জ্যোতি বসুঃ যতদূর মনে পড়ে by ফাহমিদ - উর - রহমান
জ্যোতি বসুর কমিউনিজমে দীক্ষা প্রাপ্তি ঘটে বিলাতে বসে। জ্যোতি সেখানে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে। কিন্তু ব্যারিস্টারি পাঠের চেয়ে মানুষের মুক্তির এক মহত্তর উপলব্ধিও তাকে সম্ভবত টেনেছিল। সেই সূত্রেই তিনি মার্ক্সবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন।
বিলাতে তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা রজনী পামদত্ত, হারি পলিট, বেন ব্র্যাডলে প্রমুখের সাহচর্যে আসেন। এরাই তার চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করেন। জ্যোতি আরও প্রভাবিত হয়েছিলেন বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাসকির দ্বারা। গত শতাব্দীর ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে উচ্চবিত্ত বাঙালি হিন্দু পরিবারের অনেক তরুণ বিলাতে গিয়ে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নেন। এদের মধ্যে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিত গুপ্ত, ভূপেশ গুপ্তরা ছিলেন। বিলাতে না গেলে এরা হয়তো ওভাবে কমিউনিস্ট হয়ে দেশে ফিরতেন না। সচ্ছল পরিবারের এসব তরুণ সেদিন মার্ক্সবাদীতে রূপান্তরিত হয়ে মজলুম মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছিলেন, সেটা কোনো ছোট ঘটনা নয়। কী তারা করতে পেরেছিলেন, তার মূল্যায়ন ইতিহাসই করবে। তবে তারা মানুষের মুক্তির জন্য সমাজ পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন।
ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতা আজ হারিয়েছে। মানুষের মুক্তির জন্য এই আদর্শ নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি সৃষ্টি করতে পারবে না বলে আশঙ্কা হয়। কমিউনিজমের এই ব্যর্থতা জ্যোতি বসুকে ব্যক্তিগতভাবে বিচলিত করেছে বলে মনে হয় না। আমৃত্যু জ্যোতি ছিলেন একজন বিশ্বাসী কমিউনিস্ট। তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, নেতৃত্বের দূরদর্শিতা প্রভৃতির গুণে পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থীদের দুর্গ হিসেবে টিকে আছে এটা অস্বীকার করা যাবে না।
জ্যোতির পিতা নিশিকান্ত বসু ছিলেন চিকিত্সক। তার বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্তর্গত সোনারগাঁর বারদি গ্রামে। সেই হিসেবে তিনি ছিলেন পূর্ববাংলার সন্তান। যদিও জ্যোতির জন্ম কলকাতায়। কলকাতার মেট্টোপলিটন আবহাওয়ায় তার বেড়ে ওঠা। ওই কলকাতায় বসে তার রাজনৈতিক সাফল্য এবং অবশেষে জীবনাবসান।
ব্যারিস্টারি পাঠ শেষ করে জ্যোতি দেশে ফিরে আসলেও তিনি ওকালতি ব্যবসায় তেমন জড়াননি। তিনি তার আত্মকথায় লিখেছেন আত্মীয়-স্বজনের ইচ্ছা উপেক্ষা করে পার্টির নির্দেশে তিনি এক সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হন। এর বিনিময়ে পার্টি তাকে খোরপোষ বাবদ সামান্য কিছু মাসোহারা দিত। আদর্শের জন্য এ আত্মত্যাগকে ছোট করে দেখা যায় না। পার্টির প্রতি তার আনুগত্য ছিল অপরিসীম। এই আনুগত্যে তার কখনও ভাটা পড়েনি। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও। কমিউনিজম এমন একটা আদর্শ যে, তার কর্মীদের কাছ থেকে চূড়ান্ত আনুগত্য দাবি করে। এই আনুগত্য কখনও কখনও অন্ধত্বে পরিণত হয়। জ্যোতিকেও কি এই অন্ধত্ব গ্রাস করেছিল? এজন্য কি তাকেও কম মূল্য দিতে হয়নি? তার বড় নজির হচ্ছে ১৯৯৬ সালে ভারতের ইউনাইটেড ফ্রন্ট কোয়ালিশনে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি রাজি না হওয়ায় তিনি ওই পদে বসতে পারেননি। এভাবে কমিউনিস্টরা পুরো ভারত শাসনের একটা বড় সুযোগ হারায়, যাকে জ্যোতি বলেছিলেন ঐরংঃড়ত্রপ ইষঁহফবত্—ঐতিহাসিক ভুল। অবশ্য জ্যোতির সুহৃদরা মনে করেন বাঙালি হওয়ার অপরাধে তিনি দিল্লির মসনদে বসতে পারেননি। সর্বভারতীয় নেতৃত্ব চায়নি, দিল্লিতে একজন বাঙালি প্রধানমন্ত্রী চলে আসুক। এটা অবশ্য এখন কোনো রাখঢাকের বিষয় নয়, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভারতের প্রভুত উন্নতি হয়েছে সত্য, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের অবক্ষয়টাই বড় ঘটনা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। সেই যে গোখলে বলেছিলেন ডযধঃ ইবহমধষ ঃযরহশং ঃড়ফধু, ওহফরধ ঃযরহশং ঞড়সড়ত্ত্ড়—িসেই যুগ আর বাঙালি হিন্দুদের আসবে বলে মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষীরা আজ তাই যতখানি বাঙালি, তার চেয়ে অনেক বেশি ভারতীয়। তাদের জাতীয়তাবাদ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয় মোটেই। মূল কলকাতা আজ অবাঙালিদের শহর। সেখানে বাঙালিরা সংখ্যালঘু। এসব ঘটনা থেকে আমাদের প্রগতিশীল বাঙালি ভাবুকরা কিছুটা শিক্ষা নিতে পারেন। জ্যোতি তার জীবদ্দশায় ‘যতদূর মনে পড়ে’ বলে একটা আত্মচরিত লিখেছিলেন। বাজারে তার একটা অঁঃযড়ত্রুবফ ঠবত্ংরড়হ-এর জীবনীও পাওয়া যায়। শোনা যায় এই জীবনী বিশেষ করে আত্মচরিত্র প্রকাশের আগে কমিউনিস্ট পার্টির অনুমোদন প্রয়োজন হয়েছিল। পার্টি পরিপূর্ণ নিরাপদ মনে করার পরই আত্মচরিত প্রকাশের অনুমতি দেয়। এই কারণেই জ্যোতির আত্মচরিত-নীরস রাজনৈতিক ঘটনাবলীর একটা বিবরণ হয়ে উঠেছে মাত্র। উপ-মহাদেশের রাজনীতির অনেক মাথাওয়ালা ব্যক্তিই আত্মচরিত লিখেছেন। নেহরু, আজাদ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, চৌধুরী খালিকুজ্জামান, আবুল হাশিম, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখের রাজনৈতিক আত্মকথন কিন্তু স্রেফ রাজনৈতিক ঘটনার বিবরণী নয়। এটা সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনীতির একটা আকরগ্রন্থ হয়ে উঠেছে। জ্যোতির মতো একজন শিক্ষিত রাজনীতিকের আত্মজীবনী স্রেফ পার্টি আনুগত্যের কারণে অমূল্য হয়ে উঠতে পারেনি। জ্যোতি সংসদীয় রাজনীতিতে আসেন ১৯৪৬ সালে। জ্যোতির রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল রেলওয়ে শ্রমিকদের ভেতর কাজ করে। ১৯৪৬ সালে যুক্তবঙ্গের শেষ নির্বাচনে রেলওয়ে কর্মীদের নিয়ে গঠিত ইলেক্টোরাল কলেজ থেকে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে মোট তিনজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর দু’জন ছিলেন দার্জিলিং কেন্দ্রের রতন লাল ব্রাহ্মণ এবং দিনাজপুরের রূপনারায়ণ রায়। তবে এদের মধ্যে জ্যোতিই ছিলেন সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল। সংসদীয় রাজনীতিতে তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর ধারাবাহিকভাবে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তারপরও টানা ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রী। এ এক বড় সফলতার কাহিনী। বাগ্মী ও সংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। ৪৬-এর ওই নির্বাচনে জ্যোতির প্রতিপক্ষ ছিলেন কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর। কবীরকে পরাজিত করা সহজ ব্যাপার ছিল না। জ্যোতি সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।
১৯৪৬-এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দেশ ভাগ হয়ে যায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেটা একটা দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা ছিল, সন্দেহ নেই। কারণ, এর সঙ্গে মানুষের মৃত্যু, উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া, নারীর সম্ভ্রমহানির মতো ঘটনা জড়িয়ে আছে। ভারত বিভাগের জন্য এতকাল জিন্নাহ ও তার মুসলিম লীগকে একতরফা দায়ী করা হয়েছে। কংগ্রেসের শক্তিশালী মিডিয়া সুকৌশলে এ কাজটা করে। কিন্তু ইতিহাস তো চাপা রাখা যায় না। অধুনা ভারতেরই বড় বড় বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, সংস্কৃতিবান ব্যক্তিরা বলছেন দেশভাগের জন্য জিন্নাহ ও তার মুসলিম লীগ যতটা না দায়ী কংগ্রেস নেতারা তার চেয়ে অনেক বেশি দোষী। কংগ্রেস যদি ভারতবর্ষ বহু জাতির নয়, এক জাতির দেশ এই একগুয়ে অবস্থানে অনড় না থাকত এবং সেই স্বীকৃতির ভিত্তিতে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করত তাহলে দেশভাগ হতো না। এ ব্যাপারে যে কংগ্রেস দায়িত্ব এড়াতে পারবে না এটা ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত।
দেশভাগ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল বলে মনে হয়। দেশভাগের সাম্প্রদায়িক চরিত্র অনেক কমিউনিস্ট নেতাই সেদিন পুরোপুরি অতিক্রম করতে পারেননি। যদিও কমিউনিস্ট পার্টি গত শতকের চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। তাদের এই সমর্থনের পেছনে যুক্তি ছিল হিন্দু টিরানির সামনে মজলুম মুসলমানদের আত্মরক্ষার এই আন্দোলন যুক্তিসঙ্গত। এটাকে তারা শ্রেণী সংগ্রামের এক বিশেষ রূপ হিসেবে দেখেছিল। কমিউনিস্টরা বলত ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতার কথা। কিন্তু দেশভাগ হয়েছিল সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় ভিত্তিতে। দেখা গেল কোনো কোনো কমিউনিস্ট নেতা দেশভাগের এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকেই সমর্থন করে বসেছেন। এর মধ্যে জ্যোতি বসু ছিলেন অন্যতম। জ্যোতি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতারা বাংলা ভাগ চাননি। এমনকি জিন্নাহ সাহেবও নয়। কংগ্রেস চেয়েছিল। জ্যোতি বসু কংগ্রেসের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। জ্যোতি সোহরাওয়ার্দী-শরত্বসুর স্বাধীন অখণ্ড বাংলার ফর্মুলাকেও সমর্থন করেননি। জ্যোতি তার আত্মকথায় এসব কথা সুকৌশলে গোপন করেছেন। দেশভাগের প্রাক্কালে জ্যোতি কি পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক হতে পেরেছিলেন? সন্দেহ জাগে।
বঙ্গীয় কমিউনিস্টদের এই সাম্প্রদায়িকতার একটা ইতিহাস আছে। এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন যারা করেছিলেন তাদের অনেকেই ছিলেন গত শতাব্দীর ২০ ও ৩০-এর দশকের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। এ আন্দোলন ইংরেজ বিরোধী ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে মুসলিম বিদ্বেষীও ছিল। বঙ্গীয় কমউনিস্টদের এই সাম্প্রদায়িক বিশেষত্ব পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের কমিউনিস্টদের থেকে তাদের পৃথক করেছে। এ কারণেই আজও এদেশে কমিউনিস্টদের প্রধান প্রতিপক্ষ ইসলাম। আবার অনেক ক্ষেত্রেই তারা ইতিহাসের সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে কংগ্রেসের ইতিহাসের ব্যাখ্যাকে চোখ বুঝে সমর্থন করে গেছেন।
জ্যোতি তার স্মৃতিকথায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বার বার সুরাবর্দী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হিন্দু মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা মুসলমান নামগুলোকে বিকৃতভাবে উচ্চারণ করে—এ অভিযোগ অনেক পুরনো। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোনো ছোটখাটো নেতা নন। তিনি ছিলেন যুক্তবঙ্গের শেষ মুখ্যমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সে কালের হিন্দু মিডিয়া সুরাবর্দী বলে তাকে হেয় করার চেষ্টা করত। যেমন তত্কালীন মুসলিম লীগ সভাপতি আকরাম খাঁকে বলত আক্রমণ খাঁ। জ্যোতিও কি তাকে হেয় করতে চেয়েছেন? তার মতো শিক্ষিত ও রুচিশীল ব্যক্তির কাছে এরকম আশা করা কঠিন।
পশ্চিমবঙ্গের বামেরা যে অসাম্প্রদায়িক নন তার বড় নজির হচ্ছে সেখানকার মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা। সেখানে প্রায় তিন কোটি মুসলমানের বাস। অর্থাত্ পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। সেখানকার চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পসাহিত্য কোনো জায়গায়ই এই মজলুম মুসলমানদের অবস্থান দৃশ্যমান নয়। যে হিন্দু টিরানি থেকে বাঁচবার জন্য এক সময় মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলন করতে হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা তার থেকে আজও রেহাই পায়নি। ১৯৪৭ সালেও তাদের যে অবস্থা ছিল, একুশ শতকের সূচনাতেও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িকতা স্থূল প্রকৃতির, যা সহজেই চোখে লাগে। বামেদের সাম্প্রদায়িকতা সূক্ষ্ম, সহজে ধরা যায় না। ৩৩ বছরের বাম শাসনামলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি সত্য, কিন্তু মুসলমানদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকভাবে বাড়তেও দেয়া হয়নি। জ্যোতি কি এর দায় এড়াতে পারবেন? কমিউনিস্ট বলতে আমরা যে একটা বিপ্লবী চরিত্র বুঝি, জ্যোতি বোধ হয় সে রকম কিছু ছিলেন না। জ্যোতি অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, সফল সংগঠক ছিলেন যা অনেকটা লিবারেল বুর্জোয়া নেতাদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু একটা সমাজ বিপ্লব ঘটানোর জন্য যে মনমানসিকতার দরকার সেটা জ্যোতির ছিল না। এ কারণে জ্যোতি জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও ক্যাস্ট্রো বা চে’ গুয়েভারা হতে পারেননি। তিনি শুধু ভোটের রাজনীতি করেছেন। বিদ্যমান বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতার মধ্যে জ্যোতি ও তার দল কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা করেছেন তার মধ্যে বাস্তব বুদ্ধির একটা ব্যাপার থাকতে পারে, কিন্তু কমিউনিস্ট আদর্শের মাপকাঠিতে তা কতটা গ্রহণযোগ্য এটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে। বাস্তবতা বুঝে কাজ করা বড় নেতৃত্বের একটা গুণ। কমিউনিস্ট হিসেবে তিনি শ্রমজীবী-দরিদ্র মানুষের মুক্তির কথা অবশ্যই ভেবেছিলেন। কিন্তু ভারতের মানুষ কমিউনিজম গ্রহণ করতে পুরোপুরি প্রস্তুত কিনা, এটাও তাকে ভাবতে হয়েছিল। হয়তো সে কারণেই বুর্জোয়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কমিউনিজমের অদ্ভুত খিচুড়ি তিনি পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন, যা একেবারে নজিরবিহীন। তিনি একই সঙ্গে পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের কথা বলেছেন এবং উভয়ের মন যুগিয়ে চলেছেন। এর মধ্যে কোনো শ্রেণী-সংগ্রাম তিনি দেখতে পাননি। অবশ্য এর ফলে তার রাজনৈতিক ক্ষমতার বুনিয়াদ শক্ত হয়েছে। এটা কি স্ববিরোধিতা না সুবিধাবাদ, খাঁটি মার্ক্সবাদীরাই তার উত্তর ভালো করে দিতে পারবেন।
কংগ্রেস ও বিজেপির সঙ্গে লড়াই করে দীর্ঘ ৩৩ বছর পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে বামেরা—এটা সহজ ঘটনা নয়। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে এই দীর্ঘ সময়ে কিছু ভূমি সংস্কারের মতো কাজকর্ম ছাড়া কমিউনিস্টদের অর্জন নেই বললেই চলে। আর এই অর্জন পৃথিবীর অনেক দেশে লিবারেল বুর্জোয়া, জাতীয়তাবাদী এমনকি স্বৈরাচারী নেতারাও সফলতার সঙ্গে করেছেন।
তার পরেও জ্যোতি কেন এত জনপ্রিয়? বিপ্লবী চরিত্রের না হলেও তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান, সত্, নির্লোভ ও ত্যাগী নেতা। উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি যেভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, শ্রমিকদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন, ট্রামে-বাসে পার্টির পত্রিকা বিক্রি করেছেন তা কিন্তু সহজ ব্যাপার ছিল না। যে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা কমিউনিস্টরা বলে থাকেন, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও জ্যোতি তার কিছুটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। এ সবকিছুই তাকে গণমানুষের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। রাজনীতিকের জীবনে সফলতা-ব্যর্থতা উভয়ই থাকে। যেমন থাকে সব মানুষের। জ্যোতিও তার ব্যতিক্রম নন। এই সফলতা-ব্যর্থতার ভেতর দিয়েও জ্যোতি তার কমিউনিজমের আদর্শে অবিচল থেকেছেন এবং মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। এটাই বোধহয় জ্যোতির সবচেয়ে বড় অর্জন। তার চিন্তার সঙ্গে একমত না হতে পারলেও তার নিষ্ঠাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। তার মৃত্যুর পর এখানকার কিছু মিডিয়া প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তার ছিল নাড়ির টান। এটাকে সত্য বলে মেনে নেয়ার মতো কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তিনি পূর্ববঙ্গ ছেড়ে গিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গের মানুষের জন্য তিনি কোনো রাজনীতি করেননি। তার মনের মধ্যে অখণ্ড বাঙালিত্বের কোনো টান ছিল না। তিনি ছিলেন পুরোপুরি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। তাকে নিয়ে এ প্রচারণা নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। তাকে প্রশংসা করার মতো অনেক কিছু আছে। কিন্তু এই প্রচারণা তার ভাবমূর্তিকে খাটো করবে মাত্র।
ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতা আজ হারিয়েছে। মানুষের মুক্তির জন্য এই আদর্শ নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি সৃষ্টি করতে পারবে না বলে আশঙ্কা হয়। কমিউনিজমের এই ব্যর্থতা জ্যোতি বসুকে ব্যক্তিগতভাবে বিচলিত করেছে বলে মনে হয় না। আমৃত্যু জ্যোতি ছিলেন একজন বিশ্বাসী কমিউনিস্ট। তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, নেতৃত্বের দূরদর্শিতা প্রভৃতির গুণে পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থীদের দুর্গ হিসেবে টিকে আছে এটা অস্বীকার করা যাবে না।
জ্যোতির পিতা নিশিকান্ত বসু ছিলেন চিকিত্সক। তার বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্তর্গত সোনারগাঁর বারদি গ্রামে। সেই হিসেবে তিনি ছিলেন পূর্ববাংলার সন্তান। যদিও জ্যোতির জন্ম কলকাতায়। কলকাতার মেট্টোপলিটন আবহাওয়ায় তার বেড়ে ওঠা। ওই কলকাতায় বসে তার রাজনৈতিক সাফল্য এবং অবশেষে জীবনাবসান।
ব্যারিস্টারি পাঠ শেষ করে জ্যোতি দেশে ফিরে আসলেও তিনি ওকালতি ব্যবসায় তেমন জড়াননি। তিনি তার আত্মকথায় লিখেছেন আত্মীয়-স্বজনের ইচ্ছা উপেক্ষা করে পার্টির নির্দেশে তিনি এক সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হন। এর বিনিময়ে পার্টি তাকে খোরপোষ বাবদ সামান্য কিছু মাসোহারা দিত। আদর্শের জন্য এ আত্মত্যাগকে ছোট করে দেখা যায় না। পার্টির প্রতি তার আনুগত্য ছিল অপরিসীম। এই আনুগত্যে তার কখনও ভাটা পড়েনি। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও। কমিউনিজম এমন একটা আদর্শ যে, তার কর্মীদের কাছ থেকে চূড়ান্ত আনুগত্য দাবি করে। এই আনুগত্য কখনও কখনও অন্ধত্বে পরিণত হয়। জ্যোতিকেও কি এই অন্ধত্ব গ্রাস করেছিল? এজন্য কি তাকেও কম মূল্য দিতে হয়নি? তার বড় নজির হচ্ছে ১৯৯৬ সালে ভারতের ইউনাইটেড ফ্রন্ট কোয়ালিশনে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি রাজি না হওয়ায় তিনি ওই পদে বসতে পারেননি। এভাবে কমিউনিস্টরা পুরো ভারত শাসনের একটা বড় সুযোগ হারায়, যাকে জ্যোতি বলেছিলেন ঐরংঃড়ত্রপ ইষঁহফবত্—ঐতিহাসিক ভুল। অবশ্য জ্যোতির সুহৃদরা মনে করেন বাঙালি হওয়ার অপরাধে তিনি দিল্লির মসনদে বসতে পারেননি। সর্বভারতীয় নেতৃত্ব চায়নি, দিল্লিতে একজন বাঙালি প্রধানমন্ত্রী চলে আসুক। এটা অবশ্য এখন কোনো রাখঢাকের বিষয় নয়, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভারতের প্রভুত উন্নতি হয়েছে সত্য, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের অবক্ষয়টাই বড় ঘটনা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। সেই যে গোখলে বলেছিলেন ডযধঃ ইবহমধষ ঃযরহশং ঃড়ফধু, ওহফরধ ঃযরহশং ঞড়সড়ত্ত্ড়—িসেই যুগ আর বাঙালি হিন্দুদের আসবে বলে মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষীরা আজ তাই যতখানি বাঙালি, তার চেয়ে অনেক বেশি ভারতীয়। তাদের জাতীয়তাবাদ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয় মোটেই। মূল কলকাতা আজ অবাঙালিদের শহর। সেখানে বাঙালিরা সংখ্যালঘু। এসব ঘটনা থেকে আমাদের প্রগতিশীল বাঙালি ভাবুকরা কিছুটা শিক্ষা নিতে পারেন। জ্যোতি তার জীবদ্দশায় ‘যতদূর মনে পড়ে’ বলে একটা আত্মচরিত লিখেছিলেন। বাজারে তার একটা অঁঃযড়ত্রুবফ ঠবত্ংরড়হ-এর জীবনীও পাওয়া যায়। শোনা যায় এই জীবনী বিশেষ করে আত্মচরিত্র প্রকাশের আগে কমিউনিস্ট পার্টির অনুমোদন প্রয়োজন হয়েছিল। পার্টি পরিপূর্ণ নিরাপদ মনে করার পরই আত্মচরিত প্রকাশের অনুমতি দেয়। এই কারণেই জ্যোতির আত্মচরিত-নীরস রাজনৈতিক ঘটনাবলীর একটা বিবরণ হয়ে উঠেছে মাত্র। উপ-মহাদেশের রাজনীতির অনেক মাথাওয়ালা ব্যক্তিই আত্মচরিত লিখেছেন। নেহরু, আজাদ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, চৌধুরী খালিকুজ্জামান, আবুল হাশিম, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখের রাজনৈতিক আত্মকথন কিন্তু স্রেফ রাজনৈতিক ঘটনার বিবরণী নয়। এটা সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনীতির একটা আকরগ্রন্থ হয়ে উঠেছে। জ্যোতির মতো একজন শিক্ষিত রাজনীতিকের আত্মজীবনী স্রেফ পার্টি আনুগত্যের কারণে অমূল্য হয়ে উঠতে পারেনি। জ্যোতি সংসদীয় রাজনীতিতে আসেন ১৯৪৬ সালে। জ্যোতির রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল রেলওয়ে শ্রমিকদের ভেতর কাজ করে। ১৯৪৬ সালে যুক্তবঙ্গের শেষ নির্বাচনে রেলওয়ে কর্মীদের নিয়ে গঠিত ইলেক্টোরাল কলেজ থেকে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে মোট তিনজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর দু’জন ছিলেন দার্জিলিং কেন্দ্রের রতন লাল ব্রাহ্মণ এবং দিনাজপুরের রূপনারায়ণ রায়। তবে এদের মধ্যে জ্যোতিই ছিলেন সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল। সংসদীয় রাজনীতিতে তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর ধারাবাহিকভাবে তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তারপরও টানা ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রী। এ এক বড় সফলতার কাহিনী। বাগ্মী ও সংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। ৪৬-এর ওই নির্বাচনে জ্যোতির প্রতিপক্ষ ছিলেন কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর। কবীরকে পরাজিত করা সহজ ব্যাপার ছিল না। জ্যোতি সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।
১৯৪৬-এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দেশ ভাগ হয়ে যায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেটা একটা দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা ছিল, সন্দেহ নেই। কারণ, এর সঙ্গে মানুষের মৃত্যু, উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া, নারীর সম্ভ্রমহানির মতো ঘটনা জড়িয়ে আছে। ভারত বিভাগের জন্য এতকাল জিন্নাহ ও তার মুসলিম লীগকে একতরফা দায়ী করা হয়েছে। কংগ্রেসের শক্তিশালী মিডিয়া সুকৌশলে এ কাজটা করে। কিন্তু ইতিহাস তো চাপা রাখা যায় না। অধুনা ভারতেরই বড় বড় বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, সংস্কৃতিবান ব্যক্তিরা বলছেন দেশভাগের জন্য জিন্নাহ ও তার মুসলিম লীগ যতটা না দায়ী কংগ্রেস নেতারা তার চেয়ে অনেক বেশি দোষী। কংগ্রেস যদি ভারতবর্ষ বহু জাতির নয়, এক জাতির দেশ এই একগুয়ে অবস্থানে অনড় না থাকত এবং সেই স্বীকৃতির ভিত্তিতে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করত তাহলে দেশভাগ হতো না। এ ব্যাপারে যে কংগ্রেস দায়িত্ব এড়াতে পারবে না এটা ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত।
দেশভাগ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল বলে মনে হয়। দেশভাগের সাম্প্রদায়িক চরিত্র অনেক কমিউনিস্ট নেতাই সেদিন পুরোপুরি অতিক্রম করতে পারেননি। যদিও কমিউনিস্ট পার্টি গত শতকের চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। তাদের এই সমর্থনের পেছনে যুক্তি ছিল হিন্দু টিরানির সামনে মজলুম মুসলমানদের আত্মরক্ষার এই আন্দোলন যুক্তিসঙ্গত। এটাকে তারা শ্রেণী সংগ্রামের এক বিশেষ রূপ হিসেবে দেখেছিল। কমিউনিস্টরা বলত ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতার কথা। কিন্তু দেশভাগ হয়েছিল সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় ভিত্তিতে। দেখা গেল কোনো কোনো কমিউনিস্ট নেতা দেশভাগের এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকেই সমর্থন করে বসেছেন। এর মধ্যে জ্যোতি বসু ছিলেন অন্যতম। জ্যোতি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতারা বাংলা ভাগ চাননি। এমনকি জিন্নাহ সাহেবও নয়। কংগ্রেস চেয়েছিল। জ্যোতি বসু কংগ্রেসের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। জ্যোতি সোহরাওয়ার্দী-শরত্বসুর স্বাধীন অখণ্ড বাংলার ফর্মুলাকেও সমর্থন করেননি। জ্যোতি তার আত্মকথায় এসব কথা সুকৌশলে গোপন করেছেন। দেশভাগের প্রাক্কালে জ্যোতি কি পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক হতে পেরেছিলেন? সন্দেহ জাগে।
বঙ্গীয় কমিউনিস্টদের এই সাম্প্রদায়িকতার একটা ইতিহাস আছে। এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন যারা করেছিলেন তাদের অনেকেই ছিলেন গত শতাব্দীর ২০ ও ৩০-এর দশকের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। এ আন্দোলন ইংরেজ বিরোধী ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে মুসলিম বিদ্বেষীও ছিল। বঙ্গীয় কমউনিস্টদের এই সাম্প্রদায়িক বিশেষত্ব পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের কমিউনিস্টদের থেকে তাদের পৃথক করেছে। এ কারণেই আজও এদেশে কমিউনিস্টদের প্রধান প্রতিপক্ষ ইসলাম। আবার অনেক ক্ষেত্রেই তারা ইতিহাসের সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে কংগ্রেসের ইতিহাসের ব্যাখ্যাকে চোখ বুঝে সমর্থন করে গেছেন।
জ্যোতি তার স্মৃতিকথায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বার বার সুরাবর্দী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হিন্দু মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা মুসলমান নামগুলোকে বিকৃতভাবে উচ্চারণ করে—এ অভিযোগ অনেক পুরনো। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোনো ছোটখাটো নেতা নন। তিনি ছিলেন যুক্তবঙ্গের শেষ মুখ্যমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সে কালের হিন্দু মিডিয়া সুরাবর্দী বলে তাকে হেয় করার চেষ্টা করত। যেমন তত্কালীন মুসলিম লীগ সভাপতি আকরাম খাঁকে বলত আক্রমণ খাঁ। জ্যোতিও কি তাকে হেয় করতে চেয়েছেন? তার মতো শিক্ষিত ও রুচিশীল ব্যক্তির কাছে এরকম আশা করা কঠিন।
পশ্চিমবঙ্গের বামেরা যে অসাম্প্রদায়িক নন তার বড় নজির হচ্ছে সেখানকার মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা। সেখানে প্রায় তিন কোটি মুসলমানের বাস। অর্থাত্ পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। সেখানকার চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পসাহিত্য কোনো জায়গায়ই এই মজলুম মুসলমানদের অবস্থান দৃশ্যমান নয়। যে হিন্দু টিরানি থেকে বাঁচবার জন্য এক সময় মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলন করতে হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা তার থেকে আজও রেহাই পায়নি। ১৯৪৭ সালেও তাদের যে অবস্থা ছিল, একুশ শতকের সূচনাতেও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িকতা স্থূল প্রকৃতির, যা সহজেই চোখে লাগে। বামেদের সাম্প্রদায়িকতা সূক্ষ্ম, সহজে ধরা যায় না। ৩৩ বছরের বাম শাসনামলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি সত্য, কিন্তু মুসলমানদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকভাবে বাড়তেও দেয়া হয়নি। জ্যোতি কি এর দায় এড়াতে পারবেন? কমিউনিস্ট বলতে আমরা যে একটা বিপ্লবী চরিত্র বুঝি, জ্যোতি বোধ হয় সে রকম কিছু ছিলেন না। জ্যোতি অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, সফল সংগঠক ছিলেন যা অনেকটা লিবারেল বুর্জোয়া নেতাদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু একটা সমাজ বিপ্লব ঘটানোর জন্য যে মনমানসিকতার দরকার সেটা জ্যোতির ছিল না। এ কারণে জ্যোতি জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও ক্যাস্ট্রো বা চে’ গুয়েভারা হতে পারেননি। তিনি শুধু ভোটের রাজনীতি করেছেন। বিদ্যমান বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতার মধ্যে জ্যোতি ও তার দল কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা করেছেন তার মধ্যে বাস্তব বুদ্ধির একটা ব্যাপার থাকতে পারে, কিন্তু কমিউনিস্ট আদর্শের মাপকাঠিতে তা কতটা গ্রহণযোগ্য এটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে। বাস্তবতা বুঝে কাজ করা বড় নেতৃত্বের একটা গুণ। কমিউনিস্ট হিসেবে তিনি শ্রমজীবী-দরিদ্র মানুষের মুক্তির কথা অবশ্যই ভেবেছিলেন। কিন্তু ভারতের মানুষ কমিউনিজম গ্রহণ করতে পুরোপুরি প্রস্তুত কিনা, এটাও তাকে ভাবতে হয়েছিল। হয়তো সে কারণেই বুর্জোয়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কমিউনিজমের অদ্ভুত খিচুড়ি তিনি পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন, যা একেবারে নজিরবিহীন। তিনি একই সঙ্গে পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের কথা বলেছেন এবং উভয়ের মন যুগিয়ে চলেছেন। এর মধ্যে কোনো শ্রেণী-সংগ্রাম তিনি দেখতে পাননি। অবশ্য এর ফলে তার রাজনৈতিক ক্ষমতার বুনিয়াদ শক্ত হয়েছে। এটা কি স্ববিরোধিতা না সুবিধাবাদ, খাঁটি মার্ক্সবাদীরাই তার উত্তর ভালো করে দিতে পারবেন।
কংগ্রেস ও বিজেপির সঙ্গে লড়াই করে দীর্ঘ ৩৩ বছর পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে বামেরা—এটা সহজ ঘটনা নয়। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে এই দীর্ঘ সময়ে কিছু ভূমি সংস্কারের মতো কাজকর্ম ছাড়া কমিউনিস্টদের অর্জন নেই বললেই চলে। আর এই অর্জন পৃথিবীর অনেক দেশে লিবারেল বুর্জোয়া, জাতীয়তাবাদী এমনকি স্বৈরাচারী নেতারাও সফলতার সঙ্গে করেছেন।
তার পরেও জ্যোতি কেন এত জনপ্রিয়? বিপ্লবী চরিত্রের না হলেও তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান, সত্, নির্লোভ ও ত্যাগী নেতা। উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি যেভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, শ্রমিকদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন, ট্রামে-বাসে পার্টির পত্রিকা বিক্রি করেছেন তা কিন্তু সহজ ব্যাপার ছিল না। যে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা কমিউনিস্টরা বলে থাকেন, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও জ্যোতি তার কিছুটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। এ সবকিছুই তাকে গণমানুষের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। রাজনীতিকের জীবনে সফলতা-ব্যর্থতা উভয়ই থাকে। যেমন থাকে সব মানুষের। জ্যোতিও তার ব্যতিক্রম নন। এই সফলতা-ব্যর্থতার ভেতর দিয়েও জ্যোতি তার কমিউনিজমের আদর্শে অবিচল থেকেছেন এবং মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। এটাই বোধহয় জ্যোতির সবচেয়ে বড় অর্জন। তার চিন্তার সঙ্গে একমত না হতে পারলেও তার নিষ্ঠাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। তার মৃত্যুর পর এখানকার কিছু মিডিয়া প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তার ছিল নাড়ির টান। এটাকে সত্য বলে মেনে নেয়ার মতো কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তিনি পূর্ববঙ্গ ছেড়ে গিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গের মানুষের জন্য তিনি কোনো রাজনীতি করেননি। তার মনের মধ্যে অখণ্ড বাঙালিত্বের কোনো টান ছিল না। তিনি ছিলেন পুরোপুরি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। তাকে নিয়ে এ প্রচারণা নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। তাকে প্রশংসা করার মতো অনেক কিছু আছে। কিন্তু এই প্রচারণা তার ভাবমূর্তিকে খাটো করবে মাত্র।
No comments