সদরে অন্দরে-নারীনীতি নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার by মোস্তফা হোসেইন

বাঘ ও ভেড়ার গল্প। ভেড়ার বাচ্চা পানি খাচ্ছিল নদীর ভাটিতে। উজানে থেকে বাঘ বলল, 'এই, পানি ঘোলা করিস কেন?' অবাক কাণ্ড! 'পানি যদি ঘোলাও হয়, সেই পানি উজানে যাবে কী করে_বাঘ মশাই?' বাঘ বলে, 'তাতে কি, তোর বাবা আমাকে গালি দিয়েছিল, সেটার কী হবে?'


সত্যি কথা। পানি উজানে না গেলেও বাঘের নজর ভেড়ার বাচ্চার দিকে যায়। ঘোলা পানি আসলে কোনো ব্যাপার নয়, তার চাই ভেড়ার বাচ্চা। কোনো না কোনো অছিলা বের করে নিতে তার কোনো অসুবিধা নেই। কারণ ভেড়ার বাচ্চাটা যে তার চাই-ই চাই।
বহুল প্রচলিত গল্প। যখন-তখন মনে আসে। আর মিলিয়ে নিতে ইচ্ছা করে চলমান অনেক ঘটনার সঙ্গে। এই যেমন 'নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১'র বিষয়ে বলা যায়। আমাদের দেশের কিছু মানুষ 'নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১'কে ইসলামবিরোধী বলছে। তাদের এহেন আচরণ দেখে সেই পুরনো গল্পের কথাই মনে পড়ে। তারাও যেন গল্পের সেই বাঘের মতোই। ভাটিতে থেকেও ভেড়ার বাচ্চা যেমন উজানে থাকা বাঘের পানি ঘোলা করার অপরাধে অভিযুক্ত হয়, তেমনি 'নারী উন্নয়ন নীতি'তে ইসলামবিরোধী কিছু না থাকার পরও তাকে অভিযুক্ত হতে হয়। কারণ একটাই_নারীকে তারা পদানত করে রাখতে চায়। নারীকে সেবাদাসী হিসেবে দেখে আসার এই হীন মানসিকতা থেকেই তাদের আন্দোলনের ইচ্ছা জাগে। আর সেই ইচ্ছাকে পুঁজি করে তারা হরতাল ডাকে, মাদ্রাসার কোমলমতি শিশুদের লাঠিসোঁটা হাতে দিয়ে মারপিটে নামিয়ে দেয়। গাড়ি ভাঙচুর করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্বাভাবিক করার প্রয়াস পায়।
'নারী উন্নয়ন নীতি'কে কোন কারণে কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী হিসেবে তারা আখ্যায়িত করছে? এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা তাদের কাছ থেকে আজ অবধি পাওয়া যায়নি। বরং প্রকাশ্যে তারা যা বলছে, তাকে ডাহা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। তারা বলছে, শরিয়ত মোতাবেক নারীর উত্তরাধিকার স্বত্বে যে সম্পদ পাওয়ার কথা তার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে 'নারীনীতি'তে। এটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যাচার, তা বোধকরি, খুলে বলার প্রয়োজন নেই। 'নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১'-এর ২৫(২) অনুচ্ছেদে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন শিরোনামে স্পষ্ট বলা আছে, 'উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজারব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।' যদি কেউ বাংলা বোঝেন, তাহলে তাঁর পক্ষে এই অনুচ্ছেদ পড়ার পর বলতেই হবে যে এখানে উত্তরাধিকারী হিসেবে নারী যে সম্পদ অর্জন করবে, তার ওপর নারীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকে পুরুষের সমান ভাগ দিতে হবে, তা কি এখানে উল্লেখ আছে? মোটেও না। তাহলে কি নারী যে অর্থসম্পদ অর্জন করবে সেই সম্পদের ওপর তার পূর্ণ অধিকার আন্দোলনকারীরা মেনে নিতে চাইছে না? তাহলে কোন কারণে তারা এহেন অভিযোগ আনছে? স্পষ্ট মন্তব্য করা যায়, আসলে তারা চাইছে নারী তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকুক। নারী পুরুষের পদানত হয়ে থাকুক।
বাস্তবতা হচ্ছে, নারী তার অর্জিত সম্পত্তির ওপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্ণ অধিকার পায় না। স্বামীর ঘরে গেলে স্ত্রীর সম্পত্তি যেন স্বামীরই হক হয়ে দাঁড়ায়। আবার বাবার বাড়ির সম্পদও যেটুকু নারী শরিয়ত অনুযায়ী মালিক হয়, সেটুকুও যেন তার জন্য করুণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কখনো ভাইদের চাপে পড়তে হয় তাকে। কখনো আবদারও চলে বোনের প্রতি। চাপ কিংবা আবদারের যুক্তি থাকে_বাবার বাড়িতে বছরকালে একবার এলে যে আপ্যায়ন প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে ভাইদের সমঝে চলাই যেন নারীর প্রধান দায়িত্ব। স্বামীর ঘরে গিয়ে তো স্ত্রী নিজেই স্বামীর ব্যবহার্য পণ্য হয়ে যায়। সম্পদের তো প্রশ্নই আসে না।
একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে, এ নারীনীতির মাধ্যমে নাকি পশ্চিমা জীবনব্যবস্থাকে ডেকে আনা হবে। কোন কারণে এমন সন্দেহ তারা করছে, সেই ব্যাখ্যা কিন্তু তারা দেয়নি। তারা সিডওর কথা বলছে। সিডও নাকি পশ্চিমা জীবনব্যবস্থার আলোকে করা! তাহলে বাংলার জীবনব্যবস্থার আলোক কোনটা? তারা যেমন 'নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১' না পড়েই হরতালে যেতে পারে, তেমনি তারা সিডও না পড়েই মন্তব্য করতে পারে। এভাবে কিছু না পড়ে, না বুঝে মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলার যৌক্তিকতা নেই। সম্পদে পুরুষের পাশাপাশি নারীর যেটুকু অধিকার আছে, তা যারা মানে না, তারা যেমন দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন মানে না, তেমনি শরিয়তও মানে না। মুসলিম পারিবারিক আইন তো মানেই না। সংগত কারণেই তাদের কাছ থেকে শোনা প্রয়োজন, তারা কোন আইন বলবৎ করতে চায়?
সংবিধানে স্পষ্টভাবে নারী, পুরুষ, ধর্ম কিংবা স্থানিক কারণে কোনো নাগরিকের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না বলা আছে। তারই ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে 'নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১'। একে অস্বীকার করা সংবিধানকে অস্বীকার করারই শামিল। আর সেই সুবাদে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা আনা যায়। পশ্চাৎগামী কিছু মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করে দেশে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এটা তাদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিরও কি সে রকম বৈশিষ্ট্য? এ প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে যখন তারা নারী উন্নয়ন নীতির সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতির প্রসঙ্গ টেনে আনে। নারী উন্নয়ন নীতি সম্পর্কে এখনো তারা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। বরং তারা বলেছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসে এমন কিছু নাকি তারা মেনে নেবে না। তাহলে তারা কী বলতে চায়, 'নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১' ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো? প্রধান বিরোধী দলের কাছ থেকে এভাবে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.