বিশ্বকাপ ও ভবঘুরে-ভূতগুলো সব কোথায় গেল? by ফারুক ওয়াসিফ
ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম কারওয়ান বাজারে। ভূতটা পিছু নেয় মেছোপট্টিতেই, হয়তো ইলিশের গন্ধেই। তারপর সবজির বাজার হয়ে পেঁয়াজ-রসুনের পাইকারি বাজারে এসে তার সাহস বেড়ে যায়, একদম পাশে এসে দাঁড়ায়। চোখ দুটো কোটরাগত, গায়ে বোঁটকা গন্ধ। হাড় জিরজিরে দেহ, মাথায় বাঁশের টুকরি।
বলি, নাম কী? হলুদ দাঁত বের করে বলে, ‘মিন্তি’। মিন্তি ভূতটার একটাই মিনতি, ‘মালগুলান মাথায় নিই’? বলেই মালসামান তুলে হাঁটা দিল। হাড়ের কাঠামোটি কোমর নাচাতে নাচাতে বোঝা নিয়ে ছোটে, আমি ছুটি তার পেছনে। একে তো ভূত, তায় ক্ষুধার্ত। ইলিশের লোভ কি সে ছাড়বে?
ভয় নিয়েই কথা চালাই, মিন্তি মানে কী? হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দেয়, ‘বুইলেন না, কুলি, আমরা মোট বই।’ ভূতটার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। নাম রকিবুল। সবেধন টুকরিটাও তার নয়। ২০ টাকা ভাড়া। দিনে মাথায় নেয়, রাতে এর মধ্যেই হাঁটু মুড়ে ঘুমায়। দিনে রোজগার দেড়-দুই শ টাকা। বাজারে মোট বয়, আর রাতে ঘুমায় চাঁদের অপর পিঠে, পূর্ণিমা সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতের অমাবস্যায়। খায় শেরাটন হোটেলের খাবার। উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফুটপাত মার্কেটে তার দাম প্লেটপ্রতি ২০ টাকা। আগে জমিতে খাটত। এখন কিছু নেই, কেউ নেই। না মরেই এরা ভূতের মতো হয়ে যায়। সোডিয়াম বাতির ভুতুড়ে আলোর সেই ফুটপাতেই চলে প্রেম ও ঝগড়া, জন্ম দেওয়া ও মরা, সন্তানের স্তন্যদান কিংবা অনাহার। সেখানেই তাদের সমাজ-সংসার। এ জীবন ভূতের জীবন, এদের বেগার ভূতের বেগার।
ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই ভূতসমাজকে উচ্ছেদ করছে পুলিশ। ভূতের মতোই দিনে তারা কোথায় কোন ধান্ধায় ঘুরে বেড়ায় তার ঠিক নেই। রাতে পাওয়া যায় ফুটপাতে, আন্ডারপাসে, রাজপথের চিপায়, দোকানপাটের সিঁড়িতে। তাই তাদের ধরা হয় রাতেই। তারপর চালান হয় অন্য কোথাও। এই শীতে কেবল ফুটপাতবাসীই নয়, হকার ও ভিখিরিরাও উচ্ছেদের শিকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ১৭ ফেব্রুয়ারি ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ঢাকার প্রধান প্রধান রাজপথ হকার, ভিখারি ও ফুটপাতবাসীমুক্ত করা হবে। কেন? বিদেশি দর্শকদের চোখে ঢাকাকে যাতে সুন্দর দেখায়, তিলোত্তমা লাগে। গরিব মানুষ ময়লার মতো, ভূতের মতো—তাদের পরিষ্কার করতে হয়, ভূত ঝাড়ানোর মতো তাদেরও দাবড়ানির ওপর রাখতে হয়। সম্প্রতি দিল্লি শহরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসের আগেও এ রকম উচ্ছেদ চলেছিল। প্রতিবাদও হয়েছিল। বাংলাদেশে সে রকম প্রতিবাদ এখনো জাগেনি।
অথচ এই ভিখারি ও পুলিশ আমাদেরই তৈরি। এই পুলিশ দিয়ে সেই সব ভিটাহারাকে খেদালেই কি সরকার মহাশয় দায়মুক্ত হবেন? সরকারি চোখে এরা ‘বদ স্বভাবের’ উটকো লোকজন, যারা ঠিক ‘আমাদের’ মতো মানুষ নয়। মানবাধিকার ও সুবিচারের হাত এই সব তলানির মানুুষ পর্যন্ত পৌঁছে না। উল্টো এদের বিরুদ্ধে নতুন আইন বানাচ্ছে সরকার। গত ৯ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ ‘ভবঘুরে ও আশ্রয়হীন ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১০’ এর খসড়া পাস করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র ব্লাস্ট, ব্র্যাক ও এডিডি আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘...এই খসড়া দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক এবং স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। এই আইন ‘ভবঘুরে এবং আশ্রয়হীন ব্যক্তি’র আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক স্বেচ্ছাচারী এবং বৈষম্যমূলক আটককে বৈধতা দান করে এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন সমর্থন করে।’ এ কারণেই মৌলিক অধিকারবিরোধী হয়রানিমূলক গণগ্রেপ্তারের অস্ত্রও এ ধরনের আইন। গরিব লোক দেখে দেখে ধরা হয়। তারপর মামলা-জামিনের সুড়ঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তারা আরও গরিব হয়ে যায়, কেউ কেউ ভিখারিও হয়। গরিববিরোধী আইন এভাবে গরিবি বাড়ায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র যে মৌলিক অধিকারবিরোধী এমন আইন বাতিলে উচ্চ আদালতে আরজি পেশ করেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ।
ইংরেজ আমলে ক্রিমিনাল ট্রাইব বলে একটা আইনি মার্কা ছিল। স্বাধীনচেতা সাঁওতাল-মুণ্ডা প্রভৃতি জাতির গায়ে এই মার্কা মেরে দেওয়া হতো এবং কারণে-অকারণে তাদের হয়রানি-দুঃশাসনের শিকার হতে হতো (আজ যেটা হচ্ছে পাশ্চাত্যের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বেলায়)। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ এ রকম এক আইন। এর ৮১ নম্বর ধারায় ভিক্ষাবৃত্তিকে অপরাধ বলা হয়েছে এবং এর শাস্তি এক মাসের কারাবাস। কিন্তু মানুষ কেন ভিক্ষায় বাধ্য হয়, সে বিষয়ে এই আইন লা-জবাব। এই আইন ঘা-পাঁচড়া প্রদর্শনকারীদেরও শাস্তি দেয়, কিন্তু তাদের চিকিৎসা? ক্ষুধা ও অক্ষমতার বিরুদ্ধে শেষ আশ্রয় ভিক্ষাবৃত্তি, বিকল্প ছাড়া সেই আশ্রয় কেড়ে নেওয়া অমানবিকতা। শারীরিকভাবে বাধাগ্রস্ত ব্যক্তিকে কম লোকই কাজ দেবে, কিন্তু তাদের গালি দেওয়ায় সবাই অকৃপণ।
এই আইন কারও পোশাক ভিক্ষুক বা ভবঘুরের মতো মনে হলে তাকে আটক করার ক্ষমতা দেয় পুলিশকে। পুলিশই এখানে ম্যাজিস্ট্রেটের মতো ক্ষমতাবান। ময়মনসিংহের ১৩ বছরের বালক সেলিম শারীরিক প্রতিবন্ধী। সে একটি হোটেলে সকালের পালার কাজ শেষে পার্কে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিল। পুলিশ তাকে সেখান থেকে তুলে দুই বছরের জন্য সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে আটকে রাখে। এই সময়ে তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল কেউ যদি নিরুপায় হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামে, তখন পুলিশ নিশ্চয় তাদেরও ধরবে। আটকাবাসে বাড়িতে একটা চিঠি পাঠাতে সেলিমকে তার গায়ের শার্ট বিক্রি করতে হয়। সেখানে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার দণ্ড তিন মাসের কঠিন শ্রম। নিরন্ন নিরাশ্রয় মানুষের উপায় না খুঁজে এ ধরনের আইন যাঁরা বানান, তাঁরা দরিদ্রদের অপরাধী ভাবার মানসিকতায় নিমজ্জিত থেকে উপহাস করেন আইন ও মানবাধিকারকেই। দারিদ্র্য সৃষ্টির দায় যেমন তাঁরা নেন না, তেমনি ভিখারি ও ভবঘুরেদের দমনে সরকারি কর্মচারীদের দেন আগাম দায়মুক্তি। তাঁরা অপরাধ করলেও থাকবেন বিচারের ঊর্ধ্বে।
এই আইনই এখন রাজধানী ঢাকাকে সুশীল বানানোর হাতিয়ার। বিশ্বকাপ উপলক্ষে তাই পথবাসী গরিবেরা হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। বিশ্বকাপের দেড় মাস এরা জীবিকা, বাসস্থান এবং নিজস্ব সমাজ থেকে বঞ্চিত থাকবে। বেওয়ারিশ কুকুরের মতো ধরে-বেঁধে যাদের শহরের বাইরে ছেড়ে আসা হবে, তারা কী খাবে, কোথায় থাকবে, তার দায়িত্ব কার? ২৫ মার্চের কালো রাতে প্রথম যে বাঙালিরা গণহত্যার শিকার হয়েছিল, তারা ছিল নীলক্ষেতের বস্তিবাসী আর বিভিন্ন জায়গার ফুটপাতবাসী। এরা যেন রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী, রাষ্ট্রের আওতার মধ্যে থেকেও এরা রাষ্ট্রবহির্ভূত। পুলিশের লাঠি ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনো সেবা এরা পায় না। এরা যেন পড়ে থাকা ময়লা, যাদের নিষ্কাশন করতে হয়। ভিখারি ও ফুটপাতবাসী হলো ভাইরাস, পুলিশ ও আইন হলো তার অ্যান্টি-ভাইরাস। অথচ পুলিশ নয়, এদের কাছে পাঠানো দরকার সেবা-সাহায্যের কর্মসূচি।
রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এই ধরনের মানুষকে বলা হতো ‘হোমো সাসের’। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের লন্ডনে ভিখারি ও ভবঘুরেদের এমনকি ফাঁসিও দেওয়া হতো। এদের হত্যায় অপরাধ হতো না। অথচ এই শহর ঢাকায় এ ধরনের মানুষের সংখ্যা ৩০-৪০ লাখ! ঢাকা শহরেই ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এদের চার-ছয় হাজার জনই আবার প্রতিবন্ধী। রাজনৈতিক দলগুলোও এদের ব্যাপারে দায়মুক্ত, কারণ এদের ভোট নেই। এদের সেবা নিয়েই এই শহর ও তার সবকিছু চলছে। অথচ শহরের সবচেয়ে বড় উৎসবে এরা অবাঞ্ছিত। আলো-ঝলমল সেই উৎসবের অপর পিঠের এই অন্ধকার এভাবে ঢাকা যাবে না। যত রস শুষে নেওয়া হবে, ততই ছিবড়ার পাহাড় জমতে থাকবে। কালো আইন কিংবা সুশীল চোখের আড়ে সেই পাহাড় ঢাকা যাবে না।
বলিউডের স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবিটি এই সব পথশিশুকে নিয়েই। সেখানে বস্তিবাসী সেলিম মলত্যাগ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে। বাইরে হইচই হচ্ছে, অমিতাভ আসছেন। হেলিকপ্টার নামছে। শয়তানি করে কেউ খাটা-পায়খানার ছিটকিনি বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছে। নিচের মল জমা হওয়ার চৌবাচ্চায় পড়ার পথটাই কেবল খোলা। নায়কসম্রাটকে দেখতে মরিয়া সেলিম সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। মলমাখা শরীরেই সে হাজির হয় তার স্বপ্নের নায়কের সামনে। মলমাখা হাতটাই সে তার প্রিয় নায়কের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্বকাপের আনন্দে মাতোয়ারা আমাদের সামনেও কিন্তু হাজির হতে পারে সেই ভূতেরা, তাদের ভূতশিশুরা, তাদের ভূতমায়েরা। বাড়িয়ে দিতে পারে তাদের শীর্ণ বাঁকানো হাত। আমরা যতই তাদের অদৃশ্য করে দিই না কেন, ভূতের মতো তাদের জীবন আমাদের তাড়া করে ফিরবে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.comভয় নিয়েই কথা চালাই, মিন্তি মানে কী? হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দেয়, ‘বুইলেন না, কুলি, আমরা মোট বই।’ ভূতটার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। নাম রকিবুল। সবেধন টুকরিটাও তার নয়। ২০ টাকা ভাড়া। দিনে মাথায় নেয়, রাতে এর মধ্যেই হাঁটু মুড়ে ঘুমায়। দিনে রোজগার দেড়-দুই শ টাকা। বাজারে মোট বয়, আর রাতে ঘুমায় চাঁদের অপর পিঠে, পূর্ণিমা সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতের অমাবস্যায়। খায় শেরাটন হোটেলের খাবার। উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফুটপাত মার্কেটে তার দাম প্লেটপ্রতি ২০ টাকা। আগে জমিতে খাটত। এখন কিছু নেই, কেউ নেই। না মরেই এরা ভূতের মতো হয়ে যায়। সোডিয়াম বাতির ভুতুড়ে আলোর সেই ফুটপাতেই চলে প্রেম ও ঝগড়া, জন্ম দেওয়া ও মরা, সন্তানের স্তন্যদান কিংবা অনাহার। সেখানেই তাদের সমাজ-সংসার। এ জীবন ভূতের জীবন, এদের বেগার ভূতের বেগার।
ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই ভূতসমাজকে উচ্ছেদ করছে পুলিশ। ভূতের মতোই দিনে তারা কোথায় কোন ধান্ধায় ঘুরে বেড়ায় তার ঠিক নেই। রাতে পাওয়া যায় ফুটপাতে, আন্ডারপাসে, রাজপথের চিপায়, দোকানপাটের সিঁড়িতে। তাই তাদের ধরা হয় রাতেই। তারপর চালান হয় অন্য কোথাও। এই শীতে কেবল ফুটপাতবাসীই নয়, হকার ও ভিখিরিরাও উচ্ছেদের শিকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ১৭ ফেব্রুয়ারি ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ঢাকার প্রধান প্রধান রাজপথ হকার, ভিখারি ও ফুটপাতবাসীমুক্ত করা হবে। কেন? বিদেশি দর্শকদের চোখে ঢাকাকে যাতে সুন্দর দেখায়, তিলোত্তমা লাগে। গরিব মানুষ ময়লার মতো, ভূতের মতো—তাদের পরিষ্কার করতে হয়, ভূত ঝাড়ানোর মতো তাদেরও দাবড়ানির ওপর রাখতে হয়। সম্প্রতি দিল্লি শহরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসের আগেও এ রকম উচ্ছেদ চলেছিল। প্রতিবাদও হয়েছিল। বাংলাদেশে সে রকম প্রতিবাদ এখনো জাগেনি।
অথচ এই ভিখারি ও পুলিশ আমাদেরই তৈরি। এই পুলিশ দিয়ে সেই সব ভিটাহারাকে খেদালেই কি সরকার মহাশয় দায়মুক্ত হবেন? সরকারি চোখে এরা ‘বদ স্বভাবের’ উটকো লোকজন, যারা ঠিক ‘আমাদের’ মতো মানুষ নয়। মানবাধিকার ও সুবিচারের হাত এই সব তলানির মানুুষ পর্যন্ত পৌঁছে না। উল্টো এদের বিরুদ্ধে নতুন আইন বানাচ্ছে সরকার। গত ৯ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ ‘ভবঘুরে ও আশ্রয়হীন ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১০’ এর খসড়া পাস করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র ব্লাস্ট, ব্র্যাক ও এডিডি আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘...এই খসড়া দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক এবং স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। এই আইন ‘ভবঘুরে এবং আশ্রয়হীন ব্যক্তি’র আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক স্বেচ্ছাচারী এবং বৈষম্যমূলক আটককে বৈধতা দান করে এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন সমর্থন করে।’ এ কারণেই মৌলিক অধিকারবিরোধী হয়রানিমূলক গণগ্রেপ্তারের অস্ত্রও এ ধরনের আইন। গরিব লোক দেখে দেখে ধরা হয়। তারপর মামলা-জামিনের সুড়ঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তারা আরও গরিব হয়ে যায়, কেউ কেউ ভিখারিও হয়। গরিববিরোধী আইন এভাবে গরিবি বাড়ায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র যে মৌলিক অধিকারবিরোধী এমন আইন বাতিলে উচ্চ আদালতে আরজি পেশ করেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ।
ইংরেজ আমলে ক্রিমিনাল ট্রাইব বলে একটা আইনি মার্কা ছিল। স্বাধীনচেতা সাঁওতাল-মুণ্ডা প্রভৃতি জাতির গায়ে এই মার্কা মেরে দেওয়া হতো এবং কারণে-অকারণে তাদের হয়রানি-দুঃশাসনের শিকার হতে হতো (আজ যেটা হচ্ছে পাশ্চাত্যের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বেলায়)। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ এ রকম এক আইন। এর ৮১ নম্বর ধারায় ভিক্ষাবৃত্তিকে অপরাধ বলা হয়েছে এবং এর শাস্তি এক মাসের কারাবাস। কিন্তু মানুষ কেন ভিক্ষায় বাধ্য হয়, সে বিষয়ে এই আইন লা-জবাব। এই আইন ঘা-পাঁচড়া প্রদর্শনকারীদেরও শাস্তি দেয়, কিন্তু তাদের চিকিৎসা? ক্ষুধা ও অক্ষমতার বিরুদ্ধে শেষ আশ্রয় ভিক্ষাবৃত্তি, বিকল্প ছাড়া সেই আশ্রয় কেড়ে নেওয়া অমানবিকতা। শারীরিকভাবে বাধাগ্রস্ত ব্যক্তিকে কম লোকই কাজ দেবে, কিন্তু তাদের গালি দেওয়ায় সবাই অকৃপণ।
এই আইন কারও পোশাক ভিক্ষুক বা ভবঘুরের মতো মনে হলে তাকে আটক করার ক্ষমতা দেয় পুলিশকে। পুলিশই এখানে ম্যাজিস্ট্রেটের মতো ক্ষমতাবান। ময়মনসিংহের ১৩ বছরের বালক সেলিম শারীরিক প্রতিবন্ধী। সে একটি হোটেলে সকালের পালার কাজ শেষে পার্কে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিল। পুলিশ তাকে সেখান থেকে তুলে দুই বছরের জন্য সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে আটকে রাখে। এই সময়ে তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল কেউ যদি নিরুপায় হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামে, তখন পুলিশ নিশ্চয় তাদেরও ধরবে। আটকাবাসে বাড়িতে একটা চিঠি পাঠাতে সেলিমকে তার গায়ের শার্ট বিক্রি করতে হয়। সেখানে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার দণ্ড তিন মাসের কঠিন শ্রম। নিরন্ন নিরাশ্রয় মানুষের উপায় না খুঁজে এ ধরনের আইন যাঁরা বানান, তাঁরা দরিদ্রদের অপরাধী ভাবার মানসিকতায় নিমজ্জিত থেকে উপহাস করেন আইন ও মানবাধিকারকেই। দারিদ্র্য সৃষ্টির দায় যেমন তাঁরা নেন না, তেমনি ভিখারি ও ভবঘুরেদের দমনে সরকারি কর্মচারীদের দেন আগাম দায়মুক্তি। তাঁরা অপরাধ করলেও থাকবেন বিচারের ঊর্ধ্বে।
এই আইনই এখন রাজধানী ঢাকাকে সুশীল বানানোর হাতিয়ার। বিশ্বকাপ উপলক্ষে তাই পথবাসী গরিবেরা হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। বিশ্বকাপের দেড় মাস এরা জীবিকা, বাসস্থান এবং নিজস্ব সমাজ থেকে বঞ্চিত থাকবে। বেওয়ারিশ কুকুরের মতো ধরে-বেঁধে যাদের শহরের বাইরে ছেড়ে আসা হবে, তারা কী খাবে, কোথায় থাকবে, তার দায়িত্ব কার? ২৫ মার্চের কালো রাতে প্রথম যে বাঙালিরা গণহত্যার শিকার হয়েছিল, তারা ছিল নীলক্ষেতের বস্তিবাসী আর বিভিন্ন জায়গার ফুটপাতবাসী। এরা যেন রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী, রাষ্ট্রের আওতার মধ্যে থেকেও এরা রাষ্ট্রবহির্ভূত। পুলিশের লাঠি ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনো সেবা এরা পায় না। এরা যেন পড়ে থাকা ময়লা, যাদের নিষ্কাশন করতে হয়। ভিখারি ও ফুটপাতবাসী হলো ভাইরাস, পুলিশ ও আইন হলো তার অ্যান্টি-ভাইরাস। অথচ পুলিশ নয়, এদের কাছে পাঠানো দরকার সেবা-সাহায্যের কর্মসূচি।
রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এই ধরনের মানুষকে বলা হতো ‘হোমো সাসের’। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের লন্ডনে ভিখারি ও ভবঘুরেদের এমনকি ফাঁসিও দেওয়া হতো। এদের হত্যায় অপরাধ হতো না। অথচ এই শহর ঢাকায় এ ধরনের মানুষের সংখ্যা ৩০-৪০ লাখ! ঢাকা শহরেই ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এদের চার-ছয় হাজার জনই আবার প্রতিবন্ধী। রাজনৈতিক দলগুলোও এদের ব্যাপারে দায়মুক্ত, কারণ এদের ভোট নেই। এদের সেবা নিয়েই এই শহর ও তার সবকিছু চলছে। অথচ শহরের সবচেয়ে বড় উৎসবে এরা অবাঞ্ছিত। আলো-ঝলমল সেই উৎসবের অপর পিঠের এই অন্ধকার এভাবে ঢাকা যাবে না। যত রস শুষে নেওয়া হবে, ততই ছিবড়ার পাহাড় জমতে থাকবে। কালো আইন কিংবা সুশীল চোখের আড়ে সেই পাহাড় ঢাকা যাবে না।
বলিউডের স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবিটি এই সব পথশিশুকে নিয়েই। সেখানে বস্তিবাসী সেলিম মলত্যাগ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে। বাইরে হইচই হচ্ছে, অমিতাভ আসছেন। হেলিকপ্টার নামছে। শয়তানি করে কেউ খাটা-পায়খানার ছিটকিনি বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছে। নিচের মল জমা হওয়ার চৌবাচ্চায় পড়ার পথটাই কেবল খোলা। নায়কসম্রাটকে দেখতে মরিয়া সেলিম সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। মলমাখা শরীরেই সে হাজির হয় তার স্বপ্নের নায়কের সামনে। মলমাখা হাতটাই সে তার প্রিয় নায়কের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্বকাপের আনন্দে মাতোয়ারা আমাদের সামনেও কিন্তু হাজির হতে পারে সেই ভূতেরা, তাদের ভূতশিশুরা, তাদের ভূতমায়েরা। বাড়িয়ে দিতে পারে তাদের শীর্ণ বাঁকানো হাত। আমরা যতই তাদের অদৃশ্য করে দিই না কেন, ভূতের মতো তাদের জীবন আমাদের তাড়া করে ফিরবে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
No comments