে উঠেছেন। আমার মামলার শুনানির সময় হয়েছে। হাজত থেকে সামনের চত্বরে নেমে দেখি অসংখ্য পুলিশ চত্বর ভরে ফেলেছে। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা হাত ধরতে এলে রূঢ় কণ্ঠে আমাকে স্পর্শ না করতে নির্দেশ দিলাম। তারা থমকে পিছিয়ে গেল। শুরু হলো আদালত পানে সম্মিলিত পদযাত্রা।
No comments