গোধূলির ছায়াপথে-মেন্দিস আপ্পুর গল্প by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

মাঝারি বয়স ও উচ্চতা, ঘোর তাম্রবর্ণের মেন্দিস আপ্পুর গল্প দিয়ে শুরু করছি। পুরো নাম ভিদানা মহাদিরামেগ মেন্দিস আপ্পু। দেখিনি তাকে, অথচ শ্রীলঙ্কায় সাত দিন ঘুরে এসে তার কথাই ভাবছি। দক্ষিণতম গালে শহরের সমুদ্রসৈকতে সারা দিন মাছ ধরার খেলায় মত্ত, বালুকাবেলা থেকে খানিকটা সমুদ্রের দিকে লম্বা বাঁশের চাং, সেখানে ঝুলে থাকে জেলেরা।


হাতে বড়শি, উঠছে ছোট-মাঝারি মাছ। সামান্য একটু জমি, আর সবই গেছে ঋণে। বাবু কহিলেন, ‘বুঝেছ আপ্পু, এ জমি লইব কিনে।’ একা হয়ে যাওয়ার পর আপ্পু জমি বিক্রি করে দিল ‘ইনসাইট রিসোর্ট’-এর কাছে। আরও অনেক ছোট মানুষ স্বল্প মূল্যে জমি বিক্রি করেছে নতুন জমিদারদের কাছে, সমুদ্রমেখলা দ্বীপ শ্রীলঙ্কার চারদিকে যারা প্রস্তুত করেছে অসংখ্য রিসোর্ট, যেখানে এসে আশ্রয় নেন ইউরোপের শীত থেকে নিষ্কৃতি পেতে ট্যুরিস্টরা, ‘অ্যাডাম্স পিকে’, ‘বুড্ডিস্ট টুথ টেম্পল’ শহর ক্যান্ডি ও গলের প্রান্ত বালুকাবেলায়, অপেক্ষিত ভূস্বর্গ শ্রীলঙ্কা, নভেম্বর থেকে এপ্রিল। আপ্পু মাছ ধরে আর অল্প দামে বিক্রি করে দেয়। এবার সংগ্রহের তালিকায় কারণবারি, রাতটি কাটে মধুর বিলাসে। ‘মধুর মধুর বংশী বাজে কোথা কোন কদমতলিতে, কোন মহাজন পারে বলিতে।’ কোন মহাজনের কাছে তার আত্মসমর্পণ, জানাব শেষে।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে পরে এসেছেন সাদা সারাংয়ের সঙ্গে সাদা লুঙ্গি, গলায় ঝোলানো লাল উত্তরীয়। দারুণ স্মার্ট। ৪ সেপ্টেম্বর রোটারির দক্ষিণ এশিয়া কনফারেন্স উদ্বোধন উপলক্ষে বললেন স্মিত হাস্যে: ‘বন্ধুরা, লড়াই গেছে থেমে, বিভেদ মিটিয়ে ফেলেছি। চেষ্টা করছি কীভাবে শান্তি টিকিয়ে রাখা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কাছাকাছি আসতে পারি। সুবিধা সবারই। বিনা ভিসায় এ দেশে প্রবেশ করতে অনুমতি দিয়েছি সার্কের নাগরিকদের। ফলাফল শুভ। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটানের নাগরিকেরা প্লেন বোঝাই হয়ে বেড়াতে আসছে এ দেশে। বিশেষ সুবিধার ঘোষণা দিয়েছি, যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা সহজেই গড়ে তুলতে পারে।’ প্রতিপক্ষরা বলছে ভিন্ন কথা। দেশটি মাহিন্দার হাতের মুঠোয়, সব জায়গায় নিজের লোক দিয়ে। অথচ মানুষজন যথেষ্ট খুশি, পথঘাট সবখানে চলছে উন্নতির মহোৎ সব। খুশি নয় বড়লোকেরা। আমাদের ড্রাইভার সিরি শতকরা নিরানব্বই শিক্ষিতদের মধ্যে একজন। বললেন, ‘আমাদের প্রয়োজন মাহিন্দার মতো লোক, গুটি কয়েক উঁচু মহলের সিভিল সোসাইটির প্রয়োজন নেই। উন্নতির দিকে এগিয়ে গেলেই হলো, আমরা যেন স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পারি—এটাই বড় কথা। আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হবে—এটাই আমাদের স্বপ্ন।’
কলম্বোতে ৪-৬ সেপ্টেম্বর গিয়েছি সস্ত্রীক ‘দক্ষিণ এশিয়া রোটারি কনফারেন্স অব ডেভেলপমেন্ট’-এ যোগ দিতে। তিনটি দিন শান্তি, কল্যাণ ও ভ্রাতৃত্বের অপরূপ পরিবেশ। রোটারি ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট কল্যাণ ব্যানার্জি বললেন, ‘নিজের ভালোটা সবাই বোঝে, বুঝি না আমরা। ইউরোপের চেয়েও সুখে থাকতে পারি, আমাদের চাহিদা কম বলে। কল্যাণ ও আনন্দের পসরা উপহার দেওয়া যায় পৃথিবীকে, কারণ আধ্যাত্মিকতায় সমৃদ্ধতর আমরা। প্রয়োজন আপাতবিরোধ মিটিয়ে ফেলার।’ তাঁর স্ত্রী বিনতা বললেন, ‘এই অঞ্চলের নারীরাই ইচ্ছা করলে আটটি দেশ মুড়ে দিতে পারি ভালোবাসা দিয়ে। সদিচ্ছার অভাব নেই, অভাব সদিচ্ছাকে মনের মধ্যে জায়গা দেওয়া।’
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী দেখে দেখে বক্তব্য দিলেন, সবচেয়ে বেশি হাততালি তাঁর জন্যই, কারণ পাকিস্তানের ভয়েই ভীত ভারত। কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাসান শাহরিয়ার জানালেন, ‘অনেক লিখেছি সার্ককে জাগ্রত করতে দেশি-বিদেশি জার্নালে, গা করেনি কেউ। লিখে লাভ নেই। ভারতে যেতে হলে ২০ দিনের ভিসার জঞ্জালে আটকে থাকতে হয়। কাছাকাছি আসা দুরাশা।’ সার্ক চেম্বারের সভাপতি আনিসুল হক বললেন, ‘আলাদাভাবে সম্মুখের দিকে এগিয়ে চলেছি বটে, তবে এর নামই কি প্রগতি? আটটি দেশে ১ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মানুষ, ৬০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। আটটি দেশ মিলে রপ্তানি করেছি $ ২৯০ বিলিয়ন সামগ্রী, পাশের দেশ মালয়েশিয়া একাই রপ্তানি করেছে $ ২৬৬ বিলিয়ন, সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছে $ ৩৬৬ বিলিয়ন। মালয়েশিয়া এককভাবে পর্যটনে আয় করেছে সম্মিলিত আটটি দেশের চেয়েও বেশি।’ দীর্ঘ হাততালিতে যোগ হলো অধমের তালি, কাওয়ালি গান থেকে সংগৃহীত, দুটি হাতের তালুকে এমনভাবে সংযুক্ত করতে হয়, যাতে তালির শব্দটিও হবে সংগীত উপযোগী।
লিখেছি, আমাদের এই সবুজ বদ্বীপটি হতে পারে পর্যটন আকর্ষণ। কারণ, এখানে আছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্রাম, নাম বানিয়াচং, চিরসবুজ, চিরশ্যামল; আছে শ্রীমঙ্গল, যেখানে মেয়েরা উপস্থিত করে পৃথিবীর সবচেয়ে মঙ্গলময় নৃত্য, নাম ধামাইল। লিখেছি পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় উদাত্ত ভাটিয়ালির আহ্বান, জানিয়েছি সমুদ্র উপকূলে ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’-এর কথা, যেখানে গর্জন করে এখনো ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’। এগুলো শ্রীলঙ্কার মতোই সুন্দর। পৃথিবীর সবাই জেগে উঠেছে। স্বঘোষিত নিদ্রাচ্ছন্ন টাইগাররা হাসান শাহরিয়ার, আনিসুল হক ও আমাদের কথা শোনেনি।
২৫ ডিসেম্বর ২০০৪ ‘ইনসাইট রিসোর্ট’-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ক্রিসমাস উপলক্ষে মেন্দিস আপ্পুকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, ‘প্রিয় মানুষদের একজন তুমি, তোমাকে ভুলিনি।’ আপ্পু গভীর রাত অবধি কারণবারির আশ্রয়ে বাঁশের চাংয়ে বসে ছিল। পরদিন ভোরবেলা সুনামির প্রবল উচ্ছ্বাসে মেন্দিস আপ্পুকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটাই একজন বৌদ্ধের সবচেয়ে বড় চাওয়া। নির্বাণ। মধুর বংশীর আহ্বানে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.