সহজিয়া কড়চা-সংসদীয় গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব by সৈয়দ আবুল মকসুদ

বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সুসংহত ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দলই একটি দেশকে শক্তিশালী সংসদীয় গণতন্ত্র দিতে পারে। আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের যে সংকট ও দুর্বলতা, তা রাজনৈতিক দলের সংকট ও দুর্বলতার ফল।


সাবলীল আদর্শ ও বলিষ্ঠ কর্মসূচিভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্রও সাবলীল ও সুন্দরভাবে চলত। রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আজ এই দুর্দশা।
অগণিত মানুষ একটি দলকে সমর্থন দিলেই বলা যাবে না যে দলটি শক্তিশালী। একটি দল শক্তিশালী হয় শক্তিশালী নেতৃত্বে। উপমহাদেশে প্রথম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জনপ্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল বহু নেতার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে। অতি উঁচু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতারা যৌথভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত। ১৯২০ থেকে তিনি কংগ্রেসের কর্ণধার হওয়ার পরও বহু বড় নেতা ছিলেন তাঁর সহকর্মী। তাঁরা গান্ধীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। তাঁদের সকলের সঙ্গে তাঁর মত ও পথের মিল ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁদের নিয়েই কাজ করেছেন। তাঁদের, বিশেষ করে, তরুণদের নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এবং কংগ্রেসকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যেন ১৫-২০ বছরের মধ্যে ইংরেজরা চলে গেলে তাঁরা দক্ষতার সঙ্গে সরকার পরিচালনা করতে পারেন।
অন্যদিকে উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর দল মুসলিম লীগের অবস্থা ছিল ভিন্ন। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন অত্যন্ত খর-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা। তিনি দলে আর কোনো নেতা বানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। বরং যখন দেখেছেন যে কেউ মাথা উঁচু করছেন, তাঁকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন। জি-হুজুরদের পছন্দ করতেন। ফলে তিনি যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন, তা চালানোর মতো যোগ্য ও দক্ষ রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। বহু যোগ্য আমলা পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু যত যোগ্যই হোন, আমলা দিয়ে গণতন্ত্র হয় না।
কংগ্রেসে ভিন্নমতের সহ-অবস্থান সম্ভব ছিল, লীগে তা ছিল না। যে জন্য সোহরাওয়ার্দীর মতো শিক্ষা-দীক্ষায় যোগ্যতর মানুষ এবং মওলানা ভাসানীর মতো সংগ্রামী নেতা লীগে থাকতে পারেননি। তাঁরা টিকতে পারেননি বলে তাঁদের অনুসারীরাও দল থেকে বেরিয়ে যান। নতুন দল গঠন করেন। সেই দলে—আওয়ামী মুসলিম লীগ বা আওয়ামী লীগে—নানা মত ও পথের মানুষ ছিলেন। ডান-বাম-মধ্যপন্থী সবই ছিলেন। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল ছিল। অন্তত স্বাধীনতার আগে।
আগের দিনে রাজনৈতিক নেতা তৈরি হতো দুভাবে। একদম তৃণমূল থেকে কাজ করতে করতে ওপরে উঠে আসতেন কেউ কেউ। মুসলিম লীগে মওলানা ভাসানী এবং ভারতীয় কংগ্রেসে কুমারস্বামী কামরাজ নাদার ওইভাবেই দলের শীর্ষে চলে যান। শুধু তাঁরা নন, সেকালের আরও অনেকে। আর একভাবে শিক্ষিত নেতৃত্ব তৈরি হতো। তাঁরা আসতেন ছাত্র-যুব সংগঠনের ভেতর দিয়ে। আওয়ামী লীগের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বহু নেতা প্রথম ছিলেন ছাত্র-যুব সংগঠনে। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ ছাত্ররাজনীতি করে এসেছেন অবিভক্ত বঙ্গে। পরবর্তীকালে ওই প্রক্রিয়াতেই রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেকে।
আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে বহু সংগ্রামী নেতার জন্ম ছাত্ররাজনীতি থেকে। ছাত্র নেতৃত্ব তৈরিতে সবচেয়ে উর্বর ছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশক দুটি। ওই ২০ বছরে ছাত্ররাজনীতির ভেতর দিয়ে যে নেতৃত্ব তৈরি হয়, তাঁরাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তাঁরা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন বহু যোগ্য ও সংগ্রামী নেতা জাতিকে উপহার দিয়েছে। এখনো দেশে যেটুকু রাজনীতি আছে, তা আমাদের সেই ষাটের দশকের ছাত্রনেতাদের কারণেই। ফুলটাইম ব্যবসায়ীদের দিয়ে পার্টটাইম রাজনীতি চলতে পারে, বহুদলীয় সংসদীয় রাজনীতি চলে না। পোশাকশিল্প, ব্যাংক, বিমা, জাহাজভাঙার ব্যবসা, আমদানি-রপ্তানি, ঠিকাদারি, ইনডেন্টিং, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, ফাটকাবাজারি, আদম ব্যবসা, রাতারাতি ধনী হওয়ার জন্য আরও কিছু আপত্তিকর ব্যবসা করার পর গণতান্ত্রিক রাজনীতি করার সময় পাওয়া যায় না—ইচ্ছা যদি থাকেও।
নব্বইয়ের পর থেকে আমরা যে চারটি সংসদ পেয়েছি, তাতে পূর্ণকালীন ও পেশাদার খাঁটি রাজনীতিকের সংখ্যা নিতান্ত কম, যে কয়েকজন আছেন, তাঁরা সেই ষাটের দশকের ছাত্রনেতারাই। বাকি সবই ব্যবসাদার। তাঁরা অকল্পনীয় বিত্তবান। যেন একেকজন বিল গেটস। এবং সে বিত্তের অধিকারী হয়েছেন তাঁরা গত তিরিশ বছরে। তার আগে তাঁদের অনেকেরই সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িও ছিল না, বাড়ি ও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট তো নয়ই। এত অল্প সময়ে এত বড় বড় শিল্পপতি হওয়া সম্ভব, তা জামশেদজি, রতনজি দাদাভাই টাটার চৌদ্দ পুরুষও ভাবতে পারতেন না। তাই যে হঠাৎ বিত্তবান হতে পেরেছেন তাঁরা—তা নষ্ট রাজনীতির কল্যাণেই। জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাজনীতি থাকলে সেটা সম্ভব হতো না।
স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে বহু নেতা ভারতে বহু নতুন দল গঠন করেছেন এবং সেসব দল সংসদীয় রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ছাড়াও ভারতের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, সর্বভারতীয় আন্না দ্রাবিড় মুনেত্রা কাঝাখাস, তেলেগু দেশম পার্টি, বিজু জনতা দল, শিরোমণি আকালি দল, তৃণমূল কংগ্রেস, জনতা দল ইউনাইটেড, জনতা দল সমতা, তামিল মানিলা কংগ্রেস, ন্যাশনাল কংগ্রেস, কেরালা কংগ্রেস, লোকতান্ত্রিক কংগ্রেস, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি, মণিপুর স্টেট কংগ্রেস পার্টি প্রভৃতি দলের। মুসলিম লীগ ও মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের মতো মুসলমানদের দলও আছে। অধিকাংশ দলই কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা শাখা-প্রশাখা। এসব দলের এবং সমাজবাদী বিভিন্ন দলের সদস্য লোকসভা ও রাজ্যসভা এবং বিধানসভাগুলোতে রয়েছেন। এর নামই বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র।
জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ সে পথে যায়নি। স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার পরে জওহরলাল নেহরু একই রকম বামভাবাপন্ন মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু তা কাগজেপত্রে। বাস্তবিক পক্ষে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা তাঁর হাতেই থাকে। তাঁর দলেরও অন্য কারও কাছে নয়। পাকিস্তানি আমলে আওয়ামী লীগ ছিল একটি গণতান্ত্রিক দল এবং তার প্রধান শেখ মুজিব ছিলেন একজন গণতান্ত্রিক নেতা। খুবই দুঃখজনক যে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি হলেন বেসামরিক একনায়ক। আইয়ুব খান ও জিয়াউর রহমান ছিলেন সামরিক একনায়ক। জেনারেল এরশাদ ছিলেন সামরিক স্বৈরশাসক। যেকোনো ধরনের একনায়ককে শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী হতে হয়। তা সামরিকই হোক বা বেসামরিকই হোক। যেমন ফিলিপিনের মার্কোস।
স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে যাঁরা বেসরকারি ছাত্রলীগ গঠন করেন এবং তার পরই যেসব সাবেক ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও যুবনেতা গঠন করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)—বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু তাঁদের স্বাগত জানাতে পারতেন। দেশের শীর্ষ নেতা হিসেবে দলের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁদের আশীর্বাদ জানাতে পারতেন। কিন্তু তাঁর সরকার বরং তাঁদের দমন করার নীতি গ্রহণ করে। জাসদের নেতা-কর্মীদের দ্বারা ভরে যায় জেলখানাগুলো। জাসদ ও অন্যান্য দলকে যদি বিনা বাধায় ১৯৭৩-এর নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হতো, তাহলে বাংলাদেশে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দরজা প্রশস্ত হতো।
‘এক নেতা এক দেশ—বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’—আওয়ামী লীগ ও তাঁর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের এই স্লোগানটি ছিল অগণতান্ত্রিক ও তাঁদের জন্যই আত্মঘাতী। বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে এই স্লোগান মেলে না। এটি গণতন্ত্রবিরোধী ও একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মন্ত্র।
বৈরী পরিবেশে যে আওয়ামী লীগ ছিল পাকিস্তানে সবচেয়ে শক্তিশালী দল, স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে গিয়ে তা অতি দ্রুত দুর্বল হতে থাকল। কারণ, দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে সংগঠন ভেতর থেকে ক্ষয় হয়ে যায়। অতিরিক্ত ক্ষমতা দলকে হীনবল করে। বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি হয়। নতুন নেতৃত্ব তৈরির পথ বন্ধ হয়ে যায়। দলীয় নেতৃত্ব কোনো চাকরি নয়, যে, তাঁকে শীর্ষ নেতা নিয়োগ দেবেন। তিনি সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। সেটাই গণতন্ত্রের রীতি।
বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসকের বিপরীতে হলো পারিবারিক শাসন ও সামরিক শাসন। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে আমরা পেয়েছি পারিবারিক গণতন্ত্রের শাসন অথবা সামরিক একনায়কী স্বৈরশাসন। প্রত্যেক সরকারপ্রধান চেয়েছেন তাঁর পারিবারিক সদস্যদের ভেতর থেকে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী তৈরি করতে। দল থেকে অন্য কেউ তাঁদের উত্তরাধিকারী হোন, তা তাঁদের কাম্য নয়। তার ফলে আমাদের গণতন্ত্র পারিবারিক শাসনে পর্যবসিত হয়েছে—বহুদলীয় গণতন্ত্র হয়ে ওঠেনি।
যদি আমাদের দেশে সুগঠিত ও গণতন্ত্রসম্মত রাজনৈতিক দল থাকত, তাহলে পরিস্থিতি হতো অন্য রকম। পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি হওয়ায় গত চার দশকে আমাদের যে সর্বনাশ হয়ে গেছে, তার জের চলবে আরও বহুকাল—এখনই যদি তরুণ নেতৃত্ব এর প্রতিবাদ না করেন। অবশ্য সরকার থেকে বিচিত্র রকমের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় আজ আর তরুণদের মধ্যে দ্রোহের আগুনটি নেই। ভিন্নমত প্রকাশ ও নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন কিছু করার শক্তি তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন তাঁদের একমাত্র পুঁজি তোষামোদ ও চাটুকারিতা। এবং তাতেই তাঁদের ভালো প্রাপ্তিযোগ ঘটে।
দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে রাষ্ট্রেও গণতন্ত্র থাকত—পরিবারতন্ত্র শেকড় গাড়তে পারত না। পঞ্চাশের শেষ এবং ষাটের দশকে আমরা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের থেকে অন্তত দশজন নেতা পেয়েছি, যাঁরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কাজী জাফর আহমদ সামরিক স্বৈরশাসকের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হবেন কেন? নির্বাচন করে সংসদীয় পদ্ধতিতে যদি প্রধানমন্ত্রী হতেন, তা হতো গৌরবের। পরিবারতন্ত্র না থাকলে, সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থাকলে, আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আবদুর রাজ্জাক এবং আরও কেউ কেউ সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। যদি তা না হতেন, তাহলে অন্তত সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হতেন। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, রাশেদ খান মেননদের পুরোপুরি রয়েছে। কিন্তু আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে আজ এই রাজনৈতিক দুঃসময়ে তাঁরা মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত পান না।
করাপশন বা অর্থনৈতিক অসাধুতা কোথায় নেই? আমেরিকায় আছে, ব্রিটেনে আছে, চীনে আছে, ভারতে আছে, জাপানে-কোরিয়ায়ও আছে। দুর্নীতি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি নয়। দুর্নীতি এক জিনিস, গণতন্ত্র আরেক জিনিস। ভারত দুর্নীতিতে ভরপুর, কিন্তু গণতন্ত্র তো আছে। শুধু নেহরু, তাঁর মেয়ে বা নাতি নন; সেখানে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, গুলজারিলাল নন্দ (অস্থায়ী), মোরারজি দেশাই, চরণ সিং, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, চন্দ্র শেখর, নরসীমা রাও, অটল বিহারি বাজপেয়ি, এস ডি দেব গৌড়া, আই কে গুজরাল ও মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র আছে বলে তাঁরা তা হতে পেরেছেন।
সামরিক স্বৈরশাসকেরা চান না দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গড়ে উঠুক এবং নেতৃত্ব তৈরি হোক। বরং যাঁরা নেতা তৈরি হয়ে গেছেন, তাঁদের ধ্বংস করতে চান। টাকা-পদ প্রভৃতি ঘুষ দিয়ে হোক বা জেলে ঢুকিয়ে হোক, তাঁদের সংগ্রামী চেতনা নষ্ট করাই তাঁদের লক্ষ্য। দেশকে রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছেন জিয়া ও এরশাদ। কিন্তু তাঁদের সময়ই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা তৈরি হন। নব্বইয়ের দশক থেকে তাঁরা দেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু পরিবারতান্ত্রিক গণতন্ত্রের কাছে তাঁরা পরাভূত হন।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আশির দশক পর্যন্ত আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। শতাব্দীর শেষ দশক থেকে সে পথ বন্ধ হয়ে যায়। বড় বড় দলের শীর্ষ নেতারা দলে আর কাউকে প্রাধান্য দিতে চান না, তাঁরা ভবিষ্যতে দলের প্রধান বা সরকারপ্রধান হিসেবে নিজের সন্তান ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারেন না। তাঁদের স্বপ্ন জাতিকে নিয়ে নয়, তাঁদের পুত্র-কন্যাদের ঘিরে। তাঁরা চান তাঁদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হোন তাঁদের সন্তানেরা, অন্য কোনো নেতা নন।
দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা না থাকা, সংগ্রামী নেতাদের কৌশলে বা স্বৈরাচারী পন্থায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা, তরুণ নেতাদের দুর্নীতি করে বিলাসবহুল জীবনযাপনে উৎসাহিত করা—প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের পথটি কণ্টকিত হয়ে গেছে। ওই কাঁটা সরানো সহজ কাজ নয়।
ছাত্রসমাজ থেকে ছাত্ররাজনীতির ভেতর দিয়ে আপাতত নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে না। কারণ, যেদিন থেকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হয়ে গেছে, সেদিন থেকে শুরু হয়েছে শিক্ষক-রাজনীতি। প্রতিটি ক্ষমতাসীন দলের একদল দালাল শিক্ষক রয়েছেন। তাঁরা নিজেদের স্বার্থে নিজ নিজ দলের শীর্ষ নেতার লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করেন। এ অবস্থায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা না পাচ্ছেন জ্ঞানচর্চার সুযোগ, না হচ্ছে তাঁদের রাজনীতিতে কোনো প্রশিক্ষণ। জাতি ও সমাজকে নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, সুনাগরিক হওয়ার সুযোগটিও থাকছে না।
একেকটি যুগ আসে বন্ধ্যা। সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে যায় মানুষের ভেতর থেকে। আজ আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে দ্রোহ তো নেই-ই, তারা কেমন নিরুত্তাপ, নির্লিপ্ত ও হতাশ। আরও বহুদিন আমাদের রাজনীতিতে নেতৃত্বের শূন্যতা থাকবে। স্বাভাবিক নেতৃত্ব বিকাশের পথ বন্ধ থাকায় পারিবারিক নেতৃত্ব তৈরির আয়োজন হবে। তাঁদের প্রথমে মেনে নেবেন দলের নেতারা, তারপর দেশের মানুষ। কারও ছেলে বা নাতিকে ধরে এনে বসানো হবে নেতৃত্বের আসনে। দলের কেউ বাধা দেবেন না নিজে বাদ পড়ার ভয়ে। সামন্ততন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রে তা-ই স্বাভাবিক। যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে তাতে দলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও সংগ্রামী যুবনেতা বড়জোর স্বপ্ন দেখতে পারেন একদিন উপমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হওয়ার। কোনো দিন দলের সভাপতি বা প্রধানমন্ত্রী তিনি হতে পারবেন না।
একজন রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হতে কোনো বাধা নেই, তা দোষেরও নয়। উকিলের ছেলেমেয়ে যদি উকিল হতে পারেন, ডাক্তারের ছেলেমেয়ে যদি ডাক্তার হতে পারেন, শিল্পপতির সন্তান যদি শিল্পপতি হতে পারেন—নেতার ছেলে নেতা হতে অসুবিধা কী? জনগণের মধ্যে কাজ করে নিজের যোগ্যতায় হতে হবে। নেতৃত্ব হাত দিয়ে গড়া যায় না। করাত ও হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে কাঠ কেটে মূর্তি বানানো যায়, নেতা বানানো যায় না। তা যদি হতো, তাহলে দুই বছরী উদ্দীনীয় প্রশাসন বড় দল ও বড় নেতা বানিয়ে শাসনকাল দীর্ঘস্থায়ী করতে পারত। তাদের সে পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়।
দলগুলোতে নেতৃত্ব তৈরি হোক বা না হোক, বাংলার মানুষের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, ইয়েমেন, তিউনিসিয়া বা মিসরের অনেক পার্থক্য। তারা ২০-৩০ বছর ধৈর্য ধরতে পারে, বাঙালি পারে না, বাংলার মানুষ আইয়ুব ও এরশাদকে ৯-১০ বছর সহ্য করেছিল। তারপর ফেলে দেয়। কোনো রকম একনায়কত্ব—তা সামরিক হোক বা বেসামরিক হোক বাংলার মানুষ বেশি দিন মেনে নেয় না। সংসদীয় রাজনীতিতে ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলারা ছড়ি ঘোরাবেন—সেটাও বাঙালি বেশি দিন মেনে নেবে না। সুতরাং এখনো বড় বড় দলের যেসব নেতা রাজনীতিতে সক্রিয়, কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও ভেবে দেখবেন জাতীয় রাজনীতির—সংসদীয় গণতন্ত্র অরাজনৈতিক ব্যক্তি ও অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের হাতে ছেড়ে দেবেন, নাকি রাজনীতিকদের অধিকারে রাখবেন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.