সাদাকালো-দেশ বিভাগের যন্ত্রণা কাঁটাতারের বাধা মানে না by আহমদ রফিক
বিভাজন যখন কৃত্রিম হয়, বিশেষত হয় শাসনকর্তাদের মর্জিমাফিক, তখন তা বড়ই যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাউন্টব্যাটেন, র্যাডক্লিফ প্রমুখ সাহেব-সুবোর কল্যাণে যখন ভারতবর্ষ নামক উপমহাদেশটিকে কাটাকুটি করে ফেলা হয়, তখন তার ফলাফল কারো জন্যই শুভ হয়নি।
তবে তরবারির কোপ প্রধানত পড়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবের ওপর, যেজন্য রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে জনবিচ্ছিন্নতা ঘটে।
পাঞ্জাবের সমস্যা ছিল ত্রিকোণ- তার মুসলমান, হিন্দু ও শিখ সদস্যদের নিয়ে, যদিও পাঞ্জাব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ। পাঞ্জাবি মুসলমান ও শিখ- উভয়ই যোদ্ধা জনগোষ্ঠী। তাদের রক্ত সর্বদাই গরম। তাদের হিসাবের বাইরে প্রিয় প্রদেশ বিভাগ, উঁহু, অসম্ভব। আসলে পাঞ্জাব ট্র্যাজেডির মূলে সেখানকার জনপ্রিয় রাজনীতিক-মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খানের অকাল মৃত্যু। তাঁর উত্তরসূরি খিজির হায়াত খান অবস্থা সামাল দিতে পারেননি, মি. জিন্নাহ্র জেদ ও একগুঁয়েমির কারণে, যা কিছুটা পেরেছিলেন সিকান্দার।
তাই দেশ ভাগ, প্রদেশ ভাগের আগেই শুরু হয়ে যায় রক্তের হোলিখেলা। আশঙ্কা ছিল প্রাদেশিক গভর্নর জেনকিনসের মনে। তাই তিনি ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন, 'এই প্রদেশ ভাগ করা হলে গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে চার ডিভিশন সৈন্য দরকার পড়বে।' জবাবে ভাইসরয় বলেছিলেন, জোর করে ভাগ করার ইচ্ছা তাঁর নেই। কিন্তু গোটা বিষয়টি নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতাদের ঐকমত্যের ওপর।
কিন্তু রাজনীতিবিদদের এত সদিচ্ছা থাকবে কেন? তাদের জেদ, স্বার্থ, অহমবোধ সবার ওপরে। কাজেই তাদের মধ্যে মতৈক্য দূর অস্ত। কাজেই যা ঘটার ঘটেছে। উপমহাদেশ ট্র্যাজেডির জন্য আমরা সংগত কারণেই শাসকদের দায়ী করি। কিন্তু অমানবিক ঘটনার ভয়াবহতার দায় সত্যি বলতে কি, রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের। অবশ্য সেই সঙ্গে হিন্দু মহাসভা ও শিখ সংগঠনগুলোর।
তাই ক্ষমতার হস্তান্তর পর্ব মধ্যিখানে রেখে নর-নারী-শিশু হত্যার মহোৎসব শুরু হয়ে যায় পাঞ্জাবি শিখ, মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই পর্ব শুরু করার দায় কৃপাণধারী শিখদের। দেশ বিভাগের ইতিহাস লেখক এইচ ভি হডসন কাব্যবাক্যাবলি সাজিয়ে লিখেন, 'ইন্ডিয়া পাকিস্তান যখন শান্তিপূর্ণ আনন্দ নিয়ে স্বাধীনতা দিবসের উৎসব উদ্যাপনে ব্যস্ত, পাঞ্জাবে সেই দিনটা ছিল হিংস্র সহিংসতা ও আতঙ্কের।' ঘটনা শুরু পূর্ব পাঞ্জাবে উচ্ছৃঙ্খল শিখ জনতার সহিংসতায়। তারপর যথারীতি এপার-ওপারে রক্তনদীর ঢেউ।
আর বঙ্গদেশ তথা বাংলা মূলত হিন্দু-মুসলমান অধিকারের দ্বন্দ্বে দিশেহারা। তাদের পুতুল নাচের খেলায় মাতিয়ে রেখেছেন রাজনৈতিক নেতারা। এখানেও ঠিক সেই লীগ-কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভা। সেক্যুলার নেতারা মাঠ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কল্যাণে কলকাতা হত্যাযজ্ঞ; নোয়াখালী, বিহার, ব্যস, বিদ্বেষ-ঘৃণা উপচে পড়তে থাকে। সহাবস্থান অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিভাজন অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।
এই কৃত্রিম বিভাজনের ছিল অনেক সমস্যা। একটি ঘনসংবদ্ধ অবস্থানকে যুক্তিসংগতভাবে ভাগ করা সত্যিই অসম্ভব ছিল- যেমন পাঞ্জাবে, ততোধিক বঙ্গে। স্বভাবতই যে নীতির দাবিতে বিভাজন, সেই নীতি বিভাজনের পরও রক্ষা করা যায়নি। তাই যে দাবি আদায়ের জন্য রক্তস্রোত, সেই দাবি আদায়ের পরও চলেছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত। র্যাডক্লিফ সাহেবের চৌদ্দ পুরুষ এলেও এই সমস্যার সমাধান সম্ভব ছিল না।
তাই যেমনটা আশঙ্কা করা গিয়েছিল, তেমনটাই ঘটেছে। র্যাডক্লিফ কাউকে, কোনো সম্প্রদায়কে তাঁর বাটোয়ারায় খুশি করতে পারেননি। পারবেনই বা কেমন করে, যদি কারো উঠানের ওপর দিয়ে সীমানারেখা চলে যায় কিংবা নিজের জমি ওপারে চাষ করতে গিয়ে সীমান্তরক্ষীর গুলি খেতে হয়। কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভূমি বা জলাশয়ের অধিকার হারাতে হয়। আমার দেখা গঙ্গাসাগর-কমলাসাগর অনেক উদাহরণের দুটো উদাহরণ। ট্রেনে যেতে যেতে দেখি, রেললাইনের ডানধারে কৃষক জমিতে চাষের কাজ করছে- সহযাত্রী বলেন, ওটা ভারতীয় বঙ্গ, ওরা ভারতীয় বাঙালি কৃষক। কোথায় যে ফারাক, চেহারা দেখে বুঝতে পারা যায় না।
তবু বিভাজন। তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাশা ও অহমবোধ নিয়ে জিন্নাত বুঝতে চাননি, কৃত্রিম বিভাজনে দুর্দশা বা দুঃখ বাড়বে বৈ কমবে না। একত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ কিভাবে পৃথক হবে? তাই মাওলানা আজাদ ভারতীয় মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছিলেন, মুসলমানদের বাসস্থান পাকিস্তানেও থেকে যাবে, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ যেমন পূর্ববঙ্গে। তেমনি পৃথক ভারতে থেকে যাবে কয়েক কোটি মুসলমান। তারা তো মনের দিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবে। তাহলে ভারত ভাগ করে পাকিস্তান গড়ায় সমস্যার সমাধান কোথায়? কিন্তু জিন্নাহ যুক্তির পথে হাঁটেননি।
সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। তাই ভারত ভাগ হলো। তার চেয়েও সর্বনাশা বিভাজন বাংলা ও পাঞ্জাবে। আর সেজন্যই সবচেয়ে বেশি রক্তপাত বঙ্গে, পাঞ্জাবে। সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান সিরিল র্যাডক্লিফের নিশ্চয়ই রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমানা ভাগ করে দিতে। বিশেষ করে বঙ্গের। অথবা মুচকি হেসে স্বগতোক্তি করেছিলেন- স্বাধীনতা চাইছো, দেখবে, কেমন লাগে স্বাধীনতার স্বাদ।
ভাগ হয় বঙ্গের জেলাগুলোর মধ্যে দিনাজপুর, জলপাইগুঁড়ি, মালদহ, নদীয়া এবং ছোট্ট করে রাজশাহীর প্রাকৃতিক বিভাজক নদীর কল্যাণে জিন্নাহ্র সম্প্রদায় বিভাজক নীতি মার খেয়ে যায় মুসলিমপ্রধান মুর্শিদাবাদ ভারতীয় বঙ্গে এবং হিন্দুপ্রধান খুলনা জেলা পাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে। কী কষ্ট বাস্তুহারা মানুষগুলোর! কে তার পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে শিকড় কেটে চলে যেতে চায়? তবু কখনো চলে যেতে হয়। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম? সেই কথা না বলাই ভালো। অঙ্গচ্ছেদ ঘটেছে সিলেটেরও।
র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী অখণ্ড বঙ্গদেশের ৩৬ শতাংশ এলাকা এবং ৩৫ শতাংশ অধিবাসী পশ্চিমবঙ্গের জন্য নির্ধারিত। সেখানে রয়েছে বাঙালি মুসলমানের ১৬ শতাংশ (বর্তমান হিসাব আমার জানা নেই)। অন্যদিকে, অমুসলিম জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ পূর্ববঙ্গে। বাস্তুত্যাগের হিড়িকে এবং পাকিস্তানি শাসকদের কল্যাণে এই শতাংশ হার ভয়ানকভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে একাত্তরে পাক বর্বরতার কারণে।
আমরা জানি, রাজনীতিবিদগণ জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ, মানব প্রতিনিধি। কিন্তু মানবিক চেতনা তাদের মধ্যে কতটা কাজ করে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। দেশ বিভাগের সময়কার অমানবিক ঘটনাবলি ও যুক্তিহীন কর্মকাণ্ড তেমনই প্রমাণ দেয়। প্রমাণ দেয় ভিসার বাধা, কাঁটাতারের বেড়া, সীমান্তরক্ষীর গুলি এবং অনুরূপ অনেক কিছুর।
রাজনৈতিক ঢাকের বাড়িতে তেতে ওঠা উন্মাদনা গত কয়েক দশকে অনেক উত্তাপ হারিয়েছে। হারিয়েছে অনেক দিন ধরেই, বিশেষভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে। শিক্ষিত এলিট শ্রেণী ও বিদগ্ধজন এদিক থেকে ব্যতিক্রম। কৃত্রিম কাটাকুটির ফলে সৃষ্ট ছিটমহলবাসী দুই রাষ্ট্রের মানুষ বোধ হয় সবচেয়ে বিপর্যস্ত। বিগত ৬৫ বছর ধরে তারা এক ধরনের অমানবিক জীবনযাপন করছে। তারা দেশ বিভাগ চেয়েছিল কি না আমরা জানি না। চেয়ে থাকলে আপন কর্মের ফল ভোগ করছে। আর না চেয়ে থাকলে রাজনীতিকদের পাপের বোঝা তাদের মাথায়।
এই যে দীর্ঘ মুখবন্ধ দেশ বিভাগের বিষক্রিয়া নিয়ে, এর কারণ, এই নববর্ষে তথা নব বৈশাখে কাগজে একটি সচিত্র প্রতিবেদন পাঠ। পঞ্চগড় থেকে পাঠানো সাইফুল আলম বাবুর সংবাদচিত্রটির জন্য তাঁকে ধন্যবাদ- 'উমহাক খুব দেখিবা মনটা চাহিছিল'। তা চাইবেই তো। চাওয়াটাই স্বাভাবিক। এমনই চাওয়ার টানে বিভক্ত জার্মানি এক হয়ে গেছে। অবশ্য বিশ্বরাজনীতি এর পেছনে কাজ করেছে। কৃত্রিমভাবে বিশ্বরাজনীতি ভাগ করেছে কোরিয়াকে। দুই কোরিয়ার মানুষও পরস্পরকে দেখতে চায় একই জাতিসত্তার সদস্য বিধায়।
সীমান্তের দুই পারের বাঙালিও আত্মীয়তা সূত্রে বা ভাষার মিলে পরস্পরকে দেখতে চায়- না-ই বা হলো দুই খণ্ডের ভৌগোলিক ঐক্য। বর্তমানে রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে অবস্থিত ভৌগোলিক ঐক্য দুই দিক থেকেই। কিন্তু সৌহার্দ্য প্রকাশে আপত্তি কোথায়। আপত্তি দূরে থাক, সৌহার্দ্যের আকাঙ্ক্ষা যথেষ্ট বলেই ভাসান উপলক্ষে এক দিনের মিলে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ দেখা যায়।
নানা উপলক্ষে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটে। তখন সীমান্তের কাঁটাতারের বাধা ব্যবধান তৈরি করে না। করে না বলেই পঞ্চগড় সীমান্তে কাঁটাতারের এপার-ওপারে দুই প্রতিবেশী দেশের মানুষের ভাব বিনিময়। পশ্চিমবঙ্গের পরাশনগর গ্রাম থেকে দিদি যমুনা ছুটে আসেন ঠাকুরগাঁওয়ের বাসিন্দা ছোট ভাই কৈলাশ বর্মণকে দেখতে, তার সঙ্গে দুটো কথা; সুখ-দুঃখের কথা বলতে। উপলক্ষ বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ।
ওপারে বর্ষীয়সী ননী বালা এপারের স্বজনদের দেখা পেয়ে চোখের জল ফেলেন। আক্ষেপ- 'মুই আর কতদিন বাঁচিম। মোর তানে ভগবানেরঠে তুমরাহলা পূজা দেন।'- এমনি কত আবেগঘন কথকতায় মুখর হয়ে ওঠে সীমান্ত। বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী এবং অন্যদিকে ভারতের জলপাইগুঁড়ি, শিলিগুঁড়ি ও কলকাতার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ২০ হাজার বিভিন্ন বয়সী মানুষ- নারী-পুরুষের সমাগম ঘটেছিল ওই সীমান্তে। হিসাবটা প্রতিবেদকের।
কিন্তু কাঁটাতারের তীক্ষ্ন বেড়া এসব আবেগের ধার ধারে না, বোঝেও না। যেমন বোঝে না সীমান্তরক্ষীর রাইফেলের নল। কেমন করে বুঝবে বা জানবে, আজ থেকে ৬৫ বছর আগে কিছু সংখ্যক পড়শি মানুষ পরস্পর থেকে ছিটকে পড়েছিল রাজনৈতিক ঝড়ের আঘাতে, এরপর সাম্প্রদায়িক বিষক্রিয়ার প্রভাবে। কিন্তু স্বজনপ্রীতির আবেগ উত্তরপুরুষকেও বহমান বলেই ভাবি ও জাতিসত্তার টান এড়ানো যায় না। এ টান সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রকট বিত্তবান বা এলিট শ্রেণীর তুলনায়।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি
পাঞ্জাবের সমস্যা ছিল ত্রিকোণ- তার মুসলমান, হিন্দু ও শিখ সদস্যদের নিয়ে, যদিও পাঞ্জাব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ। পাঞ্জাবি মুসলমান ও শিখ- উভয়ই যোদ্ধা জনগোষ্ঠী। তাদের রক্ত সর্বদাই গরম। তাদের হিসাবের বাইরে প্রিয় প্রদেশ বিভাগ, উঁহু, অসম্ভব। আসলে পাঞ্জাব ট্র্যাজেডির মূলে সেখানকার জনপ্রিয় রাজনীতিক-মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খানের অকাল মৃত্যু। তাঁর উত্তরসূরি খিজির হায়াত খান অবস্থা সামাল দিতে পারেননি, মি. জিন্নাহ্র জেদ ও একগুঁয়েমির কারণে, যা কিছুটা পেরেছিলেন সিকান্দার।
তাই দেশ ভাগ, প্রদেশ ভাগের আগেই শুরু হয়ে যায় রক্তের হোলিখেলা। আশঙ্কা ছিল প্রাদেশিক গভর্নর জেনকিনসের মনে। তাই তিনি ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন, 'এই প্রদেশ ভাগ করা হলে গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে চার ডিভিশন সৈন্য দরকার পড়বে।' জবাবে ভাইসরয় বলেছিলেন, জোর করে ভাগ করার ইচ্ছা তাঁর নেই। কিন্তু গোটা বিষয়টি নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতাদের ঐকমত্যের ওপর।
কিন্তু রাজনীতিবিদদের এত সদিচ্ছা থাকবে কেন? তাদের জেদ, স্বার্থ, অহমবোধ সবার ওপরে। কাজেই তাদের মধ্যে মতৈক্য দূর অস্ত। কাজেই যা ঘটার ঘটেছে। উপমহাদেশ ট্র্যাজেডির জন্য আমরা সংগত কারণেই শাসকদের দায়ী করি। কিন্তু অমানবিক ঘটনার ভয়াবহতার দায় সত্যি বলতে কি, রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের। অবশ্য সেই সঙ্গে হিন্দু মহাসভা ও শিখ সংগঠনগুলোর।
তাই ক্ষমতার হস্তান্তর পর্ব মধ্যিখানে রেখে নর-নারী-শিশু হত্যার মহোৎসব শুরু হয়ে যায় পাঞ্জাবি শিখ, মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই পর্ব শুরু করার দায় কৃপাণধারী শিখদের। দেশ বিভাগের ইতিহাস লেখক এইচ ভি হডসন কাব্যবাক্যাবলি সাজিয়ে লিখেন, 'ইন্ডিয়া পাকিস্তান যখন শান্তিপূর্ণ আনন্দ নিয়ে স্বাধীনতা দিবসের উৎসব উদ্যাপনে ব্যস্ত, পাঞ্জাবে সেই দিনটা ছিল হিংস্র সহিংসতা ও আতঙ্কের।' ঘটনা শুরু পূর্ব পাঞ্জাবে উচ্ছৃঙ্খল শিখ জনতার সহিংসতায়। তারপর যথারীতি এপার-ওপারে রক্তনদীর ঢেউ।
আর বঙ্গদেশ তথা বাংলা মূলত হিন্দু-মুসলমান অধিকারের দ্বন্দ্বে দিশেহারা। তাদের পুতুল নাচের খেলায় মাতিয়ে রেখেছেন রাজনৈতিক নেতারা। এখানেও ঠিক সেই লীগ-কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভা। সেক্যুলার নেতারা মাঠ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কল্যাণে কলকাতা হত্যাযজ্ঞ; নোয়াখালী, বিহার, ব্যস, বিদ্বেষ-ঘৃণা উপচে পড়তে থাকে। সহাবস্থান অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিভাজন অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।
এই কৃত্রিম বিভাজনের ছিল অনেক সমস্যা। একটি ঘনসংবদ্ধ অবস্থানকে যুক্তিসংগতভাবে ভাগ করা সত্যিই অসম্ভব ছিল- যেমন পাঞ্জাবে, ততোধিক বঙ্গে। স্বভাবতই যে নীতির দাবিতে বিভাজন, সেই নীতি বিভাজনের পরও রক্ষা করা যায়নি। তাই যে দাবি আদায়ের জন্য রক্তস্রোত, সেই দাবি আদায়ের পরও চলেছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত। র্যাডক্লিফ সাহেবের চৌদ্দ পুরুষ এলেও এই সমস্যার সমাধান সম্ভব ছিল না।
তাই যেমনটা আশঙ্কা করা গিয়েছিল, তেমনটাই ঘটেছে। র্যাডক্লিফ কাউকে, কোনো সম্প্রদায়কে তাঁর বাটোয়ারায় খুশি করতে পারেননি। পারবেনই বা কেমন করে, যদি কারো উঠানের ওপর দিয়ে সীমানারেখা চলে যায় কিংবা নিজের জমি ওপারে চাষ করতে গিয়ে সীমান্তরক্ষীর গুলি খেতে হয়। কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভূমি বা জলাশয়ের অধিকার হারাতে হয়। আমার দেখা গঙ্গাসাগর-কমলাসাগর অনেক উদাহরণের দুটো উদাহরণ। ট্রেনে যেতে যেতে দেখি, রেললাইনের ডানধারে কৃষক জমিতে চাষের কাজ করছে- সহযাত্রী বলেন, ওটা ভারতীয় বঙ্গ, ওরা ভারতীয় বাঙালি কৃষক। কোথায় যে ফারাক, চেহারা দেখে বুঝতে পারা যায় না।
তবু বিভাজন। তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাশা ও অহমবোধ নিয়ে জিন্নাত বুঝতে চাননি, কৃত্রিম বিভাজনে দুর্দশা বা দুঃখ বাড়বে বৈ কমবে না। একত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ কিভাবে পৃথক হবে? তাই মাওলানা আজাদ ভারতীয় মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছিলেন, মুসলমানদের বাসস্থান পাকিস্তানেও থেকে যাবে, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ যেমন পূর্ববঙ্গে। তেমনি পৃথক ভারতে থেকে যাবে কয়েক কোটি মুসলমান। তারা তো মনের দিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবে। তাহলে ভারত ভাগ করে পাকিস্তান গড়ায় সমস্যার সমাধান কোথায়? কিন্তু জিন্নাহ যুক্তির পথে হাঁটেননি।
সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। তাই ভারত ভাগ হলো। তার চেয়েও সর্বনাশা বিভাজন বাংলা ও পাঞ্জাবে। আর সেজন্যই সবচেয়ে বেশি রক্তপাত বঙ্গে, পাঞ্জাবে। সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান সিরিল র্যাডক্লিফের নিশ্চয়ই রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমানা ভাগ করে দিতে। বিশেষ করে বঙ্গের। অথবা মুচকি হেসে স্বগতোক্তি করেছিলেন- স্বাধীনতা চাইছো, দেখবে, কেমন লাগে স্বাধীনতার স্বাদ।
ভাগ হয় বঙ্গের জেলাগুলোর মধ্যে দিনাজপুর, জলপাইগুঁড়ি, মালদহ, নদীয়া এবং ছোট্ট করে রাজশাহীর প্রাকৃতিক বিভাজক নদীর কল্যাণে জিন্নাহ্র সম্প্রদায় বিভাজক নীতি মার খেয়ে যায় মুসলিমপ্রধান মুর্শিদাবাদ ভারতীয় বঙ্গে এবং হিন্দুপ্রধান খুলনা জেলা পাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে। কী কষ্ট বাস্তুহারা মানুষগুলোর! কে তার পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে শিকড় কেটে চলে যেতে চায়? তবু কখনো চলে যেতে হয়। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম? সেই কথা না বলাই ভালো। অঙ্গচ্ছেদ ঘটেছে সিলেটেরও।
র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী অখণ্ড বঙ্গদেশের ৩৬ শতাংশ এলাকা এবং ৩৫ শতাংশ অধিবাসী পশ্চিমবঙ্গের জন্য নির্ধারিত। সেখানে রয়েছে বাঙালি মুসলমানের ১৬ শতাংশ (বর্তমান হিসাব আমার জানা নেই)। অন্যদিকে, অমুসলিম জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ পূর্ববঙ্গে। বাস্তুত্যাগের হিড়িকে এবং পাকিস্তানি শাসকদের কল্যাণে এই শতাংশ হার ভয়ানকভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে একাত্তরে পাক বর্বরতার কারণে।
আমরা জানি, রাজনীতিবিদগণ জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ, মানব প্রতিনিধি। কিন্তু মানবিক চেতনা তাদের মধ্যে কতটা কাজ করে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। দেশ বিভাগের সময়কার অমানবিক ঘটনাবলি ও যুক্তিহীন কর্মকাণ্ড তেমনই প্রমাণ দেয়। প্রমাণ দেয় ভিসার বাধা, কাঁটাতারের বেড়া, সীমান্তরক্ষীর গুলি এবং অনুরূপ অনেক কিছুর।
রাজনৈতিক ঢাকের বাড়িতে তেতে ওঠা উন্মাদনা গত কয়েক দশকে অনেক উত্তাপ হারিয়েছে। হারিয়েছে অনেক দিন ধরেই, বিশেষভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে। শিক্ষিত এলিট শ্রেণী ও বিদগ্ধজন এদিক থেকে ব্যতিক্রম। কৃত্রিম কাটাকুটির ফলে সৃষ্ট ছিটমহলবাসী দুই রাষ্ট্রের মানুষ বোধ হয় সবচেয়ে বিপর্যস্ত। বিগত ৬৫ বছর ধরে তারা এক ধরনের অমানবিক জীবনযাপন করছে। তারা দেশ বিভাগ চেয়েছিল কি না আমরা জানি না। চেয়ে থাকলে আপন কর্মের ফল ভোগ করছে। আর না চেয়ে থাকলে রাজনীতিকদের পাপের বোঝা তাদের মাথায়।
এই যে দীর্ঘ মুখবন্ধ দেশ বিভাগের বিষক্রিয়া নিয়ে, এর কারণ, এই নববর্ষে তথা নব বৈশাখে কাগজে একটি সচিত্র প্রতিবেদন পাঠ। পঞ্চগড় থেকে পাঠানো সাইফুল আলম বাবুর সংবাদচিত্রটির জন্য তাঁকে ধন্যবাদ- 'উমহাক খুব দেখিবা মনটা চাহিছিল'। তা চাইবেই তো। চাওয়াটাই স্বাভাবিক। এমনই চাওয়ার টানে বিভক্ত জার্মানি এক হয়ে গেছে। অবশ্য বিশ্বরাজনীতি এর পেছনে কাজ করেছে। কৃত্রিমভাবে বিশ্বরাজনীতি ভাগ করেছে কোরিয়াকে। দুই কোরিয়ার মানুষও পরস্পরকে দেখতে চায় একই জাতিসত্তার সদস্য বিধায়।
সীমান্তের দুই পারের বাঙালিও আত্মীয়তা সূত্রে বা ভাষার মিলে পরস্পরকে দেখতে চায়- না-ই বা হলো দুই খণ্ডের ভৌগোলিক ঐক্য। বর্তমানে রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে অবস্থিত ভৌগোলিক ঐক্য দুই দিক থেকেই। কিন্তু সৌহার্দ্য প্রকাশে আপত্তি কোথায়। আপত্তি দূরে থাক, সৌহার্দ্যের আকাঙ্ক্ষা যথেষ্ট বলেই ভাসান উপলক্ষে এক দিনের মিলে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ দেখা যায়।
নানা উপলক্ষে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটে। তখন সীমান্তের কাঁটাতারের বাধা ব্যবধান তৈরি করে না। করে না বলেই পঞ্চগড় সীমান্তে কাঁটাতারের এপার-ওপারে দুই প্রতিবেশী দেশের মানুষের ভাব বিনিময়। পশ্চিমবঙ্গের পরাশনগর গ্রাম থেকে দিদি যমুনা ছুটে আসেন ঠাকুরগাঁওয়ের বাসিন্দা ছোট ভাই কৈলাশ বর্মণকে দেখতে, তার সঙ্গে দুটো কথা; সুখ-দুঃখের কথা বলতে। উপলক্ষ বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ।
ওপারে বর্ষীয়সী ননী বালা এপারের স্বজনদের দেখা পেয়ে চোখের জল ফেলেন। আক্ষেপ- 'মুই আর কতদিন বাঁচিম। মোর তানে ভগবানেরঠে তুমরাহলা পূজা দেন।'- এমনি কত আবেগঘন কথকতায় মুখর হয়ে ওঠে সীমান্ত। বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী এবং অন্যদিকে ভারতের জলপাইগুঁড়ি, শিলিগুঁড়ি ও কলকাতার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ২০ হাজার বিভিন্ন বয়সী মানুষ- নারী-পুরুষের সমাগম ঘটেছিল ওই সীমান্তে। হিসাবটা প্রতিবেদকের।
কিন্তু কাঁটাতারের তীক্ষ্ন বেড়া এসব আবেগের ধার ধারে না, বোঝেও না। যেমন বোঝে না সীমান্তরক্ষীর রাইফেলের নল। কেমন করে বুঝবে বা জানবে, আজ থেকে ৬৫ বছর আগে কিছু সংখ্যক পড়শি মানুষ পরস্পর থেকে ছিটকে পড়েছিল রাজনৈতিক ঝড়ের আঘাতে, এরপর সাম্প্রদায়িক বিষক্রিয়ার প্রভাবে। কিন্তু স্বজনপ্রীতির আবেগ উত্তরপুরুষকেও বহমান বলেই ভাবি ও জাতিসত্তার টান এড়ানো যায় না। এ টান সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রকট বিত্তবান বা এলিট শ্রেণীর তুলনায়।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি
No comments