গোধূলির ছায়াপথে-যাকে ভালোবাসা যায় by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
কবিকে ভালোবাসলে, পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হতে হবে সত্যিকারের ভালোবাসা, ফাঁক থাকলে হবে না। আমার ক্ষেত্রে দুজন: রুমি ও রবীন্দ্রনাথ। রবিঠাকুরের গান নিয়ে বই লিখছি শুনে একজন বললেন, আপনি তো ভাওয়াইয়া গান করেন, এ পথে কেন। বললাম, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।
ভদ্রলোক আমার অন্য পাঁচজন বন্ধুর মতো কাউকে ‘স্টিগমাটাইজ’ করতে পারলে খুশি। দীর্ঘ জীবনে এমন জনের সাক্ষাৎই সর্বাধিক। ১৫ বছর ক্লাসিক্যাল, ৩০ বছর লোকসংগীত, গান, কবিতা আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছি। সে কথা থাক।
রবীন্দ্রনাথকে পৃথিবী আলাদা করে রেখেছে ‘গীতাঞ্জলির কবি’-র মালা পরিয়ে, যেন তিনি ওই নোবেল প্রাইজের ২৮টি গান ছাড়া আর কিছু গাননি, আর কিছু লেখেননি। পৃথিবী কেন, ১৬ কোটি বাঙালির কথাই ধরি, অধিকাংশই রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে। তাঁর উপন্যাস, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, কবিতা, গান থেকে অস্পর্শিত তারা। কবিকে স্পর্শ করার জন্য প্রয়োজন একটি সভা, যেখানে অতিথিরা ‘রবীন্দ্র রচনাবলি’ ধুলো থেকে রেহাই দিয়ে কয়েকটি শব্দ সেখান থেকে শ্রোতাদের উপহার দেবেন।
কবির জন্মশতবার্ষিকীর বিরাট সভা। পাশেই বসে আমি। প্রধান অতিথি নামকরা ব্যক্তি, মিষ্টি করে ধীরে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন, বক্তৃতা কবিতার মতো। ফিসফিস করে বললেন, বাবা, গুরুদেবের কোনো কবিতা এ মুহূর্তে মনে আসছে না। দুটো লাইন বলতে পারবে? কানের কাছে মুখটি রেখে: ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়’, পুরোটাই আবৃত্তি করে গেলাম। বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যই তো তাঁর কবিতা।
রবীন্দ্রনৈকট্য খোঁজেন অতিথি বক্তারা, কিন্তু কতখানি নিকট তাঁরা, রবীন্দ্রমানসের কতটুকু প্রবাহ তাঁদের মধ্যে সঞ্চারিত। মনে হয় স্বল্প কয়েকজন ছাড়া সব লোক দেখানো, হুজুগের তাড়নায়, বাহবার প্রত্যাশায়। রবীন্দ্রনাথ হুজুগ থেকে দূরে, বাহবা থেকে দূরে, আপন মনের মায়ালোকে তাঁর বিহার। দেশ ভাষা মৃত্তিকার সঙ্গে তাঁর গভীর প্রণয়। গানগুলো যখন বাজিয়ে শুনি, কখনো হারমোনিয়ামের রিডে গানগুলোকে গলার সঙ্গে মেলাই বুঝতে পারি, এ গান এ কবিতা মুছে যাবে না, যত দিন বাঙালির নিঃশ্বাস বইবে।
সম্প্রতি গিয়েছি কলকাতা, সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর দুই রকম প্রস্তুতি। একটা হলো, বাঙালিরা যা সচরাচর করে থাকে, বছরজুড়ে অনুষ্ঠান আর অনুষ্ঠান, পাড়ার শিল্পীরা গান গাইছে, অভিনয় করছে, নাটক করছে, নৃত্যানুষ্ঠান করছে। প্রতিদিন রবীন্দ্রসদন ও রবীন্দ্রনামাঙ্কিত সব মঞ্চ অধিকৃত। টেলিভিশন-রেডিও সে পথেই।
অলক্ষ্যে আরেক প্রস্তুতি, রবীন্দ্রনাথের স্বরূপ আবিষ্কার। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, একটু বলুন, কীভাবে তাঁর দেখা পেলেন। বললেন, সহজে। কারণ উনি ছিলেন সহজ মানুষ। সরলভাবে যাঁরা তাঁর গান গাইবেন, মনে হয় তাঁর দেখা তিনি পাবেন। আমার কাছে যখন শুনতে চাইলেন, তখন আমারটা বললাম।
গীতবিতান তন্নতন্ন করে লাভ নেই। যেখানে মন টিকবে সেখানেই তিনি অবস্থিত। হোক তা প্রেমের গান, প্রকৃতির গান, বিচিত্র গান, ব্রহ্মসংগীত, পূজাসংগীত। সব মিলিয়েই রবীন্দ্রনাথ। যেখানে থামবে সেখানেই রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে পুরোপুরি পাওয়া যাবে সেখানেই। আর কোথাও যেতে হবে না। একদিন সন্ধ্যাবেলা গাইছিলাম এই গানটি:
মাঝে মাঝে তার বারতা
আমার ভাষায় পায় কি কথা রে
ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী
গানের তানে লুকিয়ে তারে।
আমি কান পেতে রই
ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজে উন্মুখ বিদেশি শ্রোতারা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। গান ও বক্তৃতা। তাঁরা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন আমার মুখমণ্ডলে কবির গীতাঞ্জলি। আন্দ্রে জিদ থেকে শুরু করে ডব্লিউ বি ইয়েটস যাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, মুস্তাফা নামধারী একজন তাঁকে কী দৃষ্টিতে দেখছেন, সেটাই বিচার্য। রুমি, লালন ও রবীন্দ্রনাথের তুলনামূলক ‘প্রভু চিন্তা’ প্রবন্ধে কুড়ি মিনিট বিমুগ্ধ শ্রোতারা শুনে গেছেন অধমের আলোচনা, যাতে স্থান পেয়েছে: ‘তোমার নাম বলব নানা ছলে’, ‘আমি যে গান দিয়ে তোমায় খুঁজি বাহির মনে’, ‘হে মোর দেবতা, ধরিয়া এ দেহ প্রাণ কি অমৃত তুমি চাহ করিবারে দান’, ‘আলোয় আলোকময় করে হে, এলে আলোর আলো’, ‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি, তখন তারে চিনি, আমি তখন তারে চিনি’, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এস’। প্রবন্ধটি ‘রুমির অলৌকিক বাগান’-এ ও ক্যামব্রিজ থেকে ছাপা হয়েছে।
উপরিউক্ত গান ও গীতাঞ্জলি নিয়ে আমরা গত ৫০ বছরে একটি গবেষণাগ্রন্থও হাতে পাইনি। গান শুনে গেছি শুধু। তাতে আধেকটা চেনা, আধেকটি নয়। তিনি আলোর স্পর্শে আলোকিতজন, এর উপলব্ধি আমাদের ক্ষীণ। যত দিন যাবে তত আমরা বুঝব, রবীন্দ্র আলো অন্তরকে উদ্ভাসিত করার ক্ষমতা রাখে।
২২ মার্চ, ২০১১
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
No comments