চারদিক-থেমো না শঙ্খচিল
তাঁর গান আগেও শুনেছি পথসভায়-ময়দানে। কিন্তু নিজের ভেতর জেগে ওঠার অনুভূতি প্রথম হয় শহীদ মিনারে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রয়াণ করেছেন কদিন আগে। শহীদ মিনারে প্রথম শোকসভা ডাকা হয়েছিল বাংলাদেশ লেখক শিবিরের তরফ থেকে।
কথাসাহিত্যিক ইলিয়াস আর গণসংগীতশিল্পী কামরুদ্দীন আবসার সেই সংগঠনের সহযোদ্ধা হিসেবে বহুদিন পাশাপাশি চলেছেন। ইনি কথা বলেছেন যদি, উনি তবে গান গেয়েছেন। বন্ধুর প্রয়াণে বন্ধুর বুকে যে মাতম জাগে, তা-ই যেন সেদিন তাঁর গলায় উঠে এল। কামরুদ্দীন আবসার শহীদ মিনারের লাল বেদিতে দাঁড়িয়ে গাইলেন, ‘আরও বসন্ত, বহু বসন্ত, তোমার নামেই আসুক।’ চীন-বিপ্লবের গান যেন বদলে গেল। প্রয়াত সহযোদ্ধার জন্য মর্সিয়ার মতো বেজে উঠল উপস্থিত অনেকের মনে। অন্য সময় এই গান শুনে রক্ত চনমন করত, সেদিন অশ্রুতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। চোখে কিছু দেখছি না; কিন্তু কান উৎসুক হয়ে পাতা রইল তাঁর ভেজা আর ভরাট গলার দিকে।
গণসংগীত যখন গণমানুষের স্রোতে আর ভেলা ভাসাতে পারছে না, নতুন প্রজন্মের রাগ-ক্ষোভ-ঝাঁজ ও ভালোবাসার ভাষা তা ঠিকমতো ধরতে পারছে না, তখনো কামরুদ্দীন আবসারের গণসংগীত ক্ল্যাসিক আবহ জাগায়। মনে হতো, কেবল প্রতিবাদের নয় এই গান, এই গান হূদয়ের কোমল আবেগেরও। অসাধারণ গাইতেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গাওয়া ‘শঙ্খচিল’ গানটি—‘সুদূর সমুদ্দুর, প্রশান্তের বুকে হিরোশিমা দ্বীপে আমি শঙ্খচিল/ আমার দু’ডানায়, ঢেউয়ের দোলায়, নীল শুধু নীল।’ এই গান গণের, তবু একা শুনলেও মনটা কি এক শঙ্খচিলের মহাকাব্যিক উড়ালের সঙ্গী হয়ে যায় না? গায়কির মতো মনটাও তাঁর সমুদ্রের মতোই নোনা আর সিক্ত।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যাঁরা গণসংগীত গেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি উজ্জ্বল। গণসংগীত তাঁর ওপরে ওঠার সিঁড়ি ছিল না, যৌবনের আবেগ ছিল না; সেটাই ছিল তাঁর জীবনবেদ, জীবনের শপথ। নিজের করা সুরে গাইতেন ‘চল রে ভাই, উজান বেয়ে যাই’, কিংবা ‘আমি কোনো ভালোবাসার গল্প জানি না, যেটুকু জেনেছি সবটুকু যুদ্ধের’।
কিন্তু অনেক দিন তিনি গাইতে পারছিলেন না ঠিকঠাক। চোখে সমস্যা, কানে সমস্যা, শেষপর্যন্ত গলায়ও সমস্যা শুরু হলো। এসব আমরা জানতাম। কিন্তু জানতাম না যে তাঁর বুকেও সমস্যা শিকড় গাড়ছে। দিন যায় আর সৌম্য, হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির মুখ মলিন হতে থাকে। চলাফেরায় কেমন যেন উদাস! বললে মানতেন না, কিন্তু জানতেন ঠিকই, হূদয় আসলে শেষপর্যন্ত একটি যন্ত্রই। আর যন্ত্রটি নষ্ট হলে মন-মগজ সবই অবশ হয়ে যায়। কথা বলতে দেয় না, গান গাইতে দেয় না; তখন কেবল দীর্ঘ নীরবতার আগাম পদধ্বনি।
অবশেষে যা হওয়ার, তা-ই হলো। এক দিন বাড়ি ফিরতে পারলেন না। রাত নয়টার দিকে শ্যামলীতে বাসের মধ্যেই স্ট্রোক হলো, পড়ে গেলেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা বললেন, স্ট্রোক করেছেন, মস্তিষ্কেও রক্তক্ষরণ হয়েছে ব্যাপক। আর ব্লক-ট্লক কি ছাইও নাকি আছে বুকে। চিকিৎসকেরা সাধারণত ভয় দিতে চান না স্বজনদের। কিন্তু ভয় ছিল, অনেক বড় ভয়!
হূদ্যন্ত্রের রোগ নিয়ে তিনি ভাবিত—তা মনে হতো না। তাঁর চিন্তা ছিল চোখ নিয়ে। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে চোখের দৃষ্টি কমে আসছিল তাঁর। রসিকতা করে বলতেন, ‘চোখের চিকিৎসাটা আগে। মরলেও দেইখ্যা মরতে চাই।’ এই স্বগতমৃত্যুবাসনা তাঁর আজীবনের জীবনবাদিতার পরাজয় কি? সময় বদলে গেছে, ‘এই দুনিয়া আর সেই দুনিয়া নাই’। সারা জীবন গান করেছেন, তরুণ-তরুণীদের গান শিখিয়েছেন, ডাক পেলেই চলে গেছেন মাঠে-ময়দানে, গ্রামে-গঞ্জে আর ফুলবাড়ীতে। বাংলাদেশের বিলীয়মান সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতিরোধী ধারা টিকিয়ে রাখতে মেহনত করেছেন। সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়তে পারেন যে মানুষ, সেই মানুষটা একটা লড়াই কোনো দিন করার প্রয়োজন বোধ করেননি; সে লড়াই বিত্তের, নিরাপত্তার, স্বাচ্ছন্দ্যের। সেটা তাঁর কোনো দিনই ছিল না। তাহলে কোন ভরসায় হূদেরাগের ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে যাবেন? নিজের জন্য কিছু চাওয়ার দীনতা তাঁর কোনো দিন ছিল না। তাই বুঝি অপেক্ষা করছিলেন, থামার আগে যত দূরে যাওয়া যায়, যেতে চাইছিলেন। হয়তো বিশ্বাসও করছিলেন, ‘অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’...ঘুমিয়ে পড়ার আগে যেতে চাই আরও কিছুদূর।
এখন তিনি শুয়ে আছেন সেন্ট্রাল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে। ১১ সেপ্টেম্বর রাতে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে। এখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, শরীরের বাঁ দিকটা অসাড়। শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচার চলছে, চলছে যমে-মানুষে টানাটানি। একই সঙ্গে চলছে বাঁচার আর বাঁচানোর জেদের সঙ্গে সামর্থ্যেরও টানাটানি। এত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার খরচ কে জোগাবে? বন্ধুরা এগিয়ে আসছেন, তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মীরাও বসে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছবির হাটে ২৩ সেপ্টেম্বর চিকিৎসা-সহায়তার জন্য গণসংগীতের অনুষ্ঠান হবে। চলছে চিত্র প্রদর্শনী ও বিক্রির আয়োজন।
কলিকালে ছোটকে বড় আর বড়কে ছোট লাগে। কামরুদ্দীন আবসার কেমন মানুষ আর কেমন শিল্পী, তা কীভাবে বোঝাব? তাঁকে বাঁচানোর জরুরত কাকে জানাব? শুধু বলব, কোনো কোনো মানুষ নিজের জন্য বাঁচেন না, অপরের জন্যও বাঁচেন। সেই অপর, আমরা কি তাঁকে এভাবে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেব? আমরা কি এতই নিদায়?
ফারুক ওয়াসিফ
গণসংগীত যখন গণমানুষের স্রোতে আর ভেলা ভাসাতে পারছে না, নতুন প্রজন্মের রাগ-ক্ষোভ-ঝাঁজ ও ভালোবাসার ভাষা তা ঠিকমতো ধরতে পারছে না, তখনো কামরুদ্দীন আবসারের গণসংগীত ক্ল্যাসিক আবহ জাগায়। মনে হতো, কেবল প্রতিবাদের নয় এই গান, এই গান হূদয়ের কোমল আবেগেরও। অসাধারণ গাইতেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গাওয়া ‘শঙ্খচিল’ গানটি—‘সুদূর সমুদ্দুর, প্রশান্তের বুকে হিরোশিমা দ্বীপে আমি শঙ্খচিল/ আমার দু’ডানায়, ঢেউয়ের দোলায়, নীল শুধু নীল।’ এই গান গণের, তবু একা শুনলেও মনটা কি এক শঙ্খচিলের মহাকাব্যিক উড়ালের সঙ্গী হয়ে যায় না? গায়কির মতো মনটাও তাঁর সমুদ্রের মতোই নোনা আর সিক্ত।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যাঁরা গণসংগীত গেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি উজ্জ্বল। গণসংগীত তাঁর ওপরে ওঠার সিঁড়ি ছিল না, যৌবনের আবেগ ছিল না; সেটাই ছিল তাঁর জীবনবেদ, জীবনের শপথ। নিজের করা সুরে গাইতেন ‘চল রে ভাই, উজান বেয়ে যাই’, কিংবা ‘আমি কোনো ভালোবাসার গল্প জানি না, যেটুকু জেনেছি সবটুকু যুদ্ধের’।
কিন্তু অনেক দিন তিনি গাইতে পারছিলেন না ঠিকঠাক। চোখে সমস্যা, কানে সমস্যা, শেষপর্যন্ত গলায়ও সমস্যা শুরু হলো। এসব আমরা জানতাম। কিন্তু জানতাম না যে তাঁর বুকেও সমস্যা শিকড় গাড়ছে। দিন যায় আর সৌম্য, হাস্যোজ্জ্বল মানুষটির মুখ মলিন হতে থাকে। চলাফেরায় কেমন যেন উদাস! বললে মানতেন না, কিন্তু জানতেন ঠিকই, হূদয় আসলে শেষপর্যন্ত একটি যন্ত্রই। আর যন্ত্রটি নষ্ট হলে মন-মগজ সবই অবশ হয়ে যায়। কথা বলতে দেয় না, গান গাইতে দেয় না; তখন কেবল দীর্ঘ নীরবতার আগাম পদধ্বনি।
অবশেষে যা হওয়ার, তা-ই হলো। এক দিন বাড়ি ফিরতে পারলেন না। রাত নয়টার দিকে শ্যামলীতে বাসের মধ্যেই স্ট্রোক হলো, পড়ে গেলেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা বললেন, স্ট্রোক করেছেন, মস্তিষ্কেও রক্তক্ষরণ হয়েছে ব্যাপক। আর ব্লক-ট্লক কি ছাইও নাকি আছে বুকে। চিকিৎসকেরা সাধারণত ভয় দিতে চান না স্বজনদের। কিন্তু ভয় ছিল, অনেক বড় ভয়!
হূদ্যন্ত্রের রোগ নিয়ে তিনি ভাবিত—তা মনে হতো না। তাঁর চিন্তা ছিল চোখ নিয়ে। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে চোখের দৃষ্টি কমে আসছিল তাঁর। রসিকতা করে বলতেন, ‘চোখের চিকিৎসাটা আগে। মরলেও দেইখ্যা মরতে চাই।’ এই স্বগতমৃত্যুবাসনা তাঁর আজীবনের জীবনবাদিতার পরাজয় কি? সময় বদলে গেছে, ‘এই দুনিয়া আর সেই দুনিয়া নাই’। সারা জীবন গান করেছেন, তরুণ-তরুণীদের গান শিখিয়েছেন, ডাক পেলেই চলে গেছেন মাঠে-ময়দানে, গ্রামে-গঞ্জে আর ফুলবাড়ীতে। বাংলাদেশের বিলীয়মান সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতিরোধী ধারা টিকিয়ে রাখতে মেহনত করেছেন। সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়তে পারেন যে মানুষ, সেই মানুষটা একটা লড়াই কোনো দিন করার প্রয়োজন বোধ করেননি; সে লড়াই বিত্তের, নিরাপত্তার, স্বাচ্ছন্দ্যের। সেটা তাঁর কোনো দিনই ছিল না। তাহলে কোন ভরসায় হূদেরাগের ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে যাবেন? নিজের জন্য কিছু চাওয়ার দীনতা তাঁর কোনো দিন ছিল না। তাই বুঝি অপেক্ষা করছিলেন, থামার আগে যত দূরে যাওয়া যায়, যেতে চাইছিলেন। হয়তো বিশ্বাসও করছিলেন, ‘অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’...ঘুমিয়ে পড়ার আগে যেতে চাই আরও কিছুদূর।
এখন তিনি শুয়ে আছেন সেন্ট্রাল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে। ১১ সেপ্টেম্বর রাতে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে। এখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, শরীরের বাঁ দিকটা অসাড়। শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচার চলছে, চলছে যমে-মানুষে টানাটানি। একই সঙ্গে চলছে বাঁচার আর বাঁচানোর জেদের সঙ্গে সামর্থ্যেরও টানাটানি। এত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার খরচ কে জোগাবে? বন্ধুরা এগিয়ে আসছেন, তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মীরাও বসে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছবির হাটে ২৩ সেপ্টেম্বর চিকিৎসা-সহায়তার জন্য গণসংগীতের অনুষ্ঠান হবে। চলছে চিত্র প্রদর্শনী ও বিক্রির আয়োজন।
কলিকালে ছোটকে বড় আর বড়কে ছোট লাগে। কামরুদ্দীন আবসার কেমন মানুষ আর কেমন শিল্পী, তা কীভাবে বোঝাব? তাঁকে বাঁচানোর জরুরত কাকে জানাব? শুধু বলব, কোনো কোনো মানুষ নিজের জন্য বাঁচেন না, অপরের জন্যও বাঁচেন। সেই অপর, আমরা কি তাঁকে এভাবে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেব? আমরা কি এতই নিদায়?
ফারুক ওয়াসিফ
No comments