স্মরণ-হায় সোলায়মান!

শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালা থেকে হেঁটে যাচ্ছিলাম পরীক্ষণ থিয়েটার হলের দিকে। হঠাৎ ডাক শুনে পেছনে তাকালাম। দেখলাম, হাসছে সোলায়মান। জিজ্ঞেস করলাম, যাও কোথায়? বলল, যাচ্ছি পরীক্ষণ থিয়েটারে। তখনই একঝাঁক হাসি আমার প্রায় কণ্ঠরোধ করেছিল। হাসিটার অর্থ বুঝলাম না।


ডান দিকের গ্যারেজের অন্ধকারে হারিয়ে গেল সোলায়মান। সেদিন রাঢ়াঙ-এর শো ছিল পরীক্ষণ থিয়েটারে। গ্যালারির ওপর থেকে কোরিওগ্রাফি দেখছিলাম, কাঁধে একটা স্পর্শ অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি, আবার সোলায়মান। এবার হাসল না সোলায়মান। খুবই মনোযোগ দিয়ে কোরিওগ্রাফি দেখছে। হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে উঠছে তার চোখ।
পরদিন স্টুডিও থিয়েটারে চলছিল থিয়েটার আর্ট ইউনিটের মগজ সমাচার। নাটক দেখছিলাম। হঠাৎ ডান দিকে তাকাতেই দেখি সোলায়মান বসা। আমি কথা বলতে গেলেই অঙ্গুলি নির্দেশ, সামনে তাকাও। নাটক শেষে অসংখ্য দর্শকের সঙ্গে সেও চলে গেল।
কয়েক দিন পর দেখা জাতীয় নাট্যশালায়। নাটক চলছিল, সময়ের প্রয়োজনে। হঠাৎ দেখি, মঞ্চে সোলায়মান। একি! কিছুক্ষণের মধ্যে ভ্রম কাটল। সোলায়মান নয়, অন্য কেউ। পেছন দিকে একজন আমার কাঁধে ছোট একটা চাপ দিল। দেখলাম, এখানেও সোলায়মান। চোখ টিপ দিয়ে চিরাচরিত রহস্যময় হাসি। আস্তে করে আমার ঘাড়টা ঘুরিয়ে দিল। নাটক দেখ—অনুচ্চ কণ্ঠে বলল সে।
অভিনয় শেষে আর দেখা হয়নি। চিলেকোঠায় আড্ডা মেরে লিফটের শেষ যাত্রীটি হয়ে যখন নামছি, তখন হঠাৎ করে ২ নম্বর ফ্লোরের লিফট খুলে গেল। উঠে এল সোলায়মান। ভীষণ উত্তেজিত। প্রায় আমাকে মারে। পরক্ষণে তার কণ্ঠে গান—‘এ খেলাতে কেন আমি নেই গো।’ আবার মুহূর্তেই সংলাপ। খ্যাপা পাগলার সংলাপ। ‘খুব মজায় আছো। লিফটে চড়ে গ্রিন রুমে যাও। আড্ডা দাও। এত বড় মঞ্চে একলাই অভিনয় করো। হা হা হা, আমি বাদ, না?’
এরপর তার ব্যাগটা দিয়ে আমাকে আঘাত করতে যাবে, এমন সময় লিফটের দরজা খুলে গেল। বাঁচিয়ে দিল আমাকে সেলিম আল দীন।
সোলায়মান! পিঠে হাত দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরই দেখছি, গাড়িতে উঠে যাবেন এখনই আবদুল্লাহ আল-মামুন।
মামুন ভাই, শো কেমন হলো?
ভালোই। অভিনয় করতে পারলাম না।
হঠাৎ কী দেখে আবদুল্লাহ আল-মামুন গাড়ি থেকে নেমে উল্টো পথে হাঁটছেন। তখন আমার ভয়ে গা ছমছম করছে। নিচতলায় গ্যারেজে সিগারেট টানছেন তাঁরা তিনজন। সমস্বরে আমার দিকে একটা ধিক্কার, ‘আছো ভালোই।’
আমি দ্রুত বেরিয়ে আসি। সোলায়মানের জন্য খুব গভীর একটা বেদনা অনুভব করি।
ওপরের ঘটনাগুলো ঘটেনি, কিন্তু আমি তা আমার অস্তিত্বে বহন করছি অনেক দিন ধরে।
আমাদের নতুন মঞ্চগুলোতে সে কাজ করার সুযোগ পায়নি। পেলে যে কী করত! মৃত্যু তাকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। সবগুলো মঞ্চেই দাপানো নাটক সে করে গেছে। তাই তার প্রেতাত্মা আমার মতো দর্শক-নাট্যকর্মীকে আজ পরিহাস করছে।
শেষ ঘটনাটি মহিলা সমিতির ভাঙ্গাগড়া উৎসবে, যেখানে আমাদের হূদয় ভেঙে যায়। প্রতিটি মুহূর্তে সে উপস্থিত। ইঙ্গিত হচ্ছে, হচ্ছে ইন্সপেক্টর জেনারেল, কোর্ট মার্শাল, আমিনা সুন্দরী, এই দেশে এই বেশে, জনতার শত্রু, আহ্ কমরেড, গোলাপজান।
একাকার করছে মঞ্চ। দর্শক ভেঙে পড়ছে। মহিলা সমিতির ছোট্ট গ্রিন রুমে, করিডরে, সামনের সিঁড়িতে—সর্বত্র সোলায়মান। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সম্মেলনে সেক্রেটারি জেনারেলের বক্তব্য পাঠ করছে। মৌলবাদবিরোধী উৎসবে তার নাটক হচ্ছে।
আজ সোলায়মানের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। সোলায়মান প্রবল শক্তির এক নাম। দেখতে দেখতে, ভাবতে ভাবতে আমার কণ্ঠ রোধ হয়ে গেল। বুকফাটা কান্নায় আমি চিৎকার করে উঠি। হায়! হায় সোলায়মান!
মামুনুর রশীদ

No comments

Powered by Blogger.