পুঁজিবাজার-সরকারের কি কিছুই করার নেই? by তোফায়েল আহমেদ

ডিসেম্বর ৫, ২০১০ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের দ্বিতীয় মহাবিপর্যয়ের দিন। তার পর থেকে অব্যাহত দরপতন, স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তা। বাজার সংশোধন, স্থিতিশীলতা আনয়ন বা বাজার বিকাশের বাধাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে কোথাও কোনো সিরিয়াস পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বন্ধু ও অভিভাবকহীন।


এসইসি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ, আইসিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, সামগ্রিকভাবে সরকার এবং বিশেষভাবে অর্থ মন্ত্রণালয় কারও যেন কোনো দায় নেই। সব দায়ভার যেন কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর। যাঁরা তাঁদের সঞ্চিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে মহাপাপ করে বসেছেন। তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য শাস্তিই যেন পাচ্ছেন। তাঁরা মাঝেমধ্যে বিক্ষোভ মিছিল করেন, আবার ঘরে ফিরে যান। কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়। তাঁদের জুয়াড়ি, দুর্বৃত্ত ইত্যাদি গালাগালও করা হয়। আসলে পুঁজিবাজার উন্নয়নের কর্তৃপক্ষ কে বা কারা, তা এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে একক কোনো কর্তৃপক্ষ থাকার কথাও নয়। অনেকের যৌথ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে ওঠার কথা। নবগঠিত এসইসির যোগ্যতা-দক্ষতা মূল্যায়নের সময় এখনো হয়তো আসেনি। তবে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের এখনো খুব একটা আস্থায় নেয়নি।
পুঁজিবাজারকে সুষ্ঠু ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতি কাঠামো ব্যবস্থাপনার অংশ। সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির পুরো চক্রে পুঁজিবাজারের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কথা। আমাদের পুঁজিবাজার বিগত এক দশকে সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছিল। কিন্তু ২০১০-এর মহাবিপর্যয় এবং সে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণে সুদীর্ঘ সময় ধরে উদাসীনতা বা সিদ্ধান্তহীনতা পুঁজিবাজার কাঠামোর মেরুদণ্ড বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। যতই নীরবতা, উদাসীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতা থাকুক, সরকারের ঘাড়েই শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব বর্তাবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে উত্তরণের টেকসই উপায় নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
এ দেশের পুঁজিবাজার এখন আর ফাঁকা বেলুন নয়। এর শক্ত ও পরিণত মৌলভিত্তি রয়েছে। এ দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসও নিতান্ত স্বল্প নয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড নামে পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা। ১৯৫৬ সাল থেকে সীমিত লেনদেন শুরু। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় কিছুকাল বন্ধ থাকার পর ১৯৭৬ সালে নয়টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মাত্র এক কোটি টাকার চলমান বাজার পুঁজি নিয়ে যে পুনর্গঠিত পুঁজিবাজারের যাত্রা, তা ২০০৯ সালে ৪৪৩টি তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান, ৩০ লাখ বিনিয়োগ হিসাব ও ২,২৪,১৬০ কোটি টাকার বাজার পুঁজিতে উন্নীত হয়। ১৯৯৩ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইনের অধীনে এসইসি গঠিত হয়। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামে দেশের দ্বিতীয় স্টক এক্সচেঞ্জ চালু হয়। ১৯৯৬ সালের প্রথম বিপর্যয়ের পর পুঁজিবাজারের অনেক সংস্কার সাধিত হয়। বিশেষত, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় পুঁজিবাজার উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় ‘সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড’ (সিডিবিএল) এবং ‘সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি সিস্টেম’ (সিডিএস) চালু হয়। তাতে করে কাগুজে শেয়ার সার্টিফিকেটের স্থলে ‘ইলেকট্রনিক বুক এন্ট্রি’ ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৯৬ সালের প্রথম বিপর্যয়ের পর থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে গৃহীত বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমের ফলে বাজার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসে। এভাবে দেখা যায়, ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পুঁজিবাজারের লেনদেন ও মূল্যস্তরের ওঠানামায় একটি স্বাভাবিকতা বজায় থাকে। তাই ১৯৯৬ সালের পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাজার যে অবস্থায় উপনীত হয়, সে বাজারকে অদক্ষ ও অপরিণত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে বাজারে অস্বাভাবিকতার সূত্রপাত। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ওই অস্বাভাবিকতার চরম প্রকাশ ঘটে দ্বিতীয় বারের মতো মহাবিপর্যয়ের মাধ্যমে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে এ দুই বছর বাজারের অস্বাভাবিকতার প্রকার, প্রকৃতি ও ধরনের ওপর বিশ্লেষণ হয়েছে অনেক। তদন্ত কমিটিও হয়েছে। কিন্তু তা অস্বাভাবিকতা এবং মহাপতন কি ভুল, অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতা, নাকি পরিকল্পিত কারসাজি ও লুটপাট—তা স্বচ্ছ নয়। এভাবে বাজার অতি মূল্যায়িত বা অত্যধিক মাত্রায় উত্তপ্ত হওয়া, আবার অতি অবমূল্যায়িত হয়ে সমতলে পতিত হওয়ার কারণ এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে পুঁজিবাজার বোদ্ধারা বহু আলোচনা করেছেন। মূল সমস্যা হচ্ছে, দায়দায়িত্ব স্বীকার করে এ অবস্থার উত্তরণে কেউ এগিয়ে আসছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে লাগাতার অবহেলা ও উদাসীনতা ক্ষমাহীন।
২০০৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ছিল ২৫৬টি এবং বাজার পুঁজি দুই লাখ ২৪ হাজার ১৬০ কোটির মতো। ওই একই সময়ে ডিএসসি সূচক ছিল ১০০০-এর সামান্য বেশি। ২০০৬-এর শেষ প্রান্তে এসে সে সূচক ২০০০ অতিক্রম করতে থাকে। ২০০৭ এবং ২০০৮ সূচক বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকে। তবে তা কোনোভাবে অস্বাভাবিক বলা যায় না। ২০০৮-এর শেষ প্রান্তে সূচক ৩০০০-এ স্থিতি পায়। ২০০৯ সাল থেকে সূচক, লেনদেন ও বাজার পুঁজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতার দ্রুত প্রকাশ ও বিকাশ ঘটতে থাকে। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে নতুন সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পুঁজিবাজারের অস্বাভাবিকতা ও নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ কাকতালীয়ভাবে হলেও সমসাময়িক। ২০১০ সালে সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির প্রারম্ভে ঘটে এ বিপর্যয়।
২০০৯ থেকে ৩০০০ পয়েন্টের সূচক বাড়তে বাড়তে ৯০০০-এ উন্নীত হয়। যা বাজারের মৌলভিত্তির সঙ্গে কোনোভাবে সংগতিপূর্ণ ছিল না। ২০০৯ সাল থেকে সিপিডিসহ বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অতিমূল্যায়িত পুঁজিবাজার নিয়ে বহু সতর্কবাণী উচ্চারণ করে। কিন্তু এসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসেনি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। অতি উত্তপ্ত বাজার একসময় জ্বলেপুড়ে গেল। কিন্তু একেবারে ছারখার হয়ে যায়নি। এখানে এখনো ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ, সম্ভাবনা ও উপায় যথেষ্ট রয়েছে এবং এ বাজারকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। এখানে সরকার তথা মাননীয় অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিএসই, সিএসই, এসইসি, এনবিআর, আইসিবি, ব্রোকার হাউস, দুই স্টকে তালিকাভুক্ত সব প্রতিষ্ঠান—সবার দায়িত্ব ছিল এবং এখনো সব দায়িত্ব যৌথভাবে তাদের সবার। কিন্তু একক ও যৌথভাবে কেউ-ই সে দায়িত্ব পালন করছে না। তারা কেউ-ই কারও সুবিধা-অসুবিধার কথা মন দিয়ে শুনছে না।
পুঁজিবাজারের বিপর্যয়ের কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োজিত পুঁজির ৩০-৫০ শতাংশ হারিয়েছেন। যাঁরা ঋণ করেছেন তাঁরা পুঁজির পুরোটা হারিয়েছেন। কিন্তু সে তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা, বিশেষত, ব্যাংক, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা প্রতিষ্ঠান, ব্রোকারেজ হাউস, বাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি—তারা সবাই কি লোকসান দিয়েছে? তা কিন্তু নয়। ২০১০ সালের অতি মূল্যায়িত বাজার থেকে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্মরণাতীতকালের রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করেছে। সম্প্রতি প্রথম আলোয় (২৯/০৮/২০১১) মনজুর আহমেদের একটি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে ব্যাংকগুলোর মোট মুনাফার ৩৫.১৭ শতাংশ এসেছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ থেকে। একই রকমভাবে ব্যাংকবহির্ভূত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা, তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও ব্রোকার হাউসগুলোর মুনাফা হিসাব করে দেখা যেতে পারে। ২০০৯ ও ২০১০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং বৃহৎ ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা নিয়ে সরে পড়ল, আর পতনের জালে আটকা পড়ল ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থাটি রাজনীতি ও অর্থনীতির কোনো নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মেনে নেওয়া যায় না। এখানেই সরকারের রেগুলেটর ও প্রমোটরের দায়দায়িত্ব এসে পড়ে।
এখন বাজারকে পুনরায় সক্রিয় ও স্বাভাবিক করার জন্য যে উদ্যোগটি অগ্রাধিকার পেতে পারত তা হচ্ছে ব্যাংক, বিমাসহ অন্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অধিকতর বিনিয়োগের প্রণোদনা প্রদান। কারণ, বাজার নিষ্ক্রিয় হওয়ার একটি বড় কারণ, যা বাজার বিশেষজ্ঞরা বারবার নির্দেশ করছেন, তা হচ্ছে বাজারের তীব্র তারল্য-সংকট। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা হওয়া উচিত ছিল প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে ‘ব্যাংক বাঁচানোর’ খোঁড়া অজুহাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ওপর লিখিত-অলিখিত নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মোট দায় (Liability) এর ১০ শতাংশ পর্যন্ত আগে বিনিয়োগ করত। কিছু কিছু প্রবলেম ব্যাংক শেয়ারবাজারের মুনাফার কারণে আজ আর প্রবলেম ব্যাংক তালিকায় নেই। গত আট-নয় মাসে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলো তাদের ১০ শতাংশ দূরে থাকুক ১ শতাংশও তার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেনি। অথচ বিনিয়োগ করার মতো অলস অর্থ এবং ইচ্ছা তাদের রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্তচক্ষু এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। বর্তমানকার বাজার এবং কোম্পানিগুলোর মৌলভিত্তি পর্যালোচনা করলে যেকোনো বিবেচনায় এখানে পুঁজি হারানোর ভয় নেই। ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায়িক বিবেচনাতেই বাজারে পুনরায় সক্রিয় হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা তাদের নিজ নিজ দায়ের অন্তত ৫ শতাংশ বিনিয়োগ করার নীতি গ্রহণ করতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতি সংরক্ষণবাদী মুদ্রানীতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার এবং দেশের সামগ্রিক, সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার জন্য খারাপ পরিণাম বয়ে আনছে বলে অনেকের ধারণা। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি অস্বাভাবিক পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংকগুলোর ৩৫.১৭ শতাংশ মুনাফা অর্জন মেনে নিতে পারে, তাহলে সে ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে দেওয়ার দায়-দায়িত্বও কিছুটা নিতে হবে।
পুঁজিবাজার চাঙা করার জন্য সরকারের পাঁচ হাজার কোটি টাকার ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ এত দিন পরও অপারেশনে যেতে পারল না। অন্যদিকে নতুন অর্থ বাজারে প্রবাহিত করার বদলে সরকার যমুনা ও মেঘনার শেয়ার বিক্রি করে কয়েক শ কোটি টাকা বাজার থেকে উঠিয়ে নিল। বাজারে যখন তারল্য-সংকট, সরকার সে সংকটকে আরও কিছুটা ঘনীভূত করল। এভাবে সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যার যখন সুবিধা মুনাফা উঠিয়ে নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে বসে ঝোপ বুঝে কোপ মারার জন্য অপেক্ষা করছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে কোপটা সব সময় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ের ওপরই পড়ছে।
সরকারকে কৃত্রিমভাবে পুঁজিবাজার ফোলানো-ফাঁপানোর জন্য কেউ বলবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের জন্য নীতিসহায়তার মাধ্যমে প্রণোদনা দিয়ে বাজারকে অযাচিত হস্তক্ষেপমুক্ত রাখলে বাজার তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে এসইসি এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর একটি অবহেলা বা শিথিল ভূমিকার কথা না বললেই নয়। তারা তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পরিচালনায় অদক্ষতা ও আর্থিক অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অনেক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজার থেকে আহরিত অর্থের লাভজনক ব্যবহারে যত্নবান নয়। তারা পুঁজিবাজারের অর্থকে খয়রাতি অর্থের মতো ব্যবহার করে। সঠিক মুনাফা প্রদর্শন করে না, সঠিকভাবে মুনাফা, বোনাস, রাইট শেয়ার ইত্যাদি দেয় না। এসব ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জ এবং এসইসির মনিটরিং খুবই দুর্বল। বাজারে ধস নামলে সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ারের দাম হ্রাস পায়। তাতে দৈনন্দিন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে যাঁরা বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের তো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়। তাই কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি এবং পরিচালনায় দক্ষতা যাঁদের নেই, তাঁদের থেকে জরিমানাসহ পুঁজি প্রত্যাহূত হতে পারে।
উপসংহারে আবারও বলব, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে বিপর্যয় আসে। এটি কাকতালীয় নাকি কারসাজি, সেটি অন্য বিবেচনা। কিন্তু এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় এ সরকারকেই বের করতে হবে। আমাদের ধারণা, সরকার এ কাজে পরিপূর্ণভাবেই সক্ষম। সমস্যা দায়িত্ব গ্রহণে গড়িমসি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব এবং স্ববিরোধী বক্তব্য।
২০১১ সালে বাজেট অনুমোদনের আগে শেয়ারবাজারের নেতাদের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বৈঠকে অপ্রদর্শিত আয় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি আশ্বাস পাওয়া যায়। কিন্তু পুণ্যাত্মা যুধিষ্ঠির আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী এবং যুধিষ্ঠিরপুত্র এনবিআরের চেয়ারম্যান প্রকারান্তরে অন্য কথা বলেন। তারপর আবার থাকল এসইসির মামলাভীতি। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পরিচালনা ও হিসাবনিকাশে স্বচ্ছতা এবং পুঁজিবাজারের লেনদেন নিয়মানুগত রাখার জন্য স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সার্বক্ষণিক নজরদারি সব সময়ই কাম্য। কিন্তু চোখে কালো চশমা, মাথায় কালো কাপড়, হাতে কালো ছড়ি নিয়ে অন্ধকারে কালো বিড়াল খোঁজার জন্য ঘুরে বেড়ালে অতি সংবেদনশীল পুঁজিবাজার কেন কাঁচাবাজারও স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয়। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করেন, মিছিল করেন, রাস্তায় গাড়ির টায়ার পোড়ান। সরকারের লোকজন তাঁদের দুর্বৃত্ত বলে গালিগালাজ করেন। এ অবস্থা এভাবে বেশি দিন চলতে পারে না। ২০১১ সালে সরকারের তৃতীয় বর্ষপূর্তির আগেই একটি কার্যকর পদক্ষেপ আশা করি নেওয়া হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: শিক্ষাবিদ ও লেখক।
ahmedt_dr@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.