সাদাকালো-তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংঘাতের অশুভ সূচনা-২ by আহমদ রফিক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে দুই দিনের হরতাল_তার দিনতামামি নেওয়ার আগে পূর্বকথায় ফিরে যেতে হয়। নিরপেক্ষ বিচারে (যদিও খালেদা জিয়ার একদা বক্তব্য, পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়_আমাদের বিবেচনায় মৃত্তিকাবিচ্ছিন্ন অবাস্তব চিন্তার প্রকাশ। দলীয় রাজনীতি নিরপেক্ষ মানুষের সংখ্যা কম নয়।
বরং রাজনীতিকদের আচরণের বদৌলতে সে সংখ্যা ক্রমবর্ধমান) বলা চলে একক সিদ্ধান্তে প্রস্তাবটি বিল আকারে নেওয়ার আগে বিরোধী দলের মতামত নেওয়া দরকার ছিল এবং তাতে উদার গণতান্ত্রিক আচরণের পরিচয় মিলত।
কিন্তু সব জেনে-বুঝেও বর্তমান সরকার কেন সমঝোতার পথ থেকে সরে এসেছে, তা আমাদের হিসাবে মেলে না। বিরোধী দল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এবং এ ব্যাপারে তারা অনড় জেনেও সরকার পক্ষের একতরফা সিদ্ধান্ত অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অথচ তাদের ঝুলিতে শরিক দলের দেওয়া একাধিক বিকল্প উপস্থিত ছিল। কিন্তু তারা সেসবের ধার দিয়েও যায়নি। কেন?
এ নিয়ে বিশ্লেষণের অনেক সুযোগ রয়েছে। কারো কারো ধারণা, নির্বাচনে বিশাল বিজয় সত্ত্বেও নির্বাচনী ইশতেহারের কর্মসূচির বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তাদের আগামী নির্বাচনে সাফল্যের সম্ভাবনা অনিশ্চিত করে দিয়েছে বলে তারা 'দেশকে আন্দোলন, পাল্টা আন্দোলনের পথে ঠেলে দিয়েছে। যাতে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন আসার পথ প্রশস্ত হয়' (কালের কণ্ঠ, ৭ জুন, ২০১১)।
এমন পর্যালোচনা বা বিচার-ব্যাখ্যা যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। কারণ 'ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা থেকে আওয়ামী লীগ ফায়দা তুলবে_এমন চিন্তা বাস্তবধর্মী নয়। কারণ ওয়ান-ইলেভেন কী বিএনপি, কী আওয়ামী লীগ কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি। গারদে পাঠিয়েছে দুই দলের শীর্ষনেতাদের, বাদ যাননি দুই জননেত্রী। তাহলে কোন আশায় আওয়ামী লীগ ওয়ান-ইলেভেনের অনুরূপ অঘটনের অপেক্ষায় থাকবে, যা তাদের জন্য পরিত্রাতার ভূমিকা নিতে পারে।' অতিশয় কষ্টকল্পনা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে কী থাকবে না, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন এতই উত্তপ্ত যে দুই দিনের অহেতুক ও অকার্যকর হরতাল হয়ে গেল_এর পরও অনেক মেঘ গর্জন, হুজুগ থামছে না, আবার তেমন সাড়াও মিলছে না। তা সত্ত্বেও অনেক পানি ঘোলা হয়ে গেছে। কিন্তু এর সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হলো, এই ঘোলা পানিতে মূল দুটো বিষয় অর্থাৎ 'বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত। নির্বাচন মানেই ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি। কাজেই ওইখানেই যত আগ্রহ। অন্যদিকে মন নেই, হোক না বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। তবু লেখালেখির বিরাম নেই। প্রতিদিন প্রধান পত্রিকাগুলোতে নানাভাবে_কখনো উপসম্পাদকীয় কলামের কাটাছেঁড়ায়, কখনো বিশেষজ্ঞ সাক্ষাৎকারে, কখনো মন্তব্য প্রতিবেদনে বিষয়টা নিয়ে দুই দলের তথা দুই নেত্রীর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রকাশ পাচ্ছে। তাতে কি দুই দলের অনড় অবস্থানের ভিত শক্ত হচ্ছে যুক্তি-অযুক্তির মাটি ভরাট করার মধ্য দিয়ে?
তবে এসব লেখালেখিতে কেউ কেউ নিরপেক্ষ অবস্থান নিচ্ছেন ঠিকই এবং তাতে যুক্তির প্রকাশও ঘটছে, কিন্তু তাতে বরফ গলার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলছেন সংসদে এসে কথা বলতে, যাতে সমঝোতার ভিত্তিতে বিষয়টির মীমাংসা করা যায়। কিন্তু সংসদে এলেই কি মীমাংসা ও মতৈক্য হবে? এ সমঝোতার আলোচনা আগে করে নিতে কি অসুবিধা ছিল? কেন অকারণ বিরোধী পক্ষের হাতে সুযোগ তুলে দেওয়া। হয়তো অতি আত্মবিশ্বাসী তারা, তাই। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগে সরকার পক্ষের অবস্থান বদল হোক; অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার নিশ্চয়তা দেওয়া হোক, অতঃপর আলোচনায় যাওয়া, সংসদে গিয়ে বা না গিয়ে। এখন যেকোনো দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি প্রশ্ন তুলতে পারেন এবং তা যুক্তিসংগতও বটে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যদি বহালই থাকল, তাহলে আলোচনার বা সমঝোতার কী আর বাকি থাকে। একেই বলে দুই দলের যুক্তিহীন অনড় অবস্থান। তবে যতই হাঁকডাক করুক বিরোধী দল এবং একদা বাম বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, হরতাল-অবস্থা কিন্তু প্রমাণ করে দিয়েছে মানুষ এসব আইনি বিষয় নিয়ে বড় একটা আগ্রহী নয়। তারা বরং চায় তাদের আগুনে সমস্যাগুলোর নিরসন, নিরসন না হলেও অন্ততপক্ষে প্রশমন।
আর সে জন্যই কি সরকার পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বিতর্কে এতটা অনমনীয় যে আলোচনায় না বসলে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু আমরা বলি, গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় এতটা কঠিন হওয়া ঠিক নয়। কারণ হাওয়া যে কখন কোন দিকে মোড় নেবে, তা কেউ বলতে পারে না। তাই সরকার পক্ষেরও আত্মবিশ্বাসে অনড় হওয়াটা ঠিক নয়। কারণ লাঠিপেটা করে কিছুটা ঠেকানো যায়, পুরোটা যে যায় না, আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে তেমন প্রমাণ ধরা আছে। তা ছাড়া যেখানে তাদের পক্ষ থেকেই 'তারা' আসার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আলোচনা ও সমঝোতার বিষয়টা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
আর সে জন্যই আবারও বলি, রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ হাতে না পেয়ে তড়িঘড়ি ঘোষণা দেওয়া যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকছে না এবং তা আদালতের রায়ে যুক্তিসংগত হয়নি। এ ক্ষেত্রে একটু সময় নেওয়া, ভেবে-চিন্তে দেখাই তো ঠিক হতো। তা ছাড়া এখানে আরো একটি বিবেচ্য বিষয় আছে। রায়ের সঙ্গে ওই যে 'তবে'র লেজটুকু আছে, তা সত্ত্বেও অব্যবহিত দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যেতে পারে_সেটাও তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
আমরা তাই দুই প্রধান দল এবং দুই নেত্রীকেই সহিষ্ণু মনোভাব নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিষয়টার মোকাবিলা করতে বলি। এ ক্ষেত্রে সমঝোতার বিকল্প নেই রায়ের দুদিক রক্ষার প্রকৃতির কারণে। আর সে ক্ষেত্রে ওই 'তবে'র কারণে বিরোধী দল আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তাই সরকার পক্ষের অতটা অনড় ও অনমনীয় হওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না। রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ না পাওয়া পর্যন্ত রায়ের পরমুহূর্ত থেকে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ'_এমন কঠিন অবস্থান গ্রহণ যেমন ঠিক হবে না, তেমনি তালগাছ হাতে রেখে আলোচনায় রাজি হওয়ার মতো অযৌক্তিক অবস্থানও ঠিক নয়।
সরকার পক্ষে বিষয়টা নিয়ে অহেতুক তাড়াহুড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ হাতে এখনো আড়াই বছরের মতো সময় রয়েছে, ধীরে-সুস্থে চলাই সেখানে বিধেয়। দেখা যাক না এর মধ্যে পানি কতটুকু গড়ায়, কোন দিকে গড়ায়। ইতিমধ্যে বর্তমানের প্রবল তর্ক-বিতর্কে বিশেষজ্ঞ, কলাম লেখক এবং অন্যরা তাঁদের মতামত লিখে বা বিবৃতিতে আসর সরগরম করতে থাকুন। এর মধ্য থেকে হয়তো সমঝোতার কোনো একটা পথ বেরিয়ে আসতেও পারে। এ বিষয়ে দুই পক্ষের অহেতুক জেদ কাম্য নয়, দরকার দেশের স্বার্থে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা।
কাজেই অপেক্ষায় ক্ষতি নেই, বরং তাতে সুফলই মিলতে পারে। ইতিমধ্যে বেরিয়ে আসুক আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিবরণ। আর এ বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি অনুরোধ জানাব বর্তমানে উত্তপ্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ব্যবস্থা নিতে। সেটা বিবদমান দুই রাজনৈতিক পক্ষের জন্যই নয় শুধু, দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থেও বটে।
কারণ এ রায়ের মধ্যে যে কিছুটা ফাঁকফোকর আছে তা সাবেক বিচারপতি এবং আইন বিশেষজ্ঞদের কথাবার্তায়ও বোঝা যাচ্ছে। কেননা কেউ বলছেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, আর কোনো সুযোগ নেই। আবার কেউ বলছেন, 'রায় ঘোষণার দিন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে ঠিকই, তবে আগামী দুটো নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনেই করা যাবে। সংবিধান সংশোধনের দরকার হবে না।' মতামত উদ্ধৃতি না বাড়িয়ে শুধু বলতে হয়, 'বল্ মা তারা, দাঁড়াই কোথা!'
আমরা আবারও বলি, রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই। এতে প্রায়ই সুফল মেলে। সেই সঙ্গে এ কথাও জোর দিয়ে বলি, আলোচ্য বিষয় নিয়ে এত টালমাটাল অবস্থার মধ্যে বলি, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা এবং রাজনৈতিক বিশিষ্টজন ও সংসদ সদস্যরা আপনারা ভুলে যাবেন না, 'বিসমিল্লাহ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বাতিলের বিষয়টি। মহাজোটের দুই শরিক দল এবং আরো অনেকে বলেছেন, এ দুটো বিষয় বাতিল করে তবেই বাহাত্তরের সংবিধানে যাওয়া উচিত। আমাদেরও একই কথা, কারো গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন্ন করে গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় ফেরা যায় না। কাজেই বাহাত্তরের অবিকৃত সংবিধান পুনর্বহাল আমাদের কাম্য। ক্ষমতাসীন দলকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, বাহাত্তরের অবিকৃত সংবিধান পুনর্বহাল হলে তাদের ভোটবাঙ্ েহাত পড়বে না। বিষয়টা পূর্ববর্তী লেখায় বিশদ বলা হয়েছে। তাই পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
কিন্তু সব জেনে-বুঝেও বর্তমান সরকার কেন সমঝোতার পথ থেকে সরে এসেছে, তা আমাদের হিসাবে মেলে না। বিরোধী দল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এবং এ ব্যাপারে তারা অনড় জেনেও সরকার পক্ষের একতরফা সিদ্ধান্ত অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অথচ তাদের ঝুলিতে শরিক দলের দেওয়া একাধিক বিকল্প উপস্থিত ছিল। কিন্তু তারা সেসবের ধার দিয়েও যায়নি। কেন?
এ নিয়ে বিশ্লেষণের অনেক সুযোগ রয়েছে। কারো কারো ধারণা, নির্বাচনে বিশাল বিজয় সত্ত্বেও নির্বাচনী ইশতেহারের কর্মসূচির বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তাদের আগামী নির্বাচনে সাফল্যের সম্ভাবনা অনিশ্চিত করে দিয়েছে বলে তারা 'দেশকে আন্দোলন, পাল্টা আন্দোলনের পথে ঠেলে দিয়েছে। যাতে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন আসার পথ প্রশস্ত হয়' (কালের কণ্ঠ, ৭ জুন, ২০১১)।
এমন পর্যালোচনা বা বিচার-ব্যাখ্যা যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। কারণ 'ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা থেকে আওয়ামী লীগ ফায়দা তুলবে_এমন চিন্তা বাস্তবধর্মী নয়। কারণ ওয়ান-ইলেভেন কী বিএনপি, কী আওয়ামী লীগ কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি। গারদে পাঠিয়েছে দুই দলের শীর্ষনেতাদের, বাদ যাননি দুই জননেত্রী। তাহলে কোন আশায় আওয়ামী লীগ ওয়ান-ইলেভেনের অনুরূপ অঘটনের অপেক্ষায় থাকবে, যা তাদের জন্য পরিত্রাতার ভূমিকা নিতে পারে।' অতিশয় কষ্টকল্পনা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে কী থাকবে না, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন এতই উত্তপ্ত যে দুই দিনের অহেতুক ও অকার্যকর হরতাল হয়ে গেল_এর পরও অনেক মেঘ গর্জন, হুজুগ থামছে না, আবার তেমন সাড়াও মিলছে না। তা সত্ত্বেও অনেক পানি ঘোলা হয়ে গেছে। কিন্তু এর সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হলো, এই ঘোলা পানিতে মূল দুটো বিষয় অর্থাৎ 'বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত। নির্বাচন মানেই ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি। কাজেই ওইখানেই যত আগ্রহ। অন্যদিকে মন নেই, হোক না বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। তবু লেখালেখির বিরাম নেই। প্রতিদিন প্রধান পত্রিকাগুলোতে নানাভাবে_কখনো উপসম্পাদকীয় কলামের কাটাছেঁড়ায়, কখনো বিশেষজ্ঞ সাক্ষাৎকারে, কখনো মন্তব্য প্রতিবেদনে বিষয়টা নিয়ে দুই দলের তথা দুই নেত্রীর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রকাশ পাচ্ছে। তাতে কি দুই দলের অনড় অবস্থানের ভিত শক্ত হচ্ছে যুক্তি-অযুক্তির মাটি ভরাট করার মধ্য দিয়ে?
তবে এসব লেখালেখিতে কেউ কেউ নিরপেক্ষ অবস্থান নিচ্ছেন ঠিকই এবং তাতে যুক্তির প্রকাশও ঘটছে, কিন্তু তাতে বরফ গলার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলছেন সংসদে এসে কথা বলতে, যাতে সমঝোতার ভিত্তিতে বিষয়টির মীমাংসা করা যায়। কিন্তু সংসদে এলেই কি মীমাংসা ও মতৈক্য হবে? এ সমঝোতার আলোচনা আগে করে নিতে কি অসুবিধা ছিল? কেন অকারণ বিরোধী পক্ষের হাতে সুযোগ তুলে দেওয়া। হয়তো অতি আত্মবিশ্বাসী তারা, তাই। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগে সরকার পক্ষের অবস্থান বদল হোক; অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার নিশ্চয়তা দেওয়া হোক, অতঃপর আলোচনায় যাওয়া, সংসদে গিয়ে বা না গিয়ে। এখন যেকোনো দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি প্রশ্ন তুলতে পারেন এবং তা যুক্তিসংগতও বটে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যদি বহালই থাকল, তাহলে আলোচনার বা সমঝোতার কী আর বাকি থাকে। একেই বলে দুই দলের যুক্তিহীন অনড় অবস্থান। তবে যতই হাঁকডাক করুক বিরোধী দল এবং একদা বাম বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, হরতাল-অবস্থা কিন্তু প্রমাণ করে দিয়েছে মানুষ এসব আইনি বিষয় নিয়ে বড় একটা আগ্রহী নয়। তারা বরং চায় তাদের আগুনে সমস্যাগুলোর নিরসন, নিরসন না হলেও অন্ততপক্ষে প্রশমন।
আর সে জন্যই কি সরকার পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বিতর্কে এতটা অনমনীয় যে আলোচনায় না বসলে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু আমরা বলি, গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় এতটা কঠিন হওয়া ঠিক নয়। কারণ হাওয়া যে কখন কোন দিকে মোড় নেবে, তা কেউ বলতে পারে না। তাই সরকার পক্ষেরও আত্মবিশ্বাসে অনড় হওয়াটা ঠিক নয়। কারণ লাঠিপেটা করে কিছুটা ঠেকানো যায়, পুরোটা যে যায় না, আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে তেমন প্রমাণ ধরা আছে। তা ছাড়া যেখানে তাদের পক্ষ থেকেই 'তারা' আসার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আলোচনা ও সমঝোতার বিষয়টা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
আর সে জন্যই আবারও বলি, রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ হাতে না পেয়ে তড়িঘড়ি ঘোষণা দেওয়া যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকছে না এবং তা আদালতের রায়ে যুক্তিসংগত হয়নি। এ ক্ষেত্রে একটু সময় নেওয়া, ভেবে-চিন্তে দেখাই তো ঠিক হতো। তা ছাড়া এখানে আরো একটি বিবেচ্য বিষয় আছে। রায়ের সঙ্গে ওই যে 'তবে'র লেজটুকু আছে, তা সত্ত্বেও অব্যবহিত দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যেতে পারে_সেটাও তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
আমরা তাই দুই প্রধান দল এবং দুই নেত্রীকেই সহিষ্ণু মনোভাব নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিষয়টার মোকাবিলা করতে বলি। এ ক্ষেত্রে সমঝোতার বিকল্প নেই রায়ের দুদিক রক্ষার প্রকৃতির কারণে। আর সে ক্ষেত্রে ওই 'তবে'র কারণে বিরোধী দল আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তাই সরকার পক্ষের অতটা অনড় ও অনমনীয় হওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না। রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ না পাওয়া পর্যন্ত রায়ের পরমুহূর্ত থেকে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ'_এমন কঠিন অবস্থান গ্রহণ যেমন ঠিক হবে না, তেমনি তালগাছ হাতে রেখে আলোচনায় রাজি হওয়ার মতো অযৌক্তিক অবস্থানও ঠিক নয়।
সরকার পক্ষে বিষয়টা নিয়ে অহেতুক তাড়াহুড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ হাতে এখনো আড়াই বছরের মতো সময় রয়েছে, ধীরে-সুস্থে চলাই সেখানে বিধেয়। দেখা যাক না এর মধ্যে পানি কতটুকু গড়ায়, কোন দিকে গড়ায়। ইতিমধ্যে বর্তমানের প্রবল তর্ক-বিতর্কে বিশেষজ্ঞ, কলাম লেখক এবং অন্যরা তাঁদের মতামত লিখে বা বিবৃতিতে আসর সরগরম করতে থাকুন। এর মধ্য থেকে হয়তো সমঝোতার কোনো একটা পথ বেরিয়ে আসতেও পারে। এ বিষয়ে দুই পক্ষের অহেতুক জেদ কাম্য নয়, দরকার দেশের স্বার্থে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা।
কাজেই অপেক্ষায় ক্ষতি নেই, বরং তাতে সুফলই মিলতে পারে। ইতিমধ্যে বেরিয়ে আসুক আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিবরণ। আর এ বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি অনুরোধ জানাব বর্তমানে উত্তপ্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ব্যবস্থা নিতে। সেটা বিবদমান দুই রাজনৈতিক পক্ষের জন্যই নয় শুধু, দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থেও বটে।
কারণ এ রায়ের মধ্যে যে কিছুটা ফাঁকফোকর আছে তা সাবেক বিচারপতি এবং আইন বিশেষজ্ঞদের কথাবার্তায়ও বোঝা যাচ্ছে। কেননা কেউ বলছেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, আর কোনো সুযোগ নেই। আবার কেউ বলছেন, 'রায় ঘোষণার দিন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে ঠিকই, তবে আগামী দুটো নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনেই করা যাবে। সংবিধান সংশোধনের দরকার হবে না।' মতামত উদ্ধৃতি না বাড়িয়ে শুধু বলতে হয়, 'বল্ মা তারা, দাঁড়াই কোথা!'
আমরা আবারও বলি, রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই। এতে প্রায়ই সুফল মেলে। সেই সঙ্গে এ কথাও জোর দিয়ে বলি, আলোচ্য বিষয় নিয়ে এত টালমাটাল অবস্থার মধ্যে বলি, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা এবং রাজনৈতিক বিশিষ্টজন ও সংসদ সদস্যরা আপনারা ভুলে যাবেন না, 'বিসমিল্লাহ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বাতিলের বিষয়টি। মহাজোটের দুই শরিক দল এবং আরো অনেকে বলেছেন, এ দুটো বিষয় বাতিল করে তবেই বাহাত্তরের সংবিধানে যাওয়া উচিত। আমাদেরও একই কথা, কারো গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন্ন করে গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় ফেরা যায় না। কাজেই বাহাত্তরের অবিকৃত সংবিধান পুনর্বহাল আমাদের কাম্য। ক্ষমতাসীন দলকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, বাহাত্তরের অবিকৃত সংবিধান পুনর্বহাল হলে তাদের ভোটবাঙ্ েহাত পড়বে না। বিষয়টা পূর্ববর্তী লেখায় বিশদ বলা হয়েছে। তাই পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
No comments