ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা-শাসন প্রতিষ্ঠার আগেই 'সুশাসন' চাওয়া

১. এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীর কাছে 'সুশাসন' এখন একটি অতি প্রিয় শব্দ। 'সুশাসন' নামযুক্ত এ দেশে একাধিক এনজিও রয়েছে। একটি পত্রিকা প্রায়ই শাসনসংক্রান্ত লেখাগুলো 'সুশাসন' শিরোনাম দিয়ে উপ-সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশ করে থাকে। এর বাইরেও 'সুশাসন' শব্দটি নানাভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।


কেউ বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় সুশাসন রয়েছে। কেউ বলেন, চীন-রাশিয়ায় সুশাসন রয়েছে। আবার কেউ বলেন, সৌদি আরব ও ইরানে সুশাসন রয়েছে। কারো কারো মতে, আমাদের দেশে এখনো কোনো শাসনই প্রতিষ্ঠা পায়নি, তাহলে 'সুশাসন' আসে কিভাবে!
২. যতদূর জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে সর্বপ্রথম এ দেশে 'সুশাসন' শব্দটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বলা শুরু হয়। বিশ্বব্যাংকের অভিমত_যেসব উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে দুর্নীতির প্রাদুর্ভাব রয়েছে, সেখানে সুশাসন জরুরি। প্রতিষ্ঠানটির মতে, সরকারি প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে 'সুশাসন' আসবে না। দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলো সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের দাবিতে হাজার রকম প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। সবার জানা রয়েছে, দুর্নীতি হয় পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে। উপযুক্ত মেকানিজম দুর্নীতিকে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে। যেমন টিঅ্যান্ডটি ফোনের কাছে পাওনা টাকা বকেয়া রাখার সুযোগ থাকলেও বেসরকারি মোবাইল ফোন কম্পানিগুলোতে সে সুযোগ নেই। আবার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারব্যবস্থায় ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ-নীতি প্রয়োগ এবং একই সঙ্গে জনগণের নিকটবর্তী কর্তৃপক্ষের শাসন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আমাদের দেশে কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। এর পেছনে বহু কারণ রয়েছে। এর একটি হলো, বিদেশি শাসকরা পুরো দেশটি কব্জায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে কেন্দ্রে দখল প্রতিষ্ঠা করত। দুঃখজনক হলেও সত্য, সে মানসিকতা থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। এ জন্য আমরা শুনি, রাজধানী ঢাকা জয়ী হওয়া মানেই পুরো দেশ জয়ী হওয়া। পদ্ধতি পরিবর্তন, বিকেন্দ্রীকরণ, গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন ইত্যাদি রাজনীতিকদের কাজ_এটা এনজিওগুলোর ভালোই জানা রয়েছে। তাই বলে তো আর বসে থাকা যায় না। বরং সুশাসনের নামে দাতাদের কাছ থেকে যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়, তাহলে দোষ কী! গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কয়েকটি এনজিও ঘন ঘন সভা-সেমিনার আয়োজন করে বলতে থাকে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেন 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠার আগে বিদায় না নেয়। বর্তমানে 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনরত (তাদের ভাষায়) একটি এনজিওর কর্মকাণ্ড উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। যদিও এনজিওটি কোনোভাবেই নিজেদের এনজিও বলে স্বীকার করে না, বরং প্রতিষ্ঠানটি নাগরিকদের নিয়ে গঠিত বলে দাবি করে থাকে। কিন্তু তাদের সংগঠনে কয়জন নাগরিক আছেন এবং সেই নাগরিকদের চাঁদায় অফিস ভাড়া, সভা-সেমিনারের ব্যয় নির্বাহ হয় কি না, এ ধরনের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দাতাদের অর্থায়নে এনজিওটি পরিচালিত হচ্ছে।
৩. 'সুশাসন' শব্দটি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর হলেও এটিকে সামনে রেখে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো বহুভাবে গণতন্ত্রের ক্ষতি করেছে, এখনো ক্ষতি করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করেছিল 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠার অজুহাতে। সে সময় এক শ্রেণীর রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও এনজিও ব্যক্তিত্ব অনির্বাচিত সরকারের কাছে 'সুশাসন' দাবি করতে থাকেন। আবার কয়েকটি এনজিওর মতো একটি দৈনিক পত্রিকাও 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠার ইজারা পেয়েছে মনে হয়।
৪. বলা প্রয়োজন, শাসন দৃশ্যমান। কিন্তু সুশাসন দৃশ্যমান নয়_এটা অনুভব করা যায়। সুশাসন আসে শাসন প্রতিষ্ঠার পর। সম্প্রতি কয়েকটি সহিংস রাজনৈতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, 'বর্তমানে কোনো শাসন আছে কি না সেটা প্রশ্ন' (যুগান্তর, ৪ অক্টোবর ২০১০)। তাঁর মতো অনেকেই মনে করেন, এখন দেশে দুর্বল শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে আবারও নির্বাচিত সরকার হোঁচট খেতে পারে। তাই জরুরি প্রশ্ন হলো, কোন পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যায়_এ পথ বের করা। দেশি-বিদেশি শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে এ দেশের মানুষ বিভিন্ন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। সে কারণে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্ত। এক শ্রেণীর মতবাদীরা সেই সংকটকে গণতান্ত্রিক উপায়ে অসমাধানযোগ্য মনে করে তন্ত্রমন্ত্রের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু '৫৪, '৭০, '৮৬, '৯১, '৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করে প্রমাণ করেছে, গণতন্ত্রের প্রতি এ দেশের মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সে কারণে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে উপযুক্ত ডিজাইন নিয়ে চিন্তাভাবনা করাই হবে এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
৫. আমাদের সরকারব্যবস্থায় পুরনো ব্যাংকিং পদ্ধতির ছায়া রয়েছে। একসময় একজন ম্যানেজারই ব্যাংকের সব কাজ সম্পাদন করতেন। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে পিরামিড পদ্ধতি অনুসরণ করে সব কাজ ও দায়িত্ব বিভাজন করে দেওয়া আছে। তা ছাড়া ব্যাংককে লাভজনক ও জনকল্যাণকর করার উদ্দেশ্যে পরিচালনা পর্ষদও রয়েছে। ওদিকে ১৬ কোটি জনগণের এই দেশটিতে এককেন্দ্রিক সরকার বিদ্যমান। সে জন্য আমাদের সরকারব্যবস্থা এমনভাবে সাজাতে হবে যেন তাতে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল থাকে। দীর্ঘকাল আগে থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার নামে দুটি পদ্ধতির সঙ্গে জনগণের পরিচয় রয়েছে। অর্থাৎ কিছুটা নামে, কিছুটা কাজের জন্য স্থানীয় সরকারগুলো (বিভাগ, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন ইত্যাদি) ঐতিহ্যবাহী হয়ে উঠেছে। সে জন্য দুই ধরনের সরকার পদ্ধতি অর্থাৎ একটি কেন্দ্রীয় সরকার ও অনেক স্থানীয় সরকার হবে এ দেশে যথোপযুক্ত পদ্ধতি।
৬. আমরা মনে করি, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আগে জরুরি ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থায় মৌলিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে জাতীয় কাজ ও স্থানীয় কাজ নির্দিষ্ট করে সেগুলো কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। অবশ্য এর আগে স্থানীয় সরকারের একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাস ঠিক করে সেগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কায়ন এবং যথোপযুক্ত দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে সে অনুযায়ী পদ সৃষ্টি করতে হবে। আর প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে সরকারি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে সরকারকে জনগণের অধিকতর নিকটবর্তী করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ 'নগর সরকার'-এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনটি বিভাগ, তথা নগর বিধানিক বিভাগ, নগর নির্বাহিক বিভাগ ও নগর বিচারিক বিভাগ মিলে 'নগর সরকার' গঠিত হবে। নগর সরকারের এ কাঠামোর বাইরে একজন নগর ন্যায়পাল ও একটি নির্বাচনিক বোর্ড থাকবে। নগর ন্যায়পাল নগর সরকারের সব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। নগর নির্বাচনিক বোর্ড নগর সরকারের প্রতিনিধিদের মেয়াদ শেষে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। ঢাকামুখী জনস্রোত ঠেকানোসহ পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়ণের লক্ষ্যে ৩১৬টি একরূপ নগর সরকার প্রতিষ্ঠা করা এ মুহূর্তেই প্রয়োজন। স্থানীয় সরকারের অন্য ইউনিটগুলোতেও অনুরূপভাবে 'সরকার কাঠামো' প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে নাগরিকরা কেউ-ই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বাইরে থাকবে না। ফলে জনগণের কাছে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। তখন 'সুশাসন' শব্দটি শুধু প্রচারের বিষয় হয়ে থাকবে না, নিজের প্রয়োজনে ও নিজের চেষ্টায় তা অর্জনের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
লেখকবৃন্দ : অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ডিরেক্টর ইনচার্জ, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, বিসিএস শিক্ষা এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি

No comments

Powered by Blogger.