সরল গরল-সুপ্রিম কোর্টে ‘ঘুষ’, টিআইবি ও মাহমুদুল ইসলাম by মিজানুর রহমান খান
টিআইবির ধারণাসূচক দুর্নীতি-সম্পর্কিত প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্ট কমিটি দ্বারা প্রত্যাখ্যানে অবাক হইনি। আমরা ভুলিনি, আমাদের দেশটি একাদিক্রমে পাঁচ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। তখনো এই সুপ্রিম কোর্ট উদাস থেকেছেন। আমরা ব্যথিত যে বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে তর্ক হলে, ঢালাও অভিযোগ হলে ন্যায়পরায়ণ বিচারক ও বিচার প্রশাসনের
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিব্রত বোধ করেন। কিন্তু আমরা কী করে ভুলি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকেছে কুম্ভকর্ণ হয়ে। ‘মহাপ্রলয়’, ‘কাচের ঘর’, ‘তোলা আদায়’ কত কথা বলা হলো। কিন্তু কাজের কাজ হয় না। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট কমিটি এবার বললেন, সুপ্রিম কোর্ট এ সমাজসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এতদিন বাদে এতটুকু ইঙ্গিত যথেষ্ট নয়। তবে এ রকম জরিপের ভিত্তিতে বিচার বিভাগকে ‘সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত’ আখ্যা দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমরা সমর্থন করি। আর প্রতিবেদনের সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য দিক হলো, যে সমাজে ‘অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত’ সেখানে ‘শুধুমাত্র বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রহণ ফলপ্রসূ নাও হতে পারে’ মর্মে মন্তব্য করা। আমরা এখানে বিচার বিভাগীয় সার্বভৌম ক্ষমতার অতিশয় জরুরি প্রয়োগ দেখতে চাই।
টিআইবির প্রতিবেদন অবশ্যই নিরেট তথ্যনির্ভর নয়। এমনকি তা বিশুদ্ধ বিজ্ঞানসম্মত নাও হতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্তরা কে কী করেছেন, তার জবাবদিহি অবশ্যই পেতে হবে। সাধারণ জ্ঞান এটা বলে না যে কোন বিচারক কার কাছ থেকে কয় টাকা ঘুষ নিয়েছেন, সে তথ্য কেউ সহজে প্রকাশ করবেন। অতঃপর দায়িত্বপ্রাপ্তরা টুপ করে ক্রিকেটীয় মৌতাতে ক্যাচ ধরবেন।
ওই কমিটির কাছে দুর্নীতি বা করাপশন যেন টাকা-পয়সাসর্বস্ব একটা বিষয়। মার্কিন পণ্ডিত হেনরি ক্যাম্পবেল ব্লাকের অভিধানে লেখা, দুর্নীতি মানে ক্ষমতার অপব্যবহার। দায়িত্বের, এখতিয়ারের অপব্যবহারও দুর্নীতি। আইনের অপব্যাখ্যাও দুর্নীতি। ‘গুড ফেইথ’ ছাড়া যে যা করবেন তা-ই দুর্নীতি। আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙতে, থেঁতলাতে আমরা দেখি। এই আইন কখনো সংসদের এবং আদালতেরও তৈরি করা। মুখ বদলায়, আইনের প্রয়োগ বদলায়। মুখ চিনে খাদিম কথাটি অনেকেই জানেন। তাঁরা জানবেন, মুখ চিনে আইন নামের খাদ্যও বিলানোর যোগ্য। এসবই দুর্নীতি। অতিরঞ্জন হলেও বলব, এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার কাছে আর্থিক দুর্নীতি তুচ্ছ। আমরাও টিআইবির ধারণা জরিপের সীমাবদ্ধতা দেখি। কারণ, তারা বিচার বিভাগের দুর্নীতিকে শুধুই টাকার অঙ্কে পরিমাপ করতে প্রয়াস পেয়েছে।
২০০৭ সালে আমরা যখন ‘হাতির পাঁচ পা’ দেখছিলাম, তখন টিআই বিশ্ব করাপশন রিপোর্ট ২০০৭ প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখানো হয় হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের চেয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বিচার বিভাগ বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। ৭৭ ভাগ উত্তরদাতার মতে ভারত ও ৫৫ ভাগের মতে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত। টিআইবির সমকক্ষ হলো টিআইপি। ২০১০ সালের টিআইপির খানা জরিপে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু দুর্নীতির দায়ে হাইকোর্টের রায়ে তিরস্কৃত আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রীর মতো ওই দুটি দেশের কেউ বেপরোয়া প্রতিক্রিয়া দেখাননি। সুপ্রিম কোর্ট কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন সে কারণে আমাদের বিমূঢ় করেছে। তাঁরা লিখেছেন, ‘এতে বিচার বিভাগের মান-মর্যাদাকে দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বাংলাদেশ তথা দেশবাসীকে সারা বিশ্বের সামনে হেয় করেছে।’ ওই দুই দেশের সুপ্রিম কোর্ট কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাননি। এমনকি ওই দেশ দুটির আইনবিদেরাও আমাদের অনেকের মতো ঝাঁঝালো হননি। ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রী রাম জ্যাঠমালিনীর মন্তব্য ছিল, ‘মনে হয় না পরিস্থিতি এতটা খারাপ। সমাজের অন্যান্য অংশের তুলনায় বিচারকেরা ভালো। তবে তাঁরা ফেরেশতা নন। তাঁরা এই সমাজেরই অংশ।’ এমনকি বিজেপির সাবেক আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এ ধরনের ‘ঢালাও মন্তব্য অন্যায্য’ উল্লেখ করেও বলেন, ‘ঘর ঠিক করতে সুপ্রিম কোর্টকে পদ্ধতি বার করতে হবে।’
পাকিস্তানের পত্রপত্রিকাতেও আমরা একই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখি। ভারতের সংসদ বুঝতে পেরেছে, অভিশংসন নামের কাগুজে বাঘ কাজ দেয় না। উচ্চ আদালতের দুর্নীতি রোধে তারা সম্প্রতি জবাবদিহি বিল এনেছে। সুপ্রিম কোর্টে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা শাস্তি বা নিন্দাযোগ্য। কিন্তু সব সময় অপসারণযোগ্য নয়। পাকিস্তানের দ্রোহী প্রধান বিচারপতি ইফতিখার আহমেদ চৌধুরী বিচার বিভাগ থেকে দুর্নীতি দূর করতে জিহাদে আছেন।
অথচ টিআইবির রিপোর্ট চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ভিন্ন অবস্থান নিলেন। আমরা কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু তার ফলাফল আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় তফাত থাকল না। এমনকি রাজনীতিবিদদের টেক্কা দিয়ে দুজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা যেন লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁরা বিবৃতি দিয়ে টিআইবির কর্মকর্তাদের বিচার চেয়েছেন।
এতকাল সবাই জেনেছেন বার ও বেঞ্চ হলো হরিহর আত্মা। এক ইগলের দুই ডানা। আইনজীবীরা কোর্ট অফিসার। এখন সুপ্রিম কোর্ট কমিটি বলল, আইনজীবীরা বিচার বিভাগের অংশ নন। তাঁরা বলেছে, ‘আইনজীবী, আইনজীবীদের ক্লার্ক/মোহরার এবং দালালকে কখনোই বিচার বিভাগের অংশ বলে গণ্য করা যায় না। বিচার বিভাগ বলতে প্রথমেই বিচারক এবং তৎপর বিচারালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব কর্মচারী কাজ করে, তাদের বোঝায়।’ কর্মচারীদের অভিভাবকত্ব বিচারকেরা নানাভাবে করেন। যেমন সুপ্রিম কোর্ট কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি আপিল বিভাগের বিচারপতি এস কে সিনহা। ১৫৭০ সদস্যের এই ট্রাস্টে ঝাড়ুদার থেকে বেঞ্চ অফিসারসহ আদালতের সব স্টাফ আছেন।
আমাদের বরেণ্য আইনবিদ মাহমুদুল ইসলাম ও তাঁর যোগ্য সহকর্মী প্রবীর নিয়োগী ২০০৬ সালে প্রকাশ করেন দ্য ল অব সিভিল প্রসিডিউর। এর ভূমিকায় মাহমুদুল ইসলাম যা লিখেছেন (পৃ.২ ও ৩), তা একাই এক শ। তিনি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, আইনবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং নন্দিত অ্যামিকাস কিউরি। টিআইবির রিপোর্ট বোমা হলে তাঁর পর্যবেক্ষণ পরমাণু বোমা। তাঁর কথায়: বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের থেকে শুরু করে রায় কিংবা আদেশের জাবেদা অনুলিপি সরবরাহ করার প্রতিটি পর্যায়ে আদালতের স্টাফদের ঘুষ দিতে হয়। অল্পসংখ্যক বিচারক ডায়েরি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে দৈনন্দিন কার্যতালিকায় একটি মামলা ভুক্ত করার জন্য বেঞ্চ অফিসার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আদায় করে থাকেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একবার এক সমাবেশে বলেছিলেন, গুলশান-বারিধারায় বাড়ি কী করে হলো জবাব পাওয়া যাবে কি। আমরা জবাব পাইনি। টিআইবির কর্মকর্তাদের চা পানে ডেকেছে কমিটি। কিন্তু ঘরের কাছের লোকদের কাছে তাঁরা জানতে চায়নি। ২৩ নভেম্বর ২০০৯। বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান ও বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানি হচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চালাতে যে ঘুষ লাগে সেটা সেদিন সম্ভবত ইতিহাসে প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়েছিল। দুজন আইনজীবী আদালতকে জানান যে ‘এক শ্রেণীর বেঞ্চ অফিসার মামলা তালিকাভুক্ত করতে ঘুষ নিচ্ছেন।’ অথচ তালিকায় কোন মামলা কীভাবে থাকবে, কোন ক্রমিকে তা মুদ্রিত হবে, সেটা নিরঙ্কুশভাবে বিচারকের এখতিয়ার। ওই দিন তাঁরা নির্দিষ্টভাবে তথ্য দেন যে তাঁদের এক মক্কেলকে একটি জামিন আবেদনের দ্রুত শুনানির জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এভাবে হাটে হাঁড়ি ভাঙল। কিন্তু এর কোনো তদন্ত হতে দেখলাম না। প্রতিকার দেখলাম না। মাহমুদুল ইসলামও লিখেছেন, ‘এই বিষয়ে একবার একটা ঝগড়া হলো। একজন বেঞ্চ অফিসার এবং সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর মধ্যে মারাত্মক বিবাদ হলো। কিন্তু বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি সমস্যার দিকে তাঁর মন না দিয়ে দোষারোপ করলেন আইনজীবীকেই।’ অবশ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম উল্লিখিত দুই মাননীয় বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে গণ জামিনের একটি ঘটনার তদন্ত করিয়েছিলেন। সেই রিপোর্ট চাপা পড়ে আছে। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক দায়িত্ব নিয়ে মিনিটে মিনিটে জামিনের আদেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমরা অনুমান করি, ওই তদন্তে প্রাপ্ত ফলাফলই তাঁর উষ্মার উৎস। কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে না তুলে শুধু আক্ষেপে লাভ কী। নিম্ন আদালতে ‘তোলা আদায়ের’ বিচিত্র তথ্য আমরা জানি। কিন্তু বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা কমিটির সুপারিশমতে ‘বিচারব্যবস্থার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের স্বার্থে অতিশয় জরুরি এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো’ কে নেবেন?
মাহমুদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘যোগ্য বিচারকের সংখ্যা খুবই কম এবং তাঁদের মধ্যে খুবই অল্পসংখ্যক বিচারক আছেন, যাঁরা তাঁদের কাজের জন্য গর্ব করতে পারেন। তাঁদের চারিত্রিক অখণ্ডতা ও সততা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বিচার প্রশাসনের ওপর জনগণের যে আস্থা ছিল, তা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। একজন বিচারকের অর্জন গুরুতররূপে নিচে নেমেছে।’ এখানে স্মরণ করুন আমার আগের লেখা, বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু মামলার নিষ্পত্তির হার কমছে। এবং মনে রাখুন, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরাই বারের সদস্য। আজ যিনি বারে, কাল বেঞ্চে। শুধু শপথ নিলেই মাই লর্ড।
মাহমদুল ইসলাম লেখেন, ‘আইনের বিষয়ে বারের সদস্যরা আর কোনোভাবেই উত্তমরূপে সমৃদ্ধ নন। বিশেষ করে তাঁরা যেসব মামলা পরিচালনা করেন, সেই সংশ্লিষ্ট আইন এবং তাঁদের যুক্তিতর্কের নির্ভুলতায় ঘাটতি চলছে। আইনজীবীদের মধ্যে সততা ও নিষ্ঠা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ এই ‘সর্বনিম্ন পর্যায়ের লোকেরা’ কিংবা যারা ‘দুষ্টের দমন করেন না’ (প্রধান বিচারপতি বর্ণিত) তাঁদের জন্য বিচারক হওয়ার দরজা কিন্তু বন্ধ নেই।
হাইকোর্টের জামিনের আদেশ জেলখানায় পৌঁছাতে ঘুষ লাগবেই। দৈনন্দিন কার্যবিবরণীতে ক্রমিক ভেঙে মামলা তুলতে বেঞ্চ অফিসারকে ঘুষ দেওয়া লাগবেই। অসাধু মামলাকারীরা আদালতের স্টাফদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘুষ দেবেনই। এখন প্রশ্ন হলো, বার ও বেঞ্চের অন্তত পরোক্ষ অনুমোদন কিংবা ঔদাসীন্য ছাড়া এটা সম্ভব কি না? এর জবাবও মাহমুদুল ইসলাম দিয়েছেন ‘এই ঘটনার সবচেয়ে দুঃখভারাক্রান্ত দিক হচ্ছে, কতিপয় ক্ষেত্রে আইনজীবীরাও এ ধরনের পদক্ষেপকে (ঘুষ প্রদান) অনুমোদন দিয়ে থাকেন। তাঁরা তাঁদের মক্কেলদের ঘুষ প্রদানে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করেন। আদালতের স্টাফরা অদক্ষ এবং তাঁরা এমনই একটা ভয়ানক পদ্ধতি উদ্ভাবন করে নিয়েছেন, যাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ না দিলে বিলম্বের ঘটনা ঘটবেই। আদালতের স্টাফরা ঘুষ দাবি করতে এতটাই বেপরোয়া হয়েছেন যে তাঁদের যেটা কর্তব্য, সেটা সম্পাদনেও তাঁরা ঘুষ নিচ্ছেন এবং এমন কিছু ক্ষেত্রেও তাঁরা ঘুষ নিচ্ছেন, যা করা তাঁদের উচিত নয়।’ এখানে ‘যা করা তাঁদের উচিত নয়’, সেটা করতেও তাঁরা যে ঘুষ নিচ্ছেন, সে কথার নিহিত তাৎপর্য পাঠকেরা আশা করি অনুধাবন করবেন। ইউএনবির সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদক ফারুক কাজীর ২০০৯ সালের রিপোর্টের একটি বাক্য মনে পড়ল। একজন তরুণ আইনজীবী তাঁকে বলেন, ‘ঘুষের টাকার ভাগ অনেকেই পেয়ে থাকেন।’ পত্রপত্রিকায় এটা ছাপা হয়েছে।
বিচার বিভাগের দুর্নীতি সম্পর্কে টিআইবির প্রতিবেদনকে ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ বলে নাকচ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। আবার বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে কমিটি করা হলো। আমরা একে স্বাগত জানাই। এ কমিটি ‘দুর্নীতির কারণ’ অনুসন্ধান করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বঙ্গভবনে বিচারপতি সিনহাকে চায়ের দাওয়াত দেওয়া হয়। সেটা দেশবাসী জানল। এখন নির্বাচিত সরকারের আমলে জানল উল্টো। তিনিই হলেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে দুর্নীতির কারণ অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি। এটা সেনাশাসন ও নির্বাচিত শাসনের মৌলিক পার্থক্যের সূচক কি না। যার ভিত্তিতে সেদিন তাঁর বিষয়ে ‘অন্যায্য’ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তাঁরা তো সরকারযন্ত্রে আছেন। এর জবাবদিহি কে করবে?
বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা কমিটির প্রশ্ন, মাননীয় প্রধান বিচারপতি হতে শুরু করে আপিল বিভাগের বর্তমানে কর্মরত চারজন বিচারপতি আমরা ইনকোয়ারি কমিটির সদস্যরা এবং বাকি ৮৯ বিচারপতির কারও বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ বা হয়রানির অভিযোগ আছে কি? আমরা মনে করি, এ রকমের একটি প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া অসমীচীন, অসংগত। এর মধ্য দিয়ে কমিটি তাদের শ্রেণীগত অবস্থানের প্রতি সংবেদনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। ঘুষ ধরা-ছোঁয়া যায়, কিন্তু হয়রানি যায় না। অনেক সময় এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আবু সাফার মামলায় পুরো আপিল বিভাগ আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেটা ছিল হয়রানির একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ড. কামাল হোসেন ধরনা দিয়ে নাটকীয়ভাবে সঠিক রায় ছিনিয়ে এনেছিলেন। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি রিভিউ আবেদন করারও সুযোগ পাননি। আপিল বিভাগ বলেছিলেন, তাঁকে শাস্তিদানের কারণ শিগগিরই তাঁরা জানাবেন। কিন্তু তাঁর তো জেল খাটার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। অথচ তিনি সেই ‘কারণ’ জানতে পারছেন না। সুতরাং অনেকের কাছে এটা মনে হতেই পারে, তিনি সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন।
অথচ কমিটি ও টিআইবি টাকার ওপরে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। তাই তারা বলতে পেরেছে, ‘টিআইবির প্রতিবেদনের এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই যে উল্লিখিত ঘুষের টাকা বিচারকের হাতে পৌঁছেছে।’ বিচারকেরা কেউ ঘুষ নিলেন কি নিলেন না, তাতে ভুক্তভোগী জনগণের যায় আসে না। কারণ, জমিজিরাত বেচে হলেও তাঁদের মাহমুদুল ইসলাম বর্ণিত ঘুষের টাকা দিতেই হয়। তাঁকে সাক্ষী মানছি। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হোক। অ্যামিকাস কিউরি অর্থ আদালতের বন্ধু। সেই বন্ধুদের সহায়তা শুধু বিচারে কেন, বিচার প্রশাসন চালাতেও নিতে কোনো ক্ষতি দেখি না। মাহমুদুল ইসলামের মতো আইনবিদেরা অতি উত্তম রূপে বলতে পারবেন, খুবই ‘অল্পসংখ্যক বিচারক’ কথাটির মানে কী? বেঞ্চ অফিসাররা ঘুষ নিয়ে এমন সব কাজ করেন, ‘যা তাঁদের করা উচিত নয়’ কথাটির মানে কী। এবং তাঁরা এসব করার স্পর্ধা কোথায় পান? অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে—সে কথাটি না মানার মাশুল সুপ্রিম কোর্টে বিচার-প্রার্থীরা আর কতকাল দেবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
টিআইবির প্রতিবেদন অবশ্যই নিরেট তথ্যনির্ভর নয়। এমনকি তা বিশুদ্ধ বিজ্ঞানসম্মত নাও হতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্তরা কে কী করেছেন, তার জবাবদিহি অবশ্যই পেতে হবে। সাধারণ জ্ঞান এটা বলে না যে কোন বিচারক কার কাছ থেকে কয় টাকা ঘুষ নিয়েছেন, সে তথ্য কেউ সহজে প্রকাশ করবেন। অতঃপর দায়িত্বপ্রাপ্তরা টুপ করে ক্রিকেটীয় মৌতাতে ক্যাচ ধরবেন।
ওই কমিটির কাছে দুর্নীতি বা করাপশন যেন টাকা-পয়সাসর্বস্ব একটা বিষয়। মার্কিন পণ্ডিত হেনরি ক্যাম্পবেল ব্লাকের অভিধানে লেখা, দুর্নীতি মানে ক্ষমতার অপব্যবহার। দায়িত্বের, এখতিয়ারের অপব্যবহারও দুর্নীতি। আইনের অপব্যাখ্যাও দুর্নীতি। ‘গুড ফেইথ’ ছাড়া যে যা করবেন তা-ই দুর্নীতি। আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙতে, থেঁতলাতে আমরা দেখি। এই আইন কখনো সংসদের এবং আদালতেরও তৈরি করা। মুখ বদলায়, আইনের প্রয়োগ বদলায়। মুখ চিনে খাদিম কথাটি অনেকেই জানেন। তাঁরা জানবেন, মুখ চিনে আইন নামের খাদ্যও বিলানোর যোগ্য। এসবই দুর্নীতি। অতিরঞ্জন হলেও বলব, এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার কাছে আর্থিক দুর্নীতি তুচ্ছ। আমরাও টিআইবির ধারণা জরিপের সীমাবদ্ধতা দেখি। কারণ, তারা বিচার বিভাগের দুর্নীতিকে শুধুই টাকার অঙ্কে পরিমাপ করতে প্রয়াস পেয়েছে।
২০০৭ সালে আমরা যখন ‘হাতির পাঁচ পা’ দেখছিলাম, তখন টিআই বিশ্ব করাপশন রিপোর্ট ২০০৭ প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখানো হয় হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের চেয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বিচার বিভাগ বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। ৭৭ ভাগ উত্তরদাতার মতে ভারত ও ৫৫ ভাগের মতে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত। টিআইবির সমকক্ষ হলো টিআইপি। ২০১০ সালের টিআইপির খানা জরিপে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু দুর্নীতির দায়ে হাইকোর্টের রায়ে তিরস্কৃত আমাদের আইন প্রতিমন্ত্রীর মতো ওই দুটি দেশের কেউ বেপরোয়া প্রতিক্রিয়া দেখাননি। সুপ্রিম কোর্ট কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন সে কারণে আমাদের বিমূঢ় করেছে। তাঁরা লিখেছেন, ‘এতে বিচার বিভাগের মান-মর্যাদাকে দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বাংলাদেশ তথা দেশবাসীকে সারা বিশ্বের সামনে হেয় করেছে।’ ওই দুই দেশের সুপ্রিম কোর্ট কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাননি। এমনকি ওই দেশ দুটির আইনবিদেরাও আমাদের অনেকের মতো ঝাঁঝালো হননি। ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রী রাম জ্যাঠমালিনীর মন্তব্য ছিল, ‘মনে হয় না পরিস্থিতি এতটা খারাপ। সমাজের অন্যান্য অংশের তুলনায় বিচারকেরা ভালো। তবে তাঁরা ফেরেশতা নন। তাঁরা এই সমাজেরই অংশ।’ এমনকি বিজেপির সাবেক আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এ ধরনের ‘ঢালাও মন্তব্য অন্যায্য’ উল্লেখ করেও বলেন, ‘ঘর ঠিক করতে সুপ্রিম কোর্টকে পদ্ধতি বার করতে হবে।’
পাকিস্তানের পত্রপত্রিকাতেও আমরা একই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখি। ভারতের সংসদ বুঝতে পেরেছে, অভিশংসন নামের কাগুজে বাঘ কাজ দেয় না। উচ্চ আদালতের দুর্নীতি রোধে তারা সম্প্রতি জবাবদিহি বিল এনেছে। সুপ্রিম কোর্টে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা শাস্তি বা নিন্দাযোগ্য। কিন্তু সব সময় অপসারণযোগ্য নয়। পাকিস্তানের দ্রোহী প্রধান বিচারপতি ইফতিখার আহমেদ চৌধুরী বিচার বিভাগ থেকে দুর্নীতি দূর করতে জিহাদে আছেন।
অথচ টিআইবির রিপোর্ট চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ভিন্ন অবস্থান নিলেন। আমরা কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু তার ফলাফল আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় তফাত থাকল না। এমনকি রাজনীতিবিদদের টেক্কা দিয়ে দুজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা যেন লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁরা বিবৃতি দিয়ে টিআইবির কর্মকর্তাদের বিচার চেয়েছেন।
এতকাল সবাই জেনেছেন বার ও বেঞ্চ হলো হরিহর আত্মা। এক ইগলের দুই ডানা। আইনজীবীরা কোর্ট অফিসার। এখন সুপ্রিম কোর্ট কমিটি বলল, আইনজীবীরা বিচার বিভাগের অংশ নন। তাঁরা বলেছে, ‘আইনজীবী, আইনজীবীদের ক্লার্ক/মোহরার এবং দালালকে কখনোই বিচার বিভাগের অংশ বলে গণ্য করা যায় না। বিচার বিভাগ বলতে প্রথমেই বিচারক এবং তৎপর বিচারালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব কর্মচারী কাজ করে, তাদের বোঝায়।’ কর্মচারীদের অভিভাবকত্ব বিচারকেরা নানাভাবে করেন। যেমন সুপ্রিম কোর্ট কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি আপিল বিভাগের বিচারপতি এস কে সিনহা। ১৫৭০ সদস্যের এই ট্রাস্টে ঝাড়ুদার থেকে বেঞ্চ অফিসারসহ আদালতের সব স্টাফ আছেন।
আমাদের বরেণ্য আইনবিদ মাহমুদুল ইসলাম ও তাঁর যোগ্য সহকর্মী প্রবীর নিয়োগী ২০০৬ সালে প্রকাশ করেন দ্য ল অব সিভিল প্রসিডিউর। এর ভূমিকায় মাহমুদুল ইসলাম যা লিখেছেন (পৃ.২ ও ৩), তা একাই এক শ। তিনি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, আইনবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং নন্দিত অ্যামিকাস কিউরি। টিআইবির রিপোর্ট বোমা হলে তাঁর পর্যবেক্ষণ পরমাণু বোমা। তাঁর কথায়: বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের থেকে শুরু করে রায় কিংবা আদেশের জাবেদা অনুলিপি সরবরাহ করার প্রতিটি পর্যায়ে আদালতের স্টাফদের ঘুষ দিতে হয়। অল্পসংখ্যক বিচারক ডায়েরি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে দৈনন্দিন কার্যতালিকায় একটি মামলা ভুক্ত করার জন্য বেঞ্চ অফিসার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আদায় করে থাকেন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একবার এক সমাবেশে বলেছিলেন, গুলশান-বারিধারায় বাড়ি কী করে হলো জবাব পাওয়া যাবে কি। আমরা জবাব পাইনি। টিআইবির কর্মকর্তাদের চা পানে ডেকেছে কমিটি। কিন্তু ঘরের কাছের লোকদের কাছে তাঁরা জানতে চায়নি। ২৩ নভেম্বর ২০০৯। বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান ও বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানি হচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চালাতে যে ঘুষ লাগে সেটা সেদিন সম্ভবত ইতিহাসে প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়েছিল। দুজন আইনজীবী আদালতকে জানান যে ‘এক শ্রেণীর বেঞ্চ অফিসার মামলা তালিকাভুক্ত করতে ঘুষ নিচ্ছেন।’ অথচ তালিকায় কোন মামলা কীভাবে থাকবে, কোন ক্রমিকে তা মুদ্রিত হবে, সেটা নিরঙ্কুশভাবে বিচারকের এখতিয়ার। ওই দিন তাঁরা নির্দিষ্টভাবে তথ্য দেন যে তাঁদের এক মক্কেলকে একটি জামিন আবেদনের দ্রুত শুনানির জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এভাবে হাটে হাঁড়ি ভাঙল। কিন্তু এর কোনো তদন্ত হতে দেখলাম না। প্রতিকার দেখলাম না। মাহমুদুল ইসলামও লিখেছেন, ‘এই বিষয়ে একবার একটা ঝগড়া হলো। একজন বেঞ্চ অফিসার এবং সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর মধ্যে মারাত্মক বিবাদ হলো। কিন্তু বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি সমস্যার দিকে তাঁর মন না দিয়ে দোষারোপ করলেন আইনজীবীকেই।’ অবশ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম উল্লিখিত দুই মাননীয় বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে গণ জামিনের একটি ঘটনার তদন্ত করিয়েছিলেন। সেই রিপোর্ট চাপা পড়ে আছে। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক দায়িত্ব নিয়ে মিনিটে মিনিটে জামিনের আদেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমরা অনুমান করি, ওই তদন্তে প্রাপ্ত ফলাফলই তাঁর উষ্মার উৎস। কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে না তুলে শুধু আক্ষেপে লাভ কী। নিম্ন আদালতে ‘তোলা আদায়ের’ বিচিত্র তথ্য আমরা জানি। কিন্তু বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা কমিটির সুপারিশমতে ‘বিচারব্যবস্থার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের স্বার্থে অতিশয় জরুরি এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো’ কে নেবেন?
মাহমুদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘যোগ্য বিচারকের সংখ্যা খুবই কম এবং তাঁদের মধ্যে খুবই অল্পসংখ্যক বিচারক আছেন, যাঁরা তাঁদের কাজের জন্য গর্ব করতে পারেন। তাঁদের চারিত্রিক অখণ্ডতা ও সততা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বিচার প্রশাসনের ওপর জনগণের যে আস্থা ছিল, তা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। একজন বিচারকের অর্জন গুরুতররূপে নিচে নেমেছে।’ এখানে স্মরণ করুন আমার আগের লেখা, বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু মামলার নিষ্পত্তির হার কমছে। এবং মনে রাখুন, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরাই বারের সদস্য। আজ যিনি বারে, কাল বেঞ্চে। শুধু শপথ নিলেই মাই লর্ড।
মাহমদুল ইসলাম লেখেন, ‘আইনের বিষয়ে বারের সদস্যরা আর কোনোভাবেই উত্তমরূপে সমৃদ্ধ নন। বিশেষ করে তাঁরা যেসব মামলা পরিচালনা করেন, সেই সংশ্লিষ্ট আইন এবং তাঁদের যুক্তিতর্কের নির্ভুলতায় ঘাটতি চলছে। আইনজীবীদের মধ্যে সততা ও নিষ্ঠা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ এই ‘সর্বনিম্ন পর্যায়ের লোকেরা’ কিংবা যারা ‘দুষ্টের দমন করেন না’ (প্রধান বিচারপতি বর্ণিত) তাঁদের জন্য বিচারক হওয়ার দরজা কিন্তু বন্ধ নেই।
হাইকোর্টের জামিনের আদেশ জেলখানায় পৌঁছাতে ঘুষ লাগবেই। দৈনন্দিন কার্যবিবরণীতে ক্রমিক ভেঙে মামলা তুলতে বেঞ্চ অফিসারকে ঘুষ দেওয়া লাগবেই। অসাধু মামলাকারীরা আদালতের স্টাফদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘুষ দেবেনই। এখন প্রশ্ন হলো, বার ও বেঞ্চের অন্তত পরোক্ষ অনুমোদন কিংবা ঔদাসীন্য ছাড়া এটা সম্ভব কি না? এর জবাবও মাহমুদুল ইসলাম দিয়েছেন ‘এই ঘটনার সবচেয়ে দুঃখভারাক্রান্ত দিক হচ্ছে, কতিপয় ক্ষেত্রে আইনজীবীরাও এ ধরনের পদক্ষেপকে (ঘুষ প্রদান) অনুমোদন দিয়ে থাকেন। তাঁরা তাঁদের মক্কেলদের ঘুষ প্রদানে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করেন। আদালতের স্টাফরা অদক্ষ এবং তাঁরা এমনই একটা ভয়ানক পদ্ধতি উদ্ভাবন করে নিয়েছেন, যাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ না দিলে বিলম্বের ঘটনা ঘটবেই। আদালতের স্টাফরা ঘুষ দাবি করতে এতটাই বেপরোয়া হয়েছেন যে তাঁদের যেটা কর্তব্য, সেটা সম্পাদনেও তাঁরা ঘুষ নিচ্ছেন এবং এমন কিছু ক্ষেত্রেও তাঁরা ঘুষ নিচ্ছেন, যা করা তাঁদের উচিত নয়।’ এখানে ‘যা করা তাঁদের উচিত নয়’, সেটা করতেও তাঁরা যে ঘুষ নিচ্ছেন, সে কথার নিহিত তাৎপর্য পাঠকেরা আশা করি অনুধাবন করবেন। ইউএনবির সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদক ফারুক কাজীর ২০০৯ সালের রিপোর্টের একটি বাক্য মনে পড়ল। একজন তরুণ আইনজীবী তাঁকে বলেন, ‘ঘুষের টাকার ভাগ অনেকেই পেয়ে থাকেন।’ পত্রপত্রিকায় এটা ছাপা হয়েছে।
বিচার বিভাগের দুর্নীতি সম্পর্কে টিআইবির প্রতিবেদনকে ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ বলে নাকচ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। আবার বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে কমিটি করা হলো। আমরা একে স্বাগত জানাই। এ কমিটি ‘দুর্নীতির কারণ’ অনুসন্ধান করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বঙ্গভবনে বিচারপতি সিনহাকে চায়ের দাওয়াত দেওয়া হয়। সেটা দেশবাসী জানল। এখন নির্বাচিত সরকারের আমলে জানল উল্টো। তিনিই হলেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে দুর্নীতির কারণ অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি। এটা সেনাশাসন ও নির্বাচিত শাসনের মৌলিক পার্থক্যের সূচক কি না। যার ভিত্তিতে সেদিন তাঁর বিষয়ে ‘অন্যায্য’ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তাঁরা তো সরকারযন্ত্রে আছেন। এর জবাবদিহি কে করবে?
বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা কমিটির প্রশ্ন, মাননীয় প্রধান বিচারপতি হতে শুরু করে আপিল বিভাগের বর্তমানে কর্মরত চারজন বিচারপতি আমরা ইনকোয়ারি কমিটির সদস্যরা এবং বাকি ৮৯ বিচারপতির কারও বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ বা হয়রানির অভিযোগ আছে কি? আমরা মনে করি, এ রকমের একটি প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া অসমীচীন, অসংগত। এর মধ্য দিয়ে কমিটি তাদের শ্রেণীগত অবস্থানের প্রতি সংবেদনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। ঘুষ ধরা-ছোঁয়া যায়, কিন্তু হয়রানি যায় না। অনেক সময় এটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আবু সাফার মামলায় পুরো আপিল বিভাগ আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সেটা ছিল হয়রানির একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ড. কামাল হোসেন ধরনা দিয়ে নাটকীয়ভাবে সঠিক রায় ছিনিয়ে এনেছিলেন। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি রিভিউ আবেদন করারও সুযোগ পাননি। আপিল বিভাগ বলেছিলেন, তাঁকে শাস্তিদানের কারণ শিগগিরই তাঁরা জানাবেন। কিন্তু তাঁর তো জেল খাটার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। অথচ তিনি সেই ‘কারণ’ জানতে পারছেন না। সুতরাং অনেকের কাছে এটা মনে হতেই পারে, তিনি সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন।
অথচ কমিটি ও টিআইবি টাকার ওপরে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। তাই তারা বলতে পেরেছে, ‘টিআইবির প্রতিবেদনের এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই যে উল্লিখিত ঘুষের টাকা বিচারকের হাতে পৌঁছেছে।’ বিচারকেরা কেউ ঘুষ নিলেন কি নিলেন না, তাতে ভুক্তভোগী জনগণের যায় আসে না। কারণ, জমিজিরাত বেচে হলেও তাঁদের মাহমুদুল ইসলাম বর্ণিত ঘুষের টাকা দিতেই হয়। তাঁকে সাক্ষী মানছি। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হোক। অ্যামিকাস কিউরি অর্থ আদালতের বন্ধু। সেই বন্ধুদের সহায়তা শুধু বিচারে কেন, বিচার প্রশাসন চালাতেও নিতে কোনো ক্ষতি দেখি না। মাহমুদুল ইসলামের মতো আইনবিদেরা অতি উত্তম রূপে বলতে পারবেন, খুবই ‘অল্পসংখ্যক বিচারক’ কথাটির মানে কী? বেঞ্চ অফিসাররা ঘুষ নিয়ে এমন সব কাজ করেন, ‘যা তাঁদের করা উচিত নয়’ কথাটির মানে কী। এবং তাঁরা এসব করার স্পর্ধা কোথায় পান? অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে—সে কথাটি না মানার মাশুল সুপ্রিম কোর্টে বিচার-প্রার্থীরা আর কতকাল দেবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments