বাঘা তেঁতুল-বাংলানামা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

হাজার বছর আগে, ১০১০ সালে পারস্য কবি ফেরদৌসী শেষ করেন শাহনামা। তাতে ছিল প্রায় ৬০ হাজার দ্বিপদী শ্লোক। যুদ্ধবিগ্রহ, ট্র্যাজেডি ও রাজরাজড়ার বীরত্বের কাহিনি—বেইমানি ও বিশ্বাসঘাতকতার উপাখ্যান ছিল না। চোগলখোরির তো নয়ই।


বহু শতাব্দী আগে অজ্ঞাতনামা লেখকদের দ্বারা রচিত ও সংকলিত হয়েছিল আলিফ লায়লাহ্ ওয়াহ লায়লা—সহস্র এক রজনী বা আরব্য রজনীর কাহিনি। সেসব ছিল উপকথা। আলাদিন, আলিবাবা, সিন্দাবাদ প্রভৃতি কোনো বাস্তব চরিত্র ছিল না। মধ্য এশিয়ার এক বাদশা শাহরিয়ার মনে করতেন, তাঁর স্ত্রী তাঁর প্রতি অবিশ্বাসী। অন্য পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। রানি ও তার প্রেমিকদের তিনি হত্যা করেন। তার পর থেকে সমস্ত নারী জাতিকেই তিনি ঘৃণা করতে থাকেন। প্রতিদিন একেকজনকে বিয়ে করতেন বাদশা নামদার এবং ভোর হওয়ার আগেই তাকে হত্যা করতেন।
বাদশা শাহরিয়ারের উজিরের (আমাদের দেশে যাকে আমরা বলি মন্ত্রী) দুই মেয়ে ছিল। তাদের নাম শেহেরজাদ ও দুনিয়াজাদ। শেহেরজাদ ছিল তুখোড় বুদ্ধিমতী। (এখন অবশ্য তার মতো বা তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমতী বাংলার মাটিতে অনেকেই আছেন)। সে তার বাবাকে বলল, আমাকে বাদশার সঙ্গে বিয়ে দাও। বিয়ের দিন সন্ধ্যারাত অর্থাৎ বাসরঘরে সে বাদশাকে একটি গল্প শোনাতে থাকে। রাত শেষ হয়ে এল, কিন্তু গল্পটি শেষ হলো না। গল্পটি এতই চমকপ্রদ যে সে-রাতে বাদশা শেহেরজাদকে হত্যা না করে বললেন, আগামীকাল রাতে তোমার গল্পের শেষটুকু শুনব (এবং তারপর তোমার গর্দান নেব)।
পরের দিন রাতে অল্প সময়ের মধ্যেই গল্প শেষ হয়ে গেল। বাদশা বললেন, তোমার গল্প তো দারুণ মজাদার। আর একটি শোনাও। শেহেরজাদ গল্প শুরু করে কিন্তু রাত শেষ হওয়ার আগে তা শেষ হয় না। এভাবেই রাতের পর রাত কাটে। শেষ হয় না গল্প। শেষ পর্যন্ত বাদশা তাঁর প্রতিহিংসাপরায়ণ কর্ম থেকে বিরত হন। বেঁচে যায় শেহেরজাদ ও অগণিত হতভাগিনী নারী।
শাহনামা এবং আরব্য রজনীর পর বিশ্বের ইতিহাসে যোগ হলো আরেক মহাকাব্য বা মহা-উপাখ্যান, যার নাম আমরা দিতে পারি ‘বাংলানামা’ বা ‘বাংলার মাটিতে হাজার এক দিন’। এই উপাখ্যানের রচয়িতা অবশ্য একজন নন, আরব্য রজনীর মতো অনেকে। সংকলকের নাম জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। আবুল কাসেম ফেরদৌসীর মতোই অ্যাসাঞ্জের নাম বাংলার মানুষ স্মরণ করবে চিরকাল। শাহনামা বা আরব্য রজনীতে যত কাহিনি আছে, আলোচ্য বাংলানামায় আছে তার চেয়ে বেশি: কুড়ি হাজার।
সেকালের মতো এখন রাজতন্ত্র নেই। কোনো কোনো দেশে রাজা-বাদশা থাকলেও তাঁরা ঠুঁটো জগন্নাথ, গণতান্ত্রিক সরকারই দেশ পরিচালনা করে। আমাদের মতো দেশে রাজতন্ত্র না থাকলেও আছে রাজনীতি। এখন গণতন্ত্রের যুগ। রাজা, বাদশা, উজির-নাজির নেই, আছেন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী-আমলারা। এই দুই হাজার কাহিনির কুশীলবদের মধ্যে শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, আছেন আরও অনেকে। আছেন শীর্ষস্থানীয় আমলা, কূটনীতিক, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ, এনজিও কর্মকর্তা প্রমুখ। আছেন ফিনফিনে পাঞ্জাবির ওপর হাতা কাটা কালো কোট পরা নেতা, আছেন সাফারি পরা নেতা-আমলা, আছেন অতি কেতাদুরস্ত নিখুঁত স্যুটকোট পরা সুদর্শন কূটনীতিক।
এই দুই হাজার দলিলে যেসব স্বনামধন্য ব্যক্তির নাম পাচ্ছি, তাঁদের সঙ্গে কাশিমবাজার কুঠির লোকদের পার্থক্য কোথায়? তফাত কোথায় মীরজাফর, উমিচাঁদ, মহারাজ রাজবল্লভ, মহারাজ রায়দুর্লভদের। তাঁদের সঙ্গে কোথায় পার্থক্য মোশতাক, ডালিম, ফারুক, শাহরিয়ারদের!
এসব কাহিনি ফাঁস হওয়ায় দুই প্রধান দলের নেতারাই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন। এক দলের মহাসচিব বলেছেন, উইকিলিকসের তথ্য চাটনির মতো, চমক আছে, আইনগত ভিত্তি নেই। কিন্তু যা সত্য তার আইনগত ভিত্তি থাকল কি না থাকল, তাতে কী আসে-যায়। চাটনি কোনো খারাপ জিনিস নয়। বাংলাদেশের রাজনীতির বিস্বাদ ভাত-তরকারি খেতে খেতে জনগণের এতটাই অরুচি হয়েছে যে এই চাটনিটুকুর দরকার ছিল।
এ তো চাটনি। সামনে আসছে সাতকড়ার আচার। আগামী নির্বাচনের আগেই আশা করি সেই সাতকড়ার আচার বাজারজাত করবেন মহাত্মা অ্যাসাঞ্জ। এবার যাঁদের নাম ওঠেনি বলে যাঁরা দরগায় শিরনি ও গরু-ছাগল সদকা দিয়েছেন, তাঁদের কথা যে ভবিষ্যতে থাকবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বেইমানি, বিশ্বাসঘাতকতা ও চোগলখোরি এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে নেতা-আমলা-কূটনীতিকদের এখন থেকে জনগণ তো নয়ই, তাঁদের স্ত্রীরাও বিশ্বাস করবেন না। দলের মধ্যেই যাঁরা ষড়যন্ত্র করেন, সহকর্মী ও বিজনেস পার্টনারের সুন্দরী স্ত্রীর কাছে নিজের বউ সম্পর্কে বদনাম করতে তাঁদের বাধবে না।
যা হোক, অতীতে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন থেকে রাজনীতিক, আমলা ও অন্য পেশার ক্ষমতালোভীরা তওবা করে যদি সঠিক পথে চলেন, জনগণ তাঁদের ক্ষ্যামাখেল্লা করে দেবে। জনগণ আশা করে, গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে হত্যা নয়, টেকসই করতেই নেতারা ভূমিকা রাখবেন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.