চরাচর-সোমেশ্বরী নদীর রক্তখচিত অধ্যায় by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
সোমেশ্বরী নদী বয়ে চলেছে নীরবে_আদিবাসীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম-সংঘর্ষের সাক্ষী হয়ে। নদী-পাহাড়ের অপরূপ আরণ্যক সৌন্দর্যের নেপথ্যে গাথা রয়েছে ইতিহাসের রক্তস্নাত অধ্যায়। বহু বছরের টগবগে যৌবন আজ অনেকটাই ভাটা পড়েছে তার। অবশ্য আষাঢ়-শ্রাবণে স্নিগ্ধ বর্ষার সুতীব্র জলজ উচ্ছ্বাস এসে ভরিয়ে দেয় তাকে।
নদীর পাড়ে দাঁড়ালেই দেখা যায় ভারত সীমান্তের মেঘালয় রাজ্যের মেঘে ঢাকা গারো পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য। সোমেশ্বরীর এক পারে অবস্থিত দুর্গাপুর। অন্য পারে বিরিশিরি। নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জ বাজার হয়ে যাওয়া যায় দুর্গাপুর। এই দুর্গাপুরের রয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমি। দুর্গাপুর এলাকার নামকরণ করা হয়েছে সুসং রাজের গারো সভাপতি দুর্গার নাম থেকে। আর সোমেশ্বরী নদীর নামকরণ হয়েছিল রাজার পাঠক সোমেশ্বরের নাম থেকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দুর্গাপুরের শ্রেষ্ঠ সন্তান ছিলেন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ। তিনি ছিলেন 'টংক বিদ্রোহ'র নেতা এবং সুসং মহারাজের আপন ভাগ্নে। ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি গিয়েছিলেন কলকাতা কলেজে লেখাপড়া করতে। কিন্তু স্বদেশের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর মমত্ববোধকে মণি সিংহ উপেক্ষা করতে পারেননি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েই পুরোদমে শুরু করেন প্রতিবাদ-বিদ্রোহ-সমাবেশ। ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাঠিয়ে দেয় দুর্গাপুর। 'সপ্তাহে এক দিন থানায় হাজিরা দেওয়ার শর্তে' কিছুদিন পর তাঁকে কঠিন সাজা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তা না করে বরং ঘোড়ায় চেপে দিনের পর দিন লেঙ্গুরা, বিজয়পুর, বহেরাতলীর হাজং পাড়ায় ছুটে বেড়িয়ে ওই এলাকার দরিদ্র-অভাবী মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মহাজনদের 'টংক' অর্থাৎ খাজনার কারণে একসময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল হাজং জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা। হাজংদের জমি বরাদ্দ দেওয়ার পর তখন মাথাপিছু ফসল বেঁধে দেওয়া হতো। কিন্তু প্রাকৃতিক সমস্যাবলির কথা কিছুতেই কানে নিত না মহাজনরা। তখন খরা, বন্যার প্রাদুর্ভাব ছিল নৈমিত্তিক। মহাজনদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে উপযুক্ত পরিমাণ খাজনা না দিতে পারলে মহাজন কর্তৃক অমানবিক নির্যাতনের প্রথা তখন প্রচলিত ছিল। সেসব হতদরিদ্র, দুস্থ কৃষকের আশার আলো হয়ে 'লাঙল যার, জমি তার'_এই আন্দোলিত উচ্চারণ নিয়ে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কমরেড মণি সিংহ। তাঁর সেই মহামন্ত্রে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল সহস্র আদিবাসী নারী-পুরুষ। তারা সম্মিলিতভাবে মণি সিংহের কাছে প্রতিশ্রুত হলো_'জান দেব, তবু টংক দেব না।' টংকবিরোধী আন্দোলন চলেছিল ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। নানাভাবে নানা সময়ে এই সোমেশ্বরী নদীর বুকেই রক্ত ঝরেছিল আদিবাসীদের। সুসং রাজা তাঁর ভাগ্নেকে এসব আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক প্রলোভন দেখিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শ থেকে নড়েননি একবিন্দুও। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের খণ্ড খণ্ড পটভূমির নায়ক হয়ে আছেন মণি সিংহ। টংক শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এখানে বরেণ্য স্থপতি রবিউল হুসাইনের নকশায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে, যা আজ ইতিহাসের এক গৌরবময় সংযোজন। এই নদীর সঙ্গে স্থানীয় আদিবাসীর সম্পর্ক যেন বড়ই বেদনা মাধুর্যে গড়া।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
No comments