৩৫- দরিদ্র বন্দিদের অনেকেই জানে না তাদের অসহায় স্ত্রী পুত্র কন্যা আদৌ বেঁচে আছে কিনা
নিপীড়িত শ্রেণী সেই তিমিরেই
জেলে মাঝে মধ্যে একশ্রেণীর এনজিও’র লোকজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখি। এদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানি না। হয়তো বিদেশ থেকে টাকা-পয়সা অনুদান পেয়ে লোক দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ডোনারের দেশের করদাতাদের ডলার, পাউন্ড, ইউরো পেয়ে এ দেশের সুশীল(?) সমাজের পকেট স্ফীত হলেও সমাজের নিপীড়িত শ্রেণী সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে।...
জেলে মাঝে মধ্যে একশ্রেণীর এনজিও’র লোকজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখি। এদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানি না। হয়তো বিদেশ থেকে টাকা-পয়সা অনুদান পেয়ে লোক দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ডোনারের দেশের করদাতাদের ডলার, পাউন্ড, ইউরো পেয়ে এ দেশের সুশীল(?) সমাজের পকেট স্ফীত হলেও সমাজের নিপীড়িত শ্রেণী সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে।...
জেলখানার আমবন্দিদের দুঃখ-কষ্টের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। পিসি’র দুর্নীতির কথা তো বললামই। যদিও অধিকাংশ হাজতি কিংবা কয়েদির সেখান থেকে কেনাকাটা করার সামর্থ্য নেই। কালেভদ্রে বাড়ি থেকে ফলমুল কিংবা অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী এলে সেগুলোও যে ক’দিন রেখে খাবে, তারও উপায় নেই। কারারক্ষী মিঞা সাহেবরা এবং নেতা কিসিমের কয়েদিদের ভাগ দেয়ার পর সেই খাবারের সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। অবশ্য কারারক্ষীরাও দরিদ্র পরিবার থেকেই এসেছে। রোজার মাসেই সাত নম্বর সেলে এক সকালে এক কারারক্ষীর নাস্তা খাওয়ার দৃশ্যে মনটা এতটাই বিষণ্ন হলো যে, সারাদিন ধরে আর মনের ভার কাটাতে পারলাম না। নাস্তার মেন্যু হলো জেলখানার ধুলোমাখা, আধপোড়া রুটি আর দুটো কাঁচা লঙ্কা। সেই লঙ্কাও আমার লাগোয়া সেলের কয়েদির কাছ থেকে বেচারা চেয়ে নিয়েছে।
জেলে এসে এক ধরনের অক্ষম ক্রোধে আক্রান্ত হয়ে আমি নিজেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অপ্রয়োজনীয় কৃচ্ছ্রতা পালন করছি। আমার ভাঁড়ারেও সচরাচর তেমন কিছু থাকে না। সেলের চারদিকে খুঁজে-পেতে দুটো কলা পেয়ে কারারক্ষীটির হাতে দিতেই এমন লাজুক হাসি দিয়ে সে দুটো নিল যে, চোখে পানি এসে যাওয়ার জোগাড়। এরাই তো বাংলাদেশের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। খবর নিলে জানা যেত, কারারক্ষীর সামান্য বেতনের চাকরি জোটাতে দরিদ্র পরিবারের দেড়-দুই লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। সুদিনের আশায় বাবা-মা হয়তো শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে ছেলেকে চাকরি করতে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশের এই অসহায় জনগোষ্ঠীর ঘাড়ে পাড়া দিয়েই ক্ষমতাবানরা টাকার পাহাড় গড়ে চলেছে। সেই ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে জেল প্রশাসনের একশ্রেণীর হর্তা-কর্তারাও যার যার ভাগ্য ফিরিয়ে নিচ্ছে।
সত্য-মিথ্যা জানি না, ঢাকা জেলের অধিকাংশ বন্দিই বিশ্বাস করে যে এই জেলের বর্তমান শীর্ষ প্রশাসনের সঙ্গে বৃহত্তর রাজপরিবারের এক প্রভাবশালী সদস্যের বেজায় খাতির। তাদের মধ্যে মাসিক লেনদেনের যে খামটা যাতায়াত করে, সেটাও নাকি যথেষ্ট স্ফীত। ২০০৭ সালে কারেন্ট জাল পেতে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলের ঘোষণা দেয়া গুরুতর অপরাধ দমন কমিটি এবং দুদকের সব বাহাদুররা কোথায় যেসব পালালো, বিমূঢ় আমজনতার আজ সেটাই জিজ্ঞাসা। মইন-মাসুদ-মশহুদ গংদের তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক’দিনের জন্যে ঘি-মাখন খাইয়ে কাজ ফুরাতেই কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছে। ভারতকে বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশাধিকার এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় পঞ্চাশ কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণের বিনিময়ে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক পরাশক্তির কাছে ইজারা দেয়া প্রয়োজন ছিল। সেই উদ্দেশ্য সাধনে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো সেনাবাহিনী দিয়ে জাতীয়তাবাদকে খণ্ড-বিখণ্ড করে সেক্যুলারদের ক্ষমতা গ্রহণ নিশ্চিত করার দেশি-বিদেশি প্রকল্প শতভাগ সফল হয়েছে। পরের ইতিহাস দেশবাসী দেখতেই পেয়েছেন। দেশে পরিবর্তন বলতে দুর্নীতির অঙ্কে বিশালতা এসেছে এবং গণতন্ত্রের লেবাসে ১৯৭৫ সালের মতো এক পরিবারের শাসন কায়েম হয়েছে। আমার জেলের গল্পের গরু রাগে-দুঃখে গাছে চড়ার উপক্রম করেছে। মগডালে চড়ার আগে বরং সেটিকে মাটিতে নামিয়ে ফেলা যাক।
তত্ত্বগতভাবে যে কোনো কারাগারই অপরাধীর সংশোধনের স্থান হওয়া উচিত। এ ধরনের বক্তব্য সংবলিত একাধিক স্লোগান ঢাকা এবং গোপালগঞ্জ জেলের দেয়ালে উত্কীর্ণও দেখতে পেয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের জেলে যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে নিরপরাধ লোক এসে অপরাধীতে এবং ছোট অপরাধীর পেশাদার সন্ত্রাসীতে রূপান্তর ঘটারই অধিক সম্ভাবনা। এই বাস্তবতা কেবল বন্দিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, কারারক্ষীরাও একই পরিস্থিতির শিকার। যে দরিদ্র পরিবারের সন্তানটি শেষ সম্বল বিক্রয়লব্ধ অর্থ ঘুষ দিয়ে কারারক্ষীর চাকরি জোগাড় করেছে, তার প্রথম লক্ষ্য থাকে কত তাড়াতাড়ি ঘুষের টাকাটি তুলে নেয়া যায়। এখানে ক’দিন চাকরি করলেই মায়া, মমতা, মানবতা—এসব কর্পূরের মতো উধাও হয়। সরকারি যত্সামান্য বেতনে সংসারের চাহিদা মেটে না। এমতাবস্থায়, দরিদ্র সেই কারারক্ষীর সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তারই শ্রেণীভুক্ত জেলবন্দিদের দোহন করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তাই রাতে কারাগারে একটুখানি শান্তিতে ঘুমানোর জায়গা পেতে অর্থ লাগে, অসহায় আত্মীয়-স্বজন জেলগেটে দেখা করতে এলে ঘুষ দিতে হয়, এমনকি বাড়ি থেকে খাবার-দাবার এলে তার ভাগ না দিয়ে ওয়ার্ডে আনার কোনো সুযোগ থাকে না। সাধারণ বন্দিদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার যে ব্যবস্থা জেল কর্তৃপক্ষ করেছে, সেটি দেখলে সামান্য মানবতাবোধসম্পন্ন ব্যক্তির মনেও নিদারুণ আঘাত লাগা উচিত ছিল। অথচ, নির্বিকার জেল কর্মকর্তাদের চোখের সামনে দিনের পর দিন একই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। হয়তো এসব শিক্ষিত তরুণরাও জেলখানায় কিছুদিন চাকরি করলেই সব অনুভূতি মরে গিয়ে তারাও যন্ত্রের মতো হয়ে ওঠে। দেখার সেই দৃশ্য সঠিকভাবে বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত, তারপরও জেল না দেখা পাঠকদের কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছি।
জেলগেটের কাছে দোতলা একটা ইমারতের উভয় তলায় আমবন্দিদের দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট ফুট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট দেয়ালে অল্প ব্যবধানে গোটা বিশেক খোপ। এপাশে শ’খানেক বন্দি এবং কাচ ও লোহার খাঁচা দিয়ে পৃথক করা খোপের ওপারে কয়েকশ’ আত্মীয়-স্বজন। একে অপরের মুখ দেখা প্রায় অসাধ্য। প্রত্যেকেই একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করে আপনজনকে চিনে নেয়ার চেষ্টার ফলে সেখানে যে সম্মিলিত ধ্বনির সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে কে যে কার কথা শুনতে পায় সেটি তারাই জানে। একজন জননী ওপার থেকে তার বন্দি ছেলেকে যখন ডাকে, তখন এপার থেকে কয়েক ডজন ছেলে সাড়া দেয়। গ্রাম থেকে সদ্য শহরে আসা দিশেহারা মা ভিড়ের মধ্যে তার ছেলেকে একটু ভালো করে দেখার জন্যে ঠেলাঠেলি করে খোপের কাছে এগোতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কখনও পারে, কখনও বা কনুইয়ের ধাক্কায় সিমেন্টের শক্ত মেঝেতে পড়ে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সেই ভূতলশায়িনী মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে কেউ টেনে তোলার চেষ্টা করে না। উদ্বেগ সইতে না পেরে দু-চারজন ব্যাকুল বন্দি এপারে শিক বেয়ে দেয়ালের ওপরে উঠে শাখামৃগের মতো ঝুলে থেকে আপন স্ত্রী কিংবা সন্তানকে একনজর দেখার চেষ্টাটাও করে। এরই মধ্যে দু’দিকেই ধাক্কাধাক্কি, মারামারি চলছেই। এই বিচিত্র দেখার বরাদ্দ সময় সাকুল্যে কুড়ি মিনিট। প্রথম দিন এই দৃশ্য অবলোকন করে আমার অন্তত মনে হয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দিরা চিড়িয়াখানার বোবা জানোয়ারের চেয়েও অসহায়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পেশাদার রাজনীতিবিদেরই জেলখাটার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখানে বন্দি থাকা অবস্থায় প্রতিবারই তারা কারা সংস্কারের বেশুমার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মসনদে বসলেই প্রতিশ্রুতি পালন শিকেয় তুলে রেখে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন এবং নিজের আখের গোছানোর ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ কাজে। ক্ষমতার চাকচিক্য এমনই ভুলিয়ে রাখে যে, আবার পালাবদলের আশঙ্কা তাদের মনে উঁকি দেয়ারও সুযোগ পায় না। এই হতাশার মধ্যেও সম্ভবত ২০০৬ সালের মাঝামাঝি কারা সংস্কারের একটা পরিকল্পনা তত্কালীন চারদলীয় জোট সরকার হাতে নিয়েছিল। সেই পরিকল্পনার আলোকে সে সময়ের আইজি ব্রিগেডিয়ার জাকির হাসান নাকি বন্দিদের দৈনন্দিন দুঃখ-কষ্ট লাঘবের লক্ষ্যে বেশকিছু সংস্কারের কাজ সফলভাবে সম্পন্নও করেছিলেন। তার সময়ে জেলে দুর্নীতিও যথেষ্ট কমেছিল। এসব প্রশস্তি পুরনো বন্দি এবং কারারক্ষীদের কাছ থেকেই আমার শোনা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্রিগেডিয়ার জাকিরের চাকরি তো গেছেই, সেইসঙ্গে উপরি হিসেবে তার বিরুদ্ধে নানারকম হয়রানিমূলক তদন্ত চলছে। সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তার অপরাধ হচ্ছে, তিনি নাকি যথেষ্ট পরিমাণে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ নন। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে এক তরুণ কারারক্ষীর গভীর চিন্তাশীল মন্তব্যে চমকিত হয়েছি। তার কথা হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রে একজন নাগরিক ভালো কাজ করলে দলমতনির্বিশেষে তার প্রশংসা করা হয়। তিনি সেখানে কাজের স্বীকৃতি পান। অথচ আমাদের দেশে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তারা ভালো কাজেরও দল খোঁজেন কেন? এই হীন মানসিকতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কীভাবে হবে? স্বল্প শিক্ষিত অথচ সচেতন তরুণটির অর্থবহ প্রশ্নের জবাব দিতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। চিন্তাশীল পাঠক জবাব খোঁজার চেষ্টা করতে পারেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে বিপুলসংখ্যক নাগরিক কোনো অপরাধ না করেই হয় পরিস্থিতির শিকার কিংবা শত্রুপক্ষ অথবা রাষ্ট্রের বানোয়াট মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বন্দি রয়েছেন। এই শ্রেণীর মধ্যে যাদের অর্থসম্পদ কিংবা সামাজিক প্রতিপত্তি রয়েছে, পরিণতি যা-ই হোক, তারা অন্তত আইনি লড়াই চালাতে পারছেন। কিন্তু যারা দরিদ্র ও অসহায়, তাদের হেনস্তার কোনো শেষ নেই। বছরের পর বছর বিনাবিচারে জেলে পচে এরা তো মানবেতর জীবনযাপন করছেনই, সেই সঙ্গে তাদের পুরো পরিবারও ধংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। এমন বন্দির সঙ্গেও দেখা হয়েছে যে জানে না তার অসহায় স্ত্রী, পুত্র-কন্যা আদৌ বেঁচে আছে কি-না। জেলে মাঝে-মধ্যে একশ্রেণীর এনজিও’র লোকজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখি। এদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানি না। হয়তো বিদেশ থেকে টাকা-পয়সা অনুদান পেয়ে লোক-দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ডোনারের দেশের করদাতাদের ডলার, পাউন্ড, ইউরো পেয়ে এদেশের সুশীল (?) সমাজের পকেট স্ফীত হলেও সমাজের নিপীড়িত শ্রেণী সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে। ‘লিগ্যাল এইড’ নামের বিদেশি সহায়তায় এক সরকারি প্রকল্পের কথাও বিভিন্ন সময়ে শুনেছি। এরা কাদের আইনি সহায়তা দিচ্ছে, সেটাও এক আল্লাহ আলেমুল গায়েবই জানেন। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির চার দশক মহা আড়ম্বরে উদযাপিত হলেও সমাজের কোথাও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জনগণ ভারবাহী প্রাণীর মতো সব অন্যায়-অত্যাচার বলতে গেলে মুখ বুজেই সহ্য করে চলেছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা ডিজিটাল, দিনবদল, ২০২১ সালের ভিশন ইত্যাকার চটকদার স্লোগান দিয়ে ভাবছেন, তারা নিরাপদেই থাকবেন। সম্ভবত তারা ভুলে গেছেন যে, মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র এই ভূখণ্ডটি ষোল কোটি মানুষের ঘরবসতি। এই বিপুল জনগোষ্ঠী অনন্তকাল ধরে যাবতীয় বঞ্চনা সহ্য করে কেবল মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে সম্পদের পাহাড় গড়ার সুযোগ অব্যাহতভাবে দিয়ে যাবে—এটা হতে পারে না। বাংলাদেশে অবশ্যম্ভাবী গণবিস্ফোরণের জন্য আমি অন্তত প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি। সেরকমটি ঘটলে আজকের ক্ষমতাবানরা পালানোর পথ পাবেন না।
জেলে এসে এক ধরনের অক্ষম ক্রোধে আক্রান্ত হয়ে আমি নিজেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অপ্রয়োজনীয় কৃচ্ছ্রতা পালন করছি। আমার ভাঁড়ারেও সচরাচর তেমন কিছু থাকে না। সেলের চারদিকে খুঁজে-পেতে দুটো কলা পেয়ে কারারক্ষীটির হাতে দিতেই এমন লাজুক হাসি দিয়ে সে দুটো নিল যে, চোখে পানি এসে যাওয়ার জোগাড়। এরাই তো বাংলাদেশের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। খবর নিলে জানা যেত, কারারক্ষীর সামান্য বেতনের চাকরি জোটাতে দরিদ্র পরিবারের দেড়-দুই লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। সুদিনের আশায় বাবা-মা হয়তো শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে ছেলেকে চাকরি করতে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশের এই অসহায় জনগোষ্ঠীর ঘাড়ে পাড়া দিয়েই ক্ষমতাবানরা টাকার পাহাড় গড়ে চলেছে। সেই ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে জেল প্রশাসনের একশ্রেণীর হর্তা-কর্তারাও যার যার ভাগ্য ফিরিয়ে নিচ্ছে।
সত্য-মিথ্যা জানি না, ঢাকা জেলের অধিকাংশ বন্দিই বিশ্বাস করে যে এই জেলের বর্তমান শীর্ষ প্রশাসনের সঙ্গে বৃহত্তর রাজপরিবারের এক প্রভাবশালী সদস্যের বেজায় খাতির। তাদের মধ্যে মাসিক লেনদেনের যে খামটা যাতায়াত করে, সেটাও নাকি যথেষ্ট স্ফীত। ২০০৭ সালে কারেন্ট জাল পেতে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলের ঘোষণা দেয়া গুরুতর অপরাধ দমন কমিটি এবং দুদকের সব বাহাদুররা কোথায় যেসব পালালো, বিমূঢ় আমজনতার আজ সেটাই জিজ্ঞাসা। মইন-মাসুদ-মশহুদ গংদের তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক’দিনের জন্যে ঘি-মাখন খাইয়ে কাজ ফুরাতেই কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছে। ভারতকে বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশাধিকার এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় পঞ্চাশ কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণের বিনিময়ে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক পরাশক্তির কাছে ইজারা দেয়া প্রয়োজন ছিল। সেই উদ্দেশ্য সাধনে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো সেনাবাহিনী দিয়ে জাতীয়তাবাদকে খণ্ড-বিখণ্ড করে সেক্যুলারদের ক্ষমতা গ্রহণ নিশ্চিত করার দেশি-বিদেশি প্রকল্প শতভাগ সফল হয়েছে। পরের ইতিহাস দেশবাসী দেখতেই পেয়েছেন। দেশে পরিবর্তন বলতে দুর্নীতির অঙ্কে বিশালতা এসেছে এবং গণতন্ত্রের লেবাসে ১৯৭৫ সালের মতো এক পরিবারের শাসন কায়েম হয়েছে। আমার জেলের গল্পের গরু রাগে-দুঃখে গাছে চড়ার উপক্রম করেছে। মগডালে চড়ার আগে বরং সেটিকে মাটিতে নামিয়ে ফেলা যাক।
তত্ত্বগতভাবে যে কোনো কারাগারই অপরাধীর সংশোধনের স্থান হওয়া উচিত। এ ধরনের বক্তব্য সংবলিত একাধিক স্লোগান ঢাকা এবং গোপালগঞ্জ জেলের দেয়ালে উত্কীর্ণও দেখতে পেয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের জেলে যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে নিরপরাধ লোক এসে অপরাধীতে এবং ছোট অপরাধীর পেশাদার সন্ত্রাসীতে রূপান্তর ঘটারই অধিক সম্ভাবনা। এই বাস্তবতা কেবল বন্দিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, কারারক্ষীরাও একই পরিস্থিতির শিকার। যে দরিদ্র পরিবারের সন্তানটি শেষ সম্বল বিক্রয়লব্ধ অর্থ ঘুষ দিয়ে কারারক্ষীর চাকরি জোগাড় করেছে, তার প্রথম লক্ষ্য থাকে কত তাড়াতাড়ি ঘুষের টাকাটি তুলে নেয়া যায়। এখানে ক’দিন চাকরি করলেই মায়া, মমতা, মানবতা—এসব কর্পূরের মতো উধাও হয়। সরকারি যত্সামান্য বেতনে সংসারের চাহিদা মেটে না। এমতাবস্থায়, দরিদ্র সেই কারারক্ষীর সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তারই শ্রেণীভুক্ত জেলবন্দিদের দোহন করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তাই রাতে কারাগারে একটুখানি শান্তিতে ঘুমানোর জায়গা পেতে অর্থ লাগে, অসহায় আত্মীয়-স্বজন জেলগেটে দেখা করতে এলে ঘুষ দিতে হয়, এমনকি বাড়ি থেকে খাবার-দাবার এলে তার ভাগ না দিয়ে ওয়ার্ডে আনার কোনো সুযোগ থাকে না। সাধারণ বন্দিদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার যে ব্যবস্থা জেল কর্তৃপক্ষ করেছে, সেটি দেখলে সামান্য মানবতাবোধসম্পন্ন ব্যক্তির মনেও নিদারুণ আঘাত লাগা উচিত ছিল। অথচ, নির্বিকার জেল কর্মকর্তাদের চোখের সামনে দিনের পর দিন একই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। হয়তো এসব শিক্ষিত তরুণরাও জেলখানায় কিছুদিন চাকরি করলেই সব অনুভূতি মরে গিয়ে তারাও যন্ত্রের মতো হয়ে ওঠে। দেখার সেই দৃশ্য সঠিকভাবে বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত, তারপরও জেল না দেখা পাঠকদের কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছি।
জেলগেটের কাছে দোতলা একটা ইমারতের উভয় তলায় আমবন্দিদের দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট ফুট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট দেয়ালে অল্প ব্যবধানে গোটা বিশেক খোপ। এপাশে শ’খানেক বন্দি এবং কাচ ও লোহার খাঁচা দিয়ে পৃথক করা খোপের ওপারে কয়েকশ’ আত্মীয়-স্বজন। একে অপরের মুখ দেখা প্রায় অসাধ্য। প্রত্যেকেই একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করে আপনজনকে চিনে নেয়ার চেষ্টার ফলে সেখানে যে সম্মিলিত ধ্বনির সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে কে যে কার কথা শুনতে পায় সেটি তারাই জানে। একজন জননী ওপার থেকে তার বন্দি ছেলেকে যখন ডাকে, তখন এপার থেকে কয়েক ডজন ছেলে সাড়া দেয়। গ্রাম থেকে সদ্য শহরে আসা দিশেহারা মা ভিড়ের মধ্যে তার ছেলেকে একটু ভালো করে দেখার জন্যে ঠেলাঠেলি করে খোপের কাছে এগোতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কখনও পারে, কখনও বা কনুইয়ের ধাক্কায় সিমেন্টের শক্ত মেঝেতে পড়ে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সেই ভূতলশায়িনী মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে কেউ টেনে তোলার চেষ্টা করে না। উদ্বেগ সইতে না পেরে দু-চারজন ব্যাকুল বন্দি এপারে শিক বেয়ে দেয়ালের ওপরে উঠে শাখামৃগের মতো ঝুলে থেকে আপন স্ত্রী কিংবা সন্তানকে একনজর দেখার চেষ্টাটাও করে। এরই মধ্যে দু’দিকেই ধাক্কাধাক্কি, মারামারি চলছেই। এই বিচিত্র দেখার বরাদ্দ সময় সাকুল্যে কুড়ি মিনিট। প্রথম দিন এই দৃশ্য অবলোকন করে আমার অন্তত মনে হয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দিরা চিড়িয়াখানার বোবা জানোয়ারের চেয়েও অসহায়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পেশাদার রাজনীতিবিদেরই জেলখাটার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখানে বন্দি থাকা অবস্থায় প্রতিবারই তারা কারা সংস্কারের বেশুমার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মসনদে বসলেই প্রতিশ্রুতি পালন শিকেয় তুলে রেখে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন এবং নিজের আখের গোছানোর ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ কাজে। ক্ষমতার চাকচিক্য এমনই ভুলিয়ে রাখে যে, আবার পালাবদলের আশঙ্কা তাদের মনে উঁকি দেয়ারও সুযোগ পায় না। এই হতাশার মধ্যেও সম্ভবত ২০০৬ সালের মাঝামাঝি কারা সংস্কারের একটা পরিকল্পনা তত্কালীন চারদলীয় জোট সরকার হাতে নিয়েছিল। সেই পরিকল্পনার আলোকে সে সময়ের আইজি ব্রিগেডিয়ার জাকির হাসান নাকি বন্দিদের দৈনন্দিন দুঃখ-কষ্ট লাঘবের লক্ষ্যে বেশকিছু সংস্কারের কাজ সফলভাবে সম্পন্নও করেছিলেন। তার সময়ে জেলে দুর্নীতিও যথেষ্ট কমেছিল। এসব প্রশস্তি পুরনো বন্দি এবং কারারক্ষীদের কাছ থেকেই আমার শোনা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্রিগেডিয়ার জাকিরের চাকরি তো গেছেই, সেইসঙ্গে উপরি হিসেবে তার বিরুদ্ধে নানারকম হয়রানিমূলক তদন্ত চলছে। সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তার অপরাধ হচ্ছে, তিনি নাকি যথেষ্ট পরিমাণে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ নন। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে এক তরুণ কারারক্ষীর গভীর চিন্তাশীল মন্তব্যে চমকিত হয়েছি। তার কথা হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রে একজন নাগরিক ভালো কাজ করলে দলমতনির্বিশেষে তার প্রশংসা করা হয়। তিনি সেখানে কাজের স্বীকৃতি পান। অথচ আমাদের দেশে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তারা ভালো কাজেরও দল খোঁজেন কেন? এই হীন মানসিকতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কীভাবে হবে? স্বল্প শিক্ষিত অথচ সচেতন তরুণটির অর্থবহ প্রশ্নের জবাব দিতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। চিন্তাশীল পাঠক জবাব খোঁজার চেষ্টা করতে পারেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে বিপুলসংখ্যক নাগরিক কোনো অপরাধ না করেই হয় পরিস্থিতির শিকার কিংবা শত্রুপক্ষ অথবা রাষ্ট্রের বানোয়াট মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বন্দি রয়েছেন। এই শ্রেণীর মধ্যে যাদের অর্থসম্পদ কিংবা সামাজিক প্রতিপত্তি রয়েছে, পরিণতি যা-ই হোক, তারা অন্তত আইনি লড়াই চালাতে পারছেন। কিন্তু যারা দরিদ্র ও অসহায়, তাদের হেনস্তার কোনো শেষ নেই। বছরের পর বছর বিনাবিচারে জেলে পচে এরা তো মানবেতর জীবনযাপন করছেনই, সেই সঙ্গে তাদের পুরো পরিবারও ধংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। এমন বন্দির সঙ্গেও দেখা হয়েছে যে জানে না তার অসহায় স্ত্রী, পুত্র-কন্যা আদৌ বেঁচে আছে কি-না। জেলে মাঝে-মধ্যে একশ্রেণীর এনজিও’র লোকজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখি। এদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানি না। হয়তো বিদেশ থেকে টাকা-পয়সা অনুদান পেয়ে লোক-দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ডোনারের দেশের করদাতাদের ডলার, পাউন্ড, ইউরো পেয়ে এদেশের সুশীল (?) সমাজের পকেট স্ফীত হলেও সমাজের নিপীড়িত শ্রেণী সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে। ‘লিগ্যাল এইড’ নামের বিদেশি সহায়তায় এক সরকারি প্রকল্পের কথাও বিভিন্ন সময়ে শুনেছি। এরা কাদের আইনি সহায়তা দিচ্ছে, সেটাও এক আল্লাহ আলেমুল গায়েবই জানেন। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির চার দশক মহা আড়ম্বরে উদযাপিত হলেও সমাজের কোথাও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জনগণ ভারবাহী প্রাণীর মতো সব অন্যায়-অত্যাচার বলতে গেলে মুখ বুজেই সহ্য করে চলেছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা ডিজিটাল, দিনবদল, ২০২১ সালের ভিশন ইত্যাকার চটকদার স্লোগান দিয়ে ভাবছেন, তারা নিরাপদেই থাকবেন। সম্ভবত তারা ভুলে গেছেন যে, মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র এই ভূখণ্ডটি ষোল কোটি মানুষের ঘরবসতি। এই বিপুল জনগোষ্ঠী অনন্তকাল ধরে যাবতীয় বঞ্চনা সহ্য করে কেবল মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে সম্পদের পাহাড় গড়ার সুযোগ অব্যাহতভাবে দিয়ে যাবে—এটা হতে পারে না। বাংলাদেশে অবশ্যম্ভাবী গণবিস্ফোরণের জন্য আমি অন্তত প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি। সেরকমটি ঘটলে আজকের ক্ষমতাবানরা পালানোর পথ পাবেন না।
No comments