বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-সৌদিতে জনশক্তি রপ্তানি : স্বস্তি ও কিছু শঙ্কা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
মিসর, লিবিয়া, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের অগি্নগর্ভ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে চরম বিরূপ প্রভাব পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম এ খাতটির ভবিষ্যৎও ক্রমেই সংকটাপন্ন হতে থাকে। হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিককে বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসার উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমন এক সংকটময় মুহূর্তে সৌদি আরবে নতুন করে বাংলাদেশি শ্রমিকের চাহিদা ও নিয়োগদানের বিষয়টি আশাব্যঞ্জক। তবে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও বর্তমানে প্রশ্নমুক্ত নয়। আরব বিশ্বে যে গণজাগরণ দেখা দিয়েছে, সৌদি জনভূমিতে এর কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে। সে দেশের নিয়ন্ত্রক-পরিচালকরা এখন কিভাবে এ পরিস্থিতিতে তাঁদের দেশকে আগলে রেখে এগোবেন_এ প্রশ্নের জবাব দেবে ভবিষ্যৎ।
দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। শুধু তাই নয়, আকামা নবায়ন না করাসহ বিবিধ কারণে অনেককে দেশে ফেরত আসতে হয়, আবার কেউ কেউ বক্রপথে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে জটিলতারও সৃষ্টি করেন। এখনো সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এর বাইরে আরো থেকে যেতে পারে_এ ভাবনাও অমূলক নয়। আমাদের অন্যতম প্রধান ও বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদিতে বিদ্যমান। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সৌদিতে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে সেখানে আমাদের শ্রমবাজার বিস্তৃত করার প্রয়াস চালান এবং ধারণা করা যায়, এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে বরফ গলতে শুরু করেছে। এরপর বাংলাদেশ সফরে এসেছিল সৌদি জনশক্তি আমদানিকারক সংস্থার কয়েকটি প্রতিনিধিদল। ৫ এপ্রিল ২০১১ ঢাকাস্থ বায়রা কার্যালয়ে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সমঝোতা স্মারক। এর আওতায় গৃহকর্মী, বাগানকর্মী, ড্রাইভার, নিরাপত্তাকর্মী ক্যাটাগরিতে প্রতি মাসে দেশটি ১০ হাজার করে নারীসহ বাংলাদেশি শ্রমিক নিতে সম্মত হয়েছে। পরে অন্য পেশার লোকজনও নেবে_এ প্রতিশ্রুতিও মিলেছে তাদের তরফে। নির্বাচিত শ্রমিক, এজেন্ট ও সরকারকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না; থাকা-খাওয়া, যাতায়াতসহ প্রায় যাবতীয় ব্যয় বহন করবে নিয়োগকর্তা ও সৌদি কর্তৃপক্ষ। বলা হচ্ছে, বেতন কাঠামোও আশাব্যঞ্জক। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশি যেসব শ্রমিক সেখানে অবস্থান করছেন তাঁদের ভিন্নমত রয়েছে। গত ৭ এপ্রিল একটি দৈনিকের অনলাইন মতামত বিভাগে সৌদি আরবে অবস্থানরত কয়েকজন শ্রমিকের অভিমত প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের মন্তব্যগুলো সুখকর নয়। নারী শ্রমিকদের ব্যাপারে তাঁরা কিছু সতর্কবার্তাও দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, সৌদি আরবে, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশ কোনো নারী শ্রমিক পাঠাতে চায় না। কারণ নিয়োগকর্তাদের আচার-আচরণ ভালো নয়। নানামুখী নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারী শ্রমিকদের। অন্য কোনো দেশ থেকে নারী শ্রমিক আনতে না পেরে তারা বাংলাদেশের প্রতি হাত বাড়িয়েছে। আমরা মনে করি, তাদের এ অভিযোগ খতিয়ে দেখে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের সরকারের এ ব্যাপারে আলোচনা করা উচিত। নিরাপত্তাদানের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখতেই হবে। জনশক্তি রপ্তানি আমাদের খুব প্রয়োজন, কিন্তু অবশ্যই এর আগে সার্বিক পরিস্থিতি যাচাই-বাছাই করা দরকার।
তা ছাড়া প্রশ্ন হচ্ছে, এ প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছভাবে চলবে? আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অতীতে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ বহুবার এসেছে এবং এর মধ্য দিয়ে আমাদের বহু শ্রমিক বিদেশেও গেছেন। কিন্তু আমাদের জনশক্তি রপ্তানি খাতের কিছু অসাধু ব্যক্তির অপকর্মের কারণে অনেক ক্ষেত্রে সেসব আয়োজন ভেস্তেও গেছে। এবার সৌদি আরবের নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ যেহেতু সুযোগের দরজাটা একটু বেশি প্রশস্ত করে দিয়েছে, সেহেতু সুযোগসন্ধানীরা এ থেকে বক্রপথে ফায়দা নিতে চেষ্টা করবে। এ জন্য চাই কঠোর নজরদারি। এত কর্মী নিয়োগ হবে দেশের নানা প্রান্ত থেকে এবং সংখ্যাটি বড় হওয়ায় প্রতারক চক্র অধিক তৎপর হবে_অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এটুকু আগামই বলে দেওয়া যায়। দক্ষতার বিষয়টিও সামনে থাকবে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্মীরা যাতে দক্ষ হন এবং সে দেশের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকে_এও বলে দেওয়া হয়েছে সৌদি পক্ষ থেকে। যতদূর জানি, ইতিমধ্যে একদল কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। কাজেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে এসব ব্যাপারেই অধিকতর সজাগ থাকা ভিন্ন গত্যন্তর নেই। চুক্তি মোতাবেক যোগ্য কর্মী না পাঠানো হলে কী ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতির ছায়া কতটা গাঢ় হয় কিংবা কী ঘটে তা আমাদের নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সবারই জানা আছে।
সৌদি আরবে ভবিষ্যতে স্থিতিশীলতা কতটা বজায় থাকবে_এ প্রশ্নের সদুত্তর এখনই মিলবে না। আরব বিশ্বে গণজাগরণের ঢেউ এখনো বিদ্যমান। আরব বিশ্বের মানুষ আধুনিক বিশ্বের অধিবাসীদের মতো সব রকম অধিকার ভোগ করতে এখন অনেক সচেতন। বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারের বিষয়েও তারা এখন অনেক বেশি সজাগ। যদি সৌদি আরবে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে তাহলে আগামী এক দশকের মধ্যে সে দেশের সরকার ব্যাপক উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে, সে ধরনের পরিকল্পনা-চিত্র পাওয়া গেছে। সৌদি আরব আগামী ১০ বছরের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। প্রায় অর্ধশত ইউরো ফাইটার টাইফুন জেট বিমান নিজ দেশে সংযোজন করার জন্য একটি অ্যারোমেটিক শিল্প তারা গড়ে তুলবে। জেদ্দায় নির্মিত হচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ টাওয়ার। মদিনা নগরীকে ঢেলে সাজাতে রয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। আরো অন্য শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে। কাজেই উত্তরোত্তর সেখানে দক্ষ-আধাদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়বেই। সরকার বিদেশে আমাদের শ্রমবাজার বিস্তৃত করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কম চেষ্টা করেনি এবং নানা ধরনের প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত রেখেছে। এর পরও অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। তবে এ ক্ষেত্রে সব দায়দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়। জনশক্তি রপ্তানিকারকদেরও দায়দায়িত্ব আছে এবং বিশেষ করে জনশক্তি রপ্তানি খাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে আমাদের সুনাম যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে, তাই সর্বাগ্রে দরকার এর পুনরুদ্ধার।
অবশ্যই অতীব গুরুত্বের সঙ্গে শ্রমিক নির্বাচন, প্রশিক্ষণ, প্রেরণ নিয়ে যাতে কোনো রকম তুঘলকি কাণ্ড না ঘটে সে জন্য শ্রম ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে হবে। অতীতের প্রেক্ষাপট মনে রেখেই এগোনো দরকার। সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছেও বিশেষভাবে আমাদের শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি ঊধর্ে্ব তুলে ধরতে হবে। বিদেশে কর্মরতদের অভিমত সম্পর্কে আগেই লিখেছি। বিদেশে শ্রমিকদের বঞ্চনা ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি কখনো কখনো উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে জোর দিতে হবে, যাতে দ্রুত দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়। আধুনিক বিশ্বে দক্ষ জনশক্তি ভিন্ন প্রবেশের অবকাশ ক্রমেই সংকুুচিত হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষার দিকটি যদি পুষ্ট করা যায় তাহলে এ ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়া খুবই স্বাভাবিক। আমাদের চিকিৎসক ও সেবিকাদের বাইরে যথেষ্ট কদর আছে। পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারলে নতুন নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ অনেকটাই সহজ হবে। আবারও বলতে হয়, দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির অসাধুতা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মীর দুর্নীতি এবং সার্বিক অদক্ষতার খেসারত ইতিমধ্যে আমরা কম দিইনি। অনেক দেশে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমাদের শ্রমবাজারের দরজায় খিল পড়েছে, যা এখনো উন্মুক্ত হয়নি। ব্যক্তি বা মহলবিশেষের অশুভ তৎপরতার দায় বহন করতে হচ্ছে দেশ ও জাতিকে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এ অবস্থায় যাতে আর কোনো অপ্রীতিকর কিংবা অশুভ তৎপরতা না চলতে পারে তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের এবং বায়রারও। স্বাধীনতার পর নানা দিকে আমাদের সুযোগ কম আসেনি; কিন্তু সব ভণ্ডুল করে দিতে সব সময় তৎপর থাকে একদল কালো বিড়াল, যাদের চিহ্নিত করা কোনো দুরূহ বিষয় নয়। কিন্তু এ কাজটি যথাযথভাবে করা যায়নি বলেই আমাদের অনেক সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে।
বিদেশের দূতাবাসগুলোয় কর্মরত আমাদের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কারো কারো ভূমিকা নেতিবাচকভাবে বহুবার আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এসব বিষয়েও প্রতিকারমূলক দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে নেই বললেই চলে। দূতাবাসে যাঁরা কর্মরত তাঁরা দেশ-জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁরা যদি যথাযথভাবে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ না হন এবং দেশের অবস্থান সর্বত্র দৃঢ় করার প্রয়াস চালাতে ব্যর্থ হন, তাহলে দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর অর্থে তাঁদের প্রতিপালন করে কী লাভ? বিভিন্ন দেশে আমাদের শ্রমবাজার ধরে রাখতে কিংবা নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে তাঁদের দক্ষতার দৃষ্টান্ত তেমন কিছু আছে কি? এ প্রশ্নের জবাবও সুখকর নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানকেই যদি সব ব্যাপারে কথা বলতে হয়, সব দিকে দৌড়াতে হয়, তাহলে অন্যদের আর দরকার কী? এত প্রতিকূলতার মধ্যেও সৌদি থেকে যে সুবার্তা এসেছে তা যেন কোনো কারণে বিনষ্ট না হয়, সার্বক্ষণিক সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি আমাদের শ্রমিকদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। শুধু তাই নয়, আকামা নবায়ন না করাসহ বিবিধ কারণে অনেককে দেশে ফেরত আসতে হয়, আবার কেউ কেউ বক্রপথে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে জটিলতারও সৃষ্টি করেন। এখনো সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এর বাইরে আরো থেকে যেতে পারে_এ ভাবনাও অমূলক নয়। আমাদের অন্যতম প্রধান ও বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদিতে বিদ্যমান। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সৌদিতে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে সেখানে আমাদের শ্রমবাজার বিস্তৃত করার প্রয়াস চালান এবং ধারণা করা যায়, এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে বরফ গলতে শুরু করেছে। এরপর বাংলাদেশ সফরে এসেছিল সৌদি জনশক্তি আমদানিকারক সংস্থার কয়েকটি প্রতিনিধিদল। ৫ এপ্রিল ২০১১ ঢাকাস্থ বায়রা কার্যালয়ে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সমঝোতা স্মারক। এর আওতায় গৃহকর্মী, বাগানকর্মী, ড্রাইভার, নিরাপত্তাকর্মী ক্যাটাগরিতে প্রতি মাসে দেশটি ১০ হাজার করে নারীসহ বাংলাদেশি শ্রমিক নিতে সম্মত হয়েছে। পরে অন্য পেশার লোকজনও নেবে_এ প্রতিশ্রুতিও মিলেছে তাদের তরফে। নির্বাচিত শ্রমিক, এজেন্ট ও সরকারকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না; থাকা-খাওয়া, যাতায়াতসহ প্রায় যাবতীয় ব্যয় বহন করবে নিয়োগকর্তা ও সৌদি কর্তৃপক্ষ। বলা হচ্ছে, বেতন কাঠামোও আশাব্যঞ্জক। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশি যেসব শ্রমিক সেখানে অবস্থান করছেন তাঁদের ভিন্নমত রয়েছে। গত ৭ এপ্রিল একটি দৈনিকের অনলাইন মতামত বিভাগে সৌদি আরবে অবস্থানরত কয়েকজন শ্রমিকের অভিমত প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের মন্তব্যগুলো সুখকর নয়। নারী শ্রমিকদের ব্যাপারে তাঁরা কিছু সতর্কবার্তাও দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, সৌদি আরবে, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশ কোনো নারী শ্রমিক পাঠাতে চায় না। কারণ নিয়োগকর্তাদের আচার-আচরণ ভালো নয়। নানামুখী নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারী শ্রমিকদের। অন্য কোনো দেশ থেকে নারী শ্রমিক আনতে না পেরে তারা বাংলাদেশের প্রতি হাত বাড়িয়েছে। আমরা মনে করি, তাদের এ অভিযোগ খতিয়ে দেখে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের সরকারের এ ব্যাপারে আলোচনা করা উচিত। নিরাপত্তাদানের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখতেই হবে। জনশক্তি রপ্তানি আমাদের খুব প্রয়োজন, কিন্তু অবশ্যই এর আগে সার্বিক পরিস্থিতি যাচাই-বাছাই করা দরকার।
তা ছাড়া প্রশ্ন হচ্ছে, এ প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছভাবে চলবে? আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অতীতে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ বহুবার এসেছে এবং এর মধ্য দিয়ে আমাদের বহু শ্রমিক বিদেশেও গেছেন। কিন্তু আমাদের জনশক্তি রপ্তানি খাতের কিছু অসাধু ব্যক্তির অপকর্মের কারণে অনেক ক্ষেত্রে সেসব আয়োজন ভেস্তেও গেছে। এবার সৌদি আরবের নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ যেহেতু সুযোগের দরজাটা একটু বেশি প্রশস্ত করে দিয়েছে, সেহেতু সুযোগসন্ধানীরা এ থেকে বক্রপথে ফায়দা নিতে চেষ্টা করবে। এ জন্য চাই কঠোর নজরদারি। এত কর্মী নিয়োগ হবে দেশের নানা প্রান্ত থেকে এবং সংখ্যাটি বড় হওয়ায় প্রতারক চক্র অধিক তৎপর হবে_অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এটুকু আগামই বলে দেওয়া যায়। দক্ষতার বিষয়টিও সামনে থাকবে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্মীরা যাতে দক্ষ হন এবং সে দেশের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকে_এও বলে দেওয়া হয়েছে সৌদি পক্ষ থেকে। যতদূর জানি, ইতিমধ্যে একদল কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। কাজেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে এসব ব্যাপারেই অধিকতর সজাগ থাকা ভিন্ন গত্যন্তর নেই। চুক্তি মোতাবেক যোগ্য কর্মী না পাঠানো হলে কী ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতির ছায়া কতটা গাঢ় হয় কিংবা কী ঘটে তা আমাদের নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সবারই জানা আছে।
সৌদি আরবে ভবিষ্যতে স্থিতিশীলতা কতটা বজায় থাকবে_এ প্রশ্নের সদুত্তর এখনই মিলবে না। আরব বিশ্বে গণজাগরণের ঢেউ এখনো বিদ্যমান। আরব বিশ্বের মানুষ আধুনিক বিশ্বের অধিবাসীদের মতো সব রকম অধিকার ভোগ করতে এখন অনেক সচেতন। বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারের বিষয়েও তারা এখন অনেক বেশি সজাগ। যদি সৌদি আরবে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে তাহলে আগামী এক দশকের মধ্যে সে দেশের সরকার ব্যাপক উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে, সে ধরনের পরিকল্পনা-চিত্র পাওয়া গেছে। সৌদি আরব আগামী ১০ বছরের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। প্রায় অর্ধশত ইউরো ফাইটার টাইফুন জেট বিমান নিজ দেশে সংযোজন করার জন্য একটি অ্যারোমেটিক শিল্প তারা গড়ে তুলবে। জেদ্দায় নির্মিত হচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ টাওয়ার। মদিনা নগরীকে ঢেলে সাজাতে রয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। আরো অন্য শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে। কাজেই উত্তরোত্তর সেখানে দক্ষ-আধাদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়বেই। সরকার বিদেশে আমাদের শ্রমবাজার বিস্তৃত করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কম চেষ্টা করেনি এবং নানা ধরনের প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত রেখেছে। এর পরও অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। তবে এ ক্ষেত্রে সব দায়দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়। জনশক্তি রপ্তানিকারকদেরও দায়দায়িত্ব আছে এবং বিশেষ করে জনশক্তি রপ্তানি খাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে আমাদের সুনাম যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে, তাই সর্বাগ্রে দরকার এর পুনরুদ্ধার।
অবশ্যই অতীব গুরুত্বের সঙ্গে শ্রমিক নির্বাচন, প্রশিক্ষণ, প্রেরণ নিয়ে যাতে কোনো রকম তুঘলকি কাণ্ড না ঘটে সে জন্য শ্রম ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে হবে। অতীতের প্রেক্ষাপট মনে রেখেই এগোনো দরকার। সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছেও বিশেষভাবে আমাদের শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি ঊধর্ে্ব তুলে ধরতে হবে। বিদেশে কর্মরতদের অভিমত সম্পর্কে আগেই লিখেছি। বিদেশে শ্রমিকদের বঞ্চনা ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি কখনো কখনো উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে জোর দিতে হবে, যাতে দ্রুত দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়। আধুনিক বিশ্বে দক্ষ জনশক্তি ভিন্ন প্রবেশের অবকাশ ক্রমেই সংকুুচিত হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষার দিকটি যদি পুষ্ট করা যায় তাহলে এ ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়া খুবই স্বাভাবিক। আমাদের চিকিৎসক ও সেবিকাদের বাইরে যথেষ্ট কদর আছে। পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারলে নতুন নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ অনেকটাই সহজ হবে। আবারও বলতে হয়, দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির অসাধুতা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মীর দুর্নীতি এবং সার্বিক অদক্ষতার খেসারত ইতিমধ্যে আমরা কম দিইনি। অনেক দেশে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমাদের শ্রমবাজারের দরজায় খিল পড়েছে, যা এখনো উন্মুক্ত হয়নি। ব্যক্তি বা মহলবিশেষের অশুভ তৎপরতার দায় বহন করতে হচ্ছে দেশ ও জাতিকে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এ অবস্থায় যাতে আর কোনো অপ্রীতিকর কিংবা অশুভ তৎপরতা না চলতে পারে তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের এবং বায়রারও। স্বাধীনতার পর নানা দিকে আমাদের সুযোগ কম আসেনি; কিন্তু সব ভণ্ডুল করে দিতে সব সময় তৎপর থাকে একদল কালো বিড়াল, যাদের চিহ্নিত করা কোনো দুরূহ বিষয় নয়। কিন্তু এ কাজটি যথাযথভাবে করা যায়নি বলেই আমাদের অনেক সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে।
বিদেশের দূতাবাসগুলোয় কর্মরত আমাদের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কারো কারো ভূমিকা নেতিবাচকভাবে বহুবার আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এসব বিষয়েও প্রতিকারমূলক দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে নেই বললেই চলে। দূতাবাসে যাঁরা কর্মরত তাঁরা দেশ-জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁরা যদি যথাযথভাবে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ না হন এবং দেশের অবস্থান সর্বত্র দৃঢ় করার প্রয়াস চালাতে ব্যর্থ হন, তাহলে দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর অর্থে তাঁদের প্রতিপালন করে কী লাভ? বিভিন্ন দেশে আমাদের শ্রমবাজার ধরে রাখতে কিংবা নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে তাঁদের দক্ষতার দৃষ্টান্ত তেমন কিছু আছে কি? এ প্রশ্নের জবাবও সুখকর নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানকেই যদি সব ব্যাপারে কথা বলতে হয়, সব দিকে দৌড়াতে হয়, তাহলে অন্যদের আর দরকার কী? এত প্রতিকূলতার মধ্যেও সৌদি থেকে যে সুবার্তা এসেছে তা যেন কোনো কারণে বিনষ্ট না হয়, সার্বক্ষণিক সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি আমাদের শ্রমিকদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments