রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অশনিসংকেত by এ এম এম শওকত আলী
প্রস্তাবিত নারীনীতি বাতিলের দাবিতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি আহূত হরতাল ৪ এপ্রিল হয়েছে। হরতালের সময় যেসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তা মিডিয়া প্রচার করেছে। এ হরতালে সংঘর্ষের ফলাফল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে নিঃসন্দেহে আশঙ্কাগ্রস্ত করেছে।
হরতালের একদিন আগে যশোরে এক মাদ্রাসাছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার সংবাদও ছিল। পুলিশ অবশ্য বলেছে যে তারা গুলি নয়, রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে। হরতালের দিন রাজধানীর বাইরেই সংঘর্ষের মাত্রা ছিল বেশি। নিরপেক্ষ সাধারণ নাগরিকরা তাণ্ডবের আধিক্যের মাত্রা যে এত হবে তা বুঝতে পারেনি। সরকারের ক্ষেত্রেও একই অনুমান সঠিক। কারণ হরতালের আগে কোনো প্রতিকারমূলক তৎপরতা দেখা যায়নি। এমনকি ঢাকার নিকটবর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জেও যে বড় ধরনের তাণ্ডব হবে, সেটাও কেউ আঁচ করতে পারেনি। ঘটনার ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, ফতোয়া নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ উচ্চ আদালত কর্তৃক ঘোষিত হওয়ার পরই একটি তথাকথিত ইসলামপন্থী দল প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করেছিল। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী দলটি এ ধরনের রায় সহজে মেনে নিতে চায়নি। রায়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি, কারণ এর বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। রায় চূড়ান্ত হওয়ার আগেই এর প্রকাশ্য বিরোধিতা করা নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত আচরণ। এ ধরনের আচরণ আইনের শাসনেরও পরিপন্থী।
নারীনীতির বিরোধিতার বিষয়টি কি নিছক রাজনৈতিক? ঘটনা প্রবাহে বলা যায় যে এ বিষয়টি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিরই অংশবিশেষ। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের পরবর্তী পর্যায়ে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। একই সঙ্গে একটি সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার কাজে লিপ্ত। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে সে বিষয়েও সরকারি মহল প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংসদে সংবিধান চূড়ান্ত হওয়ার আগেই কয়েকটি ইসলামপন্থী দল নারীনীতির বিষয় নিয়ে হরতালের ডাক দেয়। কাজেই দেখা যায়, ধর্ম নিয়েই রাজনীতি করতে তারা বদ্ধপরিকর। ধর্ম সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যাও যে অপব্যাখ্যা, সে বিষয়টিও সরকারসহ অনেকেই বলেছে।
ইতিমধ্যে একাধিক মিডিয়া সংবাদ প্রচার করা ছাড়াও সম্পাদকীয় লিখে হরতাল সমর্থকদের কার্যকলাপকে কোনো সমর্থন দেয়নি। এক বাক্যে বলা হয়েছে অযৌক্তিক ও বাড়াবাড়ির হরতাল_যা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। হরতাল সমর্থকদের একাংশ সাদা কাপড় পরে পবিত্র কোরআন বুকে বেঁধে মারমুখী হয়ে কর্মরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ওপর আক্রমণ করে_এ বিষয়টি ছিল দৃশ্যমান। এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের আচরণ দেখা গেল। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে এ ধরনের শক্তি ক্রমেই সক্রিয় হচ্ছে। সব হরতাল সমর্থকের হাতে লাঠি ছিল, যা সুযোগ পেলে তারা পুলিশের ওপর ব্যবহার করত। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যথেষ্ট সংযমের পরিচয় না দিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতো। টেলিভিশনে এমনো দৃশ্য দেখা গেছে যে জুডো-কারাতের কায়দায় অন্তত দুজন হরতাল সমর্থক পুলিশকে আক্রমণ করে। অতীতেও রাজনৈতিক দলের আহ্বানে হরতাল হয়েছে। হরতাল সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে। কিন্তু কর্তব্যরত পুলিশকে কেউ এভাবে আক্রমণ করেনি। পবিত্র কোরআন বুকে নিয়ে রাস্তায় নামার বিষয়ে মিডিয়ার একাংশ একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছে। সংঘর্ষের ফলে কোনো একপর্যায়ে অঘটন ঘটলে পবিত্র কোরআনকে অপবিত্র করার অভিযোগ করা সম্ভব ছিল। পবিত্র কোরআনসহ হরতাল সমর্থকদের পরিধেয় বস্ত্র দেখে অবশ্যই অনুমান করা যায় যে তারা নারীনীতি বাতিলের দাবিতে জিহাদ ঘোষণা করেছিল। জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ মধ্যযুগীয় মানসিকতা। সেটাই এখন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে ইসলামী শাসন কায়েমের সঙ্গে ইতিপূর্বে কিছু পথভ্রষ্ট গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও কার্যকলাপের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সেসব গোষ্ঠীর অধিকাংশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বিচারের সম্মুখীন, কিছু ক্ষেত্রে সাজাও হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একপর্যায়ে বলেছিলেন যে এসব গোষ্ঠী বর্তমানে সক্রিয় নয়। এ সত্ত্বেও সময় সময় এদের কর্মীরা জিহাদি বই ও বোমা এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে হাটহাজারী, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের তাণ্ডবের বিষয়টিই মিডিয়ায় প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ ওসব স্থানেই হরতাল সমর্থকরা সক্রিয় ছিল। বলা বাহুল্য, হাটহাজারীকে উগ্র ইসলামপন্থীদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে অতীতে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এ কারণে অতীতের চিহ্নিত ঘাঁটির ওপর পুলিশের নজরদারি অধিকতর সুসংহত করা প্রয়োজন। হরতালে নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর, পেট্রল পাম্পে আগুন, পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই ও থানায় হামলার ঘটনাও মিডিয়া প্রকাশ করেছে। একমাত্র হাটহাজারীতেই দেড় শতাধিক বাস ভাঙচুর করে পেট্রল পাম্পে আগুন লাগানো হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক।
মিডিয়ায় প্রকাশিত বিস্তারিত ঘটনার বিবরণে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হলো_বিভিন্ন স্থানে পেট্রল পাম্পে আগুন ধরিয়ে দেওয়া ছিল হরতাল সমর্থকদের লক্ষ্য। কারণ হাটহাজারী ছাড়াও অন্যান্য স্থানে, বিশেষ করে ফরিদপুরে হরতাল সমর্থকরা পেট্রল পাম্পেই প্রথমে আসে। দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ বাহিনী শতাধিক হরতাল সমর্থককে গ্রেপ্তার ও মামলা দায়ের করেছে। যত দ্রুত এসব মামলা প্রচলিত আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি হয়, ততই মঙ্গল।
চলমান ঘটনা প্রবাহের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সব জায়গায়ই মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীরা হরতালের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টির এ প্রচেষ্টা থেকে এদের শিক্ষার গুণগতমান সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। অতীতে যারা সশস্ত্র ইসলামিক বিপ্লবের নামে কাজ করেছে, তাদের বেশির ভাগই ছিল মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। এর অর্থ এই নয়, মাদ্রাসা প্রথা বিলুপ্ত করতে হবে। যে কাজটির প্রতি মনোযোগী হওয়া আবশ্যক তা হলো, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের আচরণ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক না হয়, তার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সার্বিকভাবে এ বিষয়টি ছাত্ররাজনীতিরই অংশ। এ জন্য সব দলকেই বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনকে রাজনীতিকায়ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
হরতালের ঘটনা সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, চারদলীয় জোটভুক্ত দলগুলো হরতালে প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলে তাদের অদৃশ্য সমর্থন ছিল। গত ৫ এপ্রিল এ উক্তির সমর্থন দেখা গেছে। রাজধানীতে জামায়াত ও পুলিশের সংঘর্ষে আহত হয়েছে ৩০ জন। জামায়াতের দাবি ছিল, দলের নেতাদের মুক্তি। নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। দাবি ভিন্নতর হলেও বিক্ষোভ মিছিলসহ অন্যান্য ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাজপথের রাজনীতি ও সহিংস ঘটনার মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রবণতার অব্যাহত চেষ্টার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলসহ সরকারের কৌশল কী তা জানা নেই। এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সর্বদলীয় সমঝোতা কি সম্ভব?
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হওয়ার অন্য কিছু বিষয়ও দৃশ্যমান। এক. সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থান। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সংশোধন। ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি, যা প্রধান বিরোধী দল করিডর মনে করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। চলমান বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকট। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে দুই দলের কিছুটা হলেও ভিন্ন্ন মত। এসবের সঙ্গে ভবিষ্যতে বারবার তীব্র আন্দোলনের হুঁশিয়ারি। প্রধান বিরোধী দল এ হুঁশিয়ারি অনেক দিন ধরেই দিচ্ছে। একটি ইসলামপন্থী দলের আহূত হরতালের পর দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলের হুমকি। জামায়াতের বিক্ষোভ। প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে জামায়াতের বর্তমানে সুম্পর্কের বিষয়ে অনেকে সন্দিহান হলেও সব আন্দোলনকারী দলই যে এক স্রোতে আসবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভুক্তভোগী হবে সাধারণ নিরীহ নাগরিক। তবে নাগরিকরাও এতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কারণ ১৯৯১-পরবর্তী সময় থেকেই হরতাল, সংসদ বর্জন ও ভাঙচুরের রাজনীতি ক্রমাগত দৃশ্যমান। নাগরিকরা অভ্যস্ত হলেও রাজনীতিবিদদের উপলব্ধি করা উচিত যে এ ধরনের রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত থাকলে তাঁরাও জনগণের আস্থা হারাবেন। অথবা রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে তারা একটি বিরূপ ধারণা পোষণ করবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
নারীনীতির বিরোধিতার বিষয়টি কি নিছক রাজনৈতিক? ঘটনা প্রবাহে বলা যায় যে এ বিষয়টি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিরই অংশবিশেষ। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের পরবর্তী পর্যায়ে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। একই সঙ্গে একটি সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার কাজে লিপ্ত। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে সে বিষয়েও সরকারি মহল প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংসদে সংবিধান চূড়ান্ত হওয়ার আগেই কয়েকটি ইসলামপন্থী দল নারীনীতির বিষয় নিয়ে হরতালের ডাক দেয়। কাজেই দেখা যায়, ধর্ম নিয়েই রাজনীতি করতে তারা বদ্ধপরিকর। ধর্ম সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যাও যে অপব্যাখ্যা, সে বিষয়টিও সরকারসহ অনেকেই বলেছে।
ইতিমধ্যে একাধিক মিডিয়া সংবাদ প্রচার করা ছাড়াও সম্পাদকীয় লিখে হরতাল সমর্থকদের কার্যকলাপকে কোনো সমর্থন দেয়নি। এক বাক্যে বলা হয়েছে অযৌক্তিক ও বাড়াবাড়ির হরতাল_যা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। হরতাল সমর্থকদের একাংশ সাদা কাপড় পরে পবিত্র কোরআন বুকে বেঁধে মারমুখী হয়ে কর্মরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ওপর আক্রমণ করে_এ বিষয়টি ছিল দৃশ্যমান। এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের আচরণ দেখা গেল। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে এ ধরনের শক্তি ক্রমেই সক্রিয় হচ্ছে। সব হরতাল সমর্থকের হাতে লাঠি ছিল, যা সুযোগ পেলে তারা পুলিশের ওপর ব্যবহার করত। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যথেষ্ট সংযমের পরিচয় না দিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতো। টেলিভিশনে এমনো দৃশ্য দেখা গেছে যে জুডো-কারাতের কায়দায় অন্তত দুজন হরতাল সমর্থক পুলিশকে আক্রমণ করে। অতীতেও রাজনৈতিক দলের আহ্বানে হরতাল হয়েছে। হরতাল সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে। কিন্তু কর্তব্যরত পুলিশকে কেউ এভাবে আক্রমণ করেনি। পবিত্র কোরআন বুকে নিয়ে রাস্তায় নামার বিষয়ে মিডিয়ার একাংশ একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছে। সংঘর্ষের ফলে কোনো একপর্যায়ে অঘটন ঘটলে পবিত্র কোরআনকে অপবিত্র করার অভিযোগ করা সম্ভব ছিল। পবিত্র কোরআনসহ হরতাল সমর্থকদের পরিধেয় বস্ত্র দেখে অবশ্যই অনুমান করা যায় যে তারা নারীনীতি বাতিলের দাবিতে জিহাদ ঘোষণা করেছিল। জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ মধ্যযুগীয় মানসিকতা। সেটাই এখন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে ইসলামী শাসন কায়েমের সঙ্গে ইতিপূর্বে কিছু পথভ্রষ্ট গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও কার্যকলাপের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সেসব গোষ্ঠীর অধিকাংশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বিচারের সম্মুখীন, কিছু ক্ষেত্রে সাজাও হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একপর্যায়ে বলেছিলেন যে এসব গোষ্ঠী বর্তমানে সক্রিয় নয়। এ সত্ত্বেও সময় সময় এদের কর্মীরা জিহাদি বই ও বোমা এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে হাটহাজারী, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের তাণ্ডবের বিষয়টিই মিডিয়ায় প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ ওসব স্থানেই হরতাল সমর্থকরা সক্রিয় ছিল। বলা বাহুল্য, হাটহাজারীকে উগ্র ইসলামপন্থীদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে অতীতে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এ কারণে অতীতের চিহ্নিত ঘাঁটির ওপর পুলিশের নজরদারি অধিকতর সুসংহত করা প্রয়োজন। হরতালে নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর, পেট্রল পাম্পে আগুন, পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই ও থানায় হামলার ঘটনাও মিডিয়া প্রকাশ করেছে। একমাত্র হাটহাজারীতেই দেড় শতাধিক বাস ভাঙচুর করে পেট্রল পাম্পে আগুন লাগানো হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক।
মিডিয়ায় প্রকাশিত বিস্তারিত ঘটনার বিবরণে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হলো_বিভিন্ন স্থানে পেট্রল পাম্পে আগুন ধরিয়ে দেওয়া ছিল হরতাল সমর্থকদের লক্ষ্য। কারণ হাটহাজারী ছাড়াও অন্যান্য স্থানে, বিশেষ করে ফরিদপুরে হরতাল সমর্থকরা পেট্রল পাম্পেই প্রথমে আসে। দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ বাহিনী শতাধিক হরতাল সমর্থককে গ্রেপ্তার ও মামলা দায়ের করেছে। যত দ্রুত এসব মামলা প্রচলিত আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি হয়, ততই মঙ্গল।
চলমান ঘটনা প্রবাহের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সব জায়গায়ই মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীরা হরতালের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টির এ প্রচেষ্টা থেকে এদের শিক্ষার গুণগতমান সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। অতীতে যারা সশস্ত্র ইসলামিক বিপ্লবের নামে কাজ করেছে, তাদের বেশির ভাগই ছিল মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। এর অর্থ এই নয়, মাদ্রাসা প্রথা বিলুপ্ত করতে হবে। যে কাজটির প্রতি মনোযোগী হওয়া আবশ্যক তা হলো, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের আচরণ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক না হয়, তার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সার্বিকভাবে এ বিষয়টি ছাত্ররাজনীতিরই অংশ। এ জন্য সব দলকেই বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনকে রাজনীতিকায়ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
হরতালের ঘটনা সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, চারদলীয় জোটভুক্ত দলগুলো হরতালে প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলে তাদের অদৃশ্য সমর্থন ছিল। গত ৫ এপ্রিল এ উক্তির সমর্থন দেখা গেছে। রাজধানীতে জামায়াত ও পুলিশের সংঘর্ষে আহত হয়েছে ৩০ জন। জামায়াতের দাবি ছিল, দলের নেতাদের মুক্তি। নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। দাবি ভিন্নতর হলেও বিক্ষোভ মিছিলসহ অন্যান্য ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাজপথের রাজনীতি ও সহিংস ঘটনার মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রবণতার অব্যাহত চেষ্টার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলসহ সরকারের কৌশল কী তা জানা নেই। এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সর্বদলীয় সমঝোতা কি সম্ভব?
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হওয়ার অন্য কিছু বিষয়ও দৃশ্যমান। এক. সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থান। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সংশোধন। ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি, যা প্রধান বিরোধী দল করিডর মনে করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। চলমান বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকট। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে দুই দলের কিছুটা হলেও ভিন্ন্ন মত। এসবের সঙ্গে ভবিষ্যতে বারবার তীব্র আন্দোলনের হুঁশিয়ারি। প্রধান বিরোধী দল এ হুঁশিয়ারি অনেক দিন ধরেই দিচ্ছে। একটি ইসলামপন্থী দলের আহূত হরতালের পর দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলের হুমকি। জামায়াতের বিক্ষোভ। প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে জামায়াতের বর্তমানে সুম্পর্কের বিষয়ে অনেকে সন্দিহান হলেও সব আন্দোলনকারী দলই যে এক স্রোতে আসবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভুক্তভোগী হবে সাধারণ নিরীহ নাগরিক। তবে নাগরিকরাও এতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কারণ ১৯৯১-পরবর্তী সময় থেকেই হরতাল, সংসদ বর্জন ও ভাঙচুরের রাজনীতি ক্রমাগত দৃশ্যমান। নাগরিকরা অভ্যস্ত হলেও রাজনীতিবিদদের উপলব্ধি করা উচিত যে এ ধরনের রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত থাকলে তাঁরাও জনগণের আস্থা হারাবেন। অথবা রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে তারা একটি বিরূপ ধারণা পোষণ করবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments