রাজনীতি-মন্ত্রীদের দারিদ্র্য by এ কে এম জাকারিয়া
রাজনীতিক ও দার্শনিকদের জন্য ‘রসিক’ পরিচয়টি নাকি খুব ভালো কিছু নয়। এতে নাকি রাজনীতিক ও দার্শনিকদের মান-মর্যাদা কমে যায়। দার্শনিক ভাববেন জগতের নানা বিষয়ে, হাস্যরস ঠিক তাঁর সঙ্গে যায় না! আর রাজনীতিকদের চিন্তায় থাকবে শুধু দেশ ও জনগণ।
কোনো রাজনীতিবিদ ‘রসিক’ হিসেবে পরিচিত হয়ে গেলে জনগণ তাঁকে একটু ‘নন সিরিয়াস’ ভাবতেই পারে! যিনি হাসি-ঠাট্টা নিয়ে থাকেন, তিনি করবেন দেশ ও জনগণের সেবা! তবে দুনিয়ার নামীদামি রাজনীতিবিদ ও বড় বড় দার্শনিকের রসবোধের অনেক ঘটনা অবশ্য এই ধারণার পক্ষে যায় না। হতে পারে রাজনীতি ও দর্শন খুবই সিরিয়াস বিষয়। তাই বলে রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকদের রসবোধ থাকবে না!
দর্শন ও দার্শনিকদের বিষয় থাক। উইনস্টন চার্চিল, দুনিয়ার সেরা নেতাদের একজন হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে। সংকট-পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিশেষ ক্ষমতা নিয়েই যেন জন্ম হয়েছিল এই রাজনীতিবিদের। তাঁর মতো নেতা না থাকলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সাফল্যের সঙ্গে সামাল দেওয়া যেত কি না, সে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। হাউস অব কমন্সের প্রথম নারী সদস্য (রক্ষণশীল দল থেকে নির্বাচিত) লেডি অ্যাস্টর একবার চার্চিলকে বলেন, ‘আপনি আমার স্বামী হলে আমি আপনার পানীয়তে বিষ দিতাম।’ চার্চিলের উত্তর, ‘আপনি আমার স্ত্রী হলে আমি তা পান করতাম।’ রসবোধ না থাকলে কি চার্চিলের মুখ থেকে বেরোত এমন ঝটপট উত্তর! ‘কেউ দল বদল করে নীতির জন্য, আবার কেউ নীতি বদল করে দলের জন্য’ বা ‘মার্কিনরা সব সময় সঠিক কাজটিই করার চেষ্টা করে, তবে এর আগে অন্য সব উপায়ই তারা চেষ্টা করে দেখে’— রসবোধের পরিচয় দেয় চার্চিলের এ ধরনের উদ্ধৃতির অভাব নেই।
আমাদের রাজনীতিবিদেরা অবশ্য খুবই সিরিয়াস, উল্টো রাজনীতিটাই হয়ে গেছে হাস্যরসের বিষয়। নেতা হয়তো ‘দেশ ও জনগণের স্বার্থে’ কথা বলছেন, আর জনগণ মুখ টিপে হাসছে। কেন? রাজনীতিটাই যে রসে টইটম্বুর হয়ে গেছে। ‘সংসদ সদস্যপদ রক্ষার জন্য নয়, দেশ ও জাতির সমস্যা তুলে ধরতেই আমরা সংসদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি’ (প্রথম আলো, ১৪ মার্চ)—বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক যত গম্ভীর মুখেই এ কথা বলুন না কেন, জনগণের না হেসে কি উপায় আছে? গত বছরের ২ জুন শেষ সংসদে গিয়েছিল বিএনপি। সংসদে অনুপস্থিতির টানা ৯০ দিন হয়ে গেছে, সদস্যপদ হারানোর ফাঁদে পড়েছে বিরোধী দল। সংসদের মূল্যবান এই সদস্যপদ না থাকলে বেতন-ভাতা, শুল্কমুক্ত গাড়ি, সঙ্গে সংসদ সদস্য হিসেবে ভোগ করা মানসম্মান—এসব কিছুই যে থাকবে না! ‘দেশ ও জাতির’ সমস্যা নিয়ে কথা বলার সময় তো এখনই! আমাদের মতো বোকা জনগণ না হেসে আর কী করবে!
সময়মতোই সংসদে যোগ দিয়েছে বিএনপি। আমাদের স্পিকার অবশ্য রসিক মানুষ। বিরোধী দলকে; বিশেষ করে, খালেদা জিয়ার সংসদে যোগ দেওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। ‘মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা, আপনার আগমনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আপনাকে সংসদে দেখলেই আমার ভালো লাগে। আশা করি, আপনাদের আগমনে সংসদ আরও বেশি কার্যকর ও অর্থবহ হবে। ...প্রতিদিন এসে কথা বলেন, আমি তো আপনার অপেক্ষায় ছিলাম’ (প্রথম আলো, ১৬ মার্চ)। স্পিকারের এসব কথায় চিঁড়ে ভিজেছে বলে মনে হয়নি। খালেদা জিয়া সিরিয়াস মানুষ, সংসদে এসেছেন জরুরি কথা বলতে, হাসির কথা মুখে আনবেন কেন! আর মহাজোট সরকার গত দুই বছরে (‘শেয়ারবাজার থেকে লুটপাট’, ‘উচ্চ আদালতে দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়া’, ‘সম্মানিত ব্যক্তিদের পেছনে লেগে যাওয়া’, ‘দেশের মানুষকে ৫০ টাকায় চাল, ১১০ টাকায় ডাল ও ১২০ টাকায় তেল খাওয়ানো’, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাহাত্তর-পঁচাত্তরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া’) দেশটাকে যেখানে নিয়ে গেছে, তাতে মুখ থেকে হাসির কথা বের হওয়ার সুযোগই বা কই!। এক ঘণ্টা ১০ মিনিটের বক্তৃতায় তিনি বলেছেন ‘দেশ ও জনগণের’ কথা, ‘জনগণের’ পক্ষ থেকে দাবি জানিয়েছেন মধ্যবর্তী নির্বাচনের। বক্তৃতা দিয়েই তিনি আবার সংসদের বাইরে। দেশ ও জনগণের কথাও বলা হলো, সদস্যপদটিও টিকে গেল! আর দরকার কী? অধিবেশনের মেয়াদ ছিল ১০ এপ্রিল পর্যন্ত, সেটাও কমিয়ে আনায় ২৪ মার্চেই শেষ হয়ে গেছে এবারের অধিবেশন। চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া এখন দেশের বাইরে। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন, সে আশা আমরা করতে পারি, কিন্তু পরের অধিবেশনে তিনি ও তাঁর দল সংসদে নিয়মিত হবেন, সে আশা কি আমরা করতে পারি! এই বাড়তি আশার কারণে পাঠক হাসছেন না তো!
মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ হিসাব নেওয়া হবে, তবে তা প্রকাশ করা হবে না। ক্ষমতায় গিয়ে মন্ত্রী-এমপিরা টাকা বানাচ্ছেন কি না, তা যদি জনগণ না-ই জানতে পারল, তবে এই হিসাব নেওয়ার মানেটা কী? এর ব্যাখ্যা আমাদের কাছে নেই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ‘জনসমক্ষে’ প্রকাশ করার বিষয়টি ছিল। এই অবস্থা থেকে সরকার কেন সরে এল, তার জবাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ‘মন্ত্রীরা চান না তাঁদের দারিদ্র্য বেশি লোক দেখুক’ (প্রথম আলো, ২১ মার্চ)। ধারণা করি, সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছিল, তখন কেউ ভাবেননি, আমাদের মন্ত্রীরা এত দরিদ্র হবেন। মন্ত্রিসভার ‘দরিদ্র’ সদস্যদের নিয়ে এখন মনে হয় বিপদেই পড়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী। সহকর্মীদের দারিদ্র্যের লজ্জা ঢাকার দায়িত্ব না নিয়ে আর উপায় কী! হাসিমুখে কথা বলেন তিনি। তাঁর এই বক্তব্যের পর আমরা তাঁকে রসিক হিসেবেও ধরে নিতে পারি। তবে অর্থমন্ত্রী যদি সিরিয়াসলি কথাটি বলে থাকেন, তখন হয়তো তাঁকে আর রসিক বলা যাবে না, কিন্তু মন্ত্রীদের এই ‘দারিদ্র্য’ নিয়ে আমাদের মুচকি হাসি থামাবে কে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzkaria@gmail.com
দর্শন ও দার্শনিকদের বিষয় থাক। উইনস্টন চার্চিল, দুনিয়ার সেরা নেতাদের একজন হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে। সংকট-পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিশেষ ক্ষমতা নিয়েই যেন জন্ম হয়েছিল এই রাজনীতিবিদের। তাঁর মতো নেতা না থাকলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সাফল্যের সঙ্গে সামাল দেওয়া যেত কি না, সে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। হাউস অব কমন্সের প্রথম নারী সদস্য (রক্ষণশীল দল থেকে নির্বাচিত) লেডি অ্যাস্টর একবার চার্চিলকে বলেন, ‘আপনি আমার স্বামী হলে আমি আপনার পানীয়তে বিষ দিতাম।’ চার্চিলের উত্তর, ‘আপনি আমার স্ত্রী হলে আমি তা পান করতাম।’ রসবোধ না থাকলে কি চার্চিলের মুখ থেকে বেরোত এমন ঝটপট উত্তর! ‘কেউ দল বদল করে নীতির জন্য, আবার কেউ নীতি বদল করে দলের জন্য’ বা ‘মার্কিনরা সব সময় সঠিক কাজটিই করার চেষ্টা করে, তবে এর আগে অন্য সব উপায়ই তারা চেষ্টা করে দেখে’— রসবোধের পরিচয় দেয় চার্চিলের এ ধরনের উদ্ধৃতির অভাব নেই।
আমাদের রাজনীতিবিদেরা অবশ্য খুবই সিরিয়াস, উল্টো রাজনীতিটাই হয়ে গেছে হাস্যরসের বিষয়। নেতা হয়তো ‘দেশ ও জনগণের স্বার্থে’ কথা বলছেন, আর জনগণ মুখ টিপে হাসছে। কেন? রাজনীতিটাই যে রসে টইটম্বুর হয়ে গেছে। ‘সংসদ সদস্যপদ রক্ষার জন্য নয়, দেশ ও জাতির সমস্যা তুলে ধরতেই আমরা সংসদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি’ (প্রথম আলো, ১৪ মার্চ)—বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক যত গম্ভীর মুখেই এ কথা বলুন না কেন, জনগণের না হেসে কি উপায় আছে? গত বছরের ২ জুন শেষ সংসদে গিয়েছিল বিএনপি। সংসদে অনুপস্থিতির টানা ৯০ দিন হয়ে গেছে, সদস্যপদ হারানোর ফাঁদে পড়েছে বিরোধী দল। সংসদের মূল্যবান এই সদস্যপদ না থাকলে বেতন-ভাতা, শুল্কমুক্ত গাড়ি, সঙ্গে সংসদ সদস্য হিসেবে ভোগ করা মানসম্মান—এসব কিছুই যে থাকবে না! ‘দেশ ও জাতির’ সমস্যা নিয়ে কথা বলার সময় তো এখনই! আমাদের মতো বোকা জনগণ না হেসে আর কী করবে!
সময়মতোই সংসদে যোগ দিয়েছে বিএনপি। আমাদের স্পিকার অবশ্য রসিক মানুষ। বিরোধী দলকে; বিশেষ করে, খালেদা জিয়ার সংসদে যোগ দেওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। ‘মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা, আপনার আগমনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আপনাকে সংসদে দেখলেই আমার ভালো লাগে। আশা করি, আপনাদের আগমনে সংসদ আরও বেশি কার্যকর ও অর্থবহ হবে। ...প্রতিদিন এসে কথা বলেন, আমি তো আপনার অপেক্ষায় ছিলাম’ (প্রথম আলো, ১৬ মার্চ)। স্পিকারের এসব কথায় চিঁড়ে ভিজেছে বলে মনে হয়নি। খালেদা জিয়া সিরিয়াস মানুষ, সংসদে এসেছেন জরুরি কথা বলতে, হাসির কথা মুখে আনবেন কেন! আর মহাজোট সরকার গত দুই বছরে (‘শেয়ারবাজার থেকে লুটপাট’, ‘উচ্চ আদালতে দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়া’, ‘সম্মানিত ব্যক্তিদের পেছনে লেগে যাওয়া’, ‘দেশের মানুষকে ৫০ টাকায় চাল, ১১০ টাকায় ডাল ও ১২০ টাকায় তেল খাওয়ানো’, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাহাত্তর-পঁচাত্তরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া’) দেশটাকে যেখানে নিয়ে গেছে, তাতে মুখ থেকে হাসির কথা বের হওয়ার সুযোগই বা কই!। এক ঘণ্টা ১০ মিনিটের বক্তৃতায় তিনি বলেছেন ‘দেশ ও জনগণের’ কথা, ‘জনগণের’ পক্ষ থেকে দাবি জানিয়েছেন মধ্যবর্তী নির্বাচনের। বক্তৃতা দিয়েই তিনি আবার সংসদের বাইরে। দেশ ও জনগণের কথাও বলা হলো, সদস্যপদটিও টিকে গেল! আর দরকার কী? অধিবেশনের মেয়াদ ছিল ১০ এপ্রিল পর্যন্ত, সেটাও কমিয়ে আনায় ২৪ মার্চেই শেষ হয়ে গেছে এবারের অধিবেশন। চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া এখন দেশের বাইরে। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন, সে আশা আমরা করতে পারি, কিন্তু পরের অধিবেশনে তিনি ও তাঁর দল সংসদে নিয়মিত হবেন, সে আশা কি আমরা করতে পারি! এই বাড়তি আশার কারণে পাঠক হাসছেন না তো!
মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ হিসাব নেওয়া হবে, তবে তা প্রকাশ করা হবে না। ক্ষমতায় গিয়ে মন্ত্রী-এমপিরা টাকা বানাচ্ছেন কি না, তা যদি জনগণ না-ই জানতে পারল, তবে এই হিসাব নেওয়ার মানেটা কী? এর ব্যাখ্যা আমাদের কাছে নেই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ‘জনসমক্ষে’ প্রকাশ করার বিষয়টি ছিল। এই অবস্থা থেকে সরকার কেন সরে এল, তার জবাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ‘মন্ত্রীরা চান না তাঁদের দারিদ্র্য বেশি লোক দেখুক’ (প্রথম আলো, ২১ মার্চ)। ধারণা করি, সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছিল, তখন কেউ ভাবেননি, আমাদের মন্ত্রীরা এত দরিদ্র হবেন। মন্ত্রিসভার ‘দরিদ্র’ সদস্যদের নিয়ে এখন মনে হয় বিপদেই পড়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী। সহকর্মীদের দারিদ্র্যের লজ্জা ঢাকার দায়িত্ব না নিয়ে আর উপায় কী! হাসিমুখে কথা বলেন তিনি। তাঁর এই বক্তব্যের পর আমরা তাঁকে রসিক হিসেবেও ধরে নিতে পারি। তবে অর্থমন্ত্রী যদি সিরিয়াসলি কথাটি বলে থাকেন, তখন হয়তো তাঁকে আর রসিক বলা যাবে না, কিন্তু মন্ত্রীদের এই ‘দারিদ্র্য’ নিয়ে আমাদের মুচকি হাসি থামাবে কে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzkaria@gmail.com
No comments