স্বপ্ন কেন কেড়ে নেওয়া হবে
দারিদ্র্যপীড়িত এই দেশে কিছু মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন স্বপ্ন। মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। স্বপ্ন দেখত লিমনও। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের তরুণ লিমনের এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। চোখে স্বপ্ন ছিল তার_সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
ইটখোলায় কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোটানো লিমনেরও নিশ্চয়ই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন। পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষার্থীর আসনে বসার পরিবর্তে লিমন এখন শুয়ে আছে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। তাকে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সাংবাদিকদেরও তথ্য সংগ্রহের জন্য তার পাশে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর নির্দেশ আছে, কাউকে কাছে ভিড়তে দেওয়া যাবে না। লিমনের খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান গিয়েছিলেন সেখানে। দেখে এসেছেন, আহত মানবাধিকার শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান লিমনের হাসপাতালে আসার পেছনে একটি নয়, দুটি গল্প আছে। একটি গল্প লিমন এবং তার এলাকার মানুষের। মাঠে গরুকে ঘাস খাওয়াতে গিয়ে পথের একটি পাকা ব্রিজের ওপর বসে বিশ্রাম নেওয়ার সময় সেখানে র্যাব নামক আতঙ্কের আগমন। কোনো রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই লিমনকে সন্ত্রাসী হিসেবে গুলি করা হয়। ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে লিমনের চাচা আহত হন র্যাবের হাতে। গুলিবিদ্ধ লিমনকে প্রথমে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হয়। এখানে তার পা ঊরু থেকে কেটে ফেলা হয়। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে লিমন সম্পর্কে কোনো খারাপ তথ্য পাওয়া যায়নি। এলাকার মানুষ, স্কুলশিক্ষক, জনপ্রতিনিধি_সবাই বলেছেন, লিমন ভালো ছেলে। হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেটির বাবা দিনমজুর। নিজেও ইটখোলায় কাজ করে লেখাপড়ার খরচ জোগাত। লিমনকে নিয়ে দ্বিতীয় গল্পটি র্যাবের। গল্পটি সবারই জানা। র্যাব গঠনের সময় বেশ কায়দা করে এই গল্পটিও তৈরি হয়েছিল। ঘটনার স্থান-কাল-পাত্রের সঙ্গে এখন গল্পের চরিত্র শুধু বদলে যায়। একসময়কার 'ক্রসফায়ার' চরিত্র না বদলে 'এনকাউন্টার' হয়ে 'বন্দুকযুদ্ধ' হয়ে যায়। র্যাবের প্রতিটি 'ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার-বন্দুকযুদ্ধের' শানেনুজুল এ রকম_বাহিনীর সদস্যরা কোথাও সন্ত্রাসীদের ধরতে গিয়েছিলেন। সেখানে সন্ত্রাসীরা র্যাবের দিকে গুলি ছুড়লে দুই পক্ষে গুলিবিনিময় হয়। গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের কোনো একজনকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়। উদ্ধার করা হয় অস্ত্র ও গুলি। লিমনের ক্ষেত্রেও তেমনই একটি গল্প সাজানো হয়েছে। এই বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট খবর পেয়েই বাহিনীর সদস্যরা সেখানে গিয়েছিলেন। গুলিবিনিময় হয়েছে। র্যাব পাল্টা গুলি চালিয়েছে। স্থানীয় লোকদের দিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। র্যাবের এক কর্মকর্তা তো ঈশ্বরের কাছে এই বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, কেউ নিহত হয়নি। কেবলই গুলিবিদ্ধ হয়েছে একজন। র্যাবের কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে' আহত র্যাবকথিত 'সন্ত্রাসী'র ব্যাপারে খবর নিতেও তাই সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের বাধা দেওয়া হয়। ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমন হোসেনের ওপর র্যাবের নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও র্যাবের নিষ্ঠুরতার ঘটনা দ্রুত তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, লিমনের ঘটনায় প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি করা হবে। তবে র্যাবের নিজস্ব বিভাগীয় তদন্তদল আছে, তারাও তদন্ত করতে পারে। র্যাবের কর্মকাণ্ড নিয়ে এর আগেও অনেক তদন্ত হয়েছে। ধরা যাক, র্যাব দোষী প্রমাণিত হয়েই গেল। তখন কি লিমন ফেরত পেয়ে যাবে তার এই হারানো পা? কেন বারবার এমনটি হবে? কেন লিমনদের স্বপ্ন এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? 'লাইসেন্স টু কিল' নিয়ে কি র্যাব চলবে? নিরাপত্তা বাহিনীও কি আমাদের জন্য নিরাপদ হবে না?
No comments