মিসর-সেক্যুলার ও বিশ্বাসী, ধনী ও গরিব, লক্ষ্য সবার এক by রবার্ট ফিস্ক
বিজয় আসেনি কিন্তু মিছিলে মিছিলে তারই উল্লাস। মানুষ আসছে এখানে লাখে লাখে। তারা উল্লসিত, সংগীতমুখর, প্রার্থনারত। বইছে মিসরীয় জনগণের বিরাট প্লাবন। শহর থেকে শহরতলি, গ্রামকে গ্রাম মানুষ আসছে। ওড়াচ্ছে মিসরের লাল-কালো-সাদা পতাকা, মাঝখানে আঁকা মিসরের প্রতীক আলোয় উদ্ভাসিত এক সোনালি ইগল।
জমায়েত কি ১০ লাখের বেশি? হয়তো। মিসরের ইতিহাসের বৃহত্তম রাজনৈতিক জনস্রোত। তারা চায় ঘৃণিত মোবারকের পতন। এই বিকেলের বিজয়োল্লাসের একটাই কমতি, হোসনি মোবারক এখনো নিজেকে মিসরের ‘প্রেসিডেন্ট’ দাবি করছেন—রাতে কী হবে কে জানে।
টেলিভিশন ভাষণে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়ে দিনটা শেষ হয় মোবারকের। যে জনগণকে তিনি এত ভালোবাসেন বলে দাবি করেন, সেই জনগণ আর তাঁকে মানছে না। বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ অথবা তাঁর নিজস্ব বাসভবন অভিমুখে ১০ লাখ লোকের মিছিল হবে। কিন্তু ২৪টি বিরোধী গোষ্ঠী মিলে তৈরি করা জোটের নেতারা পরে ভেবেছেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পুলিশের দিক থেকে আক্রমণের ঝুঁকি ব্যাপক। তাঁদের দাবি, তাহরির চত্বরের কাছেই তাঁরা এক ট্রাকভর্তি সশস্ত্র গুন্ডাকে ধরেছেন। মোবারক সমর্থক গুটিকয়েক লোক চিৎকার করছে ‘না মোবারক, না সুলেইমান, না ওবামা—কিন্তু আমেরিকাকে অপছন্দ নয়’। এর বাইরে আপনি শুনতে পাবেন, বিপ্লব আসছে। অথবা এটা কি শুধু এক গণ-অভ্যুত্থান? কিংবা নিছক এক গণবিস্ফোরণ?
মিসরে এখন যা ঘটছে তা অভূতপূর্ব। প্রথমেই চোখে পড়ে ঘটনাটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র। চাদর, নেকাব আর ওড়নাঢাকা মেয়েদের পাশেই হাঁটছে চুলখোলা মেয়েরা, ছাত্রের পাশেই হাঁটছে লম্বা দাড়ির ইমাম। ছেঁড়া স্যান্ডেলের গরিবের পাশেই হাঁটছে স্যুট পরা ধনী ব্যবসায়ী। যে মিসর আগে শ্রেণীবিভক্ত ছিল, ছিল ক্ষমতার দাপটে বিভক্ত, সেই মিসর এখন এক হয়েছে। এটাই সত্যিকারের মিসর। তারা সেই অসম্ভব ঘটিয়ে ফেলেছে—অথবা এটাই তারা ভাবছে। এবং একভাবে তারা তাদের সমাজবিপ্লবে জয়ী হয়েছে।
যে পাশ্চাত্যের অন্ধকারতম কোনাকাঞ্চিতে পর্যন্ত ‘ইসলামিজম’ তাড়া করে ফিরছে, আমেরিকা ও ইসরায়েল যাকে মদদ দিয়ে চলেছে, আশ্চর্যজনকভাবে মিসরের অভ্যুত্থানে তারা গরহাজির। ওদিকে আমার মোবাইল ফোন বেজেই চলেছে। প্রতিটি রেডিওর ঘোষক, প্রতিটি সংবাদকক্ষ জানতে চায় সেই পুরোনো প্রশ্নের উত্তর, এই মহাকাব্যিক গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে কি ইসলামিক ব্রাদারহুডের হাত রয়েছে? ব্রাদারহুডই কি আসছে মিসরের ক্ষমতায়? আমি তাদের সত্য জানিয়েছি। তাদের অনুমান সবই ভুয়া। যে দলটি নির্বাচনে মাত্র ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছে, আট কোটি জনসংখ্যার দেশে যাদের সদস্যসংখ্যা মাত্র দেড় লাখ, কী কারণে তাদের নিয়ে ভয় পেতে হবে?
এ রকমই একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় আমাকে ঘিরে থাকা ইংরেজি জানা মিসরীয়রা হাসিতে ফেটে পড়ল। আমি তখন বলছিলাম, ইসরায়েলের মহান পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে একসময় বলেছিলেন ‘মোবারক নরকে যাক’, মোবারক এখন সেই ঠিকানাতেই ধাবিত হচ্ছেন। অন্তত রাজনৈতিকভাবে। ঘটনার আকস্মিকতায় মানুষ অভিভূত। পাঁচ দিন আগে কায়রো জাদুঘরের পেছনে মোবারকের ঠ্যাঙ্গাড়ে পুলিশ আর নেশাখোর সাবেক কয়েদিদের দুর্বৃত্ত বাহিনীর কাঁদানে গ্যাসে কষ্ট পাচ্ছিলাম। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের মাথা-মুখ তারা গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল। অথচ আজ পরিস্থিতি কত আলাদা। সেটা যেন পাঁচ দিন নয়, পাঁচ মাস আগের কথা। সেই নিরস্ত্র জনতাই তাহরির চত্বর থেকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের তাড়িয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দিয়েছে। সে সময় তো এসব সাহসী মানুষের সমর্থনে কোনো পশ্চিমা নেতাকে মুখ খুলতে দেখিনি? এমনকি গতকালও নয়।
মজার ব্যাপার হলো, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মার্কিন-বিরোধিতার চেয়ে ওবামা ও হিলারির বিভিন্ন বাতিল মন্তব্য নিয়ে মশকরাই বেশি। ইশ! কায়রো সফরে এসে ওবামা যদি এই জঘন্য স্বৈরাচারীকে বিদায় নিতে বলতেন, তাহলে এখানে মিসরীয় পতাকার সঙ্গে মার্কিন পতাকাও উড়ত। তাহলে হয়তো অসম্ভবটাই ঘটত। আরবদের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ফিরে যেত ১৯২০-৩০ দশকের ভালো অবস্থায়। এমনকি ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দেওয়ার পরও ষাটের দশকেও আরব-আমেরিকা সম্পর্ক উষ্ণই ছিল। কিন্তু না, তা হওয়ার নয়। গত সাত দিনে ওয়াশিংটন শুধু কাপুরুষতাই দেখিয়েছে। আমরা পাশ্চাত্য সব সময় বলে এসেছি, আরবের নোংরা স্বৈরশাহিগুলোকে আমরা গণতন্ত্রে পরিণত করতে চাই। অথচ করেছি উল্টোটা। আমরাই এদের টিকিয়ে রেখেছি। আমরা চেয়েছি ‘স্থিতিশীলতা’, ‘আধুনিকায়ন’, ‘সংযম’, ‘দৃঢ়’ নেতৃত্ব, নমনীয় ‘সংস্কার’ এবং অনুগত মুসলমান। আর আরবরা চেয়েছে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। আজ মিসরে সেটাই তারা উদ্যাপন করছে।
‘ইসলামীকরণের’ মিথ্যা ভয়ের আড়ালে পাশ্চাত্যের নেতাদের নৈতিক ব্যর্থতাই সম্ভবত আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম ব্যর্থতা। মিসর পাশ্চাত্যবিরোধী ছিল না। এমনকি বিশেষ করে ইসরায়েলবিরোধীও নয়, যদিও এই মনোভাব বদলাতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের রোগ এমন এক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ধরেছে, যিনি ইসলামি দুনিয়ায় মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই দুনিয়ার মানুষ যখন গণতন্ত্র চাইছে, তখন সেই হাত দিয়েই তিনি তাদের হাত মোচড়াচ্ছেন।
এই ব্যর্থতা হয়তো আগামী দিনেও চলতে থাকবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মোবারকের পছন্দের মানুষ, সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান এবং ইসরায়েল-পসন্দ উপরাষ্ট্রপতি ওমর সুলেইমানকে সমর্থন দিচ্ছে। সুলেইমান সাহেব ইতিমধ্যে ‘সব পক্ষের’ সঙ্গে সংলাপের ডাক দিয়েছেন। এমনকি তাঁর গলাতেও শোনা যাচ্ছে ওবামার সুর। কিন্তু মিসরের সবাই জানে, তিনি হবেন আরেক সামরিক স্বৈরশাসক। তিনিও মোবারকের মতো তাঁর জনগণকে বলবেন বিশ্বাস করতে যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
এটা কি সম্ভব, এটা কি বিশ্বাস্য, ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রিয় মিসরীয়টি নাকি কোটি মানুষের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র ও মুক্তি তাদের উপহার দেবেন? কিংবা যে সেনাবাহিনী আজ জনতার প্রতি অনুগত, ওয়াশিংটনের দেওয়া বার্ষিক ১৩০ কোটি ডলারের সাহায্য এলেও তারা কি সেই গণতন্ত্রকে সমর্থন দিয়ে যাবে? এই সামরিক যন্ত্র গত ৩৮ বছরে কোনো যুদ্ধ লড়েনি। এদের কম প্রশিক্ষিত কিন্তু অতি অস্ত্রসজ্জিত। যদিও সেসব সমরাস্ত্র প্রধানত অকেজো। বড় বড় করপোরেট কোম্পানির ব্যবসাপাতি, আবাসন ও হোটেল ব্যবসার মধ্যে এরা গভীরভাবে নিমজ্জিত। মোবারক এভাবেই তাঁর প্রতি আনুগত্যের জন্য জেনারেলদের পুরস্কৃত করেন।
আর মার্কিনরা কী করছে? গুজব: ভাবী প্রেসিডেন্ট সুলেইমানের সঙ্গে বিরোধীদের মধ্যস্থতার জন্য মার্কিন কূটনীতিকেরা মিসরের পথে রওনা দিয়েছেন। গুজব: কায়রোর মার্কিন দূতাবাসকে হামলার হাত থেকে বাঁচাতে মার্কিন মেরিন সেনারা মিসরে ঢুকছে। বাস্তবতা: ওবামা শেষ পর্যন্ত মোবারককে বিদায় নিতে বলেছেন। বাস্তবতা: মিসরীয় সেনা পাহারায় বাকি সব মার্কিনকে কায়রোর ম্যারিয়ট হোটেল থেকে বিমানবন্দরে নেওয়া হচ্ছে। তারা পালাচ্ছে সেসব মানুষের ভয়ে, খুব সহজেই যাদের তারা বন্ধু করে নিতে পারত।
টুইটারে এক তরুণের কথা দিয়ে শেষ করি:
‘মৌলবাদের’ ভয়ে ভীত মুক্ত দুনিয়ার মানুষকে জানিয়ে দিতে চাই, মিসরে কোনো ইসলামি বিপ্লব ঘটছে না। সত্যিকার মুক্তি পেলে মিসরীয়রা কোনো চরম পন্থাকেই ক্ষমতা নিতে দেবে না।
লন্ডনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ
রবার্ট ফিস্ক: দি ইন্ডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি এবং আরব বিশেষজ্ঞ।
টেলিভিশন ভাষণে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়ে দিনটা শেষ হয় মোবারকের। যে জনগণকে তিনি এত ভালোবাসেন বলে দাবি করেন, সেই জনগণ আর তাঁকে মানছে না। বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ অথবা তাঁর নিজস্ব বাসভবন অভিমুখে ১০ লাখ লোকের মিছিল হবে। কিন্তু ২৪টি বিরোধী গোষ্ঠী মিলে তৈরি করা জোটের নেতারা পরে ভেবেছেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পুলিশের দিক থেকে আক্রমণের ঝুঁকি ব্যাপক। তাঁদের দাবি, তাহরির চত্বরের কাছেই তাঁরা এক ট্রাকভর্তি সশস্ত্র গুন্ডাকে ধরেছেন। মোবারক সমর্থক গুটিকয়েক লোক চিৎকার করছে ‘না মোবারক, না সুলেইমান, না ওবামা—কিন্তু আমেরিকাকে অপছন্দ নয়’। এর বাইরে আপনি শুনতে পাবেন, বিপ্লব আসছে। অথবা এটা কি শুধু এক গণ-অভ্যুত্থান? কিংবা নিছক এক গণবিস্ফোরণ?
মিসরে এখন যা ঘটছে তা অভূতপূর্ব। প্রথমেই চোখে পড়ে ঘটনাটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র। চাদর, নেকাব আর ওড়নাঢাকা মেয়েদের পাশেই হাঁটছে চুলখোলা মেয়েরা, ছাত্রের পাশেই হাঁটছে লম্বা দাড়ির ইমাম। ছেঁড়া স্যান্ডেলের গরিবের পাশেই হাঁটছে স্যুট পরা ধনী ব্যবসায়ী। যে মিসর আগে শ্রেণীবিভক্ত ছিল, ছিল ক্ষমতার দাপটে বিভক্ত, সেই মিসর এখন এক হয়েছে। এটাই সত্যিকারের মিসর। তারা সেই অসম্ভব ঘটিয়ে ফেলেছে—অথবা এটাই তারা ভাবছে। এবং একভাবে তারা তাদের সমাজবিপ্লবে জয়ী হয়েছে।
যে পাশ্চাত্যের অন্ধকারতম কোনাকাঞ্চিতে পর্যন্ত ‘ইসলামিজম’ তাড়া করে ফিরছে, আমেরিকা ও ইসরায়েল যাকে মদদ দিয়ে চলেছে, আশ্চর্যজনকভাবে মিসরের অভ্যুত্থানে তারা গরহাজির। ওদিকে আমার মোবাইল ফোন বেজেই চলেছে। প্রতিটি রেডিওর ঘোষক, প্রতিটি সংবাদকক্ষ জানতে চায় সেই পুরোনো প্রশ্নের উত্তর, এই মহাকাব্যিক গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে কি ইসলামিক ব্রাদারহুডের হাত রয়েছে? ব্রাদারহুডই কি আসছে মিসরের ক্ষমতায়? আমি তাদের সত্য জানিয়েছি। তাদের অনুমান সবই ভুয়া। যে দলটি নির্বাচনে মাত্র ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছে, আট কোটি জনসংখ্যার দেশে যাদের সদস্যসংখ্যা মাত্র দেড় লাখ, কী কারণে তাদের নিয়ে ভয় পেতে হবে?
এ রকমই একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় আমাকে ঘিরে থাকা ইংরেজি জানা মিসরীয়রা হাসিতে ফেটে পড়ল। আমি তখন বলছিলাম, ইসরায়েলের মহান পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে একসময় বলেছিলেন ‘মোবারক নরকে যাক’, মোবারক এখন সেই ঠিকানাতেই ধাবিত হচ্ছেন। অন্তত রাজনৈতিকভাবে। ঘটনার আকস্মিকতায় মানুষ অভিভূত। পাঁচ দিন আগে কায়রো জাদুঘরের পেছনে মোবারকের ঠ্যাঙ্গাড়ে পুলিশ আর নেশাখোর সাবেক কয়েদিদের দুর্বৃত্ত বাহিনীর কাঁদানে গ্যাসে কষ্ট পাচ্ছিলাম। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের মাথা-মুখ তারা গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল। অথচ আজ পরিস্থিতি কত আলাদা। সেটা যেন পাঁচ দিন নয়, পাঁচ মাস আগের কথা। সেই নিরস্ত্র জনতাই তাহরির চত্বর থেকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের তাড়িয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দিয়েছে। সে সময় তো এসব সাহসী মানুষের সমর্থনে কোনো পশ্চিমা নেতাকে মুখ খুলতে দেখিনি? এমনকি গতকালও নয়।
মজার ব্যাপার হলো, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মার্কিন-বিরোধিতার চেয়ে ওবামা ও হিলারির বিভিন্ন বাতিল মন্তব্য নিয়ে মশকরাই বেশি। ইশ! কায়রো সফরে এসে ওবামা যদি এই জঘন্য স্বৈরাচারীকে বিদায় নিতে বলতেন, তাহলে এখানে মিসরীয় পতাকার সঙ্গে মার্কিন পতাকাও উড়ত। তাহলে হয়তো অসম্ভবটাই ঘটত। আরবদের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ফিরে যেত ১৯২০-৩০ দশকের ভালো অবস্থায়। এমনকি ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দেওয়ার পরও ষাটের দশকেও আরব-আমেরিকা সম্পর্ক উষ্ণই ছিল। কিন্তু না, তা হওয়ার নয়। গত সাত দিনে ওয়াশিংটন শুধু কাপুরুষতাই দেখিয়েছে। আমরা পাশ্চাত্য সব সময় বলে এসেছি, আরবের নোংরা স্বৈরশাহিগুলোকে আমরা গণতন্ত্রে পরিণত করতে চাই। অথচ করেছি উল্টোটা। আমরাই এদের টিকিয়ে রেখেছি। আমরা চেয়েছি ‘স্থিতিশীলতা’, ‘আধুনিকায়ন’, ‘সংযম’, ‘দৃঢ়’ নেতৃত্ব, নমনীয় ‘সংস্কার’ এবং অনুগত মুসলমান। আর আরবরা চেয়েছে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। আজ মিসরে সেটাই তারা উদ্যাপন করছে।
‘ইসলামীকরণের’ মিথ্যা ভয়ের আড়ালে পাশ্চাত্যের নেতাদের নৈতিক ব্যর্থতাই সম্ভবত আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম ব্যর্থতা। মিসর পাশ্চাত্যবিরোধী ছিল না। এমনকি বিশেষ করে ইসরায়েলবিরোধীও নয়, যদিও এই মনোভাব বদলাতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের রোগ এমন এক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ধরেছে, যিনি ইসলামি দুনিয়ায় মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই দুনিয়ার মানুষ যখন গণতন্ত্র চাইছে, তখন সেই হাত দিয়েই তিনি তাদের হাত মোচড়াচ্ছেন।
এই ব্যর্থতা হয়তো আগামী দিনেও চলতে থাকবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মোবারকের পছন্দের মানুষ, সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান এবং ইসরায়েল-পসন্দ উপরাষ্ট্রপতি ওমর সুলেইমানকে সমর্থন দিচ্ছে। সুলেইমান সাহেব ইতিমধ্যে ‘সব পক্ষের’ সঙ্গে সংলাপের ডাক দিয়েছেন। এমনকি তাঁর গলাতেও শোনা যাচ্ছে ওবামার সুর। কিন্তু মিসরের সবাই জানে, তিনি হবেন আরেক সামরিক স্বৈরশাসক। তিনিও মোবারকের মতো তাঁর জনগণকে বলবেন বিশ্বাস করতে যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
এটা কি সম্ভব, এটা কি বিশ্বাস্য, ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রিয় মিসরীয়টি নাকি কোটি মানুষের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র ও মুক্তি তাদের উপহার দেবেন? কিংবা যে সেনাবাহিনী আজ জনতার প্রতি অনুগত, ওয়াশিংটনের দেওয়া বার্ষিক ১৩০ কোটি ডলারের সাহায্য এলেও তারা কি সেই গণতন্ত্রকে সমর্থন দিয়ে যাবে? এই সামরিক যন্ত্র গত ৩৮ বছরে কোনো যুদ্ধ লড়েনি। এদের কম প্রশিক্ষিত কিন্তু অতি অস্ত্রসজ্জিত। যদিও সেসব সমরাস্ত্র প্রধানত অকেজো। বড় বড় করপোরেট কোম্পানির ব্যবসাপাতি, আবাসন ও হোটেল ব্যবসার মধ্যে এরা গভীরভাবে নিমজ্জিত। মোবারক এভাবেই তাঁর প্রতি আনুগত্যের জন্য জেনারেলদের পুরস্কৃত করেন।
আর মার্কিনরা কী করছে? গুজব: ভাবী প্রেসিডেন্ট সুলেইমানের সঙ্গে বিরোধীদের মধ্যস্থতার জন্য মার্কিন কূটনীতিকেরা মিসরের পথে রওনা দিয়েছেন। গুজব: কায়রোর মার্কিন দূতাবাসকে হামলার হাত থেকে বাঁচাতে মার্কিন মেরিন সেনারা মিসরে ঢুকছে। বাস্তবতা: ওবামা শেষ পর্যন্ত মোবারককে বিদায় নিতে বলেছেন। বাস্তবতা: মিসরীয় সেনা পাহারায় বাকি সব মার্কিনকে কায়রোর ম্যারিয়ট হোটেল থেকে বিমানবন্দরে নেওয়া হচ্ছে। তারা পালাচ্ছে সেসব মানুষের ভয়ে, খুব সহজেই যাদের তারা বন্ধু করে নিতে পারত।
টুইটারে এক তরুণের কথা দিয়ে শেষ করি:
‘মৌলবাদের’ ভয়ে ভীত মুক্ত দুনিয়ার মানুষকে জানিয়ে দিতে চাই, মিসরে কোনো ইসলামি বিপ্লব ঘটছে না। সত্যিকার মুক্তি পেলে মিসরীয়রা কোনো চরম পন্থাকেই ক্ষমতা নিতে দেবে না।
লন্ডনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ
রবার্ট ফিস্ক: দি ইন্ডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি এবং আরব বিশেষজ্ঞ।
No comments