কণ্ঠস্বর-কালো বেড়ালের ঠিকানা by রাহাত খান
কালো বেড়াল কিন্তু শুধু রেলে নয়; সব মন্ত্রণালয়ে, সব পাবলিক সার্ভিসে, মায় বিচার বিভাগে রয়েছে। বহু বছর ধরে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ লুটপাট ও শোষণের একটা সিস্টেম আমাদের দিয়ে গিয়েছিল। এই সিস্টেমই কালো বেড়ালের মা।
স্বৈরাচারী কিংবা গণতন্ত্রী আমাদের দেশের কোনো সরকারই এই সিস্টেমে হাত দেয়নি। কোনো উদ্যোগ নেই কালো বেড়ালের জন্ম দেওয়া এই সিস্টেমটি বদলানোর কিংবা আমূল সংস্কারের। জানি কাজটা সহজ নয়
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলের কালো বেড়াল। বর্তমান সরকারের উচিত ছিল দুর্নীতির দায়ে তাকে সোজাসুজি বরখাস্ত করা। তা না করে সরকার যা করেছে তা অতিশয় ন্যক্কারজনক! সরকার প্রথমে তাকে (সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে) দিয়ে রেলমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করিয়েছে। তারপর বিরোধী দল, সুশীল সমাজের কতিপয় 'একতরফা' মতের খুব চালাক, খুব কৌশলী ব্যক্তি এবং কয়েকটি প্রচারমাধ্যমে পৈশাচিক আনন্দ (সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের কারণে) মাত্র শুরু হয়ে উৎসবানন্দে পরিণত হওয়ার আগেই, পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, আবার তাকে সরকারের দফতরবিহীন মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে! ছিঃ ছিঃ! মহাজোট সরকার এত খারাপ! এভাবে ইসলামের অপমান (আমিনীর ভাষায়) করা? রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রেফারির 'তর্জনী' ওঠে যাওয়ার পরও তাকে 'আউট' ঘোষণা না করা! ছিঃ ছিঃ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
বক্তব্যটি বিরোধী ও সন্দেহবাদীদের। শব্দ ও বাক্যগুলো আমার। পরিবেশনাও! তা আমি যখন লিখছি তখন লেখায় আমার ধরনটা তো থাকবেই। তবে পদত্যাগের পর সুরঞ্জিতের দফতরবিহীন মন্ত্রিত্বে বহাল হওয়ার দরুন উলি্লখিত দল ও মহলের আর্ত-হাহাকার ও প্রতিক্রিয়া যে ওই ধরনের ছিল এবং আছে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
আমার মতো অনেকেরই মত, সুরঞ্জিতের পদত্যাগ এবং সরকারের তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রীপদে বহাল করা দুটিই যথার্থ হয়েছে। দুর্নীতি করতে গিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত 'হাতেনাতে' ধরা পড়েছেন এটা সত্য নয়। ঘটনা পরম্পরায় দুর্নীতির দায় তার ওপর পড়েছে মাত্র। এই দায় বা অভিযোগ সত্য কি-না তা তদন্ত ও বিচারের আগেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত নয়। যুদ্ধাপরাধীদের হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ, স্বাধীনতাবিরোধিতা সবই যে বর্ণে বর্ণে সত্য তা তো আমার মতো অনেকে জানেন। তারপরও তো 'স্বচ্ছতা' ও 'ন্যায়বিচারের' স্বার্থে ১৯৭১ সালের ধর্মের ভেকধারী শয়তান-জঙ্গিদের বিচার করতে হচ্ছে। একজন জঙ্গি, একজন সন্ত্রাসী, সমাজের যে কোনো স্তরের ব্যক্তি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হলে তারও সুযোগ থাকে অভিযোগ সত্য কি-না তা আইন ও বিচারের ধারায় অগি্নশুদ্ধ করার।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তেমন কেউ তো নন। তিনি দীর্ঘ ৫৫ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এক ব্যক্তি। একজন সেরা সংবিধান বিশ্লেষক এবং পার্লামেন্টারিয়ান। বিরোধীদের না-হক বক্তব্যের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিতে তার জুড়ি নেই। অবশ্য এরপরও সত্যের খাতিরে বলতে হয়, একজন সেরা রাজনীতিবিদ, সেরা পার্লামেন্টারিয়ান হলেই তিনি দুর্নীতির ঊধর্ে্ব থাকবেনই_ এমন দাবি করা যায় না। সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর তেমন দাবি করার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। তবে অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই বা আইনের ধারায় বিচার না করে কাউকে সোজা ফাঁসি দেওয়ার বিধান বা দৃষ্টান্তও সভ্য দুনিয়ার কোথাও দেখা যায় না।
আমরা মনে করি, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর কিংবা কোনো দুর্ভাগ্যজনক বা বিধ্বংসী ঘটনা ঘটার পর দেশের চলতি সরকারের ভারপ্রাপ্ত বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির নৈতিক কারণে পদত্যাগ করাই উচিত। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সেই বিচারে ঠিক কাজটিই করেছেন। আর বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে মন্ত্রিসভায় দফতরবিহীন মন্ত্রী পদে বহাল রাখাটাও সরকারের জন্য অনৈতিক কিছু হয়নি বলে আমি মনে করি। বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে তো খানিকটা সম্মানজনক অবস্থান দেওয়াই যেতে পারে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুর্নীতি-সংক্রান্ত ঘটনাকে একটি অতিনাটকীয় রহস্য বলে মনে হয়। অভিযোগ আছে, দুর্নীতির বটবৃক্ষ হচ্ছেন রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা। মন্ত্রীর বরখাস্ত হওয়া এপিএসটিও দুর্নীতির বড় এক শিকারি। এদিকে কমান্ড্যান্ট এনামুল হক হঠাৎ বড় সাধু সেজে গেছেন! তিনি বলেছেন, গাড়িতে ঘুষের টাকা আছে আর মধ্য রাতে গাড়ির গন্তব্য কোথায়, এর কিছুই তার জানা ছিল না। একজন সরল, নিষ্পাপ, সৎ লোক আর কাকে বলে! তিনজনের একই মাইক্রোবাসে যাত্রা করা মধ্যরাতে_ সবই রহস্যপূর্ণ। এই তিন ব্যক্তি কোনো উদ্দেশ্যমূলক কারণে বা কোনো ষড়যন্ত্রের কুশীলব হিসেবে কাজ করছেন কি-না, সেই সত্যও উদ্ঘাটনের অপেক্ষা রাখে।
সবচেয়ে রহস্যপূর্ণ আধা-সামরিক বাহিনী বিজিবির ধানমণ্ডির দ্বিতীয় গলির গেট ঠিক রাত সাড়ে এগারোটা-পৌনে বারোটার দিকে হাট করে খোলা রাখাটা। প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তার প্রশ্ন তো রয়েছেই। এ ছাড়া কী উদ্দেশ্যে যা হওয়ার কথা না কোনোক্রমেই_ মধ্য রাতে সেই গেট খোলা রাখা হয়েছিল? বলতেই হয় একটা অতিনাটকীয় ঘটনা দৃশ্যপটে দেখা গেছে। ড্রাইভার আজমই বা কোথায়? বিজিবির রেকর্ডে কি আছে ভোরের দিকে গ্রেফতারকৃত সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে? চারজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়ে থাকলে ছাড়া পাওয়া বাকি তিনজন তো বলতে পারে ড্রাইভার আজম কোথায়। এ ব্যাপারে কেউই কোনো কথা বলছে না। তাই মনে হয়, মধ্যরাতে এ মন্ত্রীর বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করার কথাটা সত্য হতে পারে। সত্য না-ও হতে পারে। নিজেদের গা বাঁচানোর জন্যও তো এই 'মহান ব্যক্তি'রা অসত্য উক্তি উচ্চারণ করতে পারে। নাকি না পারাটা অসম্ভব কোনো ব্যাপার?
এই রহস্য নাটকের সত্য উদ্ঘাটন হওয়াটা জরুরি। প্রয়োজনবোধে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা উচিত সরকারের। এই ব্যাপারে কোনো বিচ্যুতি ধরা পড়লে এ জন্য সরকারকে দিতে হতে পারে চড়া দাম। এই ব্যাপারে তাই সততা প্রদর্শন ও সততা বজায় রাখার বিকল্প কিছু নেই।
একটি জাতীয় দৈনিকে সেদিনকার হেড লাইন ছিল_ 'কালো বেড়াল এখন রেলে।' পত্রিকার দৃষ্টি আকর্ষণকারী এই শিরোনামটি বর্ণে বর্ণে সত্য। দুর্নীতির ঘুণপোকা রেলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শুধু এখন নয়, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে শুরু হয়ে ধারাবাহিক এখন পর্যন্ত কোনো আমলে রেল দুর্নীতির বাইরে ছিল না। এখনও নেই।
আসলে বাংলাদেশে রেল ব্যবস্থা ধ্বংসের পেছনে একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বহুকাল ধরে কাজ করছে। আমাদের কৈশোরে এবং যৌবনের প্রথম দিক পর্যন্ত লোক যাতায়াত ও মাল পরিবহনের সেরা উপায় ছিল রেল ব্যবস্থা। ভ্রমণ ছিল আরামের। ভাড়া ছিল সবচেয়ে কম। লোক যাতায়াত ও মাল পরিবহন বাণিজ্যে সে সময় রেলের কোনো বিকল্প ছিল না। হঠাৎ এক সময় লক্ষ্য করা গেল রেল খাত শুধু যে ভয়াবহ লোকসানের গাড্ডায় পড়েছে তা-ই নয়, রেলে যাতায়াত সুবিধা কমে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বহু ছোট ও মাঝারি রেলস্টেশন। যেসব স্টেশনে যান্ত্রিক সিগন্যালের ব্যবস্থা নেই, সেখানে স্টেশন মাস্টার এবং তার সহকারী থাকা তো দূরের কথা, লণ্ঠনের আলো হাতে সিগন্যাল দেখাবার লোক পর্যন্ত নেই। বহু রেল বগি নষ্ট, ট্র্যাক নষ্ট, মেরামতের ব্যবস্থা নেই। ৯টার গাড়ি কয়টায় ছাড়ে তার ঠিক-ঠিকানা নেই কোনো। আর টিকিট? আছে, কিন্তু রেলের কাউন্টারে নয়, কালোবাজারে।
রেল ব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছিল, তবে রেলের বিশাল অঙ্কের বাজেট প্রতি বছর ঠিকই বরাদ্দ হয় বছরওয়ারি জাতীয় বাজেট। আর সেই বাজেটের টাকা নয়ছয় করার জন্য একশ্রেণীর রাজনীতিক ছাড়াও ছিল এবং আছে রেলের বেশিরভাগ আমলা, বেশিরভাগ ইঞ্জিনিয়ার, বেশিরভাগ রেল-ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার। একেবারে প্রকাশ্যে রেলের টাকা নিয়ে হরিলুট। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা খেয়ে খেয়ে চলেছে দুর্নীতির কালো বেড়াল। আসল বেড়াল কে বা কারা তা বোঝা দুঃসাধ্য নয়। তবে জবাবদিহিতা না থাকলে যা হয়! 'মিউ' ধরার উপায় ছিল না, কালো বেড়াল খেয়ে খেয়ে স্বাস্থ্যবান হয়েছে। ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারায় বাড়ি হয়েছে। একেকজন তার 'শ্বশুরের' টাকায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে এবং গ্রামের বাড়িতে আলিশান প্রাসাদ নির্মাণ করেছে। প্রত্যেক দুর্নীতিপরায়ণ আমলা ও প্রকৌশলীর ধনশালী শ্বশুর থাকে। থাকতেই হবে, উপায় কি?
ষড়যন্ত্র করে রেল ব্যবস্থা ধ্বংসের সুফল পায় কিছু কিছু মন্ত্রী অবশ্যই। এ ছাড়া একশ্রেণীর বাস-ট্রাক-লরির মালিক, আর আমলা প্রকৌশলীদের বেশিরভাগ তো আছেই। রেল ব্যবস্থা ধ্বংস হলে 'লক্ষ্মী' তো যাবে তাদের ঘরে। দেশ-জাতি গেল না থাকল, এটা তো দেশের সরকার ও বিরোধী দলের ব্যাপার। রাজনীতির ব্যাপার। কালো বেড়ালের কী? গত কয়েক যুগে রেলের লাখ লাখ কোটি টাকা গেছে কালো বেড়ালের পেটে। হ্যাঁ, গরিব জনগণের টাকা! কিন্তু কালো বেড়ালের চাই খাদ্য, চাই মাছ-কাঁটা, জনগণের ভালোমন্দ দেখবেন তো রাজনীতিবিদরা। কর্মশৈথিল্য, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে রেলের কত লাখ কোটি টাকার জমি ও সম্পদ বেহাত তা ভাবলেও মাথা ঘুরে যায়।
রেল ব্যবস্থা ধ্বংসের একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র অবশ্যই আছে। সেখানে কেউ হাত দিলেই বিপদ। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চার মাসের মন্ত্রিত্বের আমলে রেল ব্যবস্থার উন্নতি হতে শুরু করেছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়ে, কাউন্টারে টিকিট থাকে, সময়মতো গেলে টিকিট পাওয়া যায়। কোনো সন্দেহ নেই, রেলের ওপর মানুষের আস্থা একটু একটু করে হলেও ফিরে আসছিল।
তবে আমার এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য কারও পক্ষে ওকালতি করতে যাওয়া নয়। যা সত্য এবং সাধারণ মানুষও যা জানে, আমি সেটাই বলতে চাইছি। চাইছি রেল কেলেঙ্কারির হোতা কে বা কারা, তা নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে উদ্ঘাটিত হোক। দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা উপযুক্ত দণ্ড লাভ করুক।
আর একটা কথা না বললেই নয়। কালো বেড়াল কিন্তু শুধু রেলে নয়; সব মন্ত্রণালয়ে, সব পাবলিক সার্ভিসে, মায় বিচার বিভাগে রয়েছে। বহু বছর ধরে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ লুটপাট ও শোষণের একটা সিস্টেম আমাদের দিয়ে গিয়েছিল। এই সিস্টেমই কালো বেড়ালের মা। স্বৈরাচারী কিংবা গণতন্ত্রী আমাদের দেশের কোনো সরকারই এই সিস্টেমে হাত দেয়নি। কোনো উদ্যোগ নেই কালো বেড়ালের জন্ম দেওয়া এই সিস্টেমটি বদলানোর কিংবা আমূল সংস্কারের। জানি কাজটা সহজ নয়। ভিমরুলের চাকে ঢিল দিলে রক্ষা পাওয়া তো কঠিন। প্রশাসন সংস্কারের এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও জরুরি কাজটা হতে পারত জাতীয় স্বার্থে সরকার ও বিরোধী দল আলোচ্য ইস্যুতে একাত্ম হয়ে কাজ করতে পারলে। সেটা অদূর ভবিষ্যতে কিংবা দূরভবিষ্যতে সম্ভব হতে পারে কি-না জানি না, তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমনটা আশা করা নেহাতই দিবা স্বপ্নের শামিল।
কালো বেড়াল ধরা পড়বে না কোনোদিন, যতদিন দেশের রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে বিবেচনা এবং প্রশাসনে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং এর খোলনলচে বদলে দেওয়া না যায়। কালো বেড়ালের ঠিকানা : রাজনীতি ও প্রশাসন।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলের কালো বেড়াল। বর্তমান সরকারের উচিত ছিল দুর্নীতির দায়ে তাকে সোজাসুজি বরখাস্ত করা। তা না করে সরকার যা করেছে তা অতিশয় ন্যক্কারজনক! সরকার প্রথমে তাকে (সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে) দিয়ে রেলমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করিয়েছে। তারপর বিরোধী দল, সুশীল সমাজের কতিপয় 'একতরফা' মতের খুব চালাক, খুব কৌশলী ব্যক্তি এবং কয়েকটি প্রচারমাধ্যমে পৈশাচিক আনন্দ (সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের কারণে) মাত্র শুরু হয়ে উৎসবানন্দে পরিণত হওয়ার আগেই, পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, আবার তাকে সরকারের দফতরবিহীন মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে! ছিঃ ছিঃ! মহাজোট সরকার এত খারাপ! এভাবে ইসলামের অপমান (আমিনীর ভাষায়) করা? রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রেফারির 'তর্জনী' ওঠে যাওয়ার পরও তাকে 'আউট' ঘোষণা না করা! ছিঃ ছিঃ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
বক্তব্যটি বিরোধী ও সন্দেহবাদীদের। শব্দ ও বাক্যগুলো আমার। পরিবেশনাও! তা আমি যখন লিখছি তখন লেখায় আমার ধরনটা তো থাকবেই। তবে পদত্যাগের পর সুরঞ্জিতের দফতরবিহীন মন্ত্রিত্বে বহাল হওয়ার দরুন উলি্লখিত দল ও মহলের আর্ত-হাহাকার ও প্রতিক্রিয়া যে ওই ধরনের ছিল এবং আছে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
আমার মতো অনেকেরই মত, সুরঞ্জিতের পদত্যাগ এবং সরকারের তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রীপদে বহাল করা দুটিই যথার্থ হয়েছে। দুর্নীতি করতে গিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত 'হাতেনাতে' ধরা পড়েছেন এটা সত্য নয়। ঘটনা পরম্পরায় দুর্নীতির দায় তার ওপর পড়েছে মাত্র। এই দায় বা অভিযোগ সত্য কি-না তা তদন্ত ও বিচারের আগেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত নয়। যুদ্ধাপরাধীদের হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ, স্বাধীনতাবিরোধিতা সবই যে বর্ণে বর্ণে সত্য তা তো আমার মতো অনেকে জানেন। তারপরও তো 'স্বচ্ছতা' ও 'ন্যায়বিচারের' স্বার্থে ১৯৭১ সালের ধর্মের ভেকধারী শয়তান-জঙ্গিদের বিচার করতে হচ্ছে। একজন জঙ্গি, একজন সন্ত্রাসী, সমাজের যে কোনো স্তরের ব্যক্তি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হলে তারও সুযোগ থাকে অভিযোগ সত্য কি-না তা আইন ও বিচারের ধারায় অগি্নশুদ্ধ করার।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তেমন কেউ তো নন। তিনি দীর্ঘ ৫৫ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এক ব্যক্তি। একজন সেরা সংবিধান বিশ্লেষক এবং পার্লামেন্টারিয়ান। বিরোধীদের না-হক বক্তব্যের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিতে তার জুড়ি নেই। অবশ্য এরপরও সত্যের খাতিরে বলতে হয়, একজন সেরা রাজনীতিবিদ, সেরা পার্লামেন্টারিয়ান হলেই তিনি দুর্নীতির ঊধর্ে্ব থাকবেনই_ এমন দাবি করা যায় না। সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর তেমন দাবি করার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। তবে অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই বা আইনের ধারায় বিচার না করে কাউকে সোজা ফাঁসি দেওয়ার বিধান বা দৃষ্টান্তও সভ্য দুনিয়ার কোথাও দেখা যায় না।
আমরা মনে করি, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর কিংবা কোনো দুর্ভাগ্যজনক বা বিধ্বংসী ঘটনা ঘটার পর দেশের চলতি সরকারের ভারপ্রাপ্ত বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির নৈতিক কারণে পদত্যাগ করাই উচিত। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সেই বিচারে ঠিক কাজটিই করেছেন। আর বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে মন্ত্রিসভায় দফতরবিহীন মন্ত্রী পদে বহাল রাখাটাও সরকারের জন্য অনৈতিক কিছু হয়নি বলে আমি মনে করি। বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে তো খানিকটা সম্মানজনক অবস্থান দেওয়াই যেতে পারে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুর্নীতি-সংক্রান্ত ঘটনাকে একটি অতিনাটকীয় রহস্য বলে মনে হয়। অভিযোগ আছে, দুর্নীতির বটবৃক্ষ হচ্ছেন রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা। মন্ত্রীর বরখাস্ত হওয়া এপিএসটিও দুর্নীতির বড় এক শিকারি। এদিকে কমান্ড্যান্ট এনামুল হক হঠাৎ বড় সাধু সেজে গেছেন! তিনি বলেছেন, গাড়িতে ঘুষের টাকা আছে আর মধ্য রাতে গাড়ির গন্তব্য কোথায়, এর কিছুই তার জানা ছিল না। একজন সরল, নিষ্পাপ, সৎ লোক আর কাকে বলে! তিনজনের একই মাইক্রোবাসে যাত্রা করা মধ্যরাতে_ সবই রহস্যপূর্ণ। এই তিন ব্যক্তি কোনো উদ্দেশ্যমূলক কারণে বা কোনো ষড়যন্ত্রের কুশীলব হিসেবে কাজ করছেন কি-না, সেই সত্যও উদ্ঘাটনের অপেক্ষা রাখে।
সবচেয়ে রহস্যপূর্ণ আধা-সামরিক বাহিনী বিজিবির ধানমণ্ডির দ্বিতীয় গলির গেট ঠিক রাত সাড়ে এগারোটা-পৌনে বারোটার দিকে হাট করে খোলা রাখাটা। প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তার প্রশ্ন তো রয়েছেই। এ ছাড়া কী উদ্দেশ্যে যা হওয়ার কথা না কোনোক্রমেই_ মধ্য রাতে সেই গেট খোলা রাখা হয়েছিল? বলতেই হয় একটা অতিনাটকীয় ঘটনা দৃশ্যপটে দেখা গেছে। ড্রাইভার আজমই বা কোথায়? বিজিবির রেকর্ডে কি আছে ভোরের দিকে গ্রেফতারকৃত সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে? চারজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়ে থাকলে ছাড়া পাওয়া বাকি তিনজন তো বলতে পারে ড্রাইভার আজম কোথায়। এ ব্যাপারে কেউই কোনো কথা বলছে না। তাই মনে হয়, মধ্যরাতে এ মন্ত্রীর বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করার কথাটা সত্য হতে পারে। সত্য না-ও হতে পারে। নিজেদের গা বাঁচানোর জন্যও তো এই 'মহান ব্যক্তি'রা অসত্য উক্তি উচ্চারণ করতে পারে। নাকি না পারাটা অসম্ভব কোনো ব্যাপার?
এই রহস্য নাটকের সত্য উদ্ঘাটন হওয়াটা জরুরি। প্রয়োজনবোধে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা উচিত সরকারের। এই ব্যাপারে কোনো বিচ্যুতি ধরা পড়লে এ জন্য সরকারকে দিতে হতে পারে চড়া দাম। এই ব্যাপারে তাই সততা প্রদর্শন ও সততা বজায় রাখার বিকল্প কিছু নেই।
একটি জাতীয় দৈনিকে সেদিনকার হেড লাইন ছিল_ 'কালো বেড়াল এখন রেলে।' পত্রিকার দৃষ্টি আকর্ষণকারী এই শিরোনামটি বর্ণে বর্ণে সত্য। দুর্নীতির ঘুণপোকা রেলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শুধু এখন নয়, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে শুরু হয়ে ধারাবাহিক এখন পর্যন্ত কোনো আমলে রেল দুর্নীতির বাইরে ছিল না। এখনও নেই।
আসলে বাংলাদেশে রেল ব্যবস্থা ধ্বংসের পেছনে একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বহুকাল ধরে কাজ করছে। আমাদের কৈশোরে এবং যৌবনের প্রথম দিক পর্যন্ত লোক যাতায়াত ও মাল পরিবহনের সেরা উপায় ছিল রেল ব্যবস্থা। ভ্রমণ ছিল আরামের। ভাড়া ছিল সবচেয়ে কম। লোক যাতায়াত ও মাল পরিবহন বাণিজ্যে সে সময় রেলের কোনো বিকল্প ছিল না। হঠাৎ এক সময় লক্ষ্য করা গেল রেল খাত শুধু যে ভয়াবহ লোকসানের গাড্ডায় পড়েছে তা-ই নয়, রেলে যাতায়াত সুবিধা কমে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বহু ছোট ও মাঝারি রেলস্টেশন। যেসব স্টেশনে যান্ত্রিক সিগন্যালের ব্যবস্থা নেই, সেখানে স্টেশন মাস্টার এবং তার সহকারী থাকা তো দূরের কথা, লণ্ঠনের আলো হাতে সিগন্যাল দেখাবার লোক পর্যন্ত নেই। বহু রেল বগি নষ্ট, ট্র্যাক নষ্ট, মেরামতের ব্যবস্থা নেই। ৯টার গাড়ি কয়টায় ছাড়ে তার ঠিক-ঠিকানা নেই কোনো। আর টিকিট? আছে, কিন্তু রেলের কাউন্টারে নয়, কালোবাজারে।
রেল ব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছিল, তবে রেলের বিশাল অঙ্কের বাজেট প্রতি বছর ঠিকই বরাদ্দ হয় বছরওয়ারি জাতীয় বাজেট। আর সেই বাজেটের টাকা নয়ছয় করার জন্য একশ্রেণীর রাজনীতিক ছাড়াও ছিল এবং আছে রেলের বেশিরভাগ আমলা, বেশিরভাগ ইঞ্জিনিয়ার, বেশিরভাগ রেল-ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার। একেবারে প্রকাশ্যে রেলের টাকা নিয়ে হরিলুট। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা খেয়ে খেয়ে চলেছে দুর্নীতির কালো বেড়াল। আসল বেড়াল কে বা কারা তা বোঝা দুঃসাধ্য নয়। তবে জবাবদিহিতা না থাকলে যা হয়! 'মিউ' ধরার উপায় ছিল না, কালো বেড়াল খেয়ে খেয়ে স্বাস্থ্যবান হয়েছে। ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারায় বাড়ি হয়েছে। একেকজন তার 'শ্বশুরের' টাকায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে এবং গ্রামের বাড়িতে আলিশান প্রাসাদ নির্মাণ করেছে। প্রত্যেক দুর্নীতিপরায়ণ আমলা ও প্রকৌশলীর ধনশালী শ্বশুর থাকে। থাকতেই হবে, উপায় কি?
ষড়যন্ত্র করে রেল ব্যবস্থা ধ্বংসের সুফল পায় কিছু কিছু মন্ত্রী অবশ্যই। এ ছাড়া একশ্রেণীর বাস-ট্রাক-লরির মালিক, আর আমলা প্রকৌশলীদের বেশিরভাগ তো আছেই। রেল ব্যবস্থা ধ্বংস হলে 'লক্ষ্মী' তো যাবে তাদের ঘরে। দেশ-জাতি গেল না থাকল, এটা তো দেশের সরকার ও বিরোধী দলের ব্যাপার। রাজনীতির ব্যাপার। কালো বেড়ালের কী? গত কয়েক যুগে রেলের লাখ লাখ কোটি টাকা গেছে কালো বেড়ালের পেটে। হ্যাঁ, গরিব জনগণের টাকা! কিন্তু কালো বেড়ালের চাই খাদ্য, চাই মাছ-কাঁটা, জনগণের ভালোমন্দ দেখবেন তো রাজনীতিবিদরা। কর্মশৈথিল্য, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে রেলের কত লাখ কোটি টাকার জমি ও সম্পদ বেহাত তা ভাবলেও মাথা ঘুরে যায়।
রেল ব্যবস্থা ধ্বংসের একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র অবশ্যই আছে। সেখানে কেউ হাত দিলেই বিপদ। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চার মাসের মন্ত্রিত্বের আমলে রেল ব্যবস্থার উন্নতি হতে শুরু করেছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়ে, কাউন্টারে টিকিট থাকে, সময়মতো গেলে টিকিট পাওয়া যায়। কোনো সন্দেহ নেই, রেলের ওপর মানুষের আস্থা একটু একটু করে হলেও ফিরে আসছিল।
তবে আমার এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য কারও পক্ষে ওকালতি করতে যাওয়া নয়। যা সত্য এবং সাধারণ মানুষও যা জানে, আমি সেটাই বলতে চাইছি। চাইছি রেল কেলেঙ্কারির হোতা কে বা কারা, তা নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে উদ্ঘাটিত হোক। দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা উপযুক্ত দণ্ড লাভ করুক।
আর একটা কথা না বললেই নয়। কালো বেড়াল কিন্তু শুধু রেলে নয়; সব মন্ত্রণালয়ে, সব পাবলিক সার্ভিসে, মায় বিচার বিভাগে রয়েছে। বহু বছর ধরে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ লুটপাট ও শোষণের একটা সিস্টেম আমাদের দিয়ে গিয়েছিল। এই সিস্টেমই কালো বেড়ালের মা। স্বৈরাচারী কিংবা গণতন্ত্রী আমাদের দেশের কোনো সরকারই এই সিস্টেমে হাত দেয়নি। কোনো উদ্যোগ নেই কালো বেড়ালের জন্ম দেওয়া এই সিস্টেমটি বদলানোর কিংবা আমূল সংস্কারের। জানি কাজটা সহজ নয়। ভিমরুলের চাকে ঢিল দিলে রক্ষা পাওয়া তো কঠিন। প্রশাসন সংস্কারের এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও জরুরি কাজটা হতে পারত জাতীয় স্বার্থে সরকার ও বিরোধী দল আলোচ্য ইস্যুতে একাত্ম হয়ে কাজ করতে পারলে। সেটা অদূর ভবিষ্যতে কিংবা দূরভবিষ্যতে সম্ভব হতে পারে কি-না জানি না, তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমনটা আশা করা নেহাতই দিবা স্বপ্নের শামিল।
কালো বেড়াল ধরা পড়বে না কোনোদিন, যতদিন দেশের রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে বিবেচনা এবং প্রশাসনে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং এর খোলনলচে বদলে দেওয়া না যায়। কালো বেড়ালের ঠিকানা : রাজনীতি ও প্রশাসন।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments