টুকরো ক’টি বিষয় by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

গত ২৭ জানুয়ারি ২০১০-এর ‘সমকাল’ পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় ‘ভারতের চিঠি’ শিরোনামে ভারতীয় সাহিত্যিক জনাব আবুল বাশারের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখায় তিনি কাজের রাজনীতি এবং বিরোধিতার রাজনীতির প্রসঙ্গ এনেছেন যথাক্রমে কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ করে।

কলামের শেষে অবশ্য তিনি কংগ্রেসের মূল নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কথাও বলেছেন। সদ্য প্রয়াত সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা জ্যোতি বসুর মৃত্যু এবং তার মরদেহের প্রতি সম্মান জানানো—ও না জানানো প্রসঙ্গে জনাব বাশার লিখেছেন, ‘জ্যোতি বসুর মরদেহ দেশের জাতীয় পতাকায় মুড়িয়ে এই মহত্প্রাণ কমিউনিস্টকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে দেশ। মৃত নেতার মরদেহে শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে সোনিয়া এসেছিলেন বিধানসভায় এবং বসুর শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার জন্য মমতাকে সোনিয়া অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধ মমতার কাছে এসেছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। মমতা মনে করেছেন, এভাবে সোনিয়ার আসায় লাভ হয়েছে সিপিএম-এর। সোনিয়া মনে করেন, এ আসাটা রাজনৈতিক সৌজন্য। মমতা অসন্তুষ্ট। এ অসন্তোষ তার রাজনৈতিক কৌশল। মমতা গত ২৪ জানুয়ারি বসুর স্মরণসভায় আসেননি। তার দলও যায়নি।’ লেখাটি পড়তে পড়তে নিকট অতীতে বাংলাদেশের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। মরহুম সাইফুর রহমানের মৃত্যুতে শোক বার্তা পাঠিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তাছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে সাইফুর রহমান ছিলেন সবচেয়ে সফল অর্থমন্ত্রী। তার আকস্মিক মৃত্যুতে মমতাহীন ‘মমতার মতোই একটু রাজনৈতিক সৌজন্যও দেখাতে পারেননি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। মমতা তো ক্ষমতা প্রত্যাশী, কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত।’ তবু কেন?
দুই.
তখন বাংলাদেশ কেবল বিশ্বক্রিকেটে প্রবেশ করেছে। সেই সময় এক বিশ্বকাপে অঘটন ঘটিয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। আমি এ দেশেরই একশ্রেণীর মানুষকে দেখেছি, কিছুতেই যারা বাংলাদেশী ছেলেদের কৃতিত্ব দিতে পারেনি। পাকিস্তানের হেরে যাওয়াটা যেন তাদেরই লজ্জার বিষয়। শেষে যেন মুখ রক্ষার জন্য তারা বলতে থাকে—পাকিস্তান ছেড়ে দিয়েছে! বিশ্বকাপ ক্রিকেটে যে কেউ কাউকে ছেড়ে দেয় না, তা আমরা ভালোভাবেই জানি। আবার এর বিপরীত চিত্র দেখলাম, গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত যখন বাংলাদেশের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে প্রথম পর্বেই ছিটকে গেল তখন। এ দেশেরই আরেক শ্রেণীর মানুষের সে কি হাহাকার! ভারতীয় শো’বিজের এক তৃতীয় শ্রেণীর দেহসর্বস্ব মহিলা মনিকা বেদী—সারা বিশ্বকাপ জুড়ে এমন মাতম করেছে—যা দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশ দল যেন তাকে বিধবা করে দিয়েছে। সেই মাতমেরই ছায়া দেখেছি এ দেশি ভারতপন্থীদের চেহারায়, সর্বনাশ হয়ে গেছে যেন তাদেরও। নিজের দেশের বিজয় নিয়ে গৌরব করা তো দূরে থাক, পারলে তারা বাংলাদেশী ছেলেদের ক্রিকেট থেকেই বিদায় করে দিত। এই দুই দল, পাকিস্তানের পক্ষের কাওয়াল এবং ভারতের পক্ষের কীর্ত্তনীয়া, দু’দলই বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম দেশটির শত্রুপক্ষ। আমরা পাকিস্তান বা ভারতপন্থী চাই না। আমরা বাংলাদেশপন্থী চাই। এ দেশের সাধারণ মানুষ অবশ্যই বাংলাদেশপন্থী। তেমনি আমরা আমলা, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও বাংলাদেশপন্থী হিসেবে দেখতে চাই। কেউ যেন কোনো রাজনৈতিক নেতাকে পাকিস্তান বা ভারতপন্থী বলে গালি দিতে না পারে। হ্যাঁ, ‘গালি’ শব্দটিকে আমি সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি। কারণ, জনগণ তাদের নেতা বা নেত্রী বানিয়েছে নিজ দেশের জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে কাজ করতে। অন্য দেশের স্বার্থ-সংরক্ষণ করতে নয়। অন্য দেশপন্থী নেতা-নেত্রীর পক্ষে নিজের জনস্বার্থে কাজ করা সম্ভব হয় না। তাই ভিনদেশি পত্রপত্রিকা যখন আমাদের কোনো নেতা বা নেত্রীকে তাদেরপন্থী বলে শনাক্ত করে—আমরা তখন আতঙ্কে চমকে উঠি।
তিন.
শতভাগ সফল হওয়াটা এখন খুবই সম্ভব। যে পদ্ধতিতে এখন ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে সেই পদ্ধতির কথাই ধরা যাক। ছাত্র-ছাত্রীদের এখন টিকচিহ্ন দিতে হয়। আগে অনেক লিখতে হতো। প্রশ্নের উত্তর শুদ্ধ লিখলেও লেখায় বানান ভুলের জন্য নম্বর কাটা যেত। তাই শতভাগ সফল হওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব হতো না—একমাত্র অঙ্ক ছাড়া। এখন সম্ভব। প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন বা উত্তরপত্রে টিক দেয়ার জন্য যেটাকে নির্ধারিত করে দিয়েছেন সেটাতে টিকচিহ্ন দিতে পারলেই—ব্যাস, শতভাগ সফল। অতএব, শতভাগ সাফল্য নিয়ে বাক-বিতণ্ডার তো কোনো অবকাশ দেখি না। বিশেষ করে যেসব বিষয়, প্রশ্ন বা উত্তরপত্রে নেই, সেসব বিষয় যত গুরুত্বপূর্ণ, যত জীবনমরণ সমস্যারই হোক, তার জন্য তো টিক দেয়ার দায়িত্ব যার, তাকে দোষারোপ করা যায় না। এখন পদ্মার মৃত্যু বা তিস্তার হাহাকার, সীমান্তে নির্বিচারে মানুষ হত্যা বা চোরা কারবারে দেশ ভেসে যাওয়া—এসব বিষয় যদি সিলেবাসেই না থাকে তাহলে তা থেকে প্রশ্ন আসবেই বা কি করে? সিলেবাসে কি থাকবে তা তো সিলেবাস প্রণেতার উপরেই নির্ভর করে। যা থাকবে এবং প্রশ্নের যে উত্তর প্রশ্নকর্তার কাঙ্ক্ষিত হবে—সেখানে টিক দিলেই একশ’তে একশ’—শতভাগ সফল।
চার.
এই কিছুদিন আগে, ঢাকায়, বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা, একটি ত্রিদেশীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়ে গেল। টুর্নামেন্টের ফাইনালে বাংলাদেশ ছিল না। ছিল ভারত ও শ্রীলঙ্কা। মাঠে ভালোই দর্শক সমাগত হয়েছিল। আমরা টিভি পর্দায় দেখলাম, সমবেত দর্শকবৃন্দের তিন-চতুর্থাংশ শ্রীলঙ্কাকে সমর্থন দিচ্ছে মহাউল্লাসে। এরা শ্রীলঙ্কাপন্থী নন—ভারত বিরোধী। কিন্তু কেন? একটু গভীরে দৃষ্টি দিলেই এই কেন’র উত্তর পাওয়া যাবে। সীমান্তের ও পারের নয়, এপারের ভুক্তভোগী মানুষের গভীর অন্তর্জ্বালা। এই সাধারণ মানুষরা কৃতদাস বুদ্ধিজীবী নন, এরাই আমাদের প্রতিবাদকারী—প্রতিরোধকারী আগামী প্রজন্ম।
লেখক : কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.