কালের পুরাণ-জাসদ: না বিপ্লব, না সমাজতন্ত্র by সোহরাব হাসান

আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ স্লোগান নিয়ে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ গঠিত হলে এর প্রতি ব্যাপকসংখ্যক তরুণ আকৃষ্ট হয়। মূল নেতা সিরাজুল আলম খান হলেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে মেজর এম এ জলিল ও আ স ম আবদুর রব।


সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের যে বিপুল আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা ছিল তা পূরণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হতে যাচ্ছিল। অন্যদিকে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কার্যকর রাজনৈতিক দলও তখন ছিল না। ষাটের দশকের শেষ দিকে ও সত্তর-একাত্তর সালে বামপন্থী দল হিসেবে ন্যাপ মোজাফফর ও সিপিবি (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) এবং তাদের সমর্থক বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক শক্তি বেশ মজবুত ছিল। বাহাত্তরে ডাকসু নির্বাচনেও ছাত্র ইউনিয়ন জয়ী হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের আওয়ামী লীগ-তোষণনীতি সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের আশাহত করে। ফলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে আসা নবাগত জাসদ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
অবশ্য এর আগে বাহাত্তরের ২৩ জুলাই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাত্রলীগ আ স ম রব ও শাজাহান সিরাজ এবং নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন গ্রুপে আনুষ্ঠানিক ভাগ হয়ে যায়। প্রথম গ্রুপ পল্টন ময়দান এবং দ্বিতীয় গ্রুপ রমনা রেসকোর্সে সম্মেলন আহ্বান করে এবং উভয় পক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু তিনি সিদ্দিকী-মাখন গ্রুপের সম্মেলনে গেলেন, রব-শাজাহান সিরাজ গ্রুপের সম্মেলনে গেলেন না। সেই থেকে ছাত্রলীগ ‘মুজিববাদী’ ও ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’ নামে দুটি আলাদা সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে।
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতাদের নানা অপকর্মের কারণে সরকারের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে; যদিও শেখ মুজিবুর রহমান তখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। ১ জনুয়ারি ভিয়েতনাম সংহতি দিবসে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে মতিউল ইসলাম ও মীর্জা কাদের নামে দুজন কর্মী নিহত হন। এর প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন হরতালসহ আন্দোলনের নানা কর্মসূচি দেয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচির নামে বিভিন্ন স্থানে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে হামলা চালায়। কিন্তু এর পরই ‘অভিভাবক সংগঠনের’ পরামর্শে ছাত্র ইউনিয়ন সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী স্থাপন করে। এই সুযোগে জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগ সারা দেশে ছাত্রসমাজের কাছে জনপ্রিয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেল জাসদ ছাত্রলীগের কাছে কার্যত পরাজিত হয়, যদিও ভোটের বাক্স ছিনতাইয়ের কারণে সেই ফলাফল প্রকাশিত হয়নি।
জাসদ প্রতিষ্ঠার পাঁচ মাসের মাথায় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তারা ২৩৭টি আসনে প্রার্থী দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের আগেই বিভিন্ন স্থানে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। তারা বিরোধী দলের অনেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিলেও বাধা দেয়। বেশ কিছু আসনে বিরোধী দলের জয়ী প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়া হয়। দাউদকান্দিতে জাসদ প্রার্থী আবদুর রশীদ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে খন্দকার মোশতাক আহমদ হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু হেলিকপ্টারে করে ভোটের বাক্স ঢাকায় এনে তাঁকে জিতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে।
৭ মার্চের নির্বাচন সম্পর্কে মওদুদ আহমদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, ‘এটা সত্য যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করতো। আওয়ামী লীগ বিঘ্ন সৃষ্টি না করলে যে ৯টিতে বিরোধী দল জয়লাভ করেছিল তার সাথে আর বড় জোর ২০টি আসন যোগ হতো। ...সরকারি সংবাদপত্রের রক্ষণশীল হিসেবেও বিরোধী দলগুলোর অন্তত ৩০টি আসনে বিজয় ছিলো প্রায় নিশ্চিত।’ (শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, মওদুদ আহমদ, ইউপিএল)
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ৭ মার্চের নির্বাচনে বিরোধী দলের পাওয়া আসনগুলো ছিনিয়ে নেওয়া না হলে দেশের রাজনীতি ভিন্ন হতে পারত। নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ভাসানী ন্যাপের মতো দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও তাদের কর্মী ছিল না । কিন্তু জাসদ-সমর্থক ছাত্রলীগে সেই সময়ের চৌকস ও মেধাবী ছাত্রদের ভিড় বাড়তে থাকে। ফলে তাদের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়। যদিও সেই আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নেতাদের পরিষ্কার ধারণা ছিল না। কখনো তারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার কথা বলতেন, কখনো মুজিব সরকারকে হঠানোর আওয়াজ তুলতেন। এ সময় স্বাধীনতা-বিরোধিতাকারী রাজনীতিক ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারাও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানধারী সংগঠনটিতে আশ্রয় নেন। উদাহরণ হিসেবে আবদুল আওয়াল ও মাওলানা মতিনের (পরবর্তীকালে লেবার পার্টির নেতা) কথা উল্লেখ করতে পারি। প্রথমজন দুর্নীতির দায়ে আদমজী থেকে চাকরিচ্যুত, দ্বিতীয়জন একাত্তরের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। (সূত্র: বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস: বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, ড. মোহাম্মদ হাননান)
এই বিপুল ও ব্যাপক জনপ্রিয়তাকে সম্বল করে জাসদ নেতারা কী করলেন? তাঁরা কি সত্যিকারভাবে একটি বিপ্লবী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন? তাঁরা কি জনগণের সামনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মসূচি হাজির করলেন? সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক গণ-আন্দোলন গড়তে চাইলেন? না, গণ-আন্দোলনে তাদের তেমন আগ্রহ ছিল না। ‘শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে জাসদ বুর্জোয়া শ্রেণীর সরকার বলে ঘোষণা করে এবং তাকে উৎখাতের সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়’ (জাসদের রাজনীতি, নজরুল ইসলাম, প্রাচ্য প্রকাশনী, ১৯৮১)।
জাসদ বাংলাদেশের সমাজকাঠামোর স্তর নির্ধারণ করেছিল ধনতান্ত্রিক। অন্য বাম দলগুলো মনে করে, আধা ধনতান্ত্রিক, আধা সামন্ততান্ত্রিক। এ কারণে ওই সব দল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে আশু কর্তব্য বলে মনে করে। কিন্তু জাসদ সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল এবং বিপুলসংখ্যক তরুণও তাতে আকৃষ্ট হয়েছিল।
জাসদের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হয়েছিল, তৎকালীন (আওয়ামী লীগ) সরকারের দমন-পীড়নের কারণে তারা প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন বাদ দিয়ে গোপন ও সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের এই যুক্তি যে সঠিক নয়, তা জাসদের পরবর্তী দলিলেও স্বীকার করা হয়েছে।
১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাসদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিপ্লবই এযাবৎ জাসদের সবচেয়ে আলোচিত, বিতর্কিত এবং বিভ্রান্তিমূলক পদক্ষেপ। কোনো কোনো জাসদ নেতার দাবি, ‘সেদিন তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করতে গেলে রক্ষীবাহিনী/পুলিশ তাঁদের ওপর গুলি চালায়।’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই কি সেটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ছিল?
আমরা কোনো মন্তব্য না করে জাসদ নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি তুলে ধরব। জাসদের সাবেক নেতা মাহবুবুর রহমান সাদী বলেছেন: ‘পার্টির সিদ্ধান্ত ছিল এই ঘেরাওয়ের সঙ্গে সারা দেশে ঊনত্রিশটি জায়গায় সশস্ত্র ঘটনা ঘটানো এবং দুই জায়গায় সিদ্ধান্ত পালিতও হয়েছিল। এর পরও আমরা যদি বলতে চাই চুয়াত্তরে মার্চ মাসে আমরা রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে যেতে চাইনি বা এ ধরনের কোনো ইচ্ছা আমাদের ছিল না, তাহলে একে মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না।’(সূত্র: মাহবুবুর রহমান সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব)
দলের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক শাজাহান সিরাজও স্বীকার করেছেন: ‘বস্তুত ১৭ মার্চ ১৯৭৪-এ আমরা কী করতে চেয়েছিলাম? তখনকার সাহিত্যগুলো খুঁজে দেখলে মূলত একটি জবাব বেরিয়ে আসবে। চেয়েছিলাম গণ-আন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে তাকে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে।’ (জাসদের আত্মসমালোচনামূলক দলিল, ১৯৭৯) ।
জাসদ যে গণবাহিনী গড়ে তুলেছিল, তাতে ব্যাপক জনসমর্থন ছিল না। দলের প্রকাশ্য নেতারা আত্মগোপনে গিয়েই সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেন। ফলে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের পর শিক্ষাঙ্গনের বাইরে প্রকাশ্যে তাদের তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। শাজাহান সিরাজ স্বীকার করেছেন, ‘১৭ মার্চের ঘটনার পর জনগণ ও আমাদের মাঝে সৃষ্টি হয় যোগসূত্রহীনতা। বস্তুত ১৭ মার্চের পর আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।’ (রাজনৈতিক রিপোর্ট, ১৯৮০ শাজাহান সিরাজ)
আসলে জাসদ চেয়েছিল যেকোনো মূল্যে শেখ মুজিব সরকারের পতন। সেই কাজটি অন্য একটি শক্তি (শক্তি না বলে অপশক্তি বলাই শ্রেয়) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট করে ফেলায় তখন আর তাদের কিছুই করার ছিল না। সেদিনই জাসদের রাজনৈতিক ভূমিকা শেষ হয়ে গিয়েছিল। এর পরও জাসদ তার প্রাণহীন শরীর বহন করে চলেছে এবং নতুন নতুন তত্ত্বের নামে উপর্যুপরি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। নেতাদের কেউ বিএনপিতে লীন হয়েছেন। কেউ এককালের ‘রুশ-ভারতের দালাল’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। কেউ বা পরবর্তী শাসকের সঙ্গে হাত মেলানোর অপেক্ষায় থাকেন।
শেখ মুজিব জীবিত থাকতে জাসদের আন্দোলনের কৌশল ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদ এবং তার পরিবর্তে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন। (১৯৭৪ সালে গৃহীত থিসিস)। ‘কিন্তু দুই বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে আন্দোলনের চেহারাটা বদলে যায়। এবার রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদ না, কী করে বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে একটা সরকার গঠন করা যায়, সেটাই জনাব খানের (সিরাজুল আলম খান) আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে পড়ে। তাঁর মনোযোগ নিয়োজিত হয় একটা গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতি (জাসদের রাজনীতি, নজরুল ইসলাম )।
জাসদের পূর্বাপর রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, শেষ পর্যন্ত তাদের ভরসাস্থল কোনোভাবেই জনগণ নয়, ভরসাস্থল ছিল সেনাবাহিনী। ১৯৭৬ সালে দলের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের উপলব্ধি হলো ‘অগোছালো, এলোপাতাড়ি, গোজামিল [গোঁজামিল], দায়সারা কাজ দিয়ে বিপ্লব হয় না।’ (আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৭)। খোলাসা না করলেও ধারণা করা যায়, তিনি ১৯৭৫ সালের ব্যর্থ সিপাহি-জনতার বিপ্লব প্রসঙ্গেই এ কথা বলেছেন। তবে অন্য নেতারা পরিষ্কার করেছেন।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সময় জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে জাসদ ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার’ গঠন করতে চেয়েছিল। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও তারা হাল ছাড়েনি। ১৯৮০ সালে ঘোষিত হয় ১৮ দফা কর্মসূচি, যাতে আরও গণতন্ত্র, ২০০ আসনের পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বসহ ৫০০ আসনের পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ দোসর নয়, এমন বুর্জোয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠনের ওকালতি করা হয়েছে এই কর্মসূচিতে। লক্ষ করুন, তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়, যিনি কর্নেল তাহেরকে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে হত্যা করেছেন। তাঁর সঙ্গে ঐক্যের আহ্বানও জানিয়েছেন। তারা আরও বলেছেন, ‘সংগ্রাম করতে হবে সংশোধনবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের এদেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে।’ সেই সংগ্রামে এখনো জাসদ নেতারা অনড় আছেন কিনা আমরা জানতে চাই। জাসদ নেতারা একসময় জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁদের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলেছিলেন। তবে পরে দেখা গেছে, মৎস্য বা পরিবেশ মন্ত্রণালয়েও তাঁরা আপত্তি করেননি। ১৯৮০ সালে ১৮ দফা কর্মসূচি প্রশ্নে জাসদ বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং দলের একাংশ দল থেকে বেরিয়ে বাসদ নামে নতুন দল করে। পরে বাসদও দুই ভাগ হয়ে যায়। ভুল কিংবা শুদ্ধভাবে হোক, এখনো তাঁরা বিপ্লবের ঝান্ডাটি হাতে তুলে রেখেছেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদি প্রবক্তারা অনেক আগেই বিপ্লব ছেড়ে সমন্বয়ের রাজনীতিতে সমর্পিত হয়েছেন। কেউ সেনাশাসকদের নিয়ে মৈত্রী স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে দেশের প্রায় সব দল যখন স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত, আ স ম রব তখন ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ নেতার আসনে বসেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, অবিভক্ত ছাত্রলীগের তুলনামূলক সচেতন, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী অংশ নিয়েই জাসদ গঠিত হয়েছিল। তবে অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে সেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ত্যাগ ছিল না। সুবিধাবাদিতায় কেউ কেউ ‘বুর্জোয়া’ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদেরও হার মানিয়েছেন। দলের প্রথম সভাপতি জলিল ইসলামি রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। অপর দুই ‘তুখোড় সমাজতন্ত্রী’ রব আওয়ামী লীগ এবং শাজাহান সিরাজ বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হয়ে কতটা ‘সুনাম’ কুড়িয়েছেন, তা দেশবাসী জানে। তাঁদের ভুল রাজনীতির শিকার হয়ে হাজার হাজার কর্মী শাসকদের অত্যাচার নির্যাতন ভোগ করেছেন। অনেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বিপ্লবে দীক্ষা নিতে গিয়ে কারও কারও লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্ত নেতারা বহাল তবিয়তেই আছেন এবং থাকবেন। হায় রাজনীতি! হায় বিপ্লব!
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.