প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তে আস্থা রাখুন-উত্তপ্ত সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিরাজমান পরিস্থিতি সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্য পরিচালনার অন্তরায়। বার ও বেঞ্চের সুসম্পর্ক ছাড়া বিচার প্রশাসন পরিচালনা অসম্ভব। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক মামলা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তার প্রতি আমাদের নীতিগত সমর্থন রয়েছে।


তবে তিনি যে প্রক্রিয়ায় মামলার জট খুলতে তথা বিচারপ্রার্থীদের প্রতিকার দিতে যে উপায় উদ্ভাবন করেছেন, তা নিয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বর্তমানে যে ধরনের বেপরোয়া মনোভাব গ্রহণ করেছে, তা মার্জনা করা যায় না। বিচারাঙ্গনের প্রতিবাদের ভাষায় অবশ্যই বিচারিক মননের প্রতিফলন প্রত্যাশিত। প্রধান বিচারপতির অফিসকক্ষের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের নামে যে ধরনের অনভিপ্রেত স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে, তা নিন্দনীয়। কেউ আশা করে না যে অতীতের যেকোনো দুর্ভাগ্যজনক ও ক্লেদাক্ত দৃষ্টান্তের পুনরাবৃত্তি ঘটুক।
এই আন্দোলনকারীদের আমরা কিন্তু উচ্চ আদালত প্রশাসনে সুষ্ঠু নিয়মনীতি চালু কিংবা সংস্কার আনতে সোচ্চার হতে দেখিনি। অনেকের কোটারি স্বার্থে আঘাত লেগেছে বলেই তারা এখন উচ্চকিত। তাঁরা বলেছেন, ‘প্রচলিত নিয়ম অনুসারে যাতে মামলা চলে, জনগণ যাতে ন্যায়বিচার পায় ও আগাম জামিনের সুযোগ থাকে, প্রধান বিচারপতি সে ব্যবস্থা করবেন। আর যদি না হয়, তাহলে পুনরায় আইনজীবীদের সঙ্গে বসে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’
প্রচলিত নিয়মের অনেক কিছুই ছিল ঘুণে ধরা। যেমন—আইনে আগাম জামিনের বিধান নেই। তবু বিরল ক্ষেত্রে অতিসতর্কতার সঙ্গে আগাম জামিন প্রদানের এখতিয়ারকে আমরা সংগত মনে করি। কিন্তু হাইকোর্টের কোনো কোনো বেঞ্চ আগাম জামিনের নামে যে ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে মাইলফলক রায় দিয়েছেন, তা আমরা সমর্থন করেছিলাম। এবং সেই রায় উল্টে দেওয়ার মতো কিংবা নিষ্ঠার সঙ্গে তা অনুসরণ না করার কোনো বাস্তব কারণের উদ্ভব ঘটেনি। আমরা বরং মনে করি, তাঁর রায়ের আলোকে সংসদকে অবশ্যই আইন প্রণয়ন করতে হবে। আন্দোলনকারীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করা যাবে না।
সুপ্রিম কোর্টে মামলা ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘকাল ধরে অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। আদালত-সংশ্লিষ্ট অনেকেই অনিয়মকে অভ্যাসে পরিণত করেছে। এ অবস্থা রাতারাতি বদল করা সম্ভব নয়। বেঞ্চ গঠন-পুনর্গঠন ও তাদের এখতিয়ার নির্ধারণে প্রধান বিচারপতিকে সংবিধান একচ্ছত্র অধিকার দিয়েছে। তবে এর একতরফা প্রয়োগের সুযোগ নেই। বারের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে প্রধান বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ বিচারকদের একটা কর্ম সম্পর্ক বজায় থাকতে হবে। এ বিষয়ে উভয় তরফের আন্তরিকতার বিকল্প নেই। আমরা মামলা ও বেঞ্চ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনবিদদের মধ্যে বৃহত্তর বোঝাপড়া আশা করি।
আদালতের ‘বিচার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি’ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে—সুপ্রিম কোর্টের তরফে এমন ইঙ্গিতকে উসকানিমূলক বলে অভিহিত করেছেন বারের নেতারা। তবে তাঁরা মানবেন যে, বিচারপতি আব্দুল মতিনের দেওয়া রায় অব্যাহতভাবে লঙ্ঘিত হতে পারে না। আদালতের রায় ভেঙে জনগণের জন্য সুবিচার প্রতিষ্ঠার দাবি এক মস্ত পরিহাস। সর্বাগ্রে প্রধান বিচারপতির ওপর আস্থা রাখতে হবে। যেকোনো ধরনের কোটারি ও অস্বচ্ছ স্বার্থ রক্ষার চিন্তা সব পক্ষকেই পরিহার করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.