কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন-বৃহত্তর কল্যাণই হোক লক্ষ্য

কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার দাবি দীর্ঘদিনের। এ দাবি যেমন কওমি মাদ্রাসার অভ্যন্তরে, তেমনি বাইরেও। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এ মাদ্রাসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনুভব করেছেন_ তারা সমাজের উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নানা ক্ষেত্র থেকে যেমন, তেমনি পেশাগতভাবে পিছিয়ে পড়েছেন।


ফলে কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির দাবিটি বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। অন্যদিকে, সমাজের নানা মহল থেকে কওমি মাদ্রাসার সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু অতীতের সরকারগুলোর বিশেষ মনোযোগ পায়নি কওমি মাদ্রাসাগুলো। সেদিক থেকে কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতিদানের উদ্দেশ্যে একটি কমিশন গঠন প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সাধুবাদ জানাতে হয়। জাতীয় শিক্ষানীতিতে এ ধরনের একটি কমিশন গঠনের সুপারিশ ছিল। কওমি মাদ্রাসা-সংশ্লিষ্ট আলেমদের নিয়ে গঠিত কমিশন একটি ইতিবাচক দিকনির্দেশনা দিতে পারবে বলে সবাই আশা করেন। তবে কমিশনের সফলতা নিশ্চিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দরকার। বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক। মোটামুটিভাবে প্রধান ৫টি বোর্ড ও ১৩টি আঞ্চলিক বোর্ডের মাধ্যমে মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হয়। মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা পদ্ধতি, সিলেবাস, পরীক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন ইত্যাদিতে তারতম্য আছে। নানান ধারার মাদ্রাসার মধ্যে সমন্বয়ই হওয়া উচিত কমিশনের প্রধান কর্তব্য। এ কাজটি করতে হলে প্রতিনিধিত্বশীল আলেম ও ধর্মীয় শিক্ষাবিদদের কমিশনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে অথবা কমিশনের সুপারিশে তাদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। বর্তমানে মাদ্রাসাগুলোতে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে অনেক মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমকেই সুপরিকল্পিত বলার উপায় নেই। ১৭ বছরের দরসে নিজামিয়া সম্পন্ন করতে কোনো কোনো মাদ্রাসা ৬ থেকে ১২ বছর মেয়াদি সিলেবাস গ্রহণ করেছে। ফলে শিক্ষার মানে অনেক তারতম্য ঘটছে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাগ করে স্কুল ও কলেজ পর্যায়কে আলাদা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার কথা। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই গরিব। মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পন্ন করার পর শিক্ষার্থীরা যাতে সমাজের বোঝা হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্য সিলেবাসে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, ইতিহাস, ইংরেজিসহ বিভিন্ন কোর্স যুক্ত হওয়া দরকার। বর্তমানে মাদ্রাসাগুলোর সিলেবাসে আরবি-ফার্সির পাশাপাশি উর্দুর ব্যবহার থাকলেও বাংলা ভাষার উপস্থিতি একেবারেই কম। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে আলেমদের ভাবতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা একটি বিশেষায়িত ধর্মীয় শিক্ষা। বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থায় সাযুজ্য আনতে হলে একটি সমন্বিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা, শিক্ষক নিয়োগসহ মাদ্রাসা পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে স্বচ্ছ নীতি প্রণয়ন করা দরকার। সম্প্রতি বিভিন্ন মাদ্রাসা নিয়ে গণমাধ্যমে নানা বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অভিযোগ এসেছে মাদ্রাসাগুলোর অর্থায়ন নিয়ে। ধর্মীয় শিক্ষার মতো একটি ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ থাকা উচিত নয়। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অভিযোগ না ওঠে সেজন্য মাদ্রাসার আয়ের উৎসগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে উলি্লখিত হওয়া উচিত। পাশাপাশি ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ তদারকির ব্যবস্থা থাকা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে কত মাদ্রাসা আছে, সেগুলোতে ছাত্রের সংখ্যা কত তার একটি সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের সহায়তায় তৈরি হওয়া দরকার। মহিলা মাদ্রাসাগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়টিও কমিশনের বিবেচনায় থাকা উচিত। আমরা আশা করি, কমিশনের কার্যক্রমে বিভক্তির চেয়ে সমন্বয়ের বোধটাই প্রাধান্য পাবে। রাজনৈতিক ভেদাভেদ, দ্বিমত ভুলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের দিকে কমিশনের মনোযোগ থাকলে সেটিই হবে আশার কথা।

No comments

Powered by Blogger.