ইতিউতি-অস্ত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে by আতাউস সামাদ
অনেক বয়স পর্যন্ত আগ্নেয়াস্ত্র দেখে ভয় পেতাম না। সম্ভবত খুব ছোটবেলা থেকে দেখে আসছিলাম বলে ওসব গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কলকাতায় আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে মিত্রবাহিনীর ট্রাক যাতায়াত করত। সাদা-কালো দুই গাত্রবর্ণেরই সৈনিকরা সেগুলোতে গম্ভীর মুখে বসে থাকত।
তাদের হাতে থাকত নানা রকম আগ্নেয়াস্ত্র। এগুলোর মধ্যে কেমন করে যেন 'টমি গান' চেনা হয়ে গিয়েছিল। দূরপাল্লার রাইফেলও চিনতে পারতাম। মাঝেমধ্যে এ রকম বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে ভারতীয় সৈনিকরা ঘোরাফেরা করত। আমাদের পাড়ায় সিভিল ডিফেন্সের প্রধান ছিলেন আমাদের ভাড়াবাড়ির মালিক। তাঁর কাছেই বোধ হয় এরা আসত।
মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমার বাবা শখ করে একটা পয়েন্ট ২২ বোরের রাইফেল কিনেছিলেন। দুর্ঘটনাক্রমে একটা পোষা খরগোশ বাড়ির গেটের কাছে কার জানি পায়ে চাপা পড়ে মরে গেল বলে ঝরঝর করে কাঁদলেন তিনি। কোনো দিন শিকার করার জন্য ওই রাইফেল ব্যবহার করবেন তা কল্পনা করাও কঠিন ছিল। পরে একটা একনলা বন্দুকও কিনেছিলেন। আমার দুলাভাই বিখ্যাত আইনজীবী সিরাজুল হকের একটা রিভলবার ছিল। সেটাও ঘেঁটে দেখেছি। এগুলো সব লাইসেন্স করা অস্ত্র। কলেজে পড়ার সময় ইউওটিসিতে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল ও স্টেনগান চালাতে শেখানো হয়েছিল আমাদের। তবে এসব অস্ত্রের ব্যাপারে একটা শৃঙ্খলা ছিল। এগুলো কিভাবে ব্যবহার করা হবে, কখন ব্যবহার করা যাবে_সে সম্পর্কে লিখিত ও স্পষ্ট আইন ছিল। কাজেই কারো হাতে এসব অস্ত্রের কোনো একটি দেখলেই আতঙ্ক হতো না।
তবে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত চা-বাগান শ্রমিকদের লাশ জলপাইগুড়ি শহরে আমাদের স্কুলের অদূরে করলা খালের ঘাটে নামানো হলে মন খুব খারাপ হয়েছিল। পাকিস্তানে আসার পর ঢাকার লালবাগ কেল্লায় ধর্মঘটি বাঙালি পুলিশদের ওপর গুলিবর্ষণ, ভাষা আন্দোলনের সময় ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং তারপর সেনাশাসক আইয়ুব খানের আমলে প্রায়ই বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ আর নানা নামের সেপাইদের গুলি ছোড়া লেগেই ছিল। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। তখন তো চলতে-ফিরতে সারাক্ষণই সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের দেখেছি। মাঝরাতের পর আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনারা তল্লাশি চালিয়েছে। দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রেখে বুকের দিকে স্টেনগান তাক করে রেখেছে। অবশেষে বড়ভাই আজিজুস সামাদকে ধরে নিয়ে গেছে। সেই সময় বন্দুকধারী পাকিস্তানি দেখলে কিভাবে আত্মরক্ষা করব_সেই চিন্তা হতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বসবাস বলে ভয়ে সিটিয়ে যেতাম না। বিজয়ের পর একদল মুক্তিযোদ্ধা অল্প কয়েক দিন আমাদের বাড়িতে তাঁদের অস্ত্র রেখেছিলেন; তবে তখন সেগুলো কেউ ব্যবহার করেননি। ১৬ ডিসেম্বরের পর অস্ত্রভীতি তেমন ছিল না।
কিন্তু কিছুদিন যেতেই শুরু হলো অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। একই সঙ্গে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের অস্ত্র সরবরাহ বাড়াতে থাকল সরকার। তখন বৈধ ও অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি বাংলাদেশে। তবে ইদানীং ভয়ের ব্যাপার হলো, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নিয়মকানুন যেন ভেঙে পড়েছে। দুর্বৃত্তরা খুনখারাবি, ছিনতাই ও ডাকাতি করার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। তারা মোটরসাইকেল ও মোটরগাড়ি থেকেও গুলি করে। একবার-দুবার দুষ্কৃতকারীদের ককটেল ছোড়াছুড়ি আর কাটা বন্দুক ও স্টেন নিয়ে ছোটাছুটির মধ্যে পড়েছি। ভাগ্য ভালো বলে বেঁচে আছি। তবে অস্ত্রধারী পুলিশ শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির ভেতরে ঢুকে বৈঠকখানায় টেবিলের ওপর অস্ত্র রেখে কথাবার্তা বলেছে, এমনও হয়েছে। তার বন্দুকের নলটা যে আমার দিকেই ঘোরানো আছে তাও খেয়াল করেছি। আরেকবার দুই র্যাব সদস্য এলেন অফিসে। তাঁদের একজন যেন কী মনে করে তাঁর রিভলবারটা টেবিলের ওপর রাখলেন, আবার খানিকক্ষণ পর খাপে ঢুকিয়ে রাখলেন। মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা কোনো অপরাধ তদন্ত করতে বা আমাদের নিরাপত্তা দিতে আসেননি। যেসব তথ্য চাইলেন তাঁরা, সেগুলো সংগ্রহ করার জন্য সচিবালয় থেকে যে কেউ আসতে পারতেন। এটা ২০০৭-০৮-এর অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের ঘটনা। এসব কারণে আজকাল অস্ত্র দেখলে ভয় পাই। আমার মনে হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সদস্যদের অস্ত্র বহন ও প্রদর্শনের বিষয়ে একটা শিথিল ভাব চলছে। শান্তশিষ্ট নাগরিকরা হয়তো শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনের দ্বারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে অধিকতর সংযম কামনা করেন। আর এমন তো নয় যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রধারী সদস্যরা আগের তুলনায় অধিকতর সংখ্যায় ঘোরাফেরা করেন বলে অপরাধ ঘটার সংখ্যা কমে গেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেকখানি দস্যু ও অপহরণকারী কবলিত। রাজধানী ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চলে দুর্বৃত্তদের রাহাজানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলদারি ও হত্যাকাণ্ড ঘটছে আকছার।
অন্যদিকে র্যাব ও পুলিশের কথিত ক্রসফায়ার অথবা এনকাউন্টারে দাগি সন্ত্রাসী এবং অপ্রমাণিত অপরাধী নিহত হওয়ার সংখ্যাও দুশ্চিন্তা ঘটানোর মতো উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এখন দেশে ও বিদেশে আলোচিত বিষয়। মানবাধিকারকর্মীরা বিষয়টিকে হালকা করে নিতে নারাজ। যুক্তরাজ্য সরকার র্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল ও মানবাধিকার মেনে চলার বিষয়ে। উইকিলিকসে এ তথ্য প্রচার করে দেওয়ার পর ওই সরকারকে নিজ দেশে সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে জেরা করার, কাউকে নজরদারিতে রাখার ও মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে বলে শুনেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি, তথা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কথা উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এজেন্ডায় মানবাধিকার অগ্রাধিকার পায় বলে তারা দাবি করে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ বিষয়ে এখন সরব। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক দিক নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন বিধায় নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আলোচনায় আসছে। সংবাদপত্রগুলোও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তথ্য প্রকাশ ও আলোচনা সচল রেখেছে। এর ফলে সরকার, র্যাব ও পুলিশের ওপর জনমতের চাপ পড়তে শুরু করেছে।
র্যাব প্রতিষ্ঠিত হয় ২৬ মার্চ, ২০০৪ সালে। সেদিক থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে নিহত হয়েছে ৬০০ জন। সংখ্যাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিহতদের আত্মীয়স্বজন দাবি করেছেন, এনকাউন্টার-কাহিনী সঠিক নয়। তাঁদের লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের জানামতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকার দুটি ঘটনা একটি কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করায়। দুটোর একটিতে অনুসন্ধানে বেরিয়েছে যে র্যাবের কাছে এক ব্যক্তি নিজের পরিচয় তুলে ধরতে না ধরতেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এও প্রকাশ পায় যে সেই র্যাব দলটি অন্য এক ব্যক্তির খোঁজ করছিল। অপরটিতে তদন্তকারীরা প্রমাণ পেয়েছেন, র্যাব এক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর তাদের ও পুলিশের পিটুনিতে তিনি মারাত্মকভাবে জখম হন এবং তাঁকে জেলহাজতে পাঠানোর পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলেও চিকিৎসার অভাবে তিনি মারা যান। এদিকে চৌধুরী আলম অন্তর্ধান রহস্যসহ এ রকম কয়েকটি ঘটনা রহস্যই রয়ে গেছে। পুলিশের বিরুদ্ধেও চাঁদার জন্য চাপাচাপি করতে করতে কোনো কোনো ব্যক্তিকে মেরে ফেলার এবং কোনো ক্ষেত্রে পায়ে গুলি করার জোরদার অভিযোগ আছে।
এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে কিশোর লিমনের পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কাহিনী। অভিযোগ, র্যাব সদস্যরা তার পায়ে গুলি করেন। রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের এই ছেলেটি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি ছিল। কিন্তু এর আগেই তার পায়ে গুলি করা হয়। পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে তার জখম পা কেটে ফেলতে হয়। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান লিমনকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তার কাহিনী শুনে কেঁদে ফেলেন। তিনি সরকারকে এক মাসের মধ্যে বিষয়টি তদন্ত করতে অনুরোধ করেছেন। র্যাব ঘটনাটিতে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। আইন প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেছেন, র্যাবের নিজস্ব বিধি অনুযায়ী এ রকম ঘটনা ঘটলে বা কেউ নিহত হলে তার বিভাগীয় তদন্ত হয় এবং কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি হয়। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, প্রয়োজন হলে সরকার কমিটি করে তদন্ত করবে। আমাদের মনে হয়, সরকারের উচিত হবে বিষয়টির গভীরতর তদন্ত করা। কারণ যার হাতেই অস্ত্র থাকুক না কেন, তাকে রাস টেনে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে রাখতেই হয়। যশোরে পুলিশ গুলি করে একটি মাদ্রাসাছাত্রকে যে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে এবং ওই দিনের গুলিবর্ষণের ঘটনাগুলোকে যেভাবে মিথ্যা দিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে তাতেই প্রমাণ হয়, কোনো আগ্নেয়াস্ত্রধারীকেই আশকারা দেওয়া মারাত্মক ভুল। না হলে শেষকালে দেখা যাবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও দেশে বিশৃঙ্খলা এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
সরকার নিয়ন্ত্রিত বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো দেশে আইনশৃঙ্খলা সুদৃঢ় করেছে বা নাগরিকদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে তাও প্রমাণিত নয়। বরঞ্চ তর্ক উঠলে বিপরীত দিকে পাল্লা ভারী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাবেক জোট সরকার ও দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কারোরই বলার কিছু নেই।
আমরা মনে করি, অপরাধ দমন করতে হবে পুলিশের তদন্ত ও আদালতে সময়মতো বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। র্যাব যদি এলিট ফোর্স হয়, তবে তাদের কাজের ক্ষেত্রও হতে হবে বিশেষ এবং জটিল অপরাধ নিয়ে। আর সব আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে থাকতে হবে রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধার করে দেওয়ার মতো বেআইনি কাজ থেকে দূরে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমার বাবা শখ করে একটা পয়েন্ট ২২ বোরের রাইফেল কিনেছিলেন। দুর্ঘটনাক্রমে একটা পোষা খরগোশ বাড়ির গেটের কাছে কার জানি পায়ে চাপা পড়ে মরে গেল বলে ঝরঝর করে কাঁদলেন তিনি। কোনো দিন শিকার করার জন্য ওই রাইফেল ব্যবহার করবেন তা কল্পনা করাও কঠিন ছিল। পরে একটা একনলা বন্দুকও কিনেছিলেন। আমার দুলাভাই বিখ্যাত আইনজীবী সিরাজুল হকের একটা রিভলবার ছিল। সেটাও ঘেঁটে দেখেছি। এগুলো সব লাইসেন্স করা অস্ত্র। কলেজে পড়ার সময় ইউওটিসিতে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল ও স্টেনগান চালাতে শেখানো হয়েছিল আমাদের। তবে এসব অস্ত্রের ব্যাপারে একটা শৃঙ্খলা ছিল। এগুলো কিভাবে ব্যবহার করা হবে, কখন ব্যবহার করা যাবে_সে সম্পর্কে লিখিত ও স্পষ্ট আইন ছিল। কাজেই কারো হাতে এসব অস্ত্রের কোনো একটি দেখলেই আতঙ্ক হতো না।
তবে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত চা-বাগান শ্রমিকদের লাশ জলপাইগুড়ি শহরে আমাদের স্কুলের অদূরে করলা খালের ঘাটে নামানো হলে মন খুব খারাপ হয়েছিল। পাকিস্তানে আসার পর ঢাকার লালবাগ কেল্লায় ধর্মঘটি বাঙালি পুলিশদের ওপর গুলিবর্ষণ, ভাষা আন্দোলনের সময় ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং তারপর সেনাশাসক আইয়ুব খানের আমলে প্রায়ই বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ আর নানা নামের সেপাইদের গুলি ছোড়া লেগেই ছিল। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। তখন তো চলতে-ফিরতে সারাক্ষণই সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের দেখেছি। মাঝরাতের পর আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনারা তল্লাশি চালিয়েছে। দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রেখে বুকের দিকে স্টেনগান তাক করে রেখেছে। অবশেষে বড়ভাই আজিজুস সামাদকে ধরে নিয়ে গেছে। সেই সময় বন্দুকধারী পাকিস্তানি দেখলে কিভাবে আত্মরক্ষা করব_সেই চিন্তা হতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বসবাস বলে ভয়ে সিটিয়ে যেতাম না। বিজয়ের পর একদল মুক্তিযোদ্ধা অল্প কয়েক দিন আমাদের বাড়িতে তাঁদের অস্ত্র রেখেছিলেন; তবে তখন সেগুলো কেউ ব্যবহার করেননি। ১৬ ডিসেম্বরের পর অস্ত্রভীতি তেমন ছিল না।
কিন্তু কিছুদিন যেতেই শুরু হলো অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। একই সঙ্গে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের অস্ত্র সরবরাহ বাড়াতে থাকল সরকার। তখন বৈধ ও অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি বাংলাদেশে। তবে ইদানীং ভয়ের ব্যাপার হলো, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নিয়মকানুন যেন ভেঙে পড়েছে। দুর্বৃত্তরা খুনখারাবি, ছিনতাই ও ডাকাতি করার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। তারা মোটরসাইকেল ও মোটরগাড়ি থেকেও গুলি করে। একবার-দুবার দুষ্কৃতকারীদের ককটেল ছোড়াছুড়ি আর কাটা বন্দুক ও স্টেন নিয়ে ছোটাছুটির মধ্যে পড়েছি। ভাগ্য ভালো বলে বেঁচে আছি। তবে অস্ত্রধারী পুলিশ শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির ভেতরে ঢুকে বৈঠকখানায় টেবিলের ওপর অস্ত্র রেখে কথাবার্তা বলেছে, এমনও হয়েছে। তার বন্দুকের নলটা যে আমার দিকেই ঘোরানো আছে তাও খেয়াল করেছি। আরেকবার দুই র্যাব সদস্য এলেন অফিসে। তাঁদের একজন যেন কী মনে করে তাঁর রিভলবারটা টেবিলের ওপর রাখলেন, আবার খানিকক্ষণ পর খাপে ঢুকিয়ে রাখলেন। মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা কোনো অপরাধ তদন্ত করতে বা আমাদের নিরাপত্তা দিতে আসেননি। যেসব তথ্য চাইলেন তাঁরা, সেগুলো সংগ্রহ করার জন্য সচিবালয় থেকে যে কেউ আসতে পারতেন। এটা ২০০৭-০৮-এর অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের ঘটনা। এসব কারণে আজকাল অস্ত্র দেখলে ভয় পাই। আমার মনে হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সদস্যদের অস্ত্র বহন ও প্রদর্শনের বিষয়ে একটা শিথিল ভাব চলছে। শান্তশিষ্ট নাগরিকরা হয়তো শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনের দ্বারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে অধিকতর সংযম কামনা করেন। আর এমন তো নয় যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রধারী সদস্যরা আগের তুলনায় অধিকতর সংখ্যায় ঘোরাফেরা করেন বলে অপরাধ ঘটার সংখ্যা কমে গেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেকখানি দস্যু ও অপহরণকারী কবলিত। রাজধানী ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চলে দুর্বৃত্তদের রাহাজানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলদারি ও হত্যাকাণ্ড ঘটছে আকছার।
অন্যদিকে র্যাব ও পুলিশের কথিত ক্রসফায়ার অথবা এনকাউন্টারে দাগি সন্ত্রাসী এবং অপ্রমাণিত অপরাধী নিহত হওয়ার সংখ্যাও দুশ্চিন্তা ঘটানোর মতো উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এখন দেশে ও বিদেশে আলোচিত বিষয়। মানবাধিকারকর্মীরা বিষয়টিকে হালকা করে নিতে নারাজ। যুক্তরাজ্য সরকার র্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল ও মানবাধিকার মেনে চলার বিষয়ে। উইকিলিকসে এ তথ্য প্রচার করে দেওয়ার পর ওই সরকারকে নিজ দেশে সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে জেরা করার, কাউকে নজরদারিতে রাখার ও মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে বলে শুনেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি, তথা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কথা উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এজেন্ডায় মানবাধিকার অগ্রাধিকার পায় বলে তারা দাবি করে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ বিষয়ে এখন সরব। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক দিক নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন বিধায় নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আলোচনায় আসছে। সংবাদপত্রগুলোও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তথ্য প্রকাশ ও আলোচনা সচল রেখেছে। এর ফলে সরকার, র্যাব ও পুলিশের ওপর জনমতের চাপ পড়তে শুরু করেছে।
র্যাব প্রতিষ্ঠিত হয় ২৬ মার্চ, ২০০৪ সালে। সেদিক থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে নিহত হয়েছে ৬০০ জন। সংখ্যাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিহতদের আত্মীয়স্বজন দাবি করেছেন, এনকাউন্টার-কাহিনী সঠিক নয়। তাঁদের লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের জানামতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকার দুটি ঘটনা একটি কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করায়। দুটোর একটিতে অনুসন্ধানে বেরিয়েছে যে র্যাবের কাছে এক ব্যক্তি নিজের পরিচয় তুলে ধরতে না ধরতেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এও প্রকাশ পায় যে সেই র্যাব দলটি অন্য এক ব্যক্তির খোঁজ করছিল। অপরটিতে তদন্তকারীরা প্রমাণ পেয়েছেন, র্যাব এক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর তাদের ও পুলিশের পিটুনিতে তিনি মারাত্মকভাবে জখম হন এবং তাঁকে জেলহাজতে পাঠানোর পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলেও চিকিৎসার অভাবে তিনি মারা যান। এদিকে চৌধুরী আলম অন্তর্ধান রহস্যসহ এ রকম কয়েকটি ঘটনা রহস্যই রয়ে গেছে। পুলিশের বিরুদ্ধেও চাঁদার জন্য চাপাচাপি করতে করতে কোনো কোনো ব্যক্তিকে মেরে ফেলার এবং কোনো ক্ষেত্রে পায়ে গুলি করার জোরদার অভিযোগ আছে।
এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে কিশোর লিমনের পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কাহিনী। অভিযোগ, র্যাব সদস্যরা তার পায়ে গুলি করেন। রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের এই ছেলেটি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি ছিল। কিন্তু এর আগেই তার পায়ে গুলি করা হয়। পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে তার জখম পা কেটে ফেলতে হয়। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান লিমনকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তার কাহিনী শুনে কেঁদে ফেলেন। তিনি সরকারকে এক মাসের মধ্যে বিষয়টি তদন্ত করতে অনুরোধ করেছেন। র্যাব ঘটনাটিতে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। আইন প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেছেন, র্যাবের নিজস্ব বিধি অনুযায়ী এ রকম ঘটনা ঘটলে বা কেউ নিহত হলে তার বিভাগীয় তদন্ত হয় এবং কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি হয়। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, প্রয়োজন হলে সরকার কমিটি করে তদন্ত করবে। আমাদের মনে হয়, সরকারের উচিত হবে বিষয়টির গভীরতর তদন্ত করা। কারণ যার হাতেই অস্ত্র থাকুক না কেন, তাকে রাস টেনে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে রাখতেই হয়। যশোরে পুলিশ গুলি করে একটি মাদ্রাসাছাত্রকে যে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে এবং ওই দিনের গুলিবর্ষণের ঘটনাগুলোকে যেভাবে মিথ্যা দিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে তাতেই প্রমাণ হয়, কোনো আগ্নেয়াস্ত্রধারীকেই আশকারা দেওয়া মারাত্মক ভুল। না হলে শেষকালে দেখা যাবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও দেশে বিশৃঙ্খলা এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
সরকার নিয়ন্ত্রিত বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো দেশে আইনশৃঙ্খলা সুদৃঢ় করেছে বা নাগরিকদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে তাও প্রমাণিত নয়। বরঞ্চ তর্ক উঠলে বিপরীত দিকে পাল্লা ভারী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাবেক জোট সরকার ও দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কারোরই বলার কিছু নেই।
আমরা মনে করি, অপরাধ দমন করতে হবে পুলিশের তদন্ত ও আদালতে সময়মতো বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। র্যাব যদি এলিট ফোর্স হয়, তবে তাদের কাজের ক্ষেত্রও হতে হবে বিশেষ এবং জটিল অপরাধ নিয়ে। আর সব আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে থাকতে হবে রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধার করে দেওয়ার মতো বেআইনি কাজ থেকে দূরে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments