ড. ইউনূস আমেরিকার কাছে এত প্রিয় কেন? by ড. গাজী সালেহ উদ্দিন

শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে বয়সজনিত কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে ৬০ বছর পর্যন্ত থাকা যাবে এবং পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশক্রমে বাংলাদেশ


ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েই ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু দীর্ঘ ১১ বছর গ্রামীণ ব্যাংক এ ধরনের উদ্যোগ না নিয়ে ড. ইউনূসকে তাঁর পদেই অধিষ্ঠিত রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস হাইকোর্টে রিট করেছেন, মহামান্য হাইকোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে রিট খারিজ করে দিয়েছেন।
ড. ইউনূসকে নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে পুঁজিবাদতন্ত্রের ধারক-বাহক রাষ্ট্রগুলোর নেতারা নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত সরাসরি ড. ইউনূসের পক্ষ নিয়ে পত্রিকা ও টেলিভিশনে বক্তব্য দিয়েছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক ড. ইউনূসের পক্ষে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন, সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করেছেন, বিরোধী দলের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেছেন। তিনি বলেছেন, 'ইউনূসের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা না হলে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে প্রভাব পড়বে।' এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সরাসরি বাংলাদেশ সরকারকে হুমকি দিয়েছেন, যার প্রতিফলন দেখতে পাই গত ২৫ মার্চ ইকোনমিস্ট পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধ পক্ষ অবলম্বন করে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে তারা ড. ইউনূসের বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করেছে (২৬ মার্চ, কালের কণ্ঠ)। হাইকোর্টে আবেদন খারিজ হওয়ার পর ড. ইউনূস সুপ্রিম কোর্টে রিট করেছেন, তাই মামলা চলাকালীন কোনো ধরনের মন্তব্য করা হাইকোর্ট অবমাননা হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের পদস্থ কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে হুমকি দিয়ে গেলেও তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হচ্ছে না। শুধু বাম ঘরানার কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং বিএনপি ড. ইউনূসের পক্ষাবলম্বন করে আমেরিকার সঙ্গে দহরম-মহরম শুরু করেছে (যদিও বিএনপি নেতারা ড. ইউনূসের তত্ত্বের কার্যাবলি সম্পর্কে আগে সমালোচনা করেছিলেন) শুধু আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। দেশের মানসম্মান বিদেশিদের কাছে বন্ধক দিয়ে হলেও ক্ষমতায় যেতে চায় তারা।
ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অবসর দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছুটা হলেও অস্থিরতা এসেছে। এই অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে যারা কলকাঠি নাড়ছে তারা হলো বর্তমান আমেরিকা সরকার। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের মানুষের ড. ইউনূসের সম্মান রক্ষা করার তাগিদের চেয়েও আমেরিকার তাগিদটা একটু বেশি বলেই মনে হয়েছে। এটা কি শুধু ইউনূসের সঙ্গে আজকের ক্ষমতাসীন সরকারের কারো কারো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, গ্রামীণ ব্যাংকের নারী সদস্যদের স্বার্থ রক্ষা, নাকি গ্রামীণ ব্যাংক যে পদ্ধতির মাধ্যমে পুঁজিবাদকে সমাজে পাকাপোক্ত করছে, তা টিকিয়ে রাখা? বলাবাহুল্য, ড. ইউনূস নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের জনগণকে আমেরিকার বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছেন, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমেরিকা তাদের স্বার্থ ছাড়া কখনো কোনো কিছু করেনি_আফগানিস্তান যুদ্ধ বলুন, ইরাক যুদ্ধ বলুন কিংবা বর্তমান লিবিয়া যুদ্ধ। যদিও তারা মুখে মানবতার কথা বলে থাকে, কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য নিজ স্বার্থসিদ্ধি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হিংস্র পাকিস্তানিরা নিরীহ বাঙালিদের হত্যা আর মা-বোনদের ইজ্জত লুট করছিল, তখন মানবতাবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সমর্থন করেছিল। একইভাবে আরব বিশ্বে মূল্যবান খনিজ সম্পদের পরিবর্তে মুলা কিংবা অন্য কোনো সামগ্রী পাওয়া গেলে কখনো আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে চিন্তা করত না।
এবার গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল ও তত্ত্বের কথায় আসা যাক। ড. ইউনূস ১৯৭৬ সালে জোবরা গ্রামে ক্ষুদ্রঋণের প্রকল্প শুরু করেন। ক্ষুদ্রঋণের এই ধারণা আরো আগে থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ছিল, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যাংকের মাধ্যমে গরিব কৃষকদের ঋণ দেওয়া। কুমিল্লা একাডেমীও এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল, তবে ইউনূসের এই তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য হলো_(ক) ঋণের জন্য ব্যাংকে ধরনা না দেওয়া, বরঞ্চ ব্যাংককে গ্রাহকের দোরগোড়ায় পেঁৗছা। ঋণ নিতে কোনো ধরনের সিকিউরিটি না দিয়ে দলীয়ভাবে অর্থ পরিশোধের দায়িত্ব দেওয়া। শুধু মহিলাদের ঋণ দেওয়া। ঋণগ্রহীতারা যে প্রকল্পের জন্য ঋণ নেবে সে সম্পর্কে ট্রেনিং নেওয়া।
বর্তমান বাংলাদেশে এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের কার্যক্রম চালু নেই। তবে এর মূল লক্ষ্য ছিল ব্যক্তির আর্থিক উন্নয়ন, ক্ষুদ্র পুঁজি দিয়ে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা, কিন্তু সেই লক্ষ্য এখন কার্যকর নেই। যেহেতু গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার অত্যন্ত বেশি, লগি্নকৃত অর্থ ফেরত নিশ্চিত, তাই বিভিন্ন এনজিও, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে যে মহাজনি ব্যবস্থা ছিল তার আধুনিক রূপ হলো এই 'ক্ষুদ্রঋণ' ব্যবস্থা। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। ফলে এই ঋণ যে একবার গ্রহণ করেছে সে সহজে এই বৃত্ত থেকে বের হওয়া কিংবা সহজে কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ, বেশির ভাগ গ্রাহক তার প্রাত্যহিক অভাব মেটাতে এই ঋণের টাকা ব্যবহার করছে। তাই একজন ব্যক্তি একের অধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছে এবং এক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের কিস্তি পরিশোধ করছে। এভাবে সে ঋণের বেড়াজালে আটকাচ্ছে এবং ক্রমেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। বিষয়টি এভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে একসময় কৃষি কাঠামোয় 'ভূমিদাস' প্রথার প্রচলন ছিল। এই ক্ষুদ্রঋণের ফলে বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজ কাঠামোয় 'ঋণদাস' প্রথা প্রবর্তিত হলো, যারা বংশপরম্পরায় এই ঋণের বেড়াজাল ভাঙতে পারবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ ঋণগ্রহীতার মৃত্যু হলেও ওই ঋণ তার পরিবারকে শোধ করতে হয়। এমন অনেক উদাহরণ বাংলাদেশে বিদ্যমান।
ষাটের দশকে চীনের গণ-কমিউন পদ্ধতি বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। গণ-কমিউনের তত্ত্বের মূল বক্তব্য ছিল, প্রচলিত ভূমিব্যবস্থা পরিবর্তন করে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় উৎপাদন। এতে উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ উপকৃত হবে। দেশ উন্নয়নের পথে এগোবে, তাই এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন, অর্থাৎ সামন্তবাদী ব্যবস্থা অথবা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিবর্তে 'সমাজতান্ত্রিক' সমাজব্যবস্থা। তাই এর জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র বিপ্লব। এই তত্ত্বের বিপরীতে পুঁজিবাদী দেশগুলো 'সবুজ বিপ্লব' তত্ত্ব প্রচার এবং প্রয়োগ করে, এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও প্রচলিত মালিকানা ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই, জমিতে উচ্চ ফলনশীল বীজ, সার, পানি ও পরিচর্চার মাধ্যমে অধিক উৎপাদন সম্ভব। অতএব সশস্ত্র বিপ্লব নয়, সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমেই জনগণ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব। এভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধারক ও বাহকরা সাফল্য এনেছিল তাদের তত্ত্বের পক্ষে।
বর্তমানে এশিয়া মহাদেশে জনসংখ্যা ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, পক্ষান্তরে পশ্চিমা দেশগুলো ক্রমে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিক দারিদ্র্যের কারণে তৃতীয় বিশ্বে হয়তো সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেও পারে। তাই এই অধিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার প্রভাব ও প্রয়োগ না হওয়ার চাবিকাঠি হলো এই ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা। তাই পুঁজিবাদী দেশগুলোর অন্যতম দায়িত্ব হলো এই তত্ত্বটি টিকিয়ে রাখা এবং এই তত্ত্বের পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের শোষণের কার্যক্রম চালু রাখা। বিষয়টি এভাবে বলা যায়, আমেরিকা তথা পুঁজিবাদী দেশগুলোর প্রধান লক্ষ্য 'ক্ষুদ্রঋণ' তত্ত্বটি বহাল রাখতে যা যা প্রয়োজন তা-ই করা। এখানে ড. মো. ইউনূসের সম্মান গৌণ, মুখ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্র কায়েম ঠেকাতে ক্ষুদ্রঋণ তত্ত্বটির সম্মান রক্ষা করা।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.