সবার সঙ্গে মতৈক্যের ভিত্তিতে করতে হবে-তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার সংশোধন

বিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কিছু সংশোধন, পরিবর্তন ও সংযোজন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলত, এই বিধান বাতিল করলে তারা মানবে না।


এখন এটা পরিষ্কার যে বাতিলের কোনো চিন্তা সরকারি দলের নেই; বরং তারা কিছু বিষয় সংশোধনের কথা ভাবছে, যার প্রয়োজনীয়তার কথা বিভিন্ন সময় বিএনপিও বলেছে। সুতরাং এখানে সরকারি ও বিরোধী দলের মতৈক্যের একটি স্বাভাবিক ভিত্তি রয়েছে। একে ব্যবহার করে যদি সংসদে সরকারি ও বিরোধী দল অভিন্ন অবস্থান নেয় এবং সবার সম্মতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় সংশোধনী আনে, তাহলে তা দেশের জন্য ভালোই হবে।
অন্তত তিনটি বিষয়ে সংশোধনীর কথা ভাবা যেতে পারে। প্রথমত, মেয়াদ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া। প্রথম আলোর গতকালের সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এ চিন্তা এসেছে। ২০০৬ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নানাভাবে রূপান্তরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে পরিণত হয়েছিল এ কারণে যে, সংবিধানে সুনির্দিষ্ট মেয়াদকালের উল্লেখ ছিল না, শুধু নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল। সুতরাং এখানে নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু একটি ব্যতিক্রম থাকতে হবে, যেমন আছে কোনো সাংসদের শূন্য আসনে নির্বাচনের বেলায়। দৈব দুর্বিপাক, যুদ্ধবিগ্রহ বা ওই ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে সর্বোচ্চ আরও ৯০ দিন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ রাখা যেতে পারে। তবে সেই সময়সীমা অবশ্যই সুনির্দিষ্ট থাকবে।
দ্বিতীয়ত, দেখা গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকালে রাষ্ট্রপতির কাছে কয়েকটি বিষয়ে যে নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণের বিধান রয়েছে, তা সংসদীয় সরকারব্যবস্থার প্রচলিত বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদকালে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদেও একই বিধান বলবৎ রাখা হোক, সেখানে ‘প্রধানমন্ত্রী’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হবে ‘প্রধান উপদেষ্টা’ দ্বারা।
তৃতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি একটি অস্থায়ী বিধান হিসেবে রাখা দরকার। গত চার মেয়াদে দেখা গেছে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়ার শর্ত এখনো সৃষ্টি হয়নি। এর প্রধান কারণ, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ভূমিকা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি।
এ পথে কিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য ভোটার তালিকা, ভোটার আইডি কার্ড, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও তুলনামূলক স্বাধীন নির্বাচন কমিশন কাজ করতে শুরু করেছে। যখন তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীন অবস্থান নিশ্চিত হবে, তখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন থাকবে না। সেই লক্ষ্যে আগামী অন্তত আরও তিন মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান রাখা যেতে পারে।
আরও কিছু বিষয়ে সংশোধনী আনা যেতে পারে। বিশেষভাবে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিধানটি পরিবর্তন করা দরকার। আলোচনার মাধ্যমে এর বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.