রেলমন্ত্রীর ট্রেন মিস by প্রভাষ আমিন
কথায় আছে সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। কখন থামতে হবে এটা না জানলে ৫৫ বছরের বর্ণাঢ্য উজ্জ্বল ক্যারিয়ারও হারিয়ে যেতে পারে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। ক্রিকেট খেলায় টাইমিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।ব্যাটে-বলে টাইমিং ঠিকমতো হলে ছক্কা হতে পারে, আবার টাইমিংয়ে একটু হেরফের হলে সেই একই বলে ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যেতে পারেন।
আমাদের অতিপ্রিয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছক্কা মেরে হিরো সুযোগ হেলায় হারিয়ে শোচনীয়ভাবে আউট হয়ে গেলেন। এপিএসের অর্থ কেলেঙ্কারির পর পঞ্চম সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যা বললেন, যেভাবে পুরো ঘটনার দায়দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন, তা ঠিকই আছে। এটাই বলা উচিত। শুধু যদি কথাগুলো প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলতেন, তাহলে তিনি যা যা বলেছেন, তা-ই হতো। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম। তিনি ভিলেন না হয়ে হিরো হয়ে যেতে পারতেন। ঘটনার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে এপিএসের পক্ষে সাফাই গেয়ে যে পতনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তাই তাঁকে তিক্ত বিদায়ের অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী গন্তব্যে নিয়ে গেছে। পঞ্চম সংবাদ সম্মেলনে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি বলেছেন, এ বিষয়ে গণমাধ্যমে আর কোনো কথা বলবেন না তিনি। আহা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী যদি আগে তাঁকে এই বুদ্ধি দিতেন। এই কেলেঙ্কারির পর পাঁচটি সংবাদ সম্মেলনে প্রতিটিতেই তিনি বারবার অবস্থান বদল করেছেন, স্ববিরোধী কথা বলে নিজেকে জড়িয়েছেন আরো জটিল জালে। তৃতীয় সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি সেদিকে গেলে পদত্যাগ করতে দ্বিধা করবেন না। জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজেই নিজের পরিস্থিতি পদত্যাগের দিকে নিয়ে গেছেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচার জন্য তিনটি লাইফ লাইন পেয়েছিলেন। ঘটনার পরদিন প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই পুরো ঘটনার নৈতিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করতে পারতেন। এর পরদিন সংসদীয় কমিটির সভা শেষেও পদত্যাগ করতে পারতেন। উল্টো সাংবাদিকদের জ্ঞান দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলেন তিনি। তার পরদিন ছিল তাঁর শেষ লাইফ লাইন। কোনো কারণ ছাড়াই যখন তিনি সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন, সবাই ভাবলেন, বুঝি পদত্যাগের ঘোষণা দিতেই এই সংবাদ সম্মেলন। সেই লাস্ট ট্রেনটিও মিস করলেন ঝানু রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দেশের সবাই যখন বুঝে গেলেন সুরঞ্জিতের পদত্যাগ সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই কথাটি উনি কেন বুঝলেন না। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পরও আবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন সুরঞ্জিত। এপিএস, রেলের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপের কথা জানালেও নিজের পদত্যাগের ব্যাপারে থাকলেন নিশ্চুপ। রাতেই গণভবনে তলব। পরদিনই পদত্যাগের ঘোষণা। এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যতই গণতন্ত্রের স্বার্থ, তদন্তের স্বার্থের কথা বলুন না কেন; জনগণ তা বিশ্বাস করবে না। এই স্বার্থগুলো তো আগেও ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ধমক খাওয়ার আগে কি এই স্বার্থের কথাগুলো তার মাথায় আসেনি? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখন যতই উদাহরণ সৃষ্টির চেষ্টা করুন না কেন, সবাই বুঝে গেছেন, এটা পদত্যাগ নয়, পদচ্যুতি। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত তার পদত্যাগ করার সুযোগ ছিল। সেই সুযোগ তিনি হেলায় হারিয়ে অপেক্ষা করেছেন পদচ্যুতির।
পুরো ঘটনায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মিডিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ চেপে রাখেননি। তিনি একে বলছেন মিডিয়া ট্রায়াল। তাঁর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছি আমরা। হাতেনাতে এমন একটি কেলেঙ্কারি ধরার পর মিডিয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকবে। উনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে কোনো মিডিয়া বাড়াবাড়ি করেছে, মিথ্যা তথ্য লিখেছে, তাহলে আমরা সব অভিযোগ মাথা পেতে নেব। বরং অভিযুক্ত হয়েও তিনি ধমক-ধামক দিয়ে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছেন। অভিযুক্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেই সাংবাদিকরা সব অপমান মাথা নুয়ে সয়ে গেছেন। সুরঞ্জিত যখন ফারুক খানকে কম খান, সালমান রহমানকে শুঁটকির বাজারের চৌকিদার বা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর চেহারার চাকচিক্য নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন, তখনো মিডিয়া তাঁকে যথেষ্ট কাভারেজ দিয়েছে। মিডিয়ার কার্পণ্য কোথায়?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দাবি করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আরো অনেকেই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাজারে ছেড়েছেন। আমিও বিশ্বাস করি, পুরো ঘটনাটিই একটি ফাঁদ। ড্রাইভার আজম তো আর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির না যে তিনি বিবেকের তাড়নায় গাড়ি নিয়ে পিলখানায় ঢুকে গেছেন। ফাঁদ পাতা হলেও সাধারণে বিশ্বাস জন্মে যে সেটি মিথ্যা ফাঁদ নয়। রেলমন্ত্রীর এপিএস, রেলের জিএম আর নিরাপত্তা কর্মকর্তা ৭০ লাখ টাকা নিয়ে মধ্যরাতে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন- এটুকু নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মাঝখানে কেউ একজন ড্রাইভারকে দুঃসাহসী করে তুলেছেন। তাই সুরঞ্জিত বেনিফিট অব ডাউটও পাননি। সুরঞ্জিতের দুর্ভাগ্য, এই ঘটনার দুদিন পর বিটিআরসি সুরঞ্জিতের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্তকে আইজিএঙ্রে লাইসেন্স দিয়েছে। এর জন্য আগেই লাইসেন্স ফি বাবদ পাঁচ কোটি টাকা শোধ করতে হয়েছে। এই ব্যবসা দাঁড় করাতে লাগত আরো ৩০ কোটি টাকা। ছেলের পক্ষে সাফাই গেয়ে সুরঞ্জিত বলেছিলেন, তাঁর আইটি এঙ্পার্ট ছেলে আইজিএঙ্ লাইসেন্স পেতেই পারেন। কিন্তু ৫০ হাজার টাকা মাসিক বেতনের আইটি এঙ্পার্ট কিভাবে হঠাৎ ৩৫ কোটি টাকার ব্যবসা নিয়ে মাঠে নামেন, সেই প্রশ্নের জবাব মেলে না। যেদিন সৌমেন লাইসেন্স পেলেন, সেদিনই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সুনামগঞ্জের দিরাই যাওয়ার কথা ছিল। সেখানকার সবচেয়ে বড় মার্কেটটির উদ্বোধন করতে। এপিএস কেলেঙ্কারিতে তিনি যেতে পারেননি। তবে যথারীতি উদ্বোধন করা হয়েছে শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত 'সেন মার্কেট'। সারা জীবন বাম রাজনীতি করে আসা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চার মাসের মন্ত্রিত্বে কী এমন আলাদিনের চেরাগ পেলেন যে তাঁর ছেলে ৩৫ কোটি টাকার ব্যবসা শুরু করেন, রাতারাতি উঠে যায় 'সেন মার্কেট'। এ দুটি তো চাক্ষুষ প্রমাণ। কিন্তু পত্রপত্রিকায় সুরঞ্জিতের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার অর্পিত সম্পতি দখল, জলাশয় দখলসহ নানা অভিযোগ এসেছে। আর যে তিনজন মধ্যরাতে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন, তাঁদের সম্পর্কেও এন্তার অভিযোগ। ব্যাপারটা এমন নয় যে সুরঞ্জিত একাই দুর্নীতি করেছেন, আর সবাই সাধু পুরুষ। আরো অনেকের সম্পর্কেই শোনা যায়। ধরা পড়ে গেছেন দুর্ভাগা সুরঞ্জিত।
পঞ্চম সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যা বলে পদত্যাগ করলেন, সেটা করা উচিত ছিল প্রথম সংবাদ সম্মেলনে। কিন্তু প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি উল্টো দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সাফাই গাইলেন। ড্রাইভারের বিরুদ্ধে হাইজ্যাকের অভিযোগ আনলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি কেউ। সুরঞ্জিতের ভাষায় ড্রাইভার যাঁদের হাইজ্যাক করেছিল, তাঁদের বিরুদ্ধেই এখন একের পর এক তদন্ত। সংসদীয় কমিটির সভায় বিএনপির এমপি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির দাবি করায় সুরঞ্জিত তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এক দিন পরই তিনি হাইকোর্ট, দুদক, এনবিআর- সবাইকে তদন্তের জন্য ডাকলেন। আগের দিন বললেন, জিএমকে বরখাস্ত করার এখতিয়ার নেই তাঁর। পরদিনই তাঁকে বরখাস্ত করলেন। সুরঞ্জিতের মতো ঝানু রাজনীতিবিদের কাছ এতটা নড়বড়ে পদক্ষেপ আশা করেনি কেউ।
পুরো ঘটনায় ধন্যবাদ পাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার পর পরই তিনি দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। সবাই গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ফিরে এসে কী পদক্ষেপ নেন তা দেখার জন্য। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও দেরি করেননি। তাঁর এই ত্বরিত সিদ্ধান্তে সুরঞ্জিতের মন্ত্রিত্ব গেছে, কিন্তু বেঁচেছে সরকার এবং দল।
এ ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। বিট হিসেবে দীর্ঘদিন সংসদ কাভার করার সুবাদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে। সংবিধান, সংসদীয় নিয়মকানুন অনেক কিছুই শিখেছি তাঁর কাছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধু অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানই নন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল হতে বসা 'বর্ণাঢ্য চরিত্র'গুলোর একজন। আমরা সব সময় চাই ফুলটাইম রাজনীতিবিদরাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। ইদানীং যেভাবে ব্যবসায়ীরা এসে রাজনীতি দখল করে ফেলছেন, তা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। তাই তো সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আসা দুর্নীতির অভিযোগ আমাদের স্পর্শ করে না। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পতন আমাদের ভারাক্রান্ত করে। এই ঘটনায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একা হারেননি, গণতন্ত্রের পক্ষে যারা তারা সবাই হেরেছে।
পাদটিকা : বিএনপির মতো কৃপণ নই আমরা। তাই প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া ধন্যবাদ আমরা ফিরিয়ে নিতে চাই না। তবে এত অভিযোগের পর সুরঞ্জিতকে আবার দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করাটা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
লেখক : সাংবাদিক
probhash2000@gmail.com
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচার জন্য তিনটি লাইফ লাইন পেয়েছিলেন। ঘটনার পরদিন প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই পুরো ঘটনার নৈতিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করতে পারতেন। এর পরদিন সংসদীয় কমিটির সভা শেষেও পদত্যাগ করতে পারতেন। উল্টো সাংবাদিকদের জ্ঞান দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলেন তিনি। তার পরদিন ছিল তাঁর শেষ লাইফ লাইন। কোনো কারণ ছাড়াই যখন তিনি সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন, সবাই ভাবলেন, বুঝি পদত্যাগের ঘোষণা দিতেই এই সংবাদ সম্মেলন। সেই লাস্ট ট্রেনটিও মিস করলেন ঝানু রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দেশের সবাই যখন বুঝে গেলেন সুরঞ্জিতের পদত্যাগ সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই কথাটি উনি কেন বুঝলেন না। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পরও আবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন সুরঞ্জিত। এপিএস, রেলের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপের কথা জানালেও নিজের পদত্যাগের ব্যাপারে থাকলেন নিশ্চুপ। রাতেই গণভবনে তলব। পরদিনই পদত্যাগের ঘোষণা। এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যতই গণতন্ত্রের স্বার্থ, তদন্তের স্বার্থের কথা বলুন না কেন; জনগণ তা বিশ্বাস করবে না। এই স্বার্থগুলো তো আগেও ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ধমক খাওয়ার আগে কি এই স্বার্থের কথাগুলো তার মাথায় আসেনি? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখন যতই উদাহরণ সৃষ্টির চেষ্টা করুন না কেন, সবাই বুঝে গেছেন, এটা পদত্যাগ নয়, পদচ্যুতি। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত তার পদত্যাগ করার সুযোগ ছিল। সেই সুযোগ তিনি হেলায় হারিয়ে অপেক্ষা করেছেন পদচ্যুতির।
পুরো ঘটনায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মিডিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ চেপে রাখেননি। তিনি একে বলছেন মিডিয়া ট্রায়াল। তাঁর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছি আমরা। হাতেনাতে এমন একটি কেলেঙ্কারি ধরার পর মিডিয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকবে। উনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে কোনো মিডিয়া বাড়াবাড়ি করেছে, মিথ্যা তথ্য লিখেছে, তাহলে আমরা সব অভিযোগ মাথা পেতে নেব। বরং অভিযুক্ত হয়েও তিনি ধমক-ধামক দিয়ে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছেন। অভিযুক্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেই সাংবাদিকরা সব অপমান মাথা নুয়ে সয়ে গেছেন। সুরঞ্জিত যখন ফারুক খানকে কম খান, সালমান রহমানকে শুঁটকির বাজারের চৌকিদার বা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর চেহারার চাকচিক্য নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন, তখনো মিডিয়া তাঁকে যথেষ্ট কাভারেজ দিয়েছে। মিডিয়ার কার্পণ্য কোথায়?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দাবি করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আরো অনেকেই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাজারে ছেড়েছেন। আমিও বিশ্বাস করি, পুরো ঘটনাটিই একটি ফাঁদ। ড্রাইভার আজম তো আর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির না যে তিনি বিবেকের তাড়নায় গাড়ি নিয়ে পিলখানায় ঢুকে গেছেন। ফাঁদ পাতা হলেও সাধারণে বিশ্বাস জন্মে যে সেটি মিথ্যা ফাঁদ নয়। রেলমন্ত্রীর এপিএস, রেলের জিএম আর নিরাপত্তা কর্মকর্তা ৭০ লাখ টাকা নিয়ে মধ্যরাতে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন- এটুকু নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মাঝখানে কেউ একজন ড্রাইভারকে দুঃসাহসী করে তুলেছেন। তাই সুরঞ্জিত বেনিফিট অব ডাউটও পাননি। সুরঞ্জিতের দুর্ভাগ্য, এই ঘটনার দুদিন পর বিটিআরসি সুরঞ্জিতের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্তকে আইজিএঙ্রে লাইসেন্স দিয়েছে। এর জন্য আগেই লাইসেন্স ফি বাবদ পাঁচ কোটি টাকা শোধ করতে হয়েছে। এই ব্যবসা দাঁড় করাতে লাগত আরো ৩০ কোটি টাকা। ছেলের পক্ষে সাফাই গেয়ে সুরঞ্জিত বলেছিলেন, তাঁর আইটি এঙ্পার্ট ছেলে আইজিএঙ্ লাইসেন্স পেতেই পারেন। কিন্তু ৫০ হাজার টাকা মাসিক বেতনের আইটি এঙ্পার্ট কিভাবে হঠাৎ ৩৫ কোটি টাকার ব্যবসা নিয়ে মাঠে নামেন, সেই প্রশ্নের জবাব মেলে না। যেদিন সৌমেন লাইসেন্স পেলেন, সেদিনই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সুনামগঞ্জের দিরাই যাওয়ার কথা ছিল। সেখানকার সবচেয়ে বড় মার্কেটটির উদ্বোধন করতে। এপিএস কেলেঙ্কারিতে তিনি যেতে পারেননি। তবে যথারীতি উদ্বোধন করা হয়েছে শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত 'সেন মার্কেট'। সারা জীবন বাম রাজনীতি করে আসা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চার মাসের মন্ত্রিত্বে কী এমন আলাদিনের চেরাগ পেলেন যে তাঁর ছেলে ৩৫ কোটি টাকার ব্যবসা শুরু করেন, রাতারাতি উঠে যায় 'সেন মার্কেট'। এ দুটি তো চাক্ষুষ প্রমাণ। কিন্তু পত্রপত্রিকায় সুরঞ্জিতের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার অর্পিত সম্পতি দখল, জলাশয় দখলসহ নানা অভিযোগ এসেছে। আর যে তিনজন মধ্যরাতে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন, তাঁদের সম্পর্কেও এন্তার অভিযোগ। ব্যাপারটা এমন নয় যে সুরঞ্জিত একাই দুর্নীতি করেছেন, আর সবাই সাধু পুরুষ। আরো অনেকের সম্পর্কেই শোনা যায়। ধরা পড়ে গেছেন দুর্ভাগা সুরঞ্জিত।
পঞ্চম সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যা বলে পদত্যাগ করলেন, সেটা করা উচিত ছিল প্রথম সংবাদ সম্মেলনে। কিন্তু প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি উল্টো দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সাফাই গাইলেন। ড্রাইভারের বিরুদ্ধে হাইজ্যাকের অভিযোগ আনলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি কেউ। সুরঞ্জিতের ভাষায় ড্রাইভার যাঁদের হাইজ্যাক করেছিল, তাঁদের বিরুদ্ধেই এখন একের পর এক তদন্ত। সংসদীয় কমিটির সভায় বিএনপির এমপি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির দাবি করায় সুরঞ্জিত তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এক দিন পরই তিনি হাইকোর্ট, দুদক, এনবিআর- সবাইকে তদন্তের জন্য ডাকলেন। আগের দিন বললেন, জিএমকে বরখাস্ত করার এখতিয়ার নেই তাঁর। পরদিনই তাঁকে বরখাস্ত করলেন। সুরঞ্জিতের মতো ঝানু রাজনীতিবিদের কাছ এতটা নড়বড়ে পদক্ষেপ আশা করেনি কেউ।
পুরো ঘটনায় ধন্যবাদ পাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার পর পরই তিনি দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। সবাই গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ফিরে এসে কী পদক্ষেপ নেন তা দেখার জন্য। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও দেরি করেননি। তাঁর এই ত্বরিত সিদ্ধান্তে সুরঞ্জিতের মন্ত্রিত্ব গেছে, কিন্তু বেঁচেছে সরকার এবং দল।
এ ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। বিট হিসেবে দীর্ঘদিন সংসদ কাভার করার সুবাদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে। সংবিধান, সংসদীয় নিয়মকানুন অনেক কিছুই শিখেছি তাঁর কাছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধু অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানই নন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল হতে বসা 'বর্ণাঢ্য চরিত্র'গুলোর একজন। আমরা সব সময় চাই ফুলটাইম রাজনীতিবিদরাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। ইদানীং যেভাবে ব্যবসায়ীরা এসে রাজনীতি দখল করে ফেলছেন, তা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। তাই তো সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আসা দুর্নীতির অভিযোগ আমাদের স্পর্শ করে না। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পতন আমাদের ভারাক্রান্ত করে। এই ঘটনায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একা হারেননি, গণতন্ত্রের পক্ষে যারা তারা সবাই হেরেছে।
পাদটিকা : বিএনপির মতো কৃপণ নই আমরা। তাই প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া ধন্যবাদ আমরা ফিরিয়ে নিতে চাই না। তবে এত অভিযোগের পর সুরঞ্জিতকে আবার দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করাটা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
লেখক : সাংবাদিক
probhash2000@gmail.com
No comments