চারদিক-ছয়চিরির দিঘির পাড়ে চড়ক উৎসব by মুজিবুর রহমান
ছয়চিরির দিঘি কি চেনেন আপনি? এটা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নে। দেওড়াছড়া চা-বাগান সড়কে বিশাল এই দিঘি। কোনো একসময় জমিদারি আমলে এ দিঘিটি খনন করা হয়েছিল পানীয় জল ও মাছ চাষের সুবিধার্থে। তবে যুগ যুগ ধরে সনাতন ধর্মের মানুষ এ দিঘির পাড়ে বিশেষ উৎসব পালন করে আসছে।
ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে এখানে বসে বিশাল মেলা। চৈত্রের বিদায়কালে চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে চড়কপূজার অপেক্ষায় থাকেন সবাই।
বর্ণাঢ্য আয়োজন ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ১৩ এপ্রিল এখানে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী চড়ক উৎসব ও মেলা। চড়কপূজা উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই চড়ক উৎসব ও মেলায় জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল।
২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে এই চড়ক উৎসব। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। চড়কপূজা উৎসবের ১০-১২ দিন আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকার পূজারির মধ্যে ৪০-৫০ জন সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরীসহ নৃত্যগীতসহকারে ভিক্ষাবৃত্তিতে অংশ নেন। এই কদিন তাঁরা পবিত্রতার সঙ্গে সন্ন্যাসব্রত পালন করেন। সারা দিন উপবাস পালন করেন। চড়কপূজার দুই দিন আগে পূজারিরা শ্মশানে গিয়ে পূজা-অর্চনা করেন ও শেষে গৌরীর বিয়ে, গৌরী নাচ ও বিভিন্ন গান গেয়ে ঢাকের বাজনায় সরগরম করে তোলেন গোটা এলাকা।
ছয়চিরির দিঘির পাড়ে ভক্তরা নৃত্য করেছেন কলাগাছ ও বাঁশের খুঁটিবেষ্টিত মণ্ডলী তৈরি করে। পূজার প্রথম দিন নিশিরাতে তান্ত্রিক মন্ত্র দিয়ে, কাচ পড়া দিয়ে জ্বলন্ত ছাইয়ের ওপর মানুষরূপী কালী সেজে নৃত্য করে। অন্য ভক্তরা নৃত্যের তালে তালে, ছন্দে ছন্দে ঢোল, কাঁসি, করতাল বাজিয়ে থাকেন। এ সময় দর্শনার্থীরা জয়ধ্বনি এবং নারীদের কণ্ঠে উলুধ্বনি দিতে থাকেন। জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে এই ‘কালীনাচ’ অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং তান্ত্রিক মন্ত্র দিয়ে সাতটি বলিছেদ (লম্বা দা)-এর ওপর শিব শয্যা করেন। শিবের ওপর উঠে কালী ভয়ানক এক অদ্ভুত রূপ ধারণ করেন। এ সময় উপস্থিত দর্শনার্থী সবাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। কালীনাচ শেষ হওয়ার পর সকালে পূজারিরা পূজা করে পানবাটা দিয়ে চড়কগাছকে নিমন্ত্রণ জানানো হলে ঐতিহাসিক ছয়চিরির দিঘি থেকে ভেসে ওঠে ১০০ ফুট লম্বা চড়কগাছ। এ গাছের চূড়া থেকে মাচা পর্যন্ত চারটি পাখার মতো করে বাঁধা হয় চারটি মোটা বাঁশ এবং তাতে যুক্ত করা হয় মোটা লম্বা রশি। আগের বছর উৎসব শেষে এই দিঘিতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল চড়কগাছ। দিঘির পাড়ে গর্ত খুঁড়ে সোজা এবং খাড়া করে আবার পোঁতা হয় এ গাছ।
১৩ এপ্রিল বাংলা বছরের চৈত্রসংক্রান্তির দিন মানুষে মানুষে ছেয়ে গিয়েছিল ছয়চিরির পাড়। এদিন বিশেষ করে জিহ্বা ও গলায় বড়শি গেঁথে দেওয়া হয়। নৃত্যের তালে তালে চড়কগাছ ঘোরানো হয়। দেবতার পূজা-অর্চনা শেষে অপরাহে মূল সন্ন্যাসী চারজন ভক্তের (জ্যান্ত মানুষের) পিঠে লোহার দুটি করে বিরাট আকৃতির বড়শি গেঁথে রশিতে বেঁধে ঝুলিয়ে চড়কগাছ ঘোরানো হয়। এ সময় অনেকে বাতাসা ও কলা ওপরের দিকে উড়িয়ে দেন আর দর্শনার্থীরা তা কুড়িয়ে নেন। এ কঠিন কাজটি যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে সনাতনী হিন্দুধর্মের নিম্নবর্ণের শব্দকর সম্প্রদায়। হিন্দু সমাজের সব ভারী কাজও তাঁরা করেন। পিঠে বড়শি গেঁথে ঝুলিয়ে আরাধনা করার কঠিন কাজটি শব্দকর সম্প্রদায় পালন করলেও এখন মালী ও দাশ সম্প্রদায়ও এ কঠিন কাজ পালন করছে।
পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন শনিবার ফেরা চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হলো। ওই দিন দেবতার পূজা-অর্চনা করা হলো। এবারও চড়কপূজা উপলক্ষে এক বিশাল মেলা বসেছিল। মেলায় ছিল নানা ধরনের দোকান। উৎসব দেখতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশি-বিদেশি পর্যটক, জ্ঞানী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠেছিল গোটা উৎসব অঙ্গন।
মুজিবুর রহমান
বর্ণাঢ্য আয়োজন ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ১৩ এপ্রিল এখানে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী চড়ক উৎসব ও মেলা। চড়কপূজা উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই চড়ক উৎসব ও মেলায় জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল।
২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে এই চড়ক উৎসব। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। চড়কপূজা উৎসবের ১০-১২ দিন আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকার পূজারির মধ্যে ৪০-৫০ জন সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরীসহ নৃত্যগীতসহকারে ভিক্ষাবৃত্তিতে অংশ নেন। এই কদিন তাঁরা পবিত্রতার সঙ্গে সন্ন্যাসব্রত পালন করেন। সারা দিন উপবাস পালন করেন। চড়কপূজার দুই দিন আগে পূজারিরা শ্মশানে গিয়ে পূজা-অর্চনা করেন ও শেষে গৌরীর বিয়ে, গৌরী নাচ ও বিভিন্ন গান গেয়ে ঢাকের বাজনায় সরগরম করে তোলেন গোটা এলাকা।
ছয়চিরির দিঘির পাড়ে ভক্তরা নৃত্য করেছেন কলাগাছ ও বাঁশের খুঁটিবেষ্টিত মণ্ডলী তৈরি করে। পূজার প্রথম দিন নিশিরাতে তান্ত্রিক মন্ত্র দিয়ে, কাচ পড়া দিয়ে জ্বলন্ত ছাইয়ের ওপর মানুষরূপী কালী সেজে নৃত্য করে। অন্য ভক্তরা নৃত্যের তালে তালে, ছন্দে ছন্দে ঢোল, কাঁসি, করতাল বাজিয়ে থাকেন। এ সময় দর্শনার্থীরা জয়ধ্বনি এবং নারীদের কণ্ঠে উলুধ্বনি দিতে থাকেন। জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে এই ‘কালীনাচ’ অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং তান্ত্রিক মন্ত্র দিয়ে সাতটি বলিছেদ (লম্বা দা)-এর ওপর শিব শয্যা করেন। শিবের ওপর উঠে কালী ভয়ানক এক অদ্ভুত রূপ ধারণ করেন। এ সময় উপস্থিত দর্শনার্থী সবাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। কালীনাচ শেষ হওয়ার পর সকালে পূজারিরা পূজা করে পানবাটা দিয়ে চড়কগাছকে নিমন্ত্রণ জানানো হলে ঐতিহাসিক ছয়চিরির দিঘি থেকে ভেসে ওঠে ১০০ ফুট লম্বা চড়কগাছ। এ গাছের চূড়া থেকে মাচা পর্যন্ত চারটি পাখার মতো করে বাঁধা হয় চারটি মোটা বাঁশ এবং তাতে যুক্ত করা হয় মোটা লম্বা রশি। আগের বছর উৎসব শেষে এই দিঘিতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল চড়কগাছ। দিঘির পাড়ে গর্ত খুঁড়ে সোজা এবং খাড়া করে আবার পোঁতা হয় এ গাছ।
১৩ এপ্রিল বাংলা বছরের চৈত্রসংক্রান্তির দিন মানুষে মানুষে ছেয়ে গিয়েছিল ছয়চিরির পাড়। এদিন বিশেষ করে জিহ্বা ও গলায় বড়শি গেঁথে দেওয়া হয়। নৃত্যের তালে তালে চড়কগাছ ঘোরানো হয়। দেবতার পূজা-অর্চনা শেষে অপরাহে মূল সন্ন্যাসী চারজন ভক্তের (জ্যান্ত মানুষের) পিঠে লোহার দুটি করে বিরাট আকৃতির বড়শি গেঁথে রশিতে বেঁধে ঝুলিয়ে চড়কগাছ ঘোরানো হয়। এ সময় অনেকে বাতাসা ও কলা ওপরের দিকে উড়িয়ে দেন আর দর্শনার্থীরা তা কুড়িয়ে নেন। এ কঠিন কাজটি যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে সনাতনী হিন্দুধর্মের নিম্নবর্ণের শব্দকর সম্প্রদায়। হিন্দু সমাজের সব ভারী কাজও তাঁরা করেন। পিঠে বড়শি গেঁথে ঝুলিয়ে আরাধনা করার কঠিন কাজটি শব্দকর সম্প্রদায় পালন করলেও এখন মালী ও দাশ সম্প্রদায়ও এ কঠিন কাজ পালন করছে।
পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন শনিবার ফেরা চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হলো। ওই দিন দেবতার পূজা-অর্চনা করা হলো। এবারও চড়কপূজা উপলক্ষে এক বিশাল মেলা বসেছিল। মেলায় ছিল নানা ধরনের দোকান। উৎসব দেখতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশি-বিদেশি পর্যটক, জ্ঞানী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠেছিল গোটা উৎসব অঙ্গন।
মুজিবুর রহমান
No comments