চারদিক-তার আর সাহায্যের দরকার নেই by বিলকিস নাহার
বেশ কিছুদিন আগের কথা। না লিখে পারছি না। কখনো কখনো আমরা পরিস্থিতির কারণে কতটা অসহায় হয়ে পড়ি, তাই লিখব। সময়টা ২৫ অক্টোবর, ২০১০। একটি শিশু অধিকার বাস্তবায়নকারী সংস্থায় কাজ নিয়েছি। আইনের সঙ্গে জড়িত শিশুদের সহায়তায় সংস্থাটির একটি প্রকল্প আছে মতিঝিলে।
এখানে থানা ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে শিশুদের আনার পর প্রথমেই চেষ্টা করা হয় তাদের পরিবার খুঁজে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা। আর যদি কোনোভাবেই পরিবার খুঁজে না পাওয়া যায় তখন সেসব শিশুর সব ধরনের সুবিধা প্রদান করে চাকরির মাধ্যমে সমাজে পুনর্বাসন করা হয়। রিনা নামের মেয়েটি। বয়স ১৩। ২০০৩ সালের ২০ নভেম্বর কোতোয়ালি থানার মাধ্যমে আমাদের সেফ শেল্টারে আসে। বহু খোঁজাখুঁজি করেও তার পরিবারের বা আত্মীয়স্বজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ফলে সেন্টারের আরও অনেকের মতো সেও হয়ে যায় ‘অজ্ঞাত ঠিকানা’র এক শিশু।
শুরু থেকে মেয়েটি ছিল শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার শরীরে ধরা পরে মরণব্যাধি ব্লাড ক্যানসার। আমি এ প্রকল্পে ম্যানেজার হয়ে যোগদান করি। যোগদানের দিনই মেয়েটি আমার কাছে আসে, হাত ধরে বলে, ‘আফা, একটুও বালা লাগে না। কেন আমার এত অসুখ হয়? সান্ত্বনা দিই, আমরা তোমার চিকিৎসা করাব, তুমি ভালো হয়ে যাবে। সে কি জানতে পেরেছিল, তার মৃত্যু অতি নিকটে? আমার সান্ত্বনা শুধু মুখের কথা। তাই কি ওভাবে কেঁদেছিল?’
পর্যায়ক্রমে তার চিকিৎসা চলছিল। তার শরীরে রক্ত সঞ্চালন করলে সে কিছু দিন কিছুটা সুস্থ থাকত। এভাবে সুস্থতা-অসুস্থতা নিয়ে চলছিল কিশোরী রিনার জীবন। ২৬ অক্টোবর ২০১০ সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তার শরীরে এক ব্যাগ রক্ত সঞ্চালন করে পাঠিয়ে দেন এবং এক মাস পর আবার রক্ত দিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু এবার আর এক মাস অপেক্ষা করা গেল না। তার শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। তাকে এক সপ্তাহ পর আবারও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফলাফল জানিয়ে দেন, সে ৯৫ শতাংশ ঝুঁকিতে আছে। তখন হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসকেরা জানান, তার চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। তখন আমরা বলি, চিকিৎসা চলুক, সব ব্যয় আমরা বহন করব। প্রয়োজনে দেশের মানুষের কাছে আবেদন জানানো হবে একটি এতিম শিশুকে সুস্থ করে তোলার জন্য।
রিনাকে যে দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সে দিনই কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সাহায্যের আবেদন দিয়ে আসি। পত্রিকাগুলো পরের দিন তা ছাপানোর আশ্বাস দেয়, আরও বলে যদি প্রয়োজন হয় তবে আরও বড় আকারের আবেদনের ব্যবস্থা করা হবে।
কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, আমরা সব আয়োজন করে যখন রিনার চিকিৎসার জন্য মাঠে নামলাম ঠিক তখনই সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। রাতে বিছানায় ঘুমাতে গিয়ে তাকে নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে তা ঠিক করে ফেলি। এটাও চিন্তা করি, কাল সকালে উঠেই দেখতে পাব কয়েকটি পত্রিকায় রিনার ছবিসহ সাহায্যের আবেদন ছাপা হয়েছে। এভাবে ভাবতে ভাবতে একসময় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। অনেক রাতে হঠাৎ ফোনের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। রাত চারটা ৩০ মিনিট। আধো ঘুমরত অবস্থায় রিসিভ করি। জানতে পারি রিনা আর নেই।
আর কি ঘুম আসে? বিছানা ছেড়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করি। রাত একটু ফর্সা হলেই হাসপাতালে ছুটে যাই। ততক্ষণে আমাদের সেন্টার ও প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়ররা এসে গেছেন। আমি রিনার বেডের কাছে যাই। দেখি সাদা কাপড়ে ঢাকা রিনার শরীর। মুখের কাপড় সরাই, ফুটফুটে একটি মুখ যেন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। কত দিনের ঘুম যেন তার বাকি। সকালে পত্রিকায় তার ছবিসহ সাহায্যের আবেদন সবার চোখে পড়ায়, কারও সাহায্য দেওয়ার আগেই সে জানিয়ে দিল আর সাহায্য তার প্রয়োজন নেই।
অফিসের নিয়ম অনুযায়ী আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে ফোন করি। তারা জানায়, মৃতদেহ মর্গে রেখে যান, আমরা দাফনের ব্যবস্থা করব। আমরা তাদের কথামতো রিনার নিষ্প্রাণ দেহটি যখন মর্গে রেখে ফিরব, তখনই আমার প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ইকরামুল কবির ভাই বলেন, ‘আপা, কী করতে পারলাম আমরা একটি শিশুর জন্য। কোথা থেকে সে এসেছিল আর কোথায়ই বা সে গেল। সব অজ্ঞাত!’
সারা দিন মন খারাপ নিয়ে অফিস করি। যেসব পত্রিকায় রিনার জন্য সাহায্যের আবেদন ছাপা হয়েছিল সেসব পত্রিকায় শোক সংবাদ প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ জানাই। কাজ শেষে বাসায় গিয়ে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে ফোন করি। সেখানকার দায়িত্বরত কর্মী জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সবগুলো মৃতদেহ গ্রহণ করে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। কিছুটা শান্তি পাই, যাক রিনার দাফনটি তাহলে ঠিকমতো সম্পন্ন হয়েছে।
এরপর কত দিন কেটে গেছে, কিন্তু সেদিনের পর থেকে তার ছায়া যেন সারাক্ষণ আমার পাশে থাকে। রাতে ঘুমাতে গেলে চোখে ভাসে ওর ছবি। মাঝে মাঝে মনে হয়, ও এসে আমাকে বলছে, ‘তোমরা কেন আমাকে হাসপাতালের মর্গে রেখে চলে গেলে? কেন নিয়ে গেলে না সেন্টারে? সবার মতো হেসে-খেলে কাটাতে পারতাম।’
শুরু থেকে মেয়েটি ছিল শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার শরীরে ধরা পরে মরণব্যাধি ব্লাড ক্যানসার। আমি এ প্রকল্পে ম্যানেজার হয়ে যোগদান করি। যোগদানের দিনই মেয়েটি আমার কাছে আসে, হাত ধরে বলে, ‘আফা, একটুও বালা লাগে না। কেন আমার এত অসুখ হয়? সান্ত্বনা দিই, আমরা তোমার চিকিৎসা করাব, তুমি ভালো হয়ে যাবে। সে কি জানতে পেরেছিল, তার মৃত্যু অতি নিকটে? আমার সান্ত্বনা শুধু মুখের কথা। তাই কি ওভাবে কেঁদেছিল?’
পর্যায়ক্রমে তার চিকিৎসা চলছিল। তার শরীরে রক্ত সঞ্চালন করলে সে কিছু দিন কিছুটা সুস্থ থাকত। এভাবে সুস্থতা-অসুস্থতা নিয়ে চলছিল কিশোরী রিনার জীবন। ২৬ অক্টোবর ২০১০ সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তার শরীরে এক ব্যাগ রক্ত সঞ্চালন করে পাঠিয়ে দেন এবং এক মাস পর আবার রক্ত দিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু এবার আর এক মাস অপেক্ষা করা গেল না। তার শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। তাকে এক সপ্তাহ পর আবারও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফলাফল জানিয়ে দেন, সে ৯৫ শতাংশ ঝুঁকিতে আছে। তখন হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসকেরা জানান, তার চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। তখন আমরা বলি, চিকিৎসা চলুক, সব ব্যয় আমরা বহন করব। প্রয়োজনে দেশের মানুষের কাছে আবেদন জানানো হবে একটি এতিম শিশুকে সুস্থ করে তোলার জন্য।
রিনাকে যে দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সে দিনই কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সাহায্যের আবেদন দিয়ে আসি। পত্রিকাগুলো পরের দিন তা ছাপানোর আশ্বাস দেয়, আরও বলে যদি প্রয়োজন হয় তবে আরও বড় আকারের আবেদনের ব্যবস্থা করা হবে।
কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, আমরা সব আয়োজন করে যখন রিনার চিকিৎসার জন্য মাঠে নামলাম ঠিক তখনই সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। রাতে বিছানায় ঘুমাতে গিয়ে তাকে নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে তা ঠিক করে ফেলি। এটাও চিন্তা করি, কাল সকালে উঠেই দেখতে পাব কয়েকটি পত্রিকায় রিনার ছবিসহ সাহায্যের আবেদন ছাপা হয়েছে। এভাবে ভাবতে ভাবতে একসময় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। অনেক রাতে হঠাৎ ফোনের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। রাত চারটা ৩০ মিনিট। আধো ঘুমরত অবস্থায় রিসিভ করি। জানতে পারি রিনা আর নেই।
আর কি ঘুম আসে? বিছানা ছেড়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করি। রাত একটু ফর্সা হলেই হাসপাতালে ছুটে যাই। ততক্ষণে আমাদের সেন্টার ও প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়ররা এসে গেছেন। আমি রিনার বেডের কাছে যাই। দেখি সাদা কাপড়ে ঢাকা রিনার শরীর। মুখের কাপড় সরাই, ফুটফুটে একটি মুখ যেন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। কত দিনের ঘুম যেন তার বাকি। সকালে পত্রিকায় তার ছবিসহ সাহায্যের আবেদন সবার চোখে পড়ায়, কারও সাহায্য দেওয়ার আগেই সে জানিয়ে দিল আর সাহায্য তার প্রয়োজন নেই।
অফিসের নিয়ম অনুযায়ী আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে ফোন করি। তারা জানায়, মৃতদেহ মর্গে রেখে যান, আমরা দাফনের ব্যবস্থা করব। আমরা তাদের কথামতো রিনার নিষ্প্রাণ দেহটি যখন মর্গে রেখে ফিরব, তখনই আমার প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ইকরামুল কবির ভাই বলেন, ‘আপা, কী করতে পারলাম আমরা একটি শিশুর জন্য। কোথা থেকে সে এসেছিল আর কোথায়ই বা সে গেল। সব অজ্ঞাত!’
সারা দিন মন খারাপ নিয়ে অফিস করি। যেসব পত্রিকায় রিনার জন্য সাহায্যের আবেদন ছাপা হয়েছিল সেসব পত্রিকায় শোক সংবাদ প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ জানাই। কাজ শেষে বাসায় গিয়ে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে ফোন করি। সেখানকার দায়িত্বরত কর্মী জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সবগুলো মৃতদেহ গ্রহণ করে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। কিছুটা শান্তি পাই, যাক রিনার দাফনটি তাহলে ঠিকমতো সম্পন্ন হয়েছে।
এরপর কত দিন কেটে গেছে, কিন্তু সেদিনের পর থেকে তার ছায়া যেন সারাক্ষণ আমার পাশে থাকে। রাতে ঘুমাতে গেলে চোখে ভাসে ওর ছবি। মাঝে মাঝে মনে হয়, ও এসে আমাকে বলছে, ‘তোমরা কেন আমাকে হাসপাতালের মর্গে রেখে চলে গেলে? কেন নিয়ে গেলে না সেন্টারে? সবার মতো হেসে-খেলে কাটাতে পারতাম।’
No comments