পাহাড়ি জনগোষ্ঠী-ভাষার অধিকার ও পার্বত্য চুক্তি by ইলিরা দেওয়ান

১৫ ফেব্রুয়ারি এ বছরের প্রথম সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে (সূত্র: যুগান্তর, বাংলানিউজ)। প্রধানমন্ত্রী বরাবরের মতো এবারও বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে এ ঘোষণাটি দিলেন।


এমনতর আশ্বাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা বারবার আশ্বস্তই হতে চায়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে দেখা যায় ঘোষণার পর চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ ঘোষণাতেই আবদ্ধ থেকে যায়! অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের সে কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার প্রতি আমরা পুরোপুরি আস্থা রাখতে চাই।
সমপ্রতি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে সরকার আন্তরিকতা নিয়েই অগ্রসর হতে চাচ্ছে। কারণ, জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য গওহর রিজভীর রাঙামাটি সফর এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান ও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার সঙ্গে সফল দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, এর পরে ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শ্রী লারমার দীর্ঘদিন পর বৈঠক এবং সর্বশেষ ২২ জানুয়ারি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির চতুর্থবারের মতো সভা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখিত ঘটনাগুলো খুব অল্প সময়ে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে আবারও চুক্তি বাস্তবায়নের ধারা গতি পেয়েছে বলে অনেকে আশা প্রকাশ করছেন। সফল বলছি প্রতিটি বৈঠকের পর শ্রী লারমার সন্তুষ্টি প্রকাশের কারণে। চুক্তির ১৪ বছরের মধ্যে গত এক দশক চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে মনে পড়ে না। এই প্রথম তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর মত ব্যক্ত করতে গিয়ে বললেন, ‘এ যাবৎকালের মধ্যে এই প্রথম সরকারের একটি ইতিবাচক উদ্যোগ দেখলাম।’ (সূত্র: প্রথম আলো) কাজেই চুক্তি স্বাক্ষরকারী নেতা হিসেবে তাঁর এই অভিব্যক্তি নিঃসন্দেহে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত বহন করে।
১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সন্তু লারমার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ভূমি কমিশন আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো চলতি সংসদ অধিবেশনে সংশোধন করার ওপর গুরুত্বারোপ। এ ছাড়া যত দ্রুত সম্ভব বন, ভূমিসহ সাতটি বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব জেলা পরিষদগুলোর হাতে ন্যস্ত করা।
প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের কার্যকর উদ্যোগের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন, সন্তু লারমার সঙ্গে বৈঠকের কথা স্মরণে রেখে সম্ভবত তিনি এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কারণ, চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও পার্বত্য অধিবাসীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে যে দূরত্ব ও আস্থাহীনতার ভিত্তি তৈরি হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা ও সরকারের কার্যকর উদ্যোগই পারবে এই দূরত্ব কমাতে। তাই আমাদের আশা, বর্তমান সংসদ অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো যথাযথভাবে উত্থাপনের মাধ্যমে চুক্তি বাস্তবায়নের দীর্ঘদিনের জট অচিরেই দূর করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারণী থেকেও চুক্তি বাস্তবায়নের সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়।
আমাদের এ বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না যে চুক্তি বাস্তবায়নের ধারা যেখানে গিয়ে বারবার থমকে যায় তা হলো ভূমিসংক্রান্ত বিষয়। ২০০১ সালে প্রণীত ভূমি কমিশন আইনটি চুক্তির সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে বিরোধাত্মক ছিল। তাই এই বিরোধাত্মক আইনগুলোকে চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই প্রস্তাবিত ধারাগুলো সংশোধনে দীর্ঘসূত্রতার পর গত বছরের জুন মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৩ দফা সংবলিত সংশোধনী প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। কাজেই ভূমি কমিশন আইনটি যত দিন সংশোধনের মাধ্যমে কার্যকর করা না হবে, তত দিন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাও স্থবির হয়ে থাকবে।
তবে আশার বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ও চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় ভূমি কমিশন আইনে সংশোধনী আনার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় ভূমি কমিশন চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা রদ করা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিসংক্রান্ত সব কার্যক্রম ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অর্পণ করা হবে বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। দীর্ঘদিন পর হলেও এসব জটিল বিষয়কে সামনে এনে চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাকে সচল করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় সবার মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে এই চলমান প্রক্রিয়াটি যেন সচল থাকে, সেই উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।

২.
ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ বছর ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্তি। তাই এবারের ফেব্রুয়ারি মাসটি আমাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যে জাতি মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, সে জাতির কাছে ভাষার গুরুত্ব মায়েরই সমতুল্য। কিন্তু এত অর্জনের ভেতর আমাদের দেশের অন্য ভাষাগুলো কী অবস্থায় আছে, সে খবর কজনই বা রাখে!
পার্বত্য চুক্তিতে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি, প্রতিটি শিশুর মেধার বিকাশ ঘটাতে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। তাই বাংলা ভাষাভাষী ছাড়া অন্য জাতিসত্তার শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণে তাদের মাতৃভাষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করা জরুরি। সমপ্রতি জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড দেশের অপরাপর জাতিসত্তা সম্পর্কে জানার লক্ষ্যে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত স্বতন্ত্র একটি কোর্স অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে সবার আগে আদিবাসী শিশুদের প্রাথমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধ করতে এবং তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
সমপ্রতি একটি খবর পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। সেটি হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত সাড়ে তিন হাজার পাড়াকেন্দ্রের প্রায় সাড়ে ৬৬ হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হতে যাচ্ছে (সূত্র: সমকাল)! এই প্রকল্পটি শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ‘সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প’ (আইসিডিপি)-এর মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি চালু করে। এই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয়ভাবে ‘পাড়াকেন্দ্র’ নামে অধিক পরিচিত। এই প্রকল্পাধীন প্রাক-স্কুলগুলোতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার কথা বলা না হলেও প্রতিটি পাড়াকেন্দ্রে স্থানীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ফলে কোমলমতি শিশুদের কাছে শিক্ষকের অতি পরিচিতমুখ ও মাতৃভাষায় পঠন-প্রক্রিয়ার কারণে শিশু-শিক্ষকদের মধ্যে আন্তসম্পর্কটা গভীর থাকে। ফলে শিশুরা সহজে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু সমপ্রতি এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৬৬ হাজার শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, মাতৃভাষায় আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করা চুক্তি বাস্তবায়নের একটি অন্যতম শর্তও বটে।
পরিশেষে আমরা চাই, এই ভাষার মাসে দেশের অন্য জাতিসত্তাগুলোর ভাষাকেও যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে সেগুলোর স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হোক। এ ছাড়া চুক্তি বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে চলতি সংসদ অধিবেশনে ভূমি কমিশন আইনে সংশোধনীগুলো পাস করা হোক।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী
ilira.dewan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.