আরব দুনিয়া-বিপ্লবী চেতনাকে কিসের ভয়? by স্লাভো জিজেক

তিউনিসিয়া ও মিসরের চলমান জনবিদ্রোহে মুসলিম মৌলবাদের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি নজরকাড়া। আরব জনগণের এই বিদ্রোহ বেশ ভালোভাবেই সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। এই বিদ্রোহ নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে, দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, মুক্তি আর অর্থনৈতিক আশাবাদের দাবিতে।


পশ্চিমা উদারপন্থীরা বিশ্বাস করে, আরব দুনিয়ায় সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সংবেদনশীলতা শুধু কিছু উদারপন্থী অভিজাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কেবল মৌলবাদ অথবা জাতীয়তাবাদ দ্বারাই চালিত হয়। পশ্চিমা উদারপন্থীদের এই নৈরাশ্যবাদী প্রজ্ঞা ইতিমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন বড় প্রশ্ন হলো, এরপর কী হবে? কে আবির্ভূত হবে বিজয়ীর বেশে?
তিউনিসের সাময়িক সরকার গঠনের সময় ইসলামপন্থী ও র‌্যাডিকেল বামপন্থীদের বাইরে রাখা হয়। আত্মতুষ্ট উদারপন্থীদের প্রতিক্রিয়া ছিল এমন—ভালো হয়েছে, এরা তো আসলে একই; দুই পক্ষই সমগ্রতাবাদী (টোটালিট্যারিয়ান) উগ্রপন্থী। কিন্তু বিষয়টি কি এতই সরল? ইসলামপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যেই কি দীর্ঘ মেয়াদে সত্যিকারের শত্রুতা নয়? কোন নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে তারা যদি সাময়িকভাবে একতাবদ্ধ হয়ও, তবু বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছালে এই একতা ভেঙে যাবে; তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে ভয়ংকর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে, অনেক সময় তা হবে তাদের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়েও নির্মম।
ইরানের গত নির্বাচনের পর তেমন লড়াই-ই তো আমরা দেখলাম, তাই না? মোসাভির হাজার হাজার সমর্থক রাজপথে জড়ো হওয়ার পেছনে ছিল খোমেনির বিপ্লবে ধারণ করা জনতার স্বপ্ন—মুক্তি ও ন্যায়বিচারের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন যদি ইউটোপীয়ও হয়, তবু তো তা উদ্দীপনা জাগিয়েছে রাজনৈতিক-সামাজিক সৃষ্টিশীলতায়, সাংগঠনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর জনগণের মধ্যে বিতর্কের শ্বাসরুদ্ধকর বিস্ফোরণে। গণজাগরণের এই সূচনা সমাজ রূপান্তরের অচেনা সব শক্তিকে অবারিত করে, তৈরি হয় এমন মুহূর্ত, যখন সবকিছুই সম্ভব মনে হয়েছিল। পরে ইসলামপন্থী ক্ষমতাসীনেরা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে সে জাগরণ দমাতে সক্ষম হয়।
এমনকি যে আন্দোলন স্পষ্টভাবেই মৌলবাদী, সেখানেও সামাজিক গঠন-উপাদানটি যাতে নজর না এড়ায়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়। তালেবানের নিয়ত উপস্থাপন মৌলবাদী গোষ্ঠী হিসেবে, যারা সন্ত্রাসের মাধ্যমে জনগণের ওপর শাসন চাপিয়ে দেয়। তবে ২০০৯ সালের গ্রীষ্মে তালেবান পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকা দখল করে নিলে নিউইয়র্ক টাইমস লেখে, ‘তারা অল্পসংখ্যক সম্পদশালী ভূস্বামী আর ভূমিহীন ভাগচাষিদের মধ্যকার গভীর ফাটল কাজে লাগিয়ে শ্রেণীবিদ্রোহ’ ঘটিয়েছিল। তালেবান যদি কৃষকদের অবস্থার ‘সুযোগ নিয়ে’ পাকিস্তানের জন্য হুঁশিয়ারি তৈরি করতে পারে, তাহলে পাকিস্তানের উদার গণতন্ত্রী আর যুক্তরাষ্ট্র কেন সামন্ত-সমাজের এ অবস্থার ‘সুযোগ নিয়ে’ ভূমিহীন কৃষকদের সহায়তা করছে না; তাদের কে বারণ করল? তবে কি পাকিস্তানের সামন্তশক্তিগুলো উদার গণতন্ত্রের স্বাভাবিক মিত্র হওয়াই আসল কারণ?
এখান থেকে অবধারিতভাবে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা হলো, মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলার বাম পন্থার অন্তর্ধানের উল্টো পিঠেই সর্বদা ইসলামপন্থীদের উত্থান। আফগানিস্তানকে যখন চরম ইসলামি মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরা হয়, তখন কি কারও মনে থাকে যে ৪০ বছর আগে এ দেশটিরই ছিল শক্তিশালী সেক্যুলার-ঐতিহ্য; ছিল শক্তিধর কমিউনিস্ট পার্টি—সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা ছাড়াই যে পার্টি স্বাধীনভাবে ক্ষমতাসীন হতে পেরেছিল? সেই সেক্যুলার-ঐতিহ্য কোথায় গেল?
এই পটভূমি মাথায় রেখে তিউনিসিয়া ও মিসরের (ও ইয়েমেন আর...হয়তো সৌদি আরবেরও) চলমান ঘটনাবলিকে পাঠ করা খুব জরুরি। শেষ পর্যন্ত যদি অল্প কিছু উদারপন্থী আলংকারিক পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে পুরোনো শাসকেরা টিকে যান আর স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, তাতে সৃষ্টি হবে অনতিক্রম্য মৌলবাদী বিরূপ প্রতিক্রিয়া। উদার পন্থার মৌল উত্তরাধিকার টিকিয়ে রাখতে উদারপন্থীদের দরকার র‌্যাডিকেল বামপন্থীদের ভ্রাতৃত্বসুলভ সহায়তা। মিসরের চলমান ঘটনাবলি নিয়ে অত্যন্ত নির্লজ্জ ও বিপজ্জনক সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন টনি ব্লেয়ার। সিএনএনের কাছ থেকে জানলাম, তিনি বলেছেন—পরিবর্তন আবশ্যক, কিন্তু সেটি হতে হবে স্থিতিশীল পরিবর্তন। এ মুহূর্তে মিসরে স্থিতিশীল পরিবর্তনের শুধু একটাই মানে হতে পারে—মোবারক বাহিনীর সঙ্গে আপস, যার মাধ্যমে শাসকশ্রেণীর বৃত্তের সামান্য বিস্তার। এ কারণেই এই মুহূর্তে শান্তিপূর্ণ পথে সংকট উত্তরণের কথাটি অশ্লীল শোনায়। বিরোধীদের দলনের মাধ্যমে মোবারক নিজেই সেই পথটাও অসম্ভব করে তুলেছেন। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সেনা নামানোর পর মোবারকের সামনে দুটি পথ খোলা—হয় আলংকারিক কোনো পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে অল্প কিছু পরিবর্তন এনে বাকি সব পরিবর্তন ঠেকানো অথবা ক্ষমতার সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছেদ।
মিসর এক ক্রান্তিকালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে: সত্যিকারের অবাধ নির্বাচনের মানে মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া (এক দশক আগে আলজেরিয়ায় যেমনটা ঘটেছিল), এ দাবি কেউ করতে পারে না। উদারপন্থীদের উদ্বেগের আরেক কারণ, মোবারক সরে গেলে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি নেই। এটা তো সত্যি, তেমন শক্তি নেই। মোবারক নিজেই বিরোধীদের দমন করে প্রান্তীয় করে রেখেছেন, শুধু শোভাবর্ধনে ব্যবহার করেছেন। মোবারক তা করেছেন যেন তাঁকে কেউ চ্যালেঞ্জ না করতে পারে। যেন তাঁর পর আর কেউ না থাকে। মোবারকের যুক্তি ছিল—হয় শুধু তিনি থাকবেন, নয়তো বিশৃঙ্খলা। এই যুক্তি আসলে তাঁরই বিরুদ্ধের যুক্তি।
পশ্চিমা উদারপন্থীদের কপটতা শ্বাসরুদ্ধকর। প্রকাশ্যে তারা গণতন্ত্রকে সমর্থন করে আর যখন জনগণ সেক্যুলার মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে (ধর্মের পক্ষে নয়) দাঁড়িয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে, তখন তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। মুক্তির সুযোগ যখন এল, তখন কেন তারা উদ্বিগ্ন, কেন আনন্দিত নয়? যেকোনো সময়ের চেয়ে এই মুহূর্তে মাও সে তুং-এর সেই পুরোনো কথাটি খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, ‘স্বর্গের মধ্যে বিরাট বিশৃঙ্খলা—পরিস্থিতিটা অসাধারণ।’
তাহলে মোবারকের জায়গা হবে কোথায়? উত্তরটা খুব স্পষ্ট —দ্য হেগে। সেখানে যাওয়ার উপযুক্ত কোনো নেতা যদি থেকে থাকেন, সেটা তিনিই।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
স্লাভো জিজেক: স্লোভেনীয় রাজনৈতিক দার্শনিক।

No comments

Powered by Blogger.