৪১- দেশকে অকার্যকর প্রমাণে সরকার যে বদ্ধপরিকর : জনগণ দেরিতে হলেও তা উপলব্ধি করছে
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দুইখান প্রশ্ন
... দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মিজ দীপু মনির সৈন্য প্রেরণের প্রস্তাবের বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। মার্কিন প্রশাসনকে সরাসরি মিথ্যাবাদী বানানোর এই অকূটনৈতিকসুলভ চেষ্টার প্রতিবাদে মার্কিনিরা কী করবে, সেটা দুই পরম বন্ধুর ব্যাপার। ...
... বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমার দুইখান প্রশ্ন আছে...
... দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মিজ দীপু মনির সৈন্য প্রেরণের প্রস্তাবের বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। মার্কিন প্রশাসনকে সরাসরি মিথ্যাবাদী বানানোর এই অকূটনৈতিকসুলভ চেষ্টার প্রতিবাদে মার্কিনিরা কী করবে, সেটা দুই পরম বন্ধুর ব্যাপার। ...
... বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমার দুইখান প্রশ্ন আছে...
আজ আশ্বিনের সতের। দু’দিন ধরে অসহ্য ভ্যাপসা গরম চলছে। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি হওয়া সত্ত্বেও ঘন্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুত্ আসছে আর যাচ্ছে। দুপুরের আহার শেষ করে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। পরিবারের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য আনার সংগ্রামে সাতান্নটি বছরের দিন-রাত ব্যস্ত থাকায় জীবনে দিবানিদ্রার বিলাসিতা উপভোগের সুযোগ হয়নি। জেলে অখণ্ড অবসর হলেও এই গরমে প্রায়ান্ধকার কুঠুরিতে ঘুমানোর প্রশ্ন অবান্তর। এমন হাঁসফাঁস অবস্থায় এক অপরিচিত তরুণ ছোট একটা ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে উপস্থিত হলো। জেলখানায় অপ্রত্যাশিত ফুলের তোড়া দেখে অবাক হয়ে তাকালাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছেলেটি পারিবারিক বিরোধসংক্রান্ত মামলায় হাজতি হয়ে ঢাকা জেলে এসেছে। লাজুক মুখে একটা অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল, আমার সম্পর্কে এক গোলটেবিলে আলোচনাকালে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মন্তব্য পড়ে আবেগপ্রবণ হয়ে সে ফুল নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আদালত অবমাননা মামলায় আমার সাজা প্রসঙ্গে রফিক ভাই নাকি বলেছেন, বাংলাদেশে সত্য কথা বললে জেলে যেতে হয় এবং মিথ্যাবাদীরা নিরাপদে থাকে। ফুলের তোড়াটি ছেলেটির হাত থেকে নিয়ে আমিও হেসে বললাম, এই উপহার তো রফিক ভাইয়ের প্রাপ্য, আমি বড়জোর বাহক হতে পারি। খানিকক্ষণ গল্প করে অলস দুপুরের অবসাদ কাটালাম।
এদিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগবিষয়ক জটিলতা ক্রমেই বাড়ছে। আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক পত্রিকা জনকণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী একজন জুনিয়রকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রতিবাদে দুই সিনিয়র বিচারপতি আবদুল মতিন এবং শাহ মো. নাঈমুর রহমান অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছুটিতে গেছেন। প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকও এই ক’দিনের মধ্যেই নানান বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করে নিজেকে আরও বিতর্কিত করে ফেলেছেন। শপথ গ্রহণ করেই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সুরে সুর মিলিয়ে সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দায়ে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে বিচারাঙ্গনের দীর্ঘদিনের প্রথা ভঙ্গ করে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় প্রসঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করে নিজের দলীয় রাজনৈতিক অবস্থানটিকে দেশবাসীর কাছে অধিকতর পরিষ্কার করে তুলেছেন। হাইকোর্টের বিচারক থাকাকালীন বর্তমান প্রধান বিচারপতিই মুন সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত মামলাকে সূত্র করে ২০০৫ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছিলেন। সমালোচকরা বলে থাকেন, রায় দেয়ার পর দীর্ঘ সাত মাস পূর্ণাঙ্গ রায় লেখায় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করেছিলেন, যাতে তত্কালীন বিএনপি সরকার হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে শুনানিতে নিয়ে বাতিল করার সুযোগ না পায়। বিচারপতিগণ বিতর্ক এড়িয়ে চলার জন্য সচরাচর নিজের রায় নিয়ে মন্তব্য করেন না।
প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের আলোকে নতুন করে সংবিধান ছাপানোর তাগিদ দিয়ে একদিকে যেমন তার অতি উত্সাহ প্রমাণ করেছেন, অন্যদিকে প্রধান বিচারপতিসুলভ গাম্ভীর্য রক্ষাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। জেনারেল মইনের সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ শাসনামল থেকেই বিচার বিভাগের অবক্ষয় নিয়ে আমি যে উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছি, তারই যথার্থতা প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে। আমার আগাম মন্তব্য-প্রতিবেদন সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় সন্তোষ লাভ করা উচিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ ভেঙে পড়ার বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরে আমার বরং বিষাদের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে ক্রমেই একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে বর্তমান সরকার যে বদ্ধপরিকর, এই সত্য দেশের জনগণ বিলম্বে হলেও উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিত্বের মধ্যে বসবাস করেও জনগণের সেই ভাবনার প্রতিফলন দৈনন্দিন জীবনেই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলার পর এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনি দাবি করেছেন, আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ নিয়ে নাকি তার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুকের কোনো আলোচনাই হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে সরাসরি দেশে না ফিরে ইউরোপ সফরে গেছেন। সেখানে দিন চারেক চুপচাপ থেকে অবশেষে দীপু মনি এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বোধহয় আশায় ছিলেন যে, এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সৈন্য পাঠানোর তার অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিতর্কিত প্রতিশ্রুতি দানের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আশা পূর্ণ হয়নি। বাংলাদেশের ডান ও বাম দলগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের এই অবিমৃষ্যকারিতায় অবিরত সমালোচনার ঝড় উটের মতো বালুতে মুখ গুঁজে থেকেও থামানো যায়নি। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এরই মধ্যে আশা প্রকাশ করেছেন যে, এই বিষয়ে সহসাই কার্যকর আলোচনা হবে। ভয়েস অব আমেরিকা থেকেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান বিষয়ক বিশেষ সহকারীর মধ্যকার আলোচনার বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। জনরোষের ভয়ে দীপু মনিকে বাধ্য হয়েই পিছু হটতে হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, সৈন্য প্রেরণের বিষয়ে নয়, আফগান প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষক পাঠানোর আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রশাসন যে এতটা সক্ষমতা অর্জন করেছে সে তথ্যটি জানা ছিল না। নির্বাক আমজনতা এখন কোন পক্ষের কথা বিশ্বাস করবে? রিচার্ড হলব্রুক, মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স, ভয়েস অব আমেরিকা নাকি দীপু মনির? আমি আফগান নাটকের পাণ্ডুলিপিটি একটু ভিন্নভাবে সাজানোর চেষ্টা করছি। পাঠকের কাছে আগেভাগেই স্বীকার করে নিচ্ছি এই পাণ্ডুলিপি একান্তই আমার আষাঢ়ে ভাবনার ফসল, প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে গল্পের কোনো অংশ মিলে গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয় এবং অনিচ্ছাকৃত।
বছর খানেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই দেশের প্রশাসনের কাছ থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিলেন। একপাশে বারাক ওবামা এবং অপর পাশে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনকে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজনরত শেখ হাসিনার সেই গর্বিত ছবি বিপুল সংখ্যক দেশবাসীর এখনও নিশ্চয়ই স্মরণে আছে। সেবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। এটাও বাংলাদেশের যে কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য এক বিরল সম্মান। এবারের সফর যদিও জাতিসংঘকেন্দ্রিক ছিল, তারপরও বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসন নিজেদের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের ইসলামবিরোধী মোর্চার কৌশলগত মিত্র বিবেচনা করার কারণে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে ভিন্ন মাত্রার মূল্যায়ন প্রত্যাশা করেছিল। মুশকিল হলো, বড়র পিরিতি যে বালির বাঁধ এই শাশ্বত সত্যটি সব গরিবের সর্বদা স্মরণে থাকে না। কাজেই শ’খানেক সফরসঙ্গী নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন মুল্লুকে গিয়ে দেখলেন, বারাক ওবামার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ তো দূরের কথা মার্কিন প্রশাসনের কোনো মধ্যম সারির কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ করাও এবার অন্তত দুরূহ। সরকারে পাঁচ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মেজবান রাষ্ট্রের এমনতর ঠাণ্ডা ব্যবহারে দীপু মনি, ড. গওহর রিজভীসহ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং সরকার নিযুক্ত লবিস্ট ফার্মের কর্মকর্তারা প্রমাদ গুনেছেন। রাগান্বিত প্রধানমন্ত্রীর গালাগাল হজম তো করতেই হয়েছে, সেই সঙ্গে দেশে ফেরার মুখ যে আর থাকে না। জাতিসংঘ এমডিজি পুরষ্কার পাওয়া গেলেও সেটা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে, গণতন্ত্রের মানসকন্যা নিজে যে কিছুই পেলেন না। এদিকে চরম বেয়াদব বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগেই এমডিজি পুরস্কারের কৃতিত্ব দাবি করে বসে আছে। আস্পর্ধারও একটা সীমা থাকা দরকার! সরকারের সব মণি-মাণিক্য এক হয়ে তখন আস্তিনের মধ্য থেকে ট্রাম্প কার্ড বের করতে বাধ্য হলেন। আমেরিকার ‘পরীক্ষাউত্তীর্ণ বন্ধু’ বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন মহল আফগানিস্তানে বেকায়দায় পড়া মার্কিন সেনাদের উদ্ধারের জন্য চৌকস বেঙ্গল টাইগারদের পাঠিয়ে দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব ইস্পাতকঠিন করে তুলতে চায়, এমন সংবাদ পাঠানো হলো হোয়াইট হাউসে। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিউইয়র্ক থেকে বিশেষ বিমানে উড়িয়ে হোয়াইট হাউসে নিয়ে সেখানকার সবুজ লনে বারাক ওবামার সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হবে, তাতে আর সন্দেহ কোথায়? অপেক্ষা আর শেষ হয় না। দেশে ফেরার দিনও দ্রুত এগিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত এ পক্ষকে চরম হতাশায় ডুবিয়ে সিদ্ধান্ত এলো, আগে রিচার্ড হলব্রুকের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা সমাপ্ত করতে হবে। ইজ্জতও গেল, পেটও ভরলো না। কিন্তু উপায় নেই, হাতের তীর ছুটে যাওয়ার পর তূণবদ্ধ করার উপায় নেই, ওপক্ষের চাহিদামত মিটিং হলো। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখা-সাক্ষাতের ব্যাপারটা পরকীয়া বিবেচনায় চেপে যেতে চাইলেও বেরসিক রিচার্ড হলব্রুক সংবাদ মাধ্যমের কাছে সবকিছু ফাঁস করে দিলেন। এটা কি কোনো বন্ধুর কাজ হলো, চেপে গেলে এমন কী ক্ষতি হতো? কই ক’দিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিবের রিসিপশনে বারাক ওবামা-শেখ হাসিনা মোলাকাতের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসন তো টুঁ শব্দটি করল না। বাধ্য হয়ে বিটিভিকে দুটো দিন ধরে ওই এক গল্প প্রচার করতে হলো।
আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর বাংলাদেশী প্রস্তাব মিডিয়ায় প্রচার হওয়া মাত্র স্বদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে লাগল। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আমাদের সেনাবাহিনীও অনভিজ্ঞ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই হঠকারিতার সঙ্গে একমত পোষণ করেনি। এমতাবস্থায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মিজ দীপু মনির সৈন্য প্রেরণের প্রস্তাবের বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। মার্কিন প্রশাসনকে সরাসরি মিথ্যাবাদী বানানোর এই অকূটনৈতিকসুলভ চেষ্টার প্রতিবাদে মার্কিনিরা কী করবে, সেটা দুই পরম বন্ধুর মধ্যকার নিজস্ব ব্যাপার। আমি আদার ব্যাপারি, জাহাজের খবরে কাম কী? তবে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে আমার দুই খান প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্ন, মার্কিন প্রশাসনে এত কিসিমের কর্মকর্তা থাকতে আপনি বারাক ওবামার পাকিস্তান ও আফগানিস্তানবিষয়ক বিশেষ দূতের সঙ্গে বৈঠক করলেন বাংলাদেশের কোন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় আলোচনার জন্য? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই মিটিংয়ের উদ্যোক্তার ভূমিকায় কে ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না বাংলাদেশ? এই দুটো প্রশ্নের সত্য জবাব পেলে বাদবাকি বিষয় বুঝতে এ দেশের বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের আর কোনো অসুবিধা হবে না। খবরের কাগজে আজও দেখলাম, দীপু মনির বিদেশ সফর এখনও সমাপ্ত হয়নি। আশা করে আছি, তার ফেরার পর কোনো সাহসী সাংবাদিক হয়তো ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই প্রশ্ন দুটো করে বসবেন।
এদিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগবিষয়ক জটিলতা ক্রমেই বাড়ছে। আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক পত্রিকা জনকণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী একজন জুনিয়রকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রতিবাদে দুই সিনিয়র বিচারপতি আবদুল মতিন এবং শাহ মো. নাঈমুর রহমান অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছুটিতে গেছেন। প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকও এই ক’দিনের মধ্যেই নানান বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করে নিজেকে আরও বিতর্কিত করে ফেলেছেন। শপথ গ্রহণ করেই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সুরে সুর মিলিয়ে সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দায়ে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে বিচারাঙ্গনের দীর্ঘদিনের প্রথা ভঙ্গ করে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় প্রসঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করে নিজের দলীয় রাজনৈতিক অবস্থানটিকে দেশবাসীর কাছে অধিকতর পরিষ্কার করে তুলেছেন। হাইকোর্টের বিচারক থাকাকালীন বর্তমান প্রধান বিচারপতিই মুন সিনেমা হলের মালিকানা সংক্রান্ত মামলাকে সূত্র করে ২০০৫ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছিলেন। সমালোচকরা বলে থাকেন, রায় দেয়ার পর দীর্ঘ সাত মাস পূর্ণাঙ্গ রায় লেখায় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করেছিলেন, যাতে তত্কালীন বিএনপি সরকার হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে শুনানিতে নিয়ে বাতিল করার সুযোগ না পায়। বিচারপতিগণ বিতর্ক এড়িয়ে চলার জন্য সচরাচর নিজের রায় নিয়ে মন্তব্য করেন না।
প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের আলোকে নতুন করে সংবিধান ছাপানোর তাগিদ দিয়ে একদিকে যেমন তার অতি উত্সাহ প্রমাণ করেছেন, অন্যদিকে প্রধান বিচারপতিসুলভ গাম্ভীর্য রক্ষাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। জেনারেল মইনের সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ শাসনামল থেকেই বিচার বিভাগের অবক্ষয় নিয়ে আমি যে উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছি, তারই যথার্থতা প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে। আমার আগাম মন্তব্য-প্রতিবেদন সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় সন্তোষ লাভ করা উচিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ ভেঙে পড়ার বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরে আমার বরং বিষাদের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে ক্রমেই একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে বর্তমান সরকার যে বদ্ধপরিকর, এই সত্য দেশের জনগণ বিলম্বে হলেও উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিত্বের মধ্যে বসবাস করেও জনগণের সেই ভাবনার প্রতিফলন দৈনন্দিন জীবনেই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলার পর এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনি দাবি করেছেন, আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ নিয়ে নাকি তার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুকের কোনো আলোচনাই হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে সরাসরি দেশে না ফিরে ইউরোপ সফরে গেছেন। সেখানে দিন চারেক চুপচাপ থেকে অবশেষে দীপু মনি এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বোধহয় আশায় ছিলেন যে, এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সৈন্য পাঠানোর তার অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিতর্কিত প্রতিশ্রুতি দানের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আশা পূর্ণ হয়নি। বাংলাদেশের ডান ও বাম দলগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের এই অবিমৃষ্যকারিতায় অবিরত সমালোচনার ঝড় উটের মতো বালুতে মুখ গুঁজে থেকেও থামানো যায়নি। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এরই মধ্যে আশা প্রকাশ করেছেন যে, এই বিষয়ে সহসাই কার্যকর আলোচনা হবে। ভয়েস অব আমেরিকা থেকেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান বিষয়ক বিশেষ সহকারীর মধ্যকার আলোচনার বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। জনরোষের ভয়ে দীপু মনিকে বাধ্য হয়েই পিছু হটতে হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, সৈন্য প্রেরণের বিষয়ে নয়, আফগান প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষক পাঠানোর আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রশাসন যে এতটা সক্ষমতা অর্জন করেছে সে তথ্যটি জানা ছিল না। নির্বাক আমজনতা এখন কোন পক্ষের কথা বিশ্বাস করবে? রিচার্ড হলব্রুক, মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স, ভয়েস অব আমেরিকা নাকি দীপু মনির? আমি আফগান নাটকের পাণ্ডুলিপিটি একটু ভিন্নভাবে সাজানোর চেষ্টা করছি। পাঠকের কাছে আগেভাগেই স্বীকার করে নিচ্ছি এই পাণ্ডুলিপি একান্তই আমার আষাঢ়ে ভাবনার ফসল, প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে গল্পের কোনো অংশ মিলে গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয় এবং অনিচ্ছাকৃত।
বছর খানেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই দেশের প্রশাসনের কাছ থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিলেন। একপাশে বারাক ওবামা এবং অপর পাশে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনকে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজনরত শেখ হাসিনার সেই গর্বিত ছবি বিপুল সংখ্যক দেশবাসীর এখনও নিশ্চয়ই স্মরণে আছে। সেবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। এটাও বাংলাদেশের যে কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য এক বিরল সম্মান। এবারের সফর যদিও জাতিসংঘকেন্দ্রিক ছিল, তারপরও বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসন নিজেদের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের ইসলামবিরোধী মোর্চার কৌশলগত মিত্র বিবেচনা করার কারণে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে ভিন্ন মাত্রার মূল্যায়ন প্রত্যাশা করেছিল। মুশকিল হলো, বড়র পিরিতি যে বালির বাঁধ এই শাশ্বত সত্যটি সব গরিবের সর্বদা স্মরণে থাকে না। কাজেই শ’খানেক সফরসঙ্গী নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন মুল্লুকে গিয়ে দেখলেন, বারাক ওবামার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ তো দূরের কথা মার্কিন প্রশাসনের কোনো মধ্যম সারির কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ করাও এবার অন্তত দুরূহ। সরকারে পাঁচ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মেজবান রাষ্ট্রের এমনতর ঠাণ্ডা ব্যবহারে দীপু মনি, ড. গওহর রিজভীসহ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং সরকার নিযুক্ত লবিস্ট ফার্মের কর্মকর্তারা প্রমাদ গুনেছেন। রাগান্বিত প্রধানমন্ত্রীর গালাগাল হজম তো করতেই হয়েছে, সেই সঙ্গে দেশে ফেরার মুখ যে আর থাকে না। জাতিসংঘ এমডিজি পুরষ্কার পাওয়া গেলেও সেটা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে, গণতন্ত্রের মানসকন্যা নিজে যে কিছুই পেলেন না। এদিকে চরম বেয়াদব বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগেই এমডিজি পুরস্কারের কৃতিত্ব দাবি করে বসে আছে। আস্পর্ধারও একটা সীমা থাকা দরকার! সরকারের সব মণি-মাণিক্য এক হয়ে তখন আস্তিনের মধ্য থেকে ট্রাম্প কার্ড বের করতে বাধ্য হলেন। আমেরিকার ‘পরীক্ষাউত্তীর্ণ বন্ধু’ বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন মহল আফগানিস্তানে বেকায়দায় পড়া মার্কিন সেনাদের উদ্ধারের জন্য চৌকস বেঙ্গল টাইগারদের পাঠিয়ে দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব ইস্পাতকঠিন করে তুলতে চায়, এমন সংবাদ পাঠানো হলো হোয়াইট হাউসে। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিউইয়র্ক থেকে বিশেষ বিমানে উড়িয়ে হোয়াইট হাউসে নিয়ে সেখানকার সবুজ লনে বারাক ওবামার সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হবে, তাতে আর সন্দেহ কোথায়? অপেক্ষা আর শেষ হয় না। দেশে ফেরার দিনও দ্রুত এগিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত এ পক্ষকে চরম হতাশায় ডুবিয়ে সিদ্ধান্ত এলো, আগে রিচার্ড হলব্রুকের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা সমাপ্ত করতে হবে। ইজ্জতও গেল, পেটও ভরলো না। কিন্তু উপায় নেই, হাতের তীর ছুটে যাওয়ার পর তূণবদ্ধ করার উপায় নেই, ওপক্ষের চাহিদামত মিটিং হলো। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখা-সাক্ষাতের ব্যাপারটা পরকীয়া বিবেচনায় চেপে যেতে চাইলেও বেরসিক রিচার্ড হলব্রুক সংবাদ মাধ্যমের কাছে সবকিছু ফাঁস করে দিলেন। এটা কি কোনো বন্ধুর কাজ হলো, চেপে গেলে এমন কী ক্ষতি হতো? কই ক’দিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিবের রিসিপশনে বারাক ওবামা-শেখ হাসিনা মোলাকাতের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসন তো টুঁ শব্দটি করল না। বাধ্য হয়ে বিটিভিকে দুটো দিন ধরে ওই এক গল্প প্রচার করতে হলো।
আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর বাংলাদেশী প্রস্তাব মিডিয়ায় প্রচার হওয়া মাত্র স্বদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে লাগল। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, আমাদের সেনাবাহিনীও অনভিজ্ঞ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই হঠকারিতার সঙ্গে একমত পোষণ করেনি। এমতাবস্থায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মিজ দীপু মনির সৈন্য প্রেরণের প্রস্তাবের বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। মার্কিন প্রশাসনকে সরাসরি মিথ্যাবাদী বানানোর এই অকূটনৈতিকসুলভ চেষ্টার প্রতিবাদে মার্কিনিরা কী করবে, সেটা দুই পরম বন্ধুর মধ্যকার নিজস্ব ব্যাপার। আমি আদার ব্যাপারি, জাহাজের খবরে কাম কী? তবে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে আমার দুই খান প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্ন, মার্কিন প্রশাসনে এত কিসিমের কর্মকর্তা থাকতে আপনি বারাক ওবামার পাকিস্তান ও আফগানিস্তানবিষয়ক বিশেষ দূতের সঙ্গে বৈঠক করলেন বাংলাদেশের কোন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় আলোচনার জন্য? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই মিটিংয়ের উদ্যোক্তার ভূমিকায় কে ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না বাংলাদেশ? এই দুটো প্রশ্নের সত্য জবাব পেলে বাদবাকি বিষয় বুঝতে এ দেশের বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের আর কোনো অসুবিধা হবে না। খবরের কাগজে আজও দেখলাম, দীপু মনির বিদেশ সফর এখনও সমাপ্ত হয়নি। আশা করে আছি, তার ফেরার পর কোনো সাহসী সাংবাদিক হয়তো ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই প্রশ্ন দুটো করে বসবেন।
No comments