সমাজ-ক্রিকেট, মিডিয়া ও পাঠ প্রসঙ্গ by জুনান নাশিত

দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে আমাদের ক্রিকেট দল শেষ পর্যন্ত হেরেই গেল। আমরা জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিংবা হেরে গেলেও অন্তত সেটা যেন হয় মুখরক্ষার মতো। কিন্তু কোনোটাই হলো না। এ হারের অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। মিডিয়ায় এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা, তর্ক ও বিতর্ক।


সবকিছু ছাপিয়ে প্রিয় কথাশিল্পী আনিসুল হকের একটি মন্তব্যের প্রতি আমার চোখ পড়ল। মনে মনে তাঁকে সমর্থনও করলাম। তিনি বলেছেন, ‘আমার কিন্তু মনে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ যদি ইংল্যান্ডকে হারাতে পারত, বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে এভাবে হারত না। ক্রিকেট মনেরও খেলা। প্রমাণিত হলো, আমরা চাপ নিতে পারি না।’ (২০ মার্চ, প্রথম আলো) কেউ কেউ এও বলেছেন, ‘আমাদের ছেলেরা জাতির এত প্রত্যাশার চাপ সইতে পারেনি।’ সইতে পারেনি সত্য। কিন্তু কেন পারেনি কিংবা কেন আমরা পারি না, এ প্রশ্ন মনে জাগা কি স্বাভাবিক নয়? কেবল ক্রিকেট কেন, জাতীয় জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের এ চাপ সইতে না পারার অক্ষমতা রয়েছে।
আজ আমরা প্রকটভাবে দ্বিধাবিভক্ত। নানা কারণে আমাদের নতুন প্রজন্ম একটি খণ্ডিত চেতনা নিয়ে বড় হচ্ছে। বলা যায়, বিশ্বজুড়েই চলছে নানামুখী সংকট ও অস্থিরতা। প্রযুক্তির কল্যাণে সে অস্থিরতার দাপট এ দেশেও কম হবে, তেমনটা আশা করা বৃথা।
জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে অনেক সুমহান অর্জন, রয়েছে বহু সাফল্য। ঘাটতিও কিছু কম নেই। আমাদের পরিপক্বতার বিরাট অভাব রয়েছে। মেধা-মননে আমরা কম নই। কিন্তু সার্বিক অর্থে আমরা পেশাদারি গড়ে তুলতে পারছি না। এর জন্য প্রয়োজন নিষ্ঠা ও একাগ্রতা। তাতে আমাদের খামতি রয়েছে। কেন, তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। আমার মনে হয়, এ কমতি পূরণে অন্য অনেক অনুষঙ্গের মতো নিবিড় পঠন-পাঠনের অনুষঙ্গকেও প্রয়োজনীয় করে তোলা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, পাঠাভ্যাস জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুঃখের কথা, আজ আমরা অনেকটাই পাঠবিমুখ জাতিতে পরিণত হয়েছি। আগে মধ্যবিত্ত প্রতিটি পরিবারে এক আলমারি বইয়ের দেখা মিলত, আজ আর তেমনটি দেখা যায় না। সে দৃশ্য বলতে গেলে শুধুই স্মৃতি। বই নেই। কিন্তু প্রযুক্তি থেকে তো আমরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। পাঠের কাজে আমরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে পারি অনায়াসে। ঘরে ঘরে আজ একাধিক মোবাইল। একটু অবস্থাপন্ন ঘরে রয়েছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও ইন্টারনেটের সুবিধা।
‘ওয়ার্ল্ড বুক ডে-২০১১’ উপলক্ষে ব্রিটেনে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ টিনএজার কম্পিউটারের মাধ্যমে পড়াশোনা করে। ১৭ দশমিক ২ শতাংশ মুঠোফোন এবং ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ আইপডের সাহায্যে তাদের পাঠের কাজ চালিয়ে যায়। দিনে দিনে এ হার যে বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত কোনো জরিপ আমার চোখে পড়েনি। তবে এখানেও এ ধারা চালু হয়ে গেছে। আশার কথা, ই-বুক চালুর বিষয়ে বাংলা একাডেমীর বিবেচনাধীন রয়েছে।
নিজেকে সমৃদ্ধ, সংযত, সহনশীল ও সর্বোপরি সহানুভূতিশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পাঠ অত্যাবশ্যকীয়। ‘বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী’। একাকিত্বের এ সংগ্রামে পাঠাভ্যাস শক্তি ও সাহস জোগায়। আমাদের অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয়। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা তৈরি করে। আজকাল দেখা যায়, ঠুনকো কারণে কিংবা কথায় কথায় মানুষ আত্মহননের পথ বেঁচে নেয়। অস্থিরতা জয় করার মানসিক শক্তি তাদের নেই, যেমনটা পারেনি আমাদের ক্রিকেটাররা। হতাশার চাপ ও অতি উল্লাসের দাপটে তারা ভেঙে পড়েছে। নিজেকে নির্মোহ রাখতে পারেনি। আবেগে ভেসে গেছে। কিন্তু যেকোনো অর্জনের জন্য প্রচণ্ড সংযম প্রয়োজন। প্রশংসা ও বাহবা হজম করতেও শক্তি লাগে। তেমনি দরকার আক্রমণ ও সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা। সেটি অর্জন করতে হয়। পাঠাভ্যাস সে অর্জনের গতি ত্বরান্বিত করে।
পাঠ প্রসঙ্গ এলে অনেকেই ব্যস্ততার অজুহাত তোলেন। হ্যাঁ, অজুহাত। কারণ, পাঠাভ্যাস একবার তৈরি হলে কোনো ব্যস্ততাই তার বাধা হতে পারে না। অভ্যস্ততার প্রয়োজনেই মানুষ সময় বের করে নেয়। পাঠাভ্যাস গড়ে উঠলে শত ব্যস্ততার মাঝেও মানুষ একটু হলেও সময় বের করবে, তাই কি স্বাভাবিক নয়?
কিন্তু কথা হলো, পাঠাভ্যাস এক দিনে গড়ে তোলা সম্ভব নয়, কিংবা চটজলদি দোকান থেকে কিনে নেওয়ার বিষয়ও নয়। জন্মের পর আমরা যে পরিবেশে বেড়ে উঠি, তা আমাদের মানসিক গঠনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই পাঠাভ্যাস তৈরিতে আমাদের পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে। পরিবারই পারে শিশুকে পাঠমুখী করতে। এটি কেবল শখের বিষয় নয়, নিতান্ত জরুরি বিষয়।
শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ চারদিকের ‘অদ্ভুত আঁধার’ তাড়াতে দরকার আরও অনেক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের, যাঁরা সমাজ ও দেশের আঁধার তাড়াতে স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেন। বলা বাহুল্য, একাগ্র পাঠ আমাদের স্বার্থহীন ও উদার হতেও শেখায়।
আজ কি ঘরে, কি রাস্তায়, কি অফিসে, কি সংসদে—সবখানে অশালীন, অশ্রাব্য কথার বান। অসৌজন্য আচরণে আমরা এতটাই অভ্যস্ত, সৌজন্যের কথা প্রায় ভুলেই গেছি। অন্যকে আক্রমণ ও হেয় করে আমরা আনন্দ পাই। ঔদ্ধত্যকে শক্তি মনে করি, বিনয় ও ভদ্রতাকে দুর্বলতা। জয় করার চেয়ে ছিনিয়ে নেওয়াকেই আমাদের কাছে শ্রেয় মনে হয়। অন্যায়কে আড়াল করার চেয়ে দাপটের সঙ্গে তা ঘোষণা করতে পারাটাই যেন বীরত্ব। এই যখন অবস্থা, তখন পাঠ প্রসঙ্গে কথা বলাটা অনেকের কাছেই হয়তো খানিকটা বিসদৃশ ঠেকবে। কিন্তু তবু বলতে হবে। কারণ, এ ছাড়া আমাদের বিকল্প খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না।
কিংবদন্তিতুল্য নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘The brave man is not he who does not feel afraid, but he who conquers that fear.’ ভয়কে জয় করতেও যে মানসিক শক্তি প্রয়োজন, তা পঠন-পাঠনের বিকল্পে আর কিসে সম্ভব, আমার জানা নেই।
জুনান নাশিত: কবি ও সাংবাদিক।
nashit_junan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.