সময়ের প্রেক্ষিত-ধিক্ তোমাকে, মোবারক! by মনজুরুল হক
মানুষ মাত্রই লোভী। লোভ-লালসা আর হিংসা-বিদ্বেষ হচ্ছে আমাদের জীবনের একটি দিক, যার প্রভাব থেকে খুব কম মানুষই পেরেছে মুক্ত থাকতে। সৃষ্টির সেই সূচনালগ্ন থেকে মানুষ স্নেহ-মমতার পাশাপাশি মনের গভীরে লোভ-লালসার বীজও লালন করে চলেছে, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে যুদ্ধ আর ধ্বংস বরাবরের মতোই থেকে গেছে মানুষের নিত্যসঙ্গী।
তবে তার পরও লোভের মোহ থেকে মানুষ পায়নি মুক্তি। জীবনে যার প্রাপ্তি যত বেশি, তাকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে তত বেশি গভীর বন্ধনে। লোভের চক্রে আটকা পড়ে যাওয়া সে রকম অনেক প্রাপ্তির মানুষ একসময় বাস্তব বিচারবুদ্ধি ভুলে গিয়ে প্রাপ্তির সীমানাকে আরও বিস্তৃত করে নেওয়ার অন্ধ বাসনার সবকিছুতেই নিজস্ব মালিকানা দাবি করে অন্যের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশার প্রতি দেখিয়েছে চূড়ান্ত অবহেলা। ফলে হত্যা আর রক্তপাত ইতিহাসের সেই সূচনালগ্ন থেকেই আছে আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে।
সময়ের বিবর্তনে লোভী মানুষ অন্তত সামাজিক মুখরক্ষার খাতিরে লোভের পাগলা ঘোড়ার লাগাম কিছুটা টেনে ধরার চেষ্টা করলেও ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার সামান্যতম আশঙ্কা দেখা দেওয়ার মুখে লোভ আবারও বের হয়ে এসেছে তার কুৎসিত চেহারা নিয়ে, আর আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে ধোপদুরস্ত সাজপোশাকে সামনে উপস্থিত লোভী মানুষটির কদর্য চেহারা। মিসরের জীবনভর প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক হচ্ছেন সে রকম এক লোভী মানুষের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের প্রয়াত শিল্পী কামরুল হাসানের ভাষার অনুকরণে বলা যায়, কপালে খড়ম দিয়ে সুপারির আঘাত করে গেলেও লজ্জা-শরমের কোনো রকম বালাই যাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র দেখা দেয় না।
মিসরের এই শর্মিন্দামুক্ত পুরুষ বয়সের ভারে কিছুটা কাত হয়ে পড়লেও হাতে ধরে রাখা ক্ষমতার রজ্জুটি ছেড়ে দিতে একেবারেই নারাজ। দেশটির সাম্প্রতিক সমস্যার সূত্রপাতও বলা যায় সে রকম বাস্তবতা থেকে। ৩০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন এই প্রেসিডেন্ট সরকারি বেতনভোগী পেটোয়া বাহিনী আর হালুয়া-রুটির বিরাট অংশের হিস্যা লুটে নেওয়া সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট হয়ে গত তিন দশকে দেশের সব কটি নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাধিক্য বিজয় নিশ্চিত করে নিয়ে গণতন্ত্রের অনুকরণীয় এক ‘প্রতীক’ হিসেবে পশ্চিমের কাছে বরাবরই থেকেছেন খুবই প্রিয় মানুষ, যে সুবাদে মুফতে পাওয়া নানা রকম অস্ত্রের সরবরাহ দেশের মানুষকে ডান্ডাপেটা করে ঠান্ডা রাখার সামর্থ্য তাঁকে এনে দিলেও মানুষের ভালোবাসা থেকে তিনি থেকেছেন বঞ্চিত। তবে তার পরও সাধারণ জনতার পক্ষে জোটবদ্ধ হয়ে কিছু করা এ কারণে এত দিন ধরে সম্ভব হয়নি যে দেশজুড়ে ভিন্নমতের সামান্যতম চিহ্ন দেখা গেলে সেই অবস্থার অঙ্কুরে তা ধ্বংস করে দেওয়ার নীতি গ্রহণকারী পেটোয়া বাহিনীর কল্যাণে দেশটি মূলত হয়ে পড়েছে একেবারেই নেতৃত্বশূন্য। আর সেই অবস্থায় মোবারক ও তাঁর পরিবার হালুয়া-রুটির বড় অংশটি নিজেদের জন্য রেখে দিয়ে অবশিষ্ট অংশ কাজে লাগিয়েছে পেটোয়া আর সামরিক বাহিনী এবং জি-হুজুর মার্কা অনুসারীদের তৃপ্ত রাখার উদ্দেশ্যে।
সে রকম অবস্থায় দেশের অবশিষ্ট আমজনতার ভাগ্যে যা জুটেছে তা হলো, ক্ষমতাসীনদের চেটেপুটে সাফ করে ফেলা হালুয়া-রুটির প্লেটে লেগে থাকা সামান্যতম উচ্ছিষ্ট অংশ। তার পরও হালুয়া-রুটির ভাগ পাওয়া পেটোয়া বাহিনীর কল্যাণে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার দুয়ার শক্তভাবে সাঁটা থাকায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভয়ের দেয়াল অতিক্রম করে যাওয়া দেশবাসীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে গত প্রায় এক দশকে নীরব যে বিপ্লব বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ আর সংবাদপ্রবাহের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়ে মানুষকে একে অন্যের আরও অনেক কাছে নিয়ে এসেছে, তা কিন্তু হালুয়া-রুটি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বেড়ানো সব রকম নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে যাওয়া পশ্চিমের শাসকগোষ্ঠীর অতি আদরের ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্রদের’ চোখে ধরা পড়েনি। বিষয়টি যখন তাদের দৃষ্টিতে আসে, তত দিনে পানি অনেকটা গড়িয়ে মোহনার কাছাকাছি এসে উপস্থিত। মিসরের জনতা তাই এখন পর্যন্ত আগের মতোই নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় থেকে যাওয়া সত্ত্বেও নতুন করে সংঘবদ্ধ হয়ে ভয়ের দেয়াল তাদের পক্ষে অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব হয়েছে অনেকটা ঠিক তথ্যব্যবস্থার নবপ্রযুক্তির কল্যাণে। ঠিক এমনটাই দেখা গিয়েছিল মিসরের অল্প দূরের দেশ তিউনিসিয়ায়। সর্বশেষ নির্বাচনে পেটোয়া বাহিনীর কল্যাণে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত যে দেশটির প্রেসিডেন্টকে জনতার রুদ্ররোষের ভয়ে লুঙ্গিতে কষে কাছা বেঁধে নিয়ে রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে।
জয়নুল আবেদিন বেন আলীর তুলনায় মিসরের মোবারক বলা যায় অনেক বেশি ঘুঘু মক্কেল। বয়সের ভারে শরীর কাত হয়ে পড়লেও ক্ষমতার লোভের দাওয়াই তাঁকে এখনো যথেষ্ট পোক্ত রেখেছে এবং যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো নিজের নিয়োজিত মন্ত্রিসভার ঘাড়ে সব রকম দোষ চাপিয়ে দিয়ে মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে জনতাকে তুষ্ট করার দুষ্ট খেলায় নিজেকে তিনি এখন নিয়োজিত রেখেছেন। তবে আগুনের লেলিহান যে শিখা এখন দেশজুড়ে প্রজ্বলিত, তা দাবানলে রূপান্তরিত হওয়ার মুখে এ-জাতীয় দুষ্ট প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। মিসরের জনগণ তো মোবারকের নিজের দেওয়া মন্ত্রিসভার বরখাস্ত হওয়া চায়নি, যা তারা চেয়েছে তা হলো মোবারকের নিজের পদত্যাগ। কেননা, তারা ভালোভাবেই অবগত যে মোবারক বিদায় নিলে তাঁর নিয়োজিত মন্ত্রিসভা কর্পূরের মতোই বাতাসে মিলিয়ে যাবে, কোনো রকম কাঠখড় যার জন্য জনতাকে আর পোড়াতে হবে না।
মোবারক হয়তো ভাবছেন, মন্ত্রিসভার ওপর সব রকম ব্যর্থতার দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে এবং সেই সঙ্গে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের মতো নতুন যোগাযোগমাধ্যম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়ে নিজের আখের তিনি আবারও গুছিয়ে নিতে পারবেন। হয়তো এ রকম হিসাবও তাঁর মাথায় আছে যে এত কিছুর পরও জনতা শান্ত না হলে ছেলেকে নিজের আসনে বসিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা তিনি দেবেন। তবে তার পরও এবারের মিসর শান্ত হওয়ার নয়। মানুষ বুঝে গেছে, ভাঁওতাবাজি দিয়ে তাদের অন্ধকারে আটকে রাখা তথ্যের অবাধ প্রবাহের এই যুগে এখন আর সম্ভব নয়। ফলে বেন আলীর ভাগ্য গ্রহণ করে নেওয়ার আহ্বান মোবারকের প্রতি এখন জানানো হচ্ছে, যে ভাগ্য মিসরের জীবনভর প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করে নিলে পুরো অঞ্চলে এখন পর্যন্ত দাপটে বিরাজমান রাজা-বাদশাহ আর আমির-ওমরাহদের দিন শেষ হয়ে আসার ঘণ্টাও হয়তো আরেকটু জোরালোভাবে তা বাজিয়ে দেবে। ফলে এক ধরনের অস্থিরতা, এক ধরনের সহমর্মিতা মাত্র অল্প কিছুদিন আগের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যেও এখন লক্ষ করা যাচ্ছে, যে সূত্র ধরে ৪০ বছর লিবিয়ার মসনদে আসীন মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে বলতে শোনা যায়, বেন আলীর পতন হচ্ছে তিউনিসিয়ার জন্য বিরাট বড় এক ক্ষতি।
৩০ বছর ধরে একদলীয়-একনায়কী শাসনের হাল ধরে বসে থাকা অবস্থা অতি সাধারণ চরিত্রের অধিকারী মোবারককে একদিকে যেমন পরিণত করেছে ক্ষমতালিপ্সু এক লোভীতে, অন্যদিকে একইভাবে তাঁকে করে তুলেছে অন্যের প্রতি আস্থা রাখতে না পারা বিপর্যস্ত এক মানবসন্তানে। তিনি নিশ্চিত নন, ক্ষমতার হাল অন্য কারও হাতে তুলে দিলে বাকি জীবন তিনি ঝামেলামুক্তভাবে কাটাতে পারবেন কি না। ফলে ছেলের ওপর তাঁর নির্ভরশীলতা, যে ছেলেকে তিনি করতে চাইছেন তাঁর উত্তরসূরি।
তবে ক্ষমতার লোভ কিন্তু কখনোই বাবা-ছেলে আর বন্ধু-সুহূদের সম্পর্ককে স্বাভাবিকতার মধ্যে আটকে রাখেনি। ইতিহাস সেই দৃষ্টান্ত ক্রমাগতই আমাদের সামনে তুলে ধরছে। মাত্র কয়েক শ বছর আগে আমরা দেখেছি সম্রাট বাবাকে অন্ধ করে দিয়ে ক্ষমতালোভী ছেলের মসনদে আসীন হতে। আর মাত্র অল্প কয়েক বছর আগেও আমরা দেখেছি, পরিত্রাতা বন্ধুকে গোপন বিচারের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ক্ষমতা পোক্ত করার খেলায় এক সমরনায়ককে নিয়োজিত থাকতে।
ফলে মোবারকের একমাত্র পরিত্রাণ এখন হতে পারে বেন আলীর পথ অনুসরণ করে সারা বিশ্বের দুর্গন্ধময় নানা রকম উদ্ভট চরিত্রের অভয়ারণ্যে আশ্রয় গ্রহণ করা। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসর্বস্ব সেই দেশটির রাজধানীতে নিশ্চয় এ রকম একটি সড়ক আছে, যার চারদিকটা বিষ্ঠার গন্ধে পরিপূর্ণ। সেখানে এখন বাকি জীবনের জন্য যাবর কেটে বেড়াচ্ছে পূতিগন্ধময় কিছু চরিত্র, মাত্র কিছুদিন আগেও নিজ নিজ দেশে যাঁদের ক্ষমতার দাপটের সামনে আমজনতার জীবন হয়ে উঠেছিল অতিষ্ঠ। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া নীরব বিপ্লবের ঢেউ সেই দুর্গন্ধময় সমুদ্রতটে এসে আঘাত হানলে কোথায় যাবে সেখানে আশ্রয় নেওয়া সব ঘৃণিত মানবসন্তান, আর কোথায়ই বা পালাবে তাঁদের আশ্রয়দাতারা?
টোকিও থেকে
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
সময়ের বিবর্তনে লোভী মানুষ অন্তত সামাজিক মুখরক্ষার খাতিরে লোভের পাগলা ঘোড়ার লাগাম কিছুটা টেনে ধরার চেষ্টা করলেও ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার সামান্যতম আশঙ্কা দেখা দেওয়ার মুখে লোভ আবারও বের হয়ে এসেছে তার কুৎসিত চেহারা নিয়ে, আর আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে ধোপদুরস্ত সাজপোশাকে সামনে উপস্থিত লোভী মানুষটির কদর্য চেহারা। মিসরের জীবনভর প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক হচ্ছেন সে রকম এক লোভী মানুষের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের প্রয়াত শিল্পী কামরুল হাসানের ভাষার অনুকরণে বলা যায়, কপালে খড়ম দিয়ে সুপারির আঘাত করে গেলেও লজ্জা-শরমের কোনো রকম বালাই যাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র দেখা দেয় না।
মিসরের এই শর্মিন্দামুক্ত পুরুষ বয়সের ভারে কিছুটা কাত হয়ে পড়লেও হাতে ধরে রাখা ক্ষমতার রজ্জুটি ছেড়ে দিতে একেবারেই নারাজ। দেশটির সাম্প্রতিক সমস্যার সূত্রপাতও বলা যায় সে রকম বাস্তবতা থেকে। ৩০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন এই প্রেসিডেন্ট সরকারি বেতনভোগী পেটোয়া বাহিনী আর হালুয়া-রুটির বিরাট অংশের হিস্যা লুটে নেওয়া সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট হয়ে গত তিন দশকে দেশের সব কটি নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাধিক্য বিজয় নিশ্চিত করে নিয়ে গণতন্ত্রের অনুকরণীয় এক ‘প্রতীক’ হিসেবে পশ্চিমের কাছে বরাবরই থেকেছেন খুবই প্রিয় মানুষ, যে সুবাদে মুফতে পাওয়া নানা রকম অস্ত্রের সরবরাহ দেশের মানুষকে ডান্ডাপেটা করে ঠান্ডা রাখার সামর্থ্য তাঁকে এনে দিলেও মানুষের ভালোবাসা থেকে তিনি থেকেছেন বঞ্চিত। তবে তার পরও সাধারণ জনতার পক্ষে জোটবদ্ধ হয়ে কিছু করা এ কারণে এত দিন ধরে সম্ভব হয়নি যে দেশজুড়ে ভিন্নমতের সামান্যতম চিহ্ন দেখা গেলে সেই অবস্থার অঙ্কুরে তা ধ্বংস করে দেওয়ার নীতি গ্রহণকারী পেটোয়া বাহিনীর কল্যাণে দেশটি মূলত হয়ে পড়েছে একেবারেই নেতৃত্বশূন্য। আর সেই অবস্থায় মোবারক ও তাঁর পরিবার হালুয়া-রুটির বড় অংশটি নিজেদের জন্য রেখে দিয়ে অবশিষ্ট অংশ কাজে লাগিয়েছে পেটোয়া আর সামরিক বাহিনী এবং জি-হুজুর মার্কা অনুসারীদের তৃপ্ত রাখার উদ্দেশ্যে।
সে রকম অবস্থায় দেশের অবশিষ্ট আমজনতার ভাগ্যে যা জুটেছে তা হলো, ক্ষমতাসীনদের চেটেপুটে সাফ করে ফেলা হালুয়া-রুটির প্লেটে লেগে থাকা সামান্যতম উচ্ছিষ্ট অংশ। তার পরও হালুয়া-রুটির ভাগ পাওয়া পেটোয়া বাহিনীর কল্যাণে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার দুয়ার শক্তভাবে সাঁটা থাকায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভয়ের দেয়াল অতিক্রম করে যাওয়া দেশবাসীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে গত প্রায় এক দশকে নীরব যে বিপ্লব বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ আর সংবাদপ্রবাহের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়ে মানুষকে একে অন্যের আরও অনেক কাছে নিয়ে এসেছে, তা কিন্তু হালুয়া-রুটি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বেড়ানো সব রকম নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে যাওয়া পশ্চিমের শাসকগোষ্ঠীর অতি আদরের ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্রদের’ চোখে ধরা পড়েনি। বিষয়টি যখন তাদের দৃষ্টিতে আসে, তত দিনে পানি অনেকটা গড়িয়ে মোহনার কাছাকাছি এসে উপস্থিত। মিসরের জনতা তাই এখন পর্যন্ত আগের মতোই নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় থেকে যাওয়া সত্ত্বেও নতুন করে সংঘবদ্ধ হয়ে ভয়ের দেয়াল তাদের পক্ষে অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব হয়েছে অনেকটা ঠিক তথ্যব্যবস্থার নবপ্রযুক্তির কল্যাণে। ঠিক এমনটাই দেখা গিয়েছিল মিসরের অল্প দূরের দেশ তিউনিসিয়ায়। সর্বশেষ নির্বাচনে পেটোয়া বাহিনীর কল্যাণে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত যে দেশটির প্রেসিডেন্টকে জনতার রুদ্ররোষের ভয়ে লুঙ্গিতে কষে কাছা বেঁধে নিয়ে রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে।
জয়নুল আবেদিন বেন আলীর তুলনায় মিসরের মোবারক বলা যায় অনেক বেশি ঘুঘু মক্কেল। বয়সের ভারে শরীর কাত হয়ে পড়লেও ক্ষমতার লোভের দাওয়াই তাঁকে এখনো যথেষ্ট পোক্ত রেখেছে এবং যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো নিজের নিয়োজিত মন্ত্রিসভার ঘাড়ে সব রকম দোষ চাপিয়ে দিয়ে মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে জনতাকে তুষ্ট করার দুষ্ট খেলায় নিজেকে তিনি এখন নিয়োজিত রেখেছেন। তবে আগুনের লেলিহান যে শিখা এখন দেশজুড়ে প্রজ্বলিত, তা দাবানলে রূপান্তরিত হওয়ার মুখে এ-জাতীয় দুষ্ট প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। মিসরের জনগণ তো মোবারকের নিজের দেওয়া মন্ত্রিসভার বরখাস্ত হওয়া চায়নি, যা তারা চেয়েছে তা হলো মোবারকের নিজের পদত্যাগ। কেননা, তারা ভালোভাবেই অবগত যে মোবারক বিদায় নিলে তাঁর নিয়োজিত মন্ত্রিসভা কর্পূরের মতোই বাতাসে মিলিয়ে যাবে, কোনো রকম কাঠখড় যার জন্য জনতাকে আর পোড়াতে হবে না।
মোবারক হয়তো ভাবছেন, মন্ত্রিসভার ওপর সব রকম ব্যর্থতার দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে এবং সেই সঙ্গে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের মতো নতুন যোগাযোগমাধ্যম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়ে নিজের আখের তিনি আবারও গুছিয়ে নিতে পারবেন। হয়তো এ রকম হিসাবও তাঁর মাথায় আছে যে এত কিছুর পরও জনতা শান্ত না হলে ছেলেকে নিজের আসনে বসিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা তিনি দেবেন। তবে তার পরও এবারের মিসর শান্ত হওয়ার নয়। মানুষ বুঝে গেছে, ভাঁওতাবাজি দিয়ে তাদের অন্ধকারে আটকে রাখা তথ্যের অবাধ প্রবাহের এই যুগে এখন আর সম্ভব নয়। ফলে বেন আলীর ভাগ্য গ্রহণ করে নেওয়ার আহ্বান মোবারকের প্রতি এখন জানানো হচ্ছে, যে ভাগ্য মিসরের জীবনভর প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করে নিলে পুরো অঞ্চলে এখন পর্যন্ত দাপটে বিরাজমান রাজা-বাদশাহ আর আমির-ওমরাহদের দিন শেষ হয়ে আসার ঘণ্টাও হয়তো আরেকটু জোরালোভাবে তা বাজিয়ে দেবে। ফলে এক ধরনের অস্থিরতা, এক ধরনের সহমর্মিতা মাত্র অল্প কিছুদিন আগের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যেও এখন লক্ষ করা যাচ্ছে, যে সূত্র ধরে ৪০ বছর লিবিয়ার মসনদে আসীন মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে বলতে শোনা যায়, বেন আলীর পতন হচ্ছে তিউনিসিয়ার জন্য বিরাট বড় এক ক্ষতি।
৩০ বছর ধরে একদলীয়-একনায়কী শাসনের হাল ধরে বসে থাকা অবস্থা অতি সাধারণ চরিত্রের অধিকারী মোবারককে একদিকে যেমন পরিণত করেছে ক্ষমতালিপ্সু এক লোভীতে, অন্যদিকে একইভাবে তাঁকে করে তুলেছে অন্যের প্রতি আস্থা রাখতে না পারা বিপর্যস্ত এক মানবসন্তানে। তিনি নিশ্চিত নন, ক্ষমতার হাল অন্য কারও হাতে তুলে দিলে বাকি জীবন তিনি ঝামেলামুক্তভাবে কাটাতে পারবেন কি না। ফলে ছেলের ওপর তাঁর নির্ভরশীলতা, যে ছেলেকে তিনি করতে চাইছেন তাঁর উত্তরসূরি।
তবে ক্ষমতার লোভ কিন্তু কখনোই বাবা-ছেলে আর বন্ধু-সুহূদের সম্পর্ককে স্বাভাবিকতার মধ্যে আটকে রাখেনি। ইতিহাস সেই দৃষ্টান্ত ক্রমাগতই আমাদের সামনে তুলে ধরছে। মাত্র কয়েক শ বছর আগে আমরা দেখেছি সম্রাট বাবাকে অন্ধ করে দিয়ে ক্ষমতালোভী ছেলের মসনদে আসীন হতে। আর মাত্র অল্প কয়েক বছর আগেও আমরা দেখেছি, পরিত্রাতা বন্ধুকে গোপন বিচারের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ক্ষমতা পোক্ত করার খেলায় এক সমরনায়ককে নিয়োজিত থাকতে।
ফলে মোবারকের একমাত্র পরিত্রাণ এখন হতে পারে বেন আলীর পথ অনুসরণ করে সারা বিশ্বের দুর্গন্ধময় নানা রকম উদ্ভট চরিত্রের অভয়ারণ্যে আশ্রয় গ্রহণ করা। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসর্বস্ব সেই দেশটির রাজধানীতে নিশ্চয় এ রকম একটি সড়ক আছে, যার চারদিকটা বিষ্ঠার গন্ধে পরিপূর্ণ। সেখানে এখন বাকি জীবনের জন্য যাবর কেটে বেড়াচ্ছে পূতিগন্ধময় কিছু চরিত্র, মাত্র কিছুদিন আগেও নিজ নিজ দেশে যাঁদের ক্ষমতার দাপটের সামনে আমজনতার জীবন হয়ে উঠেছিল অতিষ্ঠ। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া নীরব বিপ্লবের ঢেউ সেই দুর্গন্ধময় সমুদ্রতটে এসে আঘাত হানলে কোথায় যাবে সেখানে আশ্রয় নেওয়া সব ঘৃণিত মানবসন্তান, আর কোথায়ই বা পালাবে তাঁদের আশ্রয়দাতারা?
টোকিও থেকে
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments