বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৭০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মমতাজ হাসান, বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা সফল যোদ্ধা গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা নিঃশব্দে অবস্থান নিতে থাকলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত।
একটি দলের (আলফা [এ] কোম্পানি) নেতৃত্বে মমতাজ হাসান। ভোর হওয়ার আগেই তাঁরা একযোগে আক্রমণ শুরু করলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর। শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড যুদ্ধ। তুমুল গোলাগুলিতে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হতে থাকল।
মুক্তিযোদ্ধারা মমতাজ হাসানের নেতৃত্বে সাহসিকতার সঙ্গে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁদের অন্যান্য দলও সামনে এগোতে থাকল। চারদিকের প্রচণ্ড আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি সেনারা। বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ভেঙে পড়ল পাকিস্তানি সেনাদের সব প্রতিরোধ। সকাল সাতটার মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে গেল। মুক্ত হলো বিরাট এক এলাকা। এ ঘটনা সালদা নদীতে। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে সালদা নদী এলাকা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে একেবারে হটিয়ে দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সালদা নদীর যুদ্ধ স্মরণীয় এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মমতাজ হাসান তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ বীরত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। তাঁর সাহসিকতায় অনুপ্রাণিত হন দলের সহযোদ্ধারা।
মমতাজ হাসান ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের প্রথমার্ধে ভারতে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের (বীর উত্তম) অধীনে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্ত এলাকায় ছোটখাটো কয়েকটা অপারেশনে অংশ নেন। কিছুদিন পর তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় প্রথম বাংলাদেশ অফিসার্স ওয়ার কোর্সে। প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন সালদা নদী সাব-সেক্টরে। তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন।
সালদা নদী মুক্ত হওয়ার পর মমতাজ হাসান তাঁর দল নিয়ে ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার হালদারের (বীর উত্তম) নেতৃত্বে চট্টগ্রাম এলাকায় যান। ফটিকছড়ি, নাজিরহাটসহ আরও কয়েক স্থানে যুদ্ধ করেন। ফটিকছড়িতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের একটি দল এবং সহযোগী এক কোম্পানি ইপিসিএএফ মোতায়েন ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কাজিরহাটে পৌঁছে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হন। প্রধান দল কাজিরহাট-ফটিকছড়ি রাস্তায়, বাকি দুই দলের একটি ফটিকছড়ি পাহাড়ের দিকে রাস্তায় এবং অপর দল মানিকছড়ি-রামগড়ের রাস্তায় অবস্থান নেয়। ১১ ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করেন। তাঁদের সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগীরা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ অন্য জিনিসপত্র ফেলে পালিয়ে যায়। রাত ১২টার মধ্যে সমগ্র ফটিকছড়ি মুক্ত হয়ে যায়। এই যুদ্ধেও মমতাজ হাসান যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মমতাজ হাসানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৮।
মমতাজ হাসান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। ১৯৭৪ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলার শিবপুর গ্রামে। তবে তাঁর বাবা ঢাকায় (১১৮/১ কলাবাগান, প্রথম লেন) বসবাস করতেন। মমতাজ হাসান বর্তমানে আমেরিকায় থাকেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল হাফিজ, মা জাহানারা হাফিজ। স্ত্রী পারভীন জাহান। তাঁদের তিন ছেলে।
সূত্র: মমতাজ হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মুক্তিযোদ্ধারা মমতাজ হাসানের নেতৃত্বে সাহসিকতার সঙ্গে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁদের অন্যান্য দলও সামনে এগোতে থাকল। চারদিকের প্রচণ্ড আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি সেনারা। বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ভেঙে পড়ল পাকিস্তানি সেনাদের সব প্রতিরোধ। সকাল সাতটার মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে গেল। মুক্ত হলো বিরাট এক এলাকা। এ ঘটনা সালদা নদীতে। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে সালদা নদী এলাকা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে একেবারে হটিয়ে দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সালদা নদীর যুদ্ধ স্মরণীয় এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মমতাজ হাসান তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ বীরত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। তাঁর সাহসিকতায় অনুপ্রাণিত হন দলের সহযোদ্ধারা।
মমতাজ হাসান ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের প্রথমার্ধে ভারতে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। ২ নম্বর সেক্টরের ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের (বীর উত্তম) অধীনে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্ত এলাকায় ছোটখাটো কয়েকটা অপারেশনে অংশ নেন। কিছুদিন পর তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় প্রথম বাংলাদেশ অফিসার্স ওয়ার কোর্সে। প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন সালদা নদী সাব-সেক্টরে। তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন।
সালদা নদী মুক্ত হওয়ার পর মমতাজ হাসান তাঁর দল নিয়ে ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার হালদারের (বীর উত্তম) নেতৃত্বে চট্টগ্রাম এলাকায় যান। ফটিকছড়ি, নাজিরহাটসহ আরও কয়েক স্থানে যুদ্ধ করেন। ফটিকছড়িতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের একটি দল এবং সহযোগী এক কোম্পানি ইপিসিএএফ মোতায়েন ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কাজিরহাটে পৌঁছে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হন। প্রধান দল কাজিরহাট-ফটিকছড়ি রাস্তায়, বাকি দুই দলের একটি ফটিকছড়ি পাহাড়ের দিকে রাস্তায় এবং অপর দল মানিকছড়ি-রামগড়ের রাস্তায় অবস্থান নেয়। ১১ ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করেন। তাঁদের সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগীরা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ অন্য জিনিসপত্র ফেলে পালিয়ে যায়। রাত ১২টার মধ্যে সমগ্র ফটিকছড়ি মুক্ত হয়ে যায়। এই যুদ্ধেও মমতাজ হাসান যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মমতাজ হাসানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৮।
মমতাজ হাসান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। ১৯৭৪ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলার শিবপুর গ্রামে। তবে তাঁর বাবা ঢাকায় (১১৮/১ কলাবাগান, প্রথম লেন) বসবাস করতেন। মমতাজ হাসান বর্তমানে আমেরিকায় থাকেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল হাফিজ, মা জাহানারা হাফিজ। স্ত্রী পারভীন জাহান। তাঁদের তিন ছেলে।
সূত্র: মমতাজ হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments